মুক্তি দিয়ে গেলাম

প্রিয়ার চাহনি (মে ২০১২)

এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম
  • ১৭
  • ৩৫
দশ দিন পার হয়ে গেল। অস্বাভাবিক আকৃতির সেই লোকটাকে আমাদের এলাকার পার্কের ওয়াকওয়েতে দেখতে পেলাম না। কি জানি, হয়তো অন্য কোথাও বাসা নিয়ে চলে গেছেন, নয়তো কোন বিশেষ কাজে এ এলাকার বাইরে কোথাও গিয়েছেন। যারা এখানে হাটতে আসেন তাদের সবাইকে আমি চিনিনা বা কারো সাথে তেমন আলাপ হয়না ঠিকই, কিন্তু কেন যেন মনের মধ্যে সবাইকে এক পরিবারের সদস্য মনে হয়। তাই এতদিন ভদ্রলোকের অনুপস্থিতি মনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। লোকটা হাটতে হাটতে যার সাথে গল্প-স্বল্প করতেন, অনেকদিন পর অবশ্য তাকে দেখতে পেয়ে আর কৌতুহল দমন করতে পারলাম না।
Excuse me, আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি ?
- Oh ! sure, বলুন, কি বলতে চান ?
না, মানে তেমন কিছু না, আপনার সাথে এক ভদ্রলোক আসতেন, অস্বাভাবিক রকম লম্বা, অদ্ভুত ধরনের চেহারা বিশিষ্ট- কালো এক লোক, তাকে আর দেখছি না যে ?
-বুঝতে পেরেছি, আব্দুল্লাহ সাহেবের কথা বলছেন তো ? খুবই দুঃখের সংগে বলতে হচ্ছে, তিনি আর বেঁচে নেই।
ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন । কবে, কি হয়েছিল ?
- তা দিন দশেক হল। ( একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ) কি আর বলব ! উনি আত্মহত্যা করেছেন।
সে কি ! কেন ?
- সে অনেক লম্বা কাহিনী, এ স্বল্প সময়ে বলে শেষ করা যাবে না।
উনি আপনার কে হন ?
- না, আমার সাথে তার কোন রিলেশনশিপ নেই। উনি আমার কলিগ ছিলেন। আমার কাছে উনি অনেক কিছু শেয়ার করতেন । অনেকটা সময় দিয়ে আমি তার জীবনের দুঃখগুলোকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতাম, প্রায়ই তিনি তার জীবনের বিড়ম্বনায় অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করবেন বলে বলতেন। আমি আমার সাধ্যমত অনেক প্রেরণা যুগিয়ে তাকে এরকম হতাশা থেকে ফিরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি যে শেষ পর্যন্ত সে সে পথটাই বেছে নিলেন, ভাবতেই পারিনি ।

কিছু মনে করবেন না। লোকটাকে একটু অস্বাভাবিক এবং বিকৃত চেহারার দেখতে । এ পার্কেও এমন কেউ বোধহয় নেই তার দিকে কৌতুহলি দৃষ্টি নিয়ে না তাকাতো। আমিও খুব আগ্রহী ছিলাম, জানেন ? তার এ ধরনের অস্বাভাবিক চেহারার বিষয়টা নিয়ে আমিও বেশ ভাবতাম। লোকটাকে আমাদের দেশের নাগরিক বলেও মনে হতনা। কেননা এদেশে কালো বর্ণের বা অস্বাভাবিক লম্বা মানুষ আছে ঠিকই, কিন্তু উনি যেন একটু বিশেষ ধরনের ছিলেন । তার ট্রাজেডির মূলে কি এই বিকৃত চেহারা ?
-ঠিক তাই।

কি বলব, জানেন, আমার খুব কৌতুহল ছিল, উনার সাথে কথা বলার। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনটা বড় বিষাদময় হয়ে গেল। এখন খুব আফসোস হচ্ছে । নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন আগেই আলাপ করলাম না ? আমরা শহরের মানুষগুলো যেন কেমন যান্ত্রিক হয়ে গেছি। এখানে অনেকদিন একসাথে যাদের সংগে আমরা মর্নিং ওয়াক করছি, অথচ আমরা কেউ কাউকে চিনি না। অথচ একদিন কাউকে না দেখলে কিন্তু তার জন্য মনটা ঠিকই ব্যকুল হয়। মনে হয় আপনজন কাউকে দেখছিনা। আমার মনে হয় আমাদের সবারই উচিত প্রথমদিন না হোক অন্তত ২য় বা ৩য় দিন সবার সাথে পরিচিত হওয়া । এটা আসলে খুব অন্যায় কাজ করি। মানুষ হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিৎ।
- ঠিক তাই। আপনি কি লেখালেখি করেন ?
কি করে বুঝলেন ?
- মানে আপনার কৌতুহলী ইচ্ছা আর কথা বলার ধরন শুনে মনে হল।
তেমন ভাল কোন কিছু করতে পারি না। তবে একটু আধটু চেষ্টা করি। বিশেষ করে আমাদের চারপাশের কোন অসংগতি, অন্যায়, অপরাধ, পরিবেশ বিপর্যয় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে যখন খুব বেশী ভাবনায় পড়ি, তখন মনে হয় কিছু লিখি। কিন্তু হয়ে ওঠে না তেমন।
- উনার রেখে যাওয়া একটা ডায়রি আছে আমার কাছে। আপনি পড়বেন ?
পড়ব না মানে, অবশ্যই পড়ব। ইস! আমার কি যে ভাল লাগছে, আপনার কথা শুনে, মনে হচ্ছে এখনি আপনার সাথে ---
- ঠিক আছে, আমি কাল সকালে নিয়ে আসব, কেমন ?
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।

পরদিন ছিল সরকারী ছুটির দিন। ডায়রিটা এক নিঃশ্বাসে পুরো পড়ে ফেললাম।

জানিনা, কে আমার মা, কে আমার বাবা ? কি আমার পরিচয় ? আমার জন্ম দাতারা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন, তাও আমি জানিনা। শৈশবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মার্মা উপজাতিভুক্ত এক বাবা ও মায়ের কোলে বড় হয়েছিলাম। তাদের কাছে শুনেছি, আমার পালক বাবা যে জাহাজে নঙ্গর ফেলার কাজ করতেন সে জাহাজ আফ্রিকার কোন এক অঞ্চলে এসে প্রবল ঘূর্ণি ঝড়ের কবলে পড়ে। সাগর পাড় ঘেঁষে সবুজ বন বিশিষ্ট একটা পার্কের কাছে জাহাজটা জরুরী নঙ্গর করে। সে ঝড়ের ঘূর্ণিবাতাসে আমি সেই জাহাজের উপর অক্ষত অবস্থায় পড়ি। ঝড় থেমে গেলে আমার পালক বাবা আমাকে কোলে নিয়ে সেই পার্কের ভেতরে এবং আশে পাশে অনেক এলাকায় ঘুরেছিলেন, পুলিশের সহায়তা নিয়ে তিনি আমার বাবা মাকে খুঁজেছিলেন। কিন্তু কোন সন্ধান পান নি। ওদিকে জাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে বাধ্য হল। আমি আমার সে বাবা হিরণ্ময় মার্মার সাথে বাংলাদেশে চলে এলাম। আমি তখনও দুগ্ধ পোষ্য শিশু ছিলাম। আমার বাবা আমাকে নিয়ে জাহাজে অনেক কষ্ট করেছেন। মা, বাবা উভয় দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেই আমাকে নিয়ে চলে এলেন রাঙামাটির হিম ছড়িতে। আমার এই মা মাস খানেক আগে একটা মরা মেয়ে প্রসব করে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন। জাহাজে থাকায় কোন খবর আমার বাবা পাননি। বন্দরে নেমে তিনি সে দুঃসংবাদ পান। মরা বাচ্চার খবর শুনে আমাকে বুকে জড়িয়ে আমার বাবার সে কি কান্না আর একই সাথে আনন্দেরও কান্না। এই জন্যই ভগবান তোকে আমার কোলে এনে ফেলেছে গো বাপধন ! বাবা আমাকে মা রূপাময়ী মার্মার কোলে দিয়ে বললেন, দেখত তোর বুকের দুধ খায় কিনা। মা আমাকে বুকে নিয়ে পাগলের মত প্রথমেই সে কাজটা করেন এবং আমি আমার জীবনে পেলাম সবচেয়ে পবিত্র বিশুদ্ধ খাবার, আমার মায়ের দুধ। আমার গায়ের চামড়া দিয়ে এ বাবা মায়ের পায়ের জুতো বানিয়ে দিলেও সে ঋণ শোধ হবে না। বাচ্চা মরে যাওয়ার দুঃখে আমার মা এতটাই শোকাভিভূত ছিলেন যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার শারীরিক গঠনের অস্বাভাবিকতা আর চেহারার মধ্যে এক অসাধারণ ভিন্নতা তিনি লক্ষই করেননি। কেননা তখন তিনি কেবলই সন্তান হারা পাগলিনী এক মা। কিন্তু দিনে দিনে আমি যখন বড় হতে লাগলাম তখন তিনি আমাকে দেখেই ভয় পেতে শুরু করেন। হাত পা অস্বাভাবিক লম্বা। একটা স্বাভাবিক দুধের বাচ্চার আকৃতির চেয়ে আমার আকৃতি ছিল তিনগুণ বেশী লম্বা। মুখের গঠনও স্বাভাবিক মানুষের আকৃতির মত নয়। মাঝে মাঝে আমার মা আমার বাবাকে বলতেন, এ মানুষের বাচ্চা তো ?
বাবা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, টেলিভিশনে আফ্রিকার মানুষগুলো দেখ। সেখানকার মানুষের আকৃতি এরকমই।
সেই থেকে মা প্রায়ই আফ্রিকার মানুষদের ছবি দেখতেন আর আমার সাথে মেলাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু মায়ের মন থেকে ভয়টা কিছুতেই দূর হতে চায়না। কেননা মা অনেক আফ্রিকানই দেখলেন, আমি দেখতে তাদের মত কিছুটা হলেও আমার দেহের গঠন অনেকটাই আলাদা। মা আমাকে স্বাভাবিক মানুষের বাচ্চার মত মেনে নিতে পারছিলেন না। সেই সাথে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন আমাকে ভিড় করে দেখত আর নানা রকম মন্তব্য করত। তাতে মা আরও বেশী ভয় পেতেন। এ খবর আশে পাশে গ্রাম, শহরময় ছড়িয়ে পড়লে মানুষ দলে দলে আমাকে দেখতে আসতেন। আমার বাবা অতিষ্ঠ হয়ে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু মানুষ এক পর্যায়ে আমার মা বাবার উপর ক্ষিপ্ত হয় এবং এলাকায় এ নিয়ে সালিশ বসল। সিদ্ধান্ত হল আমাকে আফ্রিকায় রেখে আসতে হবে। আমার মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি ওকে আমার বুকের দুধ খাইয়েছি। ও আমার ছেলে। আমি কিছুতেই তা হতে দিব না। তার পরে আইনের আশ্রয় নিলেন আমার মা বাবা। আদালত আমার মায়ের পক্ষে রায় দেয়ায় সবাই লজ্জা পেলেন। সেই থেকেই আমি বড় হলাম আমার মায়ের কোলে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে। তার পরে আমি যখন একটু বড় হলাম। মাকে মা এবং বাবাকে বাবা বলে ডাকতে শিখলাম। মায়ের মুখের সব কথা শিখে ফেললাম তখন মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার সব ভয় দূর করে দিলেন। আমার সে অস্বাভাবিক চেহারা আর তার কাছে ভীতিপ্রদ মনে হতনা। আমাকে বুকে করে তার সে কি আনন্দ ! আমার বয়স যখন তের আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার উচ্চতা তখনই ছিল প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি। অন্য সব ছেলেদের থেকে আমি একেবারেই আলাদা। আমার সাথে কেউই মিশত না। তবে পড়াশুনায় সবার চাইতে আমি ভাল হওয়ায় টিচাররা আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। যাদের সাথে পড়তাম তারা মাঝে মাঝে ঠাট্টা বিদ্রূপ করলেও পরীক্ষার রেজাল্ট বরাবর ভাল হওয়াতে কেউ আর তেমন সাহস করে কিছু বলত না। স্কুলে যারা নতুন আসতো তারা অবাক হয়ে আমাকে ফিরে ফিরে দেখতো। রাস্তা ঘাটে স্বাভাবিক চলাচল করতে পারতাম না। অস্বাভাবিক চেহারার মানুষ হওয়ায় আমাকে পথচারীরা ঘুরে ফিরে দেখতো। নানা রকম কথা বলত। আমি কি আদিম কালের মানুষ কি না, অনেকেই তা জানতে চাইতো আমার কাছে। আমি কেবল বলতাম, আমি জানিনা। খুবই অসহ্য লাগছিল। আমার আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে হতনা। কিন্তু এরকম যন্ত্রণার কথা শুনে মা আমার সাথে স্কুল পর্যন্ত আসতেন আবার ছুটির সময় আমাকে নিয়ে আসতেন। পথে কেউ বিরক্ত করলে মা তাদের ধমকে দিতেন। গ্রামের চেয়ারম্যান বাবুর কাছে মা নালিশ জানালে তিনি আমাকে বিরক্ত না করার জন্য এলাকার সবাইকে বলে দিলেন। কিন্তু তারপরও আমি আমার অস্বাভাবিকতা নিয়ে মোটেও শান্তিতে ছিলাম না। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে আমাকে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে। যাহোক আমার বাবা আবার চলে গেলেন জাহাজে। দীর্ঘ সময় আমি আর আমার মা। সুখে দুখে ভালই ছিলাম। আমি লেখাপড়ায় অনেক ভাল রেজাল্ট করায় আমার মাও ভীষণ খুশী ছিলেন। আমাকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন আমার মা। কিন্তু সে সুখ বেশীদিন সইল না। প্রচণ্ড সাইক্লোন। উপকূলীয় এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেল। স্রোতের টানে শত শত মানুষ বিলীন হয়ে গেল সমুদ্রে। সেই সাথে আমার মাও পাড়ি জমালেন। সে যাত্রায় একটা উঁচু গাছের শাখায় বেধে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলাম। বাবাকে চিঠি লিখে জানালাম মায়ের চলে যাবার কথা। দেশে ফিরে আমার বাবা খুব ভেঙে পড়লেন। এর পরে জাহাজ থেকে তিনি আর বাড়ি ফিরতেন না। আমাকে টাকা পাঠাতেন, চিঠি লিখতেন। লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে একটা কর্মজীবন বেছে নিয়ে ঘর সংসারী হতে উপদেশ দিলেন। আমি এখন একা। এলাকার লোকজন থেকে আমি একেবারেই আলাদা। কেউ আমার সাথে মিশতোনা। আমার কাছে কেউ আসতোনা। আমি অসহায় হয়ে গেলাম। এরা কি মানুষ ? তার পরে চলে এলাম ঢাকা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম। এখানে এসেও আমি একই আচরণ মানুষের কাছ থেকে পেতাম। তবে কিছু মুসলমান ছেলে আমাকে বন্ধু রূপে মেনে নেয়ায় আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। অনেকদিন বাবার চিঠি পাই না। যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, তখন আমার বাবার এক বন্ধুর চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন, আমার বাবা আর বেচে নেই। খুব কেঁদেছিলাম। আমার বন্ধু সেলিম। সে আমাকে অনেক সান্ত্বনা দিল। আমার জীবনে অনেকটা সময় এবং অর্থ সেই বিনিয়োগ করে আমাকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। আমি ইসলাম ধর্ম জানার আগ্রহ নিয়ে গোপনে এ বিষয়ে পড়াশুনা করতাম। সেলিমের হাত ধরেই আমি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলাম। আমার নাম রাখা হল আব্দুল্লাহ। এ নামটাও আমার খুব পছন্দ হল। আল্লাহর কাছে লাখ কোটি শোকর যে আমি সত্য ধর্মে দীক্ষিত হতে পেরেছিলাম। লেখাপড়া শেষ করলাম। বিসিএস পাশ করলাম। আমার অস্বাভাবিক চেহারার কারণে আমাকে ভাইবা বোর্ড থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও আমার অসাধারণ রেজাল্ট এর কারণে বাদ দিতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আমার অন্যান্য বন্ধুদের মত আমার আমার জীবনেও একজন বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর প্রয়োজন অনুভূত হত। আমার হৃদয় কতবার রঙিন হয়েছে । কত না রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে, তা কেবল এ বুকেই কিন্তু আমি তো সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য সৃষ্টি। আমাকে দেখেই সবাই চমকে ওঠে। অনেক মানুষ আমাকে দেখে আৎকে উঠেছে, কত মেয়েরা আমাকে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে দূরে সরে গেছে - সে কথা মনে হতে সে আশা আমার মনের গহীনে নীরবে কেবল কান্নার নহর বইয়ে গেছে। কেউ শোনেনি সে কান্নার ভাষা। আমার এ অসহায়ত্বকে একান্তভাবে একমাত্র বন্ধু সেলিম এতোটাই বুঝেছে এবং সে আমাকে এতটাই কাছে টেনে নিয়ে আমাকে স্বাভাবিক হতে সহায়তা করেছে যে, মা বাবা মরে যাবার পর আমার মনে হয়েছে তাকেই বুঝি সৃষ্টিকর্তা আমার মা এবং বাবা দুজনের রোল প্লে করার জন্য পাঠিয়েছেন। তার সে ঋণ শোধ করা আমার জীবনে সাধ্য হবেনা। আমার বন্ধু আমাকে বিয়ে দেবার জন্য কতলোকের কাছে যে ছোট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মনে পড়ে একবার এক গরীব ঘরের কোনরকম শিক্ষিত একটা মেয়েকে দেখাতে নিয়ে গেল। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে সে মেয়ের বাবা মাকে আমার চেহারার অস্বাভাবিকতাকে আগেই বর্ণনা করেছিল। তারা তখন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, পুরুষ মানুষের চেহারায় কি আসে যায়, আমরা রাজি আছি, আপনি ছেলেকে নিয়ে আসেন। সে নিজে এসে মেয়ে দেখে যাক। আমার আর ইচ্ছা ছিলনা আর কোন মেয়ে আমাকে দেখে ভয় পাক। আর কোন মেয়ের মা আমাকে দেখে বেহুশ হয়ে যান। বন্ধু সেলিমের অনেক পিড়াপিড়ির পর গেলাম সেবাড়িতে। সেই একই দৃশ্য। আশে পাশে হাজার লোক ভিড়ে গেল মিউজিয়াম থেকে আনা অদ্ভুত জন্তুটাকে দেখবার জন্য। অনেক বিড়ম্বনার সমুদ্র পেরিয়ে সেই বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র আমার দিকে আমার হবু শাশুড়ির দৃষ্টি পড়তেই তিনি একটা চিৎকার দিয়ে বললেন, ও মা, এ কি ! এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে চলে গেলেন দূরে। আমি পাত্র শুনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন । সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। সেই একই দৃশ্য। আমাকে সহ আমার বন্ধুকে এলাকার লোকজন তো মেরেই ফেলে । মেয়ের বাবা আমার বন্ধুর হাত ধরে কেঁদে বললেন, বাবা আমি গরীব, তাই বলে আপনি এভাবেই তামাসা করলেন ? আমার বন্ধু তাকে কোন কথাই গোপন না করার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। শেষবারের মত আর আমাকে নিয়ে এ দুঃসাহস করবেনা এই ওয়াদা করে সে যাত্রা কোনরকম দু'বন্ধু জানটা নিয়ে পালিয়ে এলাম।
দিন শেষে রাত আসলেই আমি অসহায় হয়ে পড়ি। অন্ধকার আমার সহ্য হয়না। সারারাত আত্মজীবনী লেখালেখি করে কাটাই। কিন্তু এভাবে আর কতইবা রাত জাগা যায়। আমার যৌবন আমার শত্রু হয়ে কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে নিয়ত। খুব কাছে থেকে আমার বন্ধু তা অনুভব করত। আমার কষ্ট অনুভব করে সে আমাকে বলত তুমি আফ্রিকা ফিরে যাও। সেখানে তোমাদের পরিচিত সমাজ তোমাকে ফেলে দেবেনা। কিন্তু আমি তার সে কথায় কর্ণপাত করলাম না। কেননা আমি এখন মনে প্রাণে বাঙালি। এদেশকে আমার মায়ের মত ভালবেসেছি। আফ্রিকা, আমার মায়ের অন্যান্য ছেলের কাছে যেমন অপরিচিত, আমার কাছেও তাই। কেমন করে সে দেশকে আমি আমার দেশ ভাবতে পারি ? বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম। আমি কি তোমার কাছেও বিড়ম্বিত হয়ে উঠেছি ? সে আমার মুখ চেপে ধরল, ছি ! একথা ভাবলেও পাপ হবে। তাহলে কেন আমাকে আফ্রিকায় নির্বাসিত করতে চাইছ ? সে বলল, সে তো তোমার কষ্ট দেখে। আমি বললাম, তুমি আমাকে যা দিয়েছ তা আমার জীবনের সব কষ্টকে দূর করে জীবনের স্বপ্ন দেখার স্বাদ এবং শক্তি পেয়েছি, সে কি কম বড় পাওয়া ? সে একদিন সাহস করে আমাকে অনৈতিকভাবে যৌবনের জ্বালা মিটাতে বলল। কিন্তু সাথে সাথে আমার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সে লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে আমার কাছে ক্ষমা চাইল। আমি দীর্ঘদিন রোজা থেকেছি। আমার বন্ধু আমার সে সাধনার সহায়তা করেছে। আমার ব্যাথায় সেও ডুকরে কেঁদেছে। আমার বন্ধুটিও নাছোড় বান্দা। সে আমাকে না জানিয়ে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের এক স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে আমার জীবনের সব ট্রাজেডির কথা তুলে ধরেছে। আমার গুনের কথা সব শুনে সে মেয়ে আমাকে না দেখেই পাগল হয়ে গেল। আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না। আমার বন্ধুটা বলল, ওর কোন অভিভাবক নেই। আমিই তার অভিভাবক। তাই তোমাকে আমি এই রাতের আধারে বিয়ে দিতে চাই। আমি বলেছি ওকে। বিয়ের আগে আমার বন্ধুর মুখ তুমি দেখবেনা। তার মুখ দেখবে বাসর শেষে। ও আমার সব শর্তে রাজি। ও প্রথমে তোমাকে পাবে একজন গুণধরই মানুষ হিসেবে। তারপরে তোমাকে দেখে আচমকা ভয় পেয়ে গেলেও একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে পেয়ে সব ভুলে তোমার অস্বাভাবিকত্ব মেনে নিয়ে সুখীই হবে। আমার সাহস হলনা। আমি অনেক আপত্তি করলাম। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। মেয়েটাকে কথা দিয়ে ফেলেছে। এখন সে কি করবে ? তাই অনেক অনিচ্ছা স্বত্বতেও আমি রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু যা আমি আশংকা করেছিলাম, তাই হল। যাই হোক না কেন, বাসর ঘরে কোন মেয়ে তার স্বামীর মুখ না দেখে পারে ? এ স্বাভাবিকতার কোন ব্যতিক্রম হলনা। আমি নির্বাক হয়ে মুখ নিচু করে বসে রইলাম। ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি দৌড় দিয়ে বের হয়ে গেলাম। আমার সাবধানী বন্ধু পাশের ঘরে ছিল। দ্রুতই সে আমার ঘরে এসে ওর চোখে মুখে পানি দিয়ে তার পাশে পাথরের মত বসে রইল। আমি পাশের এক কামরায় যেয়ে একটা চিরকুট লিখলাম। কেননা আমি আর এভাবে আমার বন্ধুকে কষ্ট দিতে পারিনা। নিজের সাথে আর প্রবঞ্চনা করার শক্তি পেলাম না। আমি হেরেই গেলাম । আমার এই বিড়ম্বিত জীবনের যন্ত্রণার সাথী আর কেউ হোক তা আর আমি চাইনা। আমি তোমাদের মুক্তি দিয়ে গেলাম। বন্ধু আমাকে ক্ষমা করে দিও।
পরদিন সকালে সেলিম সাহেবের হাতে ডায়রিটা ফেরত দিয়ে বললাম, আপনিই কি সেই সেলিম সাহেব ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ । আমিই সে হতভাগা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ................চমতকার একটা বিষয় নিয়ে লিখলেন। আমাদের দেশের কিছু প্রতিবন্ধীরা এই একই সমস্যায় ভোগে, আর সেটা আমাদের কারণেই। শুভেচ্ছা রইল।
সূর্য গল্প যখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে তখনই বুঝি গল্পকার স্বার্থক। ভাল লাগা রইল পুরোটাই (শেষ দিকে প্যারায় স্পেস না থাকায় চোখের ধকলে গেছে কিছুটা)
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । শেষের দিকে আপনি যে কষ্ট পেয়েছন, তার জন্য আমিও খুব কষ্ট পেয়েছ। যাতে আর এরকম কষ্ট কারো পেতে না হয় সেজন্য আমি সচেষ্ট থাকব । আপনাকে আবারো অনেক অনেক ধন্যবাদ ।
মামুন ম. আজিজ হুম..খূব পরিণত লেখা..আপনি কিন্তু গল্পকবিতায় পছন্দের লেখকদের মধ্যে পড়েন।
কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আপনাদের অনেকের লেখার কাছে আমার লেখা তেমন কিছুই না। এর চেয়ে বেশী পাবার যোগ্যতাই আমার নেই । চেষ্টা করছী আপনাদের পাশে থাকার, কিছু লিখবার, কিছু শিখবার । এতেবারেই তেলাপোকায় খাচ্ছিল, যতটুকু ঠাই পেয়েছি, তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করছি । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
মৃন্ময় মিজান গল্প ভাল লাগল। তবে উপস্থাপন শৈলী বোধহয় আরো ভাল হতে পারত।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । আসলে এরকম সমালোচনাই আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় । আপনি আমার মনের আশা পূরণ করেছেন । ইনশাল্লাহ গল্পের ত্রুটি বিচ্যুতি দূর হতে সহায়ক হবে ।
আহমেদ সাবের একজন অস্বাভাবিক চেহারার মানুষের জীবনের বেদনা নিয়ে গল্প। সুন্দর থিম। সবাই যে আল্লাহর সৃষ্টি, সে কথাটা আমরা ভুলে যাই। গল্প ভাল লাগল।
রোদের ছায়া অন্য রকম একটা গল্প, বর্ণনা ভিষণ ভালো .....অসাধারণ
মিলন বনিক ইমদাদ ভাই, আগেই প্রিয়তে নিলাম অনেকের মন্তব্য এটা সত্য কাহিনী কিনা..আমারও..তবে ভালো লাগার কোনো কমতি নেই..পুরোপুরি মুগ্ধ...শুভ কামনা থাকলো...
প্রিয়ম এটাকি বাস্তব কোনো ঘটনা ?
কিছুটা বাস্তব । আর কিছু কল্পণার মিশ্রনে এটিকে উপস্থাপন করেছি । কেমন লাগল, বললেন না তো ? আপনাকে ধন্যবাদ ।
মনের ও মন থেকে বলসি খুব খুব ভালো লেগেছে
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি সারারাত আত্মজীবনী লেখালেখি করে কাটাই। কিন্তু এভাবে আর কতইবা রাত জাগা যায়। আমার যৌবন আমার শত্রু হয়ে কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে নিয়ত। খুব কাছে থেকে আমার বন্ধু তা অনুভব করত। আমার কষ্ট অনুভব করে সে আমাকে বলত তুমি আফ্রিকা ফিরে যাও। সেখানে তোমাদের পরিচিত সমাজ তোমাকে ফেলে দেবেনা। কিন্তু আমি তার সে কথায় কর্ণপাত করলাম না। কেননা আমি এখন মনে প্রাণে বাঙালি। এদেশকে আমার মায়ের মত ভালবেসেছি।// এক কথায় অসাধারন গল্প...পাকা হাতের বুনন বুঝাই যায়....সর্ব্বোচ্চ মূর‍্যায়েনর মানডন্ডে মূল্যায়ন করা যাবেনা...কি আর করা,,,৫/৫
আপনার মূল্যবান মন্তেব্যর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।

২৯ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪