আমি সেলিব্রেটির বাবা

নতুন (এপ্রিল ২০১২)

এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম
  • ১৬
  • ৭২
হিঃ হিঃ হিঃ
- কি ব্যাপার, একা একা পাগলের মত হাসছ কেন ?
হাসছি কেন? হিঃ হিঃ হিঃ তুমি যেভাবে আমার বাবাকে ঘন ঘন আব্বা ,আব্বা বলছিলে- তা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল।
- তো ? এতে হাসির কি হল ? শশুরকে তো আব্বাই বলতে হয়। এতে হাসির কি হল ?
না, মানে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তোমার শশুরকে কোন কিছু বলেই ডাকতে শুনিনি কি না, তাই একটু অবাক হচ্ছি। যখনই মুখোমুখি হয়েছ, কেবল সালাম দিয়ে প্রয়োজনীয় কথা বলতে। আজ তুমি এমন আগে, পিছে, কথার মাঝে যেভাবে আব্বা -আব্বা বলছিলে, শুনে আমার কাছে বেশ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।
- দেখ, প্রথম প্রথম একটা অপরিচিত লোককে হঠাৎ করে আব্বা বলে ডাকা খুব সহজ কাজ নয়। আমার মনে হয় এরকম পরিস্থিতি সবার ক্ষেত্রেই হয়। এখন পুরাতন হয়ে গেছি, তাই হয়তো বিষয়টা স্বাভাবিক হয়ে গেছে, তাই নয় কি ? তা এতে এত হাসির কি হল ?
কিন্তু, আমার মনে হয়, আমার আব্বার বিচক্ষণতার পরিচয় পেয়েই তুমি তাকে তেল দিতে শুরু করেছ। আমার শশুরকেও তো তুমি এতবার আব্বা বল না।
- ধ্যাত ! কি সব পচা প্যাঁচাল শুরু করেছ, ছাড় তো ?
আচ্ছা, সে যাকগে। মেয়েটাকে শিল্পকলায় ভর্তি করবা কবে ?
- কেন, শিল্প কলায় কি হবে ?
আশ্চর্য ব্যাপার ! শিল্প কলায় কি হবে মানে ? এই যে টি. ভিতে এত বাচ্চাদের প্রোগ্রাম দেখ, তোমার কি মনে হয় না, আমাদের নিশিও এক সময় হয়ে যেতে পারে বড় মাপের এক সেলিব্রেটি !
-দুত্তরি, কি যে বল না ? এসবের পেছনে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হয়। না তোমার ফ্যামিলিতে, না আমার ফ্যামিলিতে শিল্পীর কোন স্রোতধারা আছে, বল ? এসব বাজে চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেল। আর এসব কালচারে সাময়িক চমক আছে বটে, তবে শেষ পরিণতি কারোরই ভাল হয় না। দেখ না, এসব লাইনে কত স্টারদের জীবনে ভুরি ভুরি করুন দৃষ্টান্ত রয়েছে।
যা, বাব্বা, তুমি তো দেখছি ১০০ বছর পরের ভাবনা এখনি ভেবে ফেলছ। এত দূর ভাবলে কিছু সৃষ্টি হয়না, বুঝলে ?
-মূর্খের মত কথা বল না।
মূর্খের মত কথা আমি বলছি, না কি তুমি বলছ ?
- ধ্যাত ! রাখ তো. এসব।
না, রাখা রাখি নেই। শোন, তুমি চেয়েছিলে কলেজের অধ্যাপক হতে। তোমার ফ্যামিলির সবাই তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু তা কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, তুমি কিন্তু এখন রিয়ালাইজ করতে পারছ। আগে বুঝতে পারনি। তাই, আমার মনে হয় নিশির ব্যাপারে আমার সাথে তোমার দ্বিমত থাকা উচিৎ নয়। আর তোমার দ্বিমত থাকলেও আমি তা মানব না। কেননা তোমার বা তোমাদের বাড়ির ডিসিশনের চেয়ে আমাদের বাড়ির ডিসিশন যে বেশী ফলপ্রসূ হয়, তার প্রমাণ তুমি নিজেই। সুতরাং-----
- আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি যা ভাল মনে কর।
এই তো, তোমার বুদ্ধির তালাটা খুলে গেছে। এটা তোমার একটা বিশেষ গুন। তুমি খুব সহজেই বুঝতে পার। প্রথম প্রথম অবশ্য তোমার তালাটা খট করে আটকে যায়। হেরিডিটি বলে একটা কথা আছে না, তা তো মানতেই হয় ,তাই না ? যাক। এই ভাল যে, তোমার বুদ্ধির তালাটা দ্রুত খুলে যায়। এটা খুবই পজিটিভ একটা দিক। এজন্যই তো তুমি আমার এত প্রিয় ! হাউ সুইট ! ডার্লিং !
***********
বার বছর গড়িয়ে গেল। চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, এই তো সেদিন। রাফছানের বাবা সেই যে তার সাথে অভিমান করে ছোট ছেলের কাছে আমেরিকায় চলে গিয়েছেন, আর তার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেন নি। কতবার ফোনে কথা বলতে চেয়েছে, কতবার ছোটভাইয়ের ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তার বাবার একটাই কথা, ওর মত মেরুদণ্ডহীন ছেলের বাবা পরিচয় দিয়ে নিজেকে কোন অবস্থাতেই আর ছোট করতে চান না তিনি। সমাজের কাছে অনেক খাট করে দিয়েছে সে তার বাবাকে। তাই দেশে সব থাকতেও অনিচ্ছা সত্ত্বে দেশ ছেড়ে এ পরের দেশে চলে এসেছেন তিনি।
ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কাজ। কত ব্যস্ততায় কাটে রাফছানের সময়। কোনদিকে তার তাকানোর সময় নেই। একটা মাত্র মেয়ে। তার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিশি ছাড়া আর কোন সন্তান নিতে নারাজ ছিল তার স্ত্রী। সে চায় তার এই এক মেয়েই হাজার সন্তানের সমান সত্তা নিয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে যে, ইতিহাসের পাতায় তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার মেয়ে হবে আকাশ ছোঁয়া সেলিব্রেটি। যেমন হয়েছে ঐশ্বরিয়া, শিল্পা শেঠী, কারিনা আর শাকিরারা। তার মেয়েও হবে বিশ্বসেরা স্টার। এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা।
অনেক সাধের সে সাধনা আজ তার সার্থক হয়েছে। এরা এখন টাকার বিছানায় ঘুমায়। টাকা কি এক দিক দিয়ে আসছে ? তিনি যেমন রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে আসছে তেমনি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী আসছে নিশির আকাশে ওড়ার মাধ্যমে। বিশ্বমানের জীবন্ত তারকা সে। নিশির মা সে টাকার হিসেব রেখে সামাল দিতে পারছে না। এত টাকা ! এত টাকা ! টাকায় যে এত সুখ ! তা আগে জানা ছিলনা। নিশির মা এখন সে সুখের নেশায় বিভোর। প্রথম প্রথম স্বপ্নের ঘোরে বিভোর থাকলেতো রাফছানের এখন আর এত সুখের চুম্বন সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু সহ্য না করেও আর উপায় কী ! যে সুখের সিঁড়ি বেয়ে এত উপরে সে চলেছে যে সেখান থেকে নামা খুব শক্ত। এখন সে সুখের যন্ত্রণায় ঔষধ হিসেবে সহায়ক হয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাবে তাস এর আড্ডা আর বোতলের পর বোতল মদ। গভীর রাতে বেহুশ হয়ে ঘরে ফেরা। এ ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। নিশির মারও এতে কিছু যায় আসেনা। তার হাতেও সময় নেই তাকে নিয়ে ভাববার। দিন-রাত কতরকম শিডিউল তাকে মেনটেন করতে হয় ! কত শত স্পট ! কত রকম শুটিং ! কত পত্রিকার রিপোর্টারদের সাথে নিশিকে সাক্ষাৎকার দিতে হয় ! এক কথায় প্রতিটা মুহূর্তই তাকে তার মেয়ের সাথে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার মেয়ের সাথে সে নিজেও যে এত মূল্যবান মা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেন, সেও কি কম বড় পাওয়া ?
রাফছানকে সময় দেবার মত সময় কোথায় তাদের ?
ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোর পাশে দেয়ালে দেয়ালে বড় রঙিন পোষ্টারে ছেয়ে গেছে। বিশ্বমানের সেরা মডেল নিশির ফ্যাশন শো। ইন্টারন্যাশনাল নীটিং ওয়্যার হাউজ এ শো এর আয়োজন করেছে। সেখানে উপস্থিত থাকবে ইউরোপ, আমেরিকার বড় বড় গার্মেন্টস বায়ার সংস্থার বড় বড় কর্মকর্তারা। কাকরাইলের মোড়ে রাফছানের গাড়ি ট্রাফিক সিগনালে আটকে রয়েছে। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল পাশের দেয়ালের দিকে। তার মেয়ের অর্ধ নগ্ন অবয়ব। একটা বখাটে তরুণ আর এক তরুণকে বলছে-
নিশি, নিশিরে------ কোনদিন তো ছুঁয়ে দেখতে পাব না, আয় দোস্ত ছবিতেই একটা চুমু খাই। বলেই পোষ্টারে নিশির ছবিতে পাগলের মত চুমু খেতে লাগল। আশে পাশের কিছু দর্শক পাগল বলে অট্ট হাসি দিয়ে তার এ পাগলামিকে স্বাগত জানালো। কেউ মন্তব্য করল, অয় হালায় গেছে, এক্কেবারেই টাল ----। ছবির বাবাটা তখন চোখ বন্ধ করে মৃতের মত পড়ে রইল। সমস্ত শরীর ঘেমে ভিজে গেছে। থর থর করে কাঁপছে সারা শরীর। অনেকক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে এভাবে বসে থাকার পর একটু ইজি হয়ে ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি ঘোরাও, বাসায় চল।
**********
অ-নে-ক দিন, অ-নে-ক বছর এসময়ে রাফছান বাসায় থাকেনি। এমনকি ছুটির দিনেও নয়। তাই গত ১২ বছরে দিনের এ সময়টাতে তার এ স্বর্গসম বাসভবনে কীভাবে কত সাধনায় ইন্টারন্যাশনাল স্টার নিশি তৈরি হয়েছে তা তার জানা হয়ে ওঠেনি। এক কথায় টাকা কামাই করার নেশায় তা জানার সময় সে পায়নি। তার জীবন থেকে ১২ বাছর গড়িয়ে গিয়ে তার মেয়েটাও যে ১৭ তে পা দিয়েছে- এটা সে একটাবারও ভাবে নি? আজ তার মেয়ের প্রায়-নগ্ন ছবির পোষ্টার তার নেশার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। টাকা রোজগারের নেশায় বিভোর এ বাবা কোনদিন তার মেয়ের বেড়ে ওঠাকে চোখে দেখতে পায়নি। কোনদিন তার সময় হয়নি মেয়েকে নিয়ে ভাববার। তার স্ত্রী আর মেয়েও তার এ অনুপস্থিতি অনুভব করেনি। মানে অনুভব করার সময় পায়নি। রাগে ক্ষোভে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। এরকম টাল-মাটাল অবস্থায় তারই নিজ বাসায় ঢুকতে যেয়ে প্রথমেই হোঁচট খেলেন নামকরা মিডিয়ার প্রোডাকশনের এক বয়ের হাতে।
( ধাক্কা মেরে ) যান, মিয়া, এখন ভেতরে ঢোকা নিষেধ।
-নিষেধ, মানে ?
আরে ? কয়কি হালায় ? মাথা কি খারাপ হইছে ? বেশী খাইছেন মনে হয় ? আপনি তো টলতাছেন দেখতাছি। দেখতাছেন না, কেউ যাইতে পারছেনা ভেতরে, বলা নাই, কওয়া নাই- এক্কেবারে গেটের মইধ্যে মাথা ঢুকাইছেন ? যান মিয়া, ফুটেন? মেডামরে লাইভ দেখার শখ অইছে ? পর্দায় দেইখেন, যান?
- মানে ? কী হচ্ছে এসব ? আমার বাড়িতে -----
(গলা ধাক্কা দিয়ে) চুপ ! এক্কেবারে চুপ! অয়, কাল্লু , এইডার মাথা খারাপ অইছে। ম্যাডামের বাড়িরে এই হালায় নিজের বাড়ি কইয়া ঢুকতে চাইতাছে। অরে একটু সাইজ করতো। এক্কেবারে রাস্তার হেইপারে ধাক্কাইয়া বাইর কইরা দিয়্যায়। হালায় মাতলামি করার আর জায়গা পাওনাই।
ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে চিৎকার দিয়ে গর্জে উঠলেন রাফসান। (দারোয়ানের নাম ধরে) আক্কাস ? আক্কাস? কোথায় গেলি ?
( সাহেবের চিৎকার শুনে টিভির লোকদের দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে থাকা আক্কাস দৌড়ে এলো গেইটের বাইরে। সাহেবের এ অবস্থা দেখে, সবাইকে ঠেলে নিজেই চিৎকার করছে)
হায়, হায় হরছে কী ? স্যার, স্যার , হায়, হায়রে, আইজ আমার চাকরী গেছে। এই সরেন, আপনেরা, মোগো স্যাররে এ হরছেন কি আপনেরা ? এই স্যার আপনোগো ম্যাডামের আব্বা । সরেন, সরেন।
দারোয়ানের এ কথা শুনে সবাই এক ছিটকে দূরে সরে পড়ল। হতভম্ব হয়ে গেল। গলা ধাক্কাদানকারীর অবস্থা বেসামাল। রাফছানের পা দু'খানা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, স্যারগো, চিনতে পারিনাই, মাফ কইরা-----। পা ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে কষে দারোয়ানের গাল পেঁচিয়ে এক থাপ্পড় মেরে দ্রুত ঘরে ঢুকলেন ।
ঘরে ঢুকেই আরো বেগতিক অবস্থা। বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে চলছে ম্যাডামের ইন্টারভিউ । হঠাৎ আগন্তকের আগমনে পরিচালক সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।
কাট ,কাট, কাট ? এটা কি হল ? ইনি সেটের মধ্যে কি করে এলেন ? প্রোডাকশনের লোকরা নেই গেটে?
হঠাৎ ইন্টারভিউ প্রদানকারী ম্যাডাম বাবা, বাবা বলে লাফ দিয়ে উঠে বাবার দিকে এগিয়ে এলে পরিচালক সাহেবের রাগ প্রোশমিত হয়ে এলো। মুহূর্তেই চেহারায় পরিবর্তন।
সরি, আংকেল, আমি চিনতে পারিনি, আপনাকে।
-বাবা, তুমি এখন ? (মেয়ের দিকে তাকালেন না এবং কোন কথাও বললেন না। সোজা চলে গেলেন নিজের বেড রুমে। কিছুক্ষণের জন্য ক্যামেরা অফ রইল )
ম্যাডাম বললেন, ইটস ওকে । আপনাদের আর কতক্ষণ লাগবে ?
- এই ৫ মিনিটের মধ্যেই শেষ হবে।
আচ্ছা, শেষ করুন তাহলে।
খুব সংক্ষেপে ইন্টারভিউ কার্যক্রম শেষ হল ।
ঘরের মেহমানরা বিদেয় হওয়ার পূর্ব মুহর্ত পর্যন্ত তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেন তার বেড রুমে।
কাজ শেষ করে মা মেয়ে বাবার কামরায় এলন। মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওগো, এ সময় ? তোমার কি শরীর খারাপ?
কোন জবাব না দিয়ে রাফছান বাঘের মত চোখ পাকিয়ে তাদেও দিকে একটু তাকালেন তার পর
মুহূর্তের মধ্যে ঘরের সব কিছু ভেঙে খান খান করে দিল।
তার স্ত্রী অনেক বাঁধা দিয়েও কিছু করতে পারলনা।
- তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ?
না গো, আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আমি এত বড় সেলিব্রেটির বাবা ! আমি কি পাগল হতে পারি ? আজ আমার চেয়ে সুখী আর কে আছে বল ? আমি কত বড় স্টার এর বাবা ! আকাশ ছোঁয়া সুনাম ! এ যে কত বড় সুখ !
- হ্যাঁ, তা যখন বুঝেছই তো, সব এভাবে ভাঙছ কেন ?
কী যে বলব, তোমায়। বুঝেছি বলেই তো এটা আজ করতে পারছি। এভাবে ভাঙার মধ্যে যে এত আনন্দ লুকিয়ে ছিল, আমি এতদিনে বুঝতে পারিনি।
************
আহত, পরাজিত রাফছানের জীবনের আরো দশটা বছর পেরিয়ে গেছে। এত বড় জেহাদ করেও তিনি তার মেয়ে ও স্ত্রীকে আকাশ থেকে টেনে জমিনে নামাতে পারেন নি। কেননা নিশি তখন তার সংসারের কেবল মাত্র একটা মেয়ে নয়। সে তখন একটা জ্যান্ত প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে কত নামকরা সব প্রযোজকদের লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা । স্বল্প মেয়াদী বিনিয়োগের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ হয়েছে বেশী। কেননা তার বয়স কেবল মাত্র ২৭। কত মজবুত তার দেহের বাঁধন ! তার এ শরীরটা অনেক দামী। তার দেহের পেছনে যে বিনিয়োগ হয়েছে তার সুফল পাওয়া যাবে আরো কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ বছর। তার মেয়ের দেহ যে দিনে দিনে এত বিশাল সম্পদ হয়ে গেছে তা কি রাফছান কখনো কল্পনা করেছে ? নিশির বিয়ে নিয়ে তার মা এতদিন কিছু ভাবেন নি। ভাবার সময় তিনি পান নি। বিয়ে দিয়ে নিশির মূল্যবান শরীর নষ্ট করার সময় কোথায় ? তাই ভুল করেও সে কাজ করতে নারাজ সে আর তার মা। এখন দেশে- বিদেশে কত প্রচারিত, প্রসারিত একটা নাম- " নিশি''--- " নিশি''--- কেবলই " নিশি'' । আর সে হচ্ছে সেই নিশিরই মা। তার কি পা আছে মাটিতে ? এ নিয়ে উনি যতই পাগলামিই করুক, আজ যেখানে তারা পৌঁছেছে- সেখান থেকে এক কদম পিছে আসার সুযোগ নেই । এর পেছনে কত কলা-কুশলী, কত লোকের জীবন, জীবিকা জড়িত ! আর সে বৃহত্তর প্রয়োজনে তারা রাফছানকে ছেড়ে আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হলেন।

মনের দু:খে পরাজিত রাফছান সব কিছু ছেড়ে আমেরিকায় তার বাবার কাছে চলে গেল। তার বাবারও এখন শেষ সময়। নিভু নিভু সে চোখ দিয়ে গলিত অশ্রু আর বের হয়না। মৃত শয্যায় তার ছেলের এরকম করুন পরিণতি তাকে দেখতে হবে- এটা কখনো ভাবতে পারেন নি। তাই শেষ সময়ে তার ছেলের এ পরাজয়, তার একাকীত্ব ভীষণভাবে মর্মাহত করল বৃদ্ধকে। তার মৃত্যুকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে এলো ।
রাফছানের বাকী জীবনটা তার ছোটভাইয়ের কাছে কেটে গেল। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া শিখিয়ে তার শেষ জীবনের সময়টা কেটেছে। যে জীবনটা তার জীবনের শুরুতে তার বাবা দেখে যেতে চেয়েছিলেন, তা শেষ জীবনে এসে তার জীবনের পাথেয় হলেও তার বাবা তা দেখে যেতে পারলেন না। এ যাতনা নিয়ে বাকী জীবনটা তাই অশ্রুসিক্ত কেটে গেল তার।
নিশির মা অনেক বড় ব্যামোর স্বীকার। অনেক অভিজাত ব্যামো। ক্যান্সার ! তার শেষ সময়ে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে যেতে পারছেন না, এটা ভেবে তিনি আরো বেশী ভেঙে পড়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও নিশির বাবার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারলেন না। নিশি যখন বুঝতে শিখেছিল যে তার জীবনে একজন পুরুষ মানুষ খুবই প্রয়োজন, তখন সে তাকিয়ে দেখে তার শরীর আর সে প্রয়োজনের উপযুক্ত নেই।
অ-নে-ক পেছনে ফেলে এসেছে তার সে মূল্যবান প্রয়োজনকে। তার শরীরটা এযাবতকাল যে খাতে বিনিয়োগ হয়েছিল সে খাতের জরুরী প্রয়োজনে অনেক খুইয়ে গেছে। সভ্যতার নামে, প্রগতির নামে সে প্রয়োজন অনেকখানি তার মনের অজান্তেই মিটে গেছে। ভাবতেও এখন তার শরীর ঘিন ঘিন করে। যেসব গুণীজনদের হাত ধরে সে আকাশছোঁয়া সেলিব্রেটী হয়েছিল সেসব গুণীজনরা এখন আর তার কাছেও আসে না। তাকে আর এখন তাদের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া সেসব বিখ্যাত শিল্প স্রষ্টাদের অনেকেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। যারা আছেন, তারাও প্রায় নিভু নিভু। এখন নিশি একেবারেই একা। তার পুরণ সব পোষ্টার এখনো তার ঘরে ঝুলছে। সেগুলো দেখে দেখেই তার দুচোখ ভিজে দিন রাত কেটে যায়। রাজপথের দেয়ালে দেয়ালে নতুন নতুন সেলিব্রেটিদের ছবি। নতুন নতুন চ্যানেল, নতুন নতুন প্রডিউসার, ডিরেক্টর। নতুন নতুন ইনভেস্টর। সেখানে কেউ আর নিশিকে চেনে না।
মায়ের শেষ সময় জানিয়ে বাবাকে লেখা চিঠির ডাকে সাড়া দিলেন বৃদ্ধ রাফছান। তিনি নিজেই এখন চলছেন লাঠির সাহায্যে। তাই তার ছোট ভাইকেই দায়িত্বটা নিতে বললেন। আমেরিকায় ওদের যখন নিয়ে আসা হল তখন তার মায়ের অবস্থা একেবারেই শেষ পর্যায়ে। কিছুদিনের মধ্যে তার মা চলে গেলেন ইহলোক ত্যাগ করে। নিশি এখন একেবারেই একা। তার শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে। আয়নায় নিজের মুখটা দেখে শিউরে ওঠে। গরম জ্বলে ভিজে গেল চোখ দুটো। আকাশছোঁয়া সেলিব্রেটি সেই নিশি, এই ! এখন ছোট চাচার ঘরের একটা কোণে পড়ে আছে ফেলে দেয়া কুঁকড়ে যাওয়া বাসি শুকনো ফুলের মত।
পাশের ঘরে বৃদ্ধ বাবা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। চোখ বেয়ে গলিত অশ্রুরেখা বেয়ে পড়ছে, আর ডুকরে ডুকরে হৃদয়ে স্পন্দিত হচ্ছে- হায় ! " আমি সেলিব্রেটির বাবা "।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এম আর সকাল আমার মনে হয়..লেখা কখনও পূরণ হয় না.. লেখকও হয় না... মনটা হয়ত ভোলা হয়ে যায়..
কষ্ট করে পড়েছেন, অনেক ধন্যবাদ ।
susmita এত বাস্তব একটা গল্প!!চমৎকার লেগেছে :)
এত পূরণ একটা গল্প পড়ে এখনো পাঠক মন্তব্য করছেন ? সত্যিই আমি খুবই কৃতজ্ঞ ।
সূর্য গল্পের "নিশি" অথবা রিয়েল লাইফ সেলিব্রেটিদের নিয়ে অনেক কিছুই ঘটে, রটে। সেগুলোতে ভিন্নমত থাকাও স্বাভাবিক। আমি অনেক রিটায়ার লোকদেরও একই অবস্থায় দেখেছি, তাই ছেলে মেয়ের আলাদা নির্বাসন খুব বেশি ভাবায় না আমাকে। তবে বেলাল্লাপনা বলেও একটা কথা আছে সেটাকে অবশ্যই নিন্দা জানাই। গল্প ভাল লেগেছে।
আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন .....................মানুষ কিসে সুখি হয়, বলতে পারেন? আপনি বলে দিয়েছেন, কিসে সুখি হয়না। চমৎকার। শুভেচ্ছা জানবেন।
আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি বিষয় ভিত্তিক না হলেও লেখাটা ভালো লাগল। সাবলিল এবং সুন্দর .....ইমদাদুল ভাই আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ..........
মামুন ম. আজিজ রিয়েলিটি ডেসক্রাইবড...দারুন বস।
ঝরা শিক্ষনীয় বিষয়
আমাদের মায়েদের এবং কন্যা সন্তানদের যদি বোধোদয় হয়, তাহলে নিজেকে স্বাথর্ক মনে করব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
Israt ভালো লাগল গল্পটা। হায় বার্ধক্য ! একেই সবচেয়ে বড় ভয়!
ইশরাত আপনাকে ধন্যবাদ । কেন , শুধু কি বাধ্যকেই ভয় ? এধরনের সেলিব্রেটি হবার যন্ত্রণাকে ভয় করে না ?
stardom যদি উপভোগ করা যায় ক্ষতি কি? খ্যাতির তো কিছু বিড়ম্বনা থাকবেই. তবে খ্যাতির শীর্ষে উঠে বার্ধক্যের কারণে নির্বাসিত হওয়াটা খুব কষ্টের।
একটা কণ্যা সন্তান অনেক মূল্যবান । কেননা তার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে 'মা' । তাই নিজের মূল্যবান জীবনের ক্ষতি না করে খ্যাতি অজর্ন করতে পারলে তো কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু এ গল্পের সেলিব্রেটি আর তার মায়ের জীবনের পরিণতি কে কেবল বাধ্যর্ক্যেই করুণ হয়েছে ? এখানে যা ঘটেছে, তা যেন কোন মা বোনের জীবণে না ঘটে, এটাই কাম্য হোক সকল সুস্থ্যজনের । আপনাকে ধন্যবাদ ।
রোদের ছায়া একটু বড় আকারে লেখা হলেও খুব সুন্দর ..... তবে বিষয়ের সাথে যোগাযোগ টা পেলাম না /
আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে আরো বেশী অনুপ্রাণীত করল । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

২৯ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী