বিন্দু কুটীর ঝোপ

সবুজ (জুলাই ২০১২)

খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
  • ২৪
  • ১৫৪
( ক )
কাঠ ফাটা রোদের উঠোন। প্রকৃতির বৈরীতা তখন চরমে। জ্যৈষ্ঠের মাঝা মাঝি কোন এক ঠা ঠা রোদের দুপুর। গ্রামীণ প্রজন্মের কিছু কিশোর যুবক আর কিছু উৎসাহী কিশোরী। হেটে চলেছে ওরা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। সাথে চলেছে ছোট ছোট ছেলে মেয়ের দল। হৈ হুল্লোরের মাঝে সাজ সাজ উৎসবের আমেজ...................................................................।

ছেলেদের মাথা আর কোমরে বাধা গামছা । কারো গলায় ভাঙ্গা পুরানো ঢোল। কারো বা হাতে ভাঙ্গা থালার কাঁসর ঘন্টা। মেয়েদের কারো হাতে কাঁচকলা ধান দুবলোর সাজোন কুলো। কারো হাতে আবার ত্রি-পত্রক আম্র মঙ্গল ঘট। সব মিলিয়ে সাজনা বাজনা সহযোগে সুসজ্জিত একটি দল। গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এরা আল্লাহ’র কাছে বৃষ্টির পানি চায়। চিরাচরিত গ্রামের কৃষকরা খরা মৌসুমে দীর্ঘ দিন ধরে বৃষ্টি না হলে আল্লাহ’র কাছে বৃষ্টির পানি চেয়ে আসছে বহুকাল ধরে এ ভাবেই ।ঃ
আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই...................................................আল্লা মেঘ দে। এটা হলো ওদের দলীয় সঙ্গিত।

গ্রামের প্রতিটা বাড়ির উঠোনে এরা আনুষ্ঠানিক ভাবে আল্লাহ’র কাছে পানি চায়, তপ্ত রোদের উঠোনে গড়াগড়ি খায়, আর আকাশের দিকে চিৎ হয়ে মাতম করে গায়ঃ আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই ...................................................আল্লা মেঘ দে।

যে বাড়িতে যখন যায় তখন সে বাড়ির গৃহ বধূরা কলস কলস পানি এনে তপ্ত রোদের উঠোনে মাতম রত ছেলেদের গায়ে পানি ঢালতে থাকে। এক সময় উঠোনের ধুলো বালি পিচ্ছিল কাদায় পরিণত হয় পানির তোড়ে।

অনেক সময় কোন আনাড়ী গৃহ বধূ পানি ঢালতে গিয়ে দৈবাৎ পিছলে পড়ে গেলে হাসির ফুয়ারা উঠে সমবেত দর্শকদের মাঝে। এর পরে দলটির সর্দার বাড়ির কর্তা বধূর কাছ থেকে মুষ্ঠির চাল নিয়ে যখন বাজনা বাজাতে বাজাতে অন্য বাড়ির দিকে রওনা হয় গোটা দলটি তখন কাদা মাখা শরীর নিয়ে তাকে অনুসরণ করে।

এমনি এক আবেগ ঘন মুহুর্তে সেদিন লজ্জায় লাল হয়েছিল কাজলী। ঘুরে ঘুরে এক সময় দলটি শুকুর মুন্সির বাড়ির উঠোনে আসে। আল্লা মেঘ দে পানি দে.....যখন তুঙে তখন কাজলী আর ওর চাচাতো বোন শেফালী পানি ঢালছিল উঠোনে। এক পর্যায়ে উঠোনে গড়াগড়ি রত কালাচাঁন নামের ছোড়াটার পায়ের সাথে শাড়ীর অাঁচলটা হঠাৎ জড়িয়ে যায়। আর বিপর্যয়টা ঠিক তখনি ঘটে । তাড়াহূড়ো করে পানি ঢেলে আবার পানি আনতে যেতেই অাঁচলে টান লেগে চিতপাট হয়ে পড়ে যায় বেচারি কাজলী।

দৃশ্য দেখে সবাই হো হো হাসিতে যখন মগ্ন, কালাচাঁন ছোড়াটা ফ্যাল ফ্যাল করে তখন কাজলীর লজ্জা গিলছিল। কাজলী নিজের লজ্জা ঢেকে নিয়ে, কিছুক্ষনের জন্য মনের অজামেত্ম কালাচাঁনের চোখের গভীরে হারিয়ে গিয়েছিল।
( খ )
এই মৌসুমে কৃষকরা দলে দলে আউস পাট আর আমন ধানের জমি নিড়ায়। কাজের ফাঁকে সারি গানের আবেশে কচি কচি সবুজ ফসলের প্রাণেও যেন দোলা লাগে। সবুজ সমুদ্রের মাঝে ঢেউ খেলে যায় সুখের দমকা হাওয়া। অথচ খরায় চিরচেনা সেই কচি কচি সবুজ ফসল গুলো রোদে পুড়ে ধুসর কালো হয়ে গেছে। রোদে পোড়া কচি ফসলের পাথারের দিকে তাকালে বুক ফেটে কান্না আসে শুকুর মুন্সির।
বছরের একটা মাত্র খন্দক ফসল করতে পয়সা দিয়ে পানি কিনতে হয়না। আল্লাহ’র কুদরতে জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে যে বৃষ্টি হয় তাতেই এক রকম বিনা খরচে ফসল ঘরে উঠে আসে। সেই খন্দকের ফসল যদি মারা যায় তবে শুকুর মুন্সির মতো ছোট ছোট কৃষকের বাঁচার আর কায়দা থাকেনা। তাই চিমত্মা চেতনায় বিমূর্ষ্য কৃষক আজ দিশেহারা। একে তো অভাব তার উপরে ফসল অজন্মার আশঙ্কা.....ভেবে ভেবে শুকুর আলি মুন্সি কোন কুল কিনারা খুঁজে পায়না।

এদিকে মেয়েটাও দিন দিন তাল গাছের মতো লম্বা হয়ে উঠছে। শুকুর মুন্সির সামনে এটাই এখন বড় দায়। ভেবেছিল এই খন্দকের ফসল দিয়ে কাজলীর বিয়েটা এবার সেরে ফেলবে। কিন্তু দেশ কালের যে কি হলো। মেঘ নেই পানি নেই যে দিকে তাকায় শুধু হু হু বিরান মরুভূমির মতো লাগে। সবুজের কচি কচি দেহ গুলো পুড়ে আবলুস হয়ে গেছে সব। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অলস দুপুরে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে শুকুর মুন্সি।

বাবা ঘুমিয়ে গেলে পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে কাজলী। বাড়ির দক্ষিণ কাণী বরাবর আম গাছটা জড়িয়ে ধরে তাতে মাথা আর গাল ঠেকিয়ে উদাস নয়নে চেয়ে থাকে সবুজে চেরা মেটো পথের দিকে। এক সময় ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যায় সেই রূপকথার মদন কুমারের দেশে।
প্রতি দিন শুকুর মুন্সির বাড়ির সামনে বিলের ধারে মোশ চরাতে আসে কালাচাঁন । মোশের পিঠে চড়ে গান গায় আর সুযোগ বুঝে কাজলীর সাথে টাঙ্কি মারে। কাজলীও সুরেলা কন্ঠের আবেশে গা ভাসিয়ে দিয়ে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে উন্মুক্ত পাথারের আঙ্গিনায় কালাচাঁনের চোখে চোখ রেখে । মোশের পিঠে কালাচাঁনকে তখন ঠিক যেন ঘোড়ায় চড়া মদন কুমারের মতোই মনে হয় ওর কাছে।ঃ

আমি স্বপ্নে দেখলাম... মধু মালারে....কালাচাঁনের সুরেলা কন্ঠে মধুমালার পালা শুনতে শুনতে কখন যে মনের খেয়ালে কলমির জলে ঝাপিয়ে সাঁতার কাটতে থাকে কাজলী নিজেও তা জানেনা। সমবয়সী না হলেও চাচাতো বোন শেফালী ওকে সময়ে সঙ্গ দিয়ে থাকে। গোসলের ছলে দুজন মিলে কখনো কলমীর শাক তোলে, শাপলার লাল দিয়ে মালা বানায়, কখনো বা আবার কলমির ফুল খোপায় গুঁজে কালাচাঁনের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

সে দিন দুপুরে নামাজ শেষ করার আগে শুকুর মুন্সি কি মনে করে মেয়েকে কাছে ডেকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ফুঁ দিয়ে দেয় সারা শরীরে। মেয়ের গায়ে যেন বদ নজর না লাগে ভাব খানা ঠিক এমনি। বাবার এহেন কার্যকলাপে কাজলী মনে মনে হাসে। বাবার মনটা একটু বেশী মাত্রায় মেয়ে কেন্দ্রিক হওয়ায় কাজলী ভাবে......বাবাকে বলবে নাকি কালাচাঁনের সেই কথাটা ?
কিন্তু বলি বলি করতেই শুকুর মুন্সি এবার দু হাত তুলে...মুনাজাত শুরু করে...................................................................
( গ ) ঃ মুনাজাতঃ
’’হে আল্লাহ পরওয়ার দিগার দয়াশীল ওগো দয়াময় / দুহাত তুলে করি মুনাজাত তোমার রহমত খানি চাই।
কচিকচি সবুজ ফসলের মাঠ তোমারই কুদরত জানি / ওদের জীবন বাঁচিয়ে দাও রহিম ঝড়িয়ে বৃষ্টির পানি।
সবুজ যদিনা বাঁচে দুনিয়ায় বল মানুষ কি করে বাঁচে / সবুজই যে তোমার মূল কেরামতি আর যত সব পাছে।
সবুজেই শ্বাস - সবুজেই বাস - সবুজই যোগায় অন্ন / কত যে অপরূপ মহিমা তোমার সকলই মোদের জন্য।
আমি গুনাহগার শুকুর মুন্সি দিও তুমি মোরে পানা / পানি বিনে ফসল না হলে আমি শুকুর যে আর বাঁচিনা।
রহমতের বৃষ্টি ঝরে যেন খোদা না ফুরাতে এই রাত / আমিন আমিন ছুম্মা আমিন কবুল কর মোর মুনাজাত।
আমিন...........


মুনাজাত শেষ করে অশ্রু সজল চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকায় শুকুর মুন্সি। কাজলী এবার কথাটা বাবাকে বলবে বলে মনস্থির করে। মেয়ে কিছু একটা বলতে চায় অাঁচ করতে পেরে শুকুর মুন্সি জানতে চায় .............................ঃ

তুই কি হামাক কিছু কবার চাইচ্ছু রে মা ?.........................................................ঃ
হয় আববা হামি তোমাক এক খান কতা কবারই তো চাইচ্ছি ....................................ঃ
তে কইচ্ছু না ক্যা .... ক’দিনি কি কবার চইচ্ছু ....বলতে বলতে শুকুর মুন্সি জায়নামাজ থেকে উঠে বিছানায় আরাম করে বালিশে হেলান দিয়ে বসে। এর মধ্যে কাজলী বাবার জন্য পান সুপারী আনতে গিয়ে এক প্রকার দিধা গ্রস্থ হয়ে আবারো ভাবতে থাকে বাবাকে কথাটা বলবে কিনা.............................................................................?

আজ কালাচাঁন আর ও দুজনে মিলে বিলের ধারে ঐ বিন্দুকুটীর ঝোপটাকে স্বাক্ষী রেখে অনাড়ম্বর পরিবেশে এক ধরনের আবেগের বসে কাজটি সেরে ফেলেছে। কালাচাঁন ছোড়াটা ’আল্লা মেঘদে পানিদে’ দলের সাথে ঘুরে ঘুরে অনেক কিছুই শিখেছে। অতি খরার সময় আকাশ থেকে পানি নামানোর জন্য ব্যাঙা ব্যেঙির বিয়ে দেয়ার নাকি রেয়াজ আছে।
যেদিন ব্যাঙা ব্যেঙির বিয়ে দেয়া হয় ঠিক সেই দিন রাতেই নাকি মুশোল ধারায় বৃষ্টি হয়....কথাটা কালাচাঁন ঐ বিন্দুকুটীর ঝোপটাকে স্বাক্ষী রেখে ওকে বলেছে।
বাবার হাতে পান তুলে দিতে দিতে কাজলী এবারে অতি উৎসাহী হয়ে বলে উঠে..................................ঃ
ল্যাও পান ল্যাও.......তুমাক আর চিমত্মা করা লাইগবি না আববা ..................................................ঃ
কিসোক রে মা .....ক্যা কি হচে.... চিমত্মা করা লাগবি না মানে ? কুন চিমত্ম্যার কতা কইচ্চুৃ...? কাজলীর কথায় শুকুর মুন্সির বুকের ভেতরটায় ছ্যাৎ করে উঠে...................................................ঃ
ক্যা এইযে...আবাদ বিন্যাদ খ্যাত খোলা সব মইর্যা যাইচ্চে.....পানি হইচ্ছেনা....বিষ্টির ক্যানে তোমরা সগোলি খালি কান্দিচ্ছিন তাউ বিষ্টি হইচ্চেনা সেই কতা...........................................
কাজলীর কথাটা আত্ম কেন্দ্রিক না হওয়ায় শুকুর মুন্সি অনেকটা সস্থির খুঁজে পায় মনে। সুতরাং মুখের পান এমাড়ি ওমাড়ি করতে করতে কৌতূহলী হয়ে আবার জানতে চায়........................ঃ
হু ঠিকি তো আছে ......তা কি কবার চাইচ্চু কবুতো........বিষ্টি হইচ্ছেনা তাতো সগোলি জানে.,,,..আবার চিমত্মা করার কতা মানা করিচ্চু......কি হচে কবুতো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে গলায় ভর দিয়ে কাজলী এবার বলে উঠে..................ঃ

হয় আববা ....হামি কয়া দিচ্চি আইজ রাইতে বিষ্টি হোবেই হোবে......তুমি দেইখ্যা লিও.. ....এক্কে ঝম ঝম কইর্যা বিষ্টি হোবে আইজ রাইতে.............এ্যামুন পানি হোবে তা তুমি চিমত্মাই কইরব্যার পাইরবিন নাকো..................
মেয়ের কথা শুনে গা ঝাড়া দিয়ে এবার শুকুর মুন্সি বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। আবেগে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। একটা অলৌকিক আলোর বিচ্ছুরণ যেন দেখতে পায় কাজলীর হাসি মাখা মুখের অবয়বে। উৎসুক হয়ে জানতে চায় আবার..............ঃ

তুই কিঙ্কা কইরা জানলু যে আইজ রাইতে বিষ্টি হোবেই হোবে.....? শুকুর মুন্সি কৌতুহলি প্রশ্ন করে বসে মেয়েকে। কাজলী এবার কালাচাঁনের সেই কাহিনীর কথা বাবাকে খুলে বলতে থাকে...............................ঃ
কতাডা তাহলে তুমাক খুইল্যাই কইচ্চি শুনো....আইজ বিয়্যান বেলা মোল্লাকে বাড়ির কালাচাঁন আর হামি.....দুইজনা মিলা দুইড্যা ব্যাঙা ব্যেঙি ধইর্যা ওরকে কপালে সিঁন্দুর মাখায়া....... বিয়া দিয়া দিছি.........................
তারপর ঐ বিন্দুকুটীর ঝোপেক স্বাক্ষী রাইখ্যা বিয়ার পর ওরকে পানিত ছাইড়্যা দেওয়া হচে.....জানিন আববা বিয়া হয়া ব্যাঙা ব্যেঙি দুইড্যার লাপা লাপি দেকে কেডা.....খুবই খুশি হচে অরা........................ কালাচাঁন তো কইচ্চে আইজ রাইতে পানি হোবেই হোবে.....কুনো মিছ নাই......এক্কে হানডেন্ডে হানডেন্ড (১০০/১০০)।

মেয়ের কথা গুলো খুব মনযোগ দিয়ে শুনছিল শুকুর মুন্সি। মনে পড়ে ছোট বেলায় তারাও এমন অনেক ব্যাঙা ব্যেঙির বিয়ে দিয়েছে। এতে করে বৃষ্টি হয় কিনা তা শুকুর মুন্সির জানা নেই তবে গ্রাম বাংলায় এটির প্রচলন আছে।

কিন্তু মেয়ের কথায় কালাচাঁনের উপর এতটা আত্ম বিশ্বাসের গোমর খুঁজে পায়না সহজে। হাসতে হাসতে শুকুর মুন্সি মেয়েকে এবার কাছে টেনে আদর করতে থাকে। চোখ দুটো আবেগে অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠে, দু হাতের তালু দিয়ে অশ্রু মুছে নিয়ে শুকুর মুন্সি বিরবির করে বলতে থাকে.................................................................................ঃ
তাই জ্যান হয়রে মা তাই জ্যান হয়। আইজ রাইতেই জ্যান বিষ্টি হয়। হামি দোয়া করিচ্চি....তুরকে ব্যাঙা ব্যেঙির বিয়া দেওয়া জ্যান স্বার্থক হয়...........................................................................................

পরক্ষনেই ব্যাঙা ব্যেঙির বিয়ের সাথে মেয়ের বিয়ের ভাবাবেগে হারিয়ে যায় শুকুর মুন্সি। বুকের গভীর থেকে চাপা ধরনের একটা হাপিত্যেশ বেরিয়ে আসে। আবার মেয়ের কথার মাঝে বিপর্যস্ত মনের কোনায় গভীর অন্ধকারের মধ্যেও যেন কিছুটা আলোর রেখা দেখতে পায় শুকুর মুন্সি।
( ঘ )
’’এবার এক প্রকার হমত্ম দমত্ম হয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে অভিজ্ঞ কৃষক শুকুর আলী মুন্সি। মুখ তুলে তাকায় আকাশের দিকে। দেখে নেয় আকাশের চলমান জলবায়ুর ভাউ (ভাব)। কালাচাঁন আর কাজলীর সহজ সরল সমীকরণের সাথে মিলে যায় একজন অশিক্ষিত কৃষক বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণ। যেখানে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রয়োজন হয়না। অভিজ্ঞ কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারে সম্ভাব্য আবহাওয়ার পূর্ভাভাস।’’
সম্ভাবনার আবেশে শুকুর মুন্সি প্রশামিত্মর জানালা খুলে রাতে এশা’র নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে পরে । সারা দিন কাজ কর্মের পর রাতের ঘুমটা স্বাভাবিক ভাবেই একটু গভীর হয়ায় মুহর্তের মধ্যে তলিয়ে যায় বিভোর ঘুমে ।
ওদিকে নিজের ঘরে বসে কাজলী বিনিদ্র রাতের প্রহর গুনতে থাকে । কালাচাঁনের কথা মতো আজ রাতে বৃষ্টি না হলে ওর আত্ম বিশ্বাসের অব্যাহত স্রোত ধারা থমকে দাড়াবে। কালাচাঁনের সব কথাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চায় কাজলী। কেননা এটা যে ওর সরল মনের ভালোবাসার সহজ সমীকরণ।

ভাবতে ভাবতে এক সময় রাতের গভীরে কিছুটা তন্দ্রাভিভুত হয়ে পড়ে কাজলী.....হঠাৎ করে চমকে উঠে.....কিসের যেন শব্দ শুনতে পেয়ে !.....কান দুটো সজাগ হয়ে উঠে ওর। খেয়াল করে বুঝতে পারে ঠিক বিন্দুকুটীর ঝোপটার কাছ থেকে আসছে একটানা সেই .... ঘ্যাঙ..ওর ..ঘ্যঙ..ওর শব্দটা............................
মনে পড়ে যায় কালাচাঁন ঠিক এমনটিই বলেছিল ওকে.... বৃষ্টি হওয়ার আগে নব বিবাহিত ব্যাঙা ব্যেঙি দুটো এভাবেই ঘ্যাঙ..ওর..ঘ্যাঙ..ওর...করে ডাকতে থাকবে। সহজ সরল ভাবে সব কিছুই যেন মিলে যাচ্ছে......তবে তো সত্যি সত্যিই আজ বৃষ্টি হবে......................................!!
হঠাৎ করে কাজলীর হৃদপিন্ডের শ্বাস প্রশ্বাস বেরে যায়। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় ...কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই অলৌকিক ভাবে গুর গুর করে মেঘ ডেকে উঠে আকাশে.... তার পর শুরু হয় মুশোল ধারায় কাঙ্খিত সেই রহমতের বৃষ্টি। দৌড়ে গিয়ে ঘুমে অচেতন বাবাকে খুশির কান্না জড়িত কন্ঠে ডাকতে থাকে কাজলী......................ঃ
আববা ...ক্যা আববা ...আববা... শুইনব্যার পাইচ্ছিন ন্যা ?.....ক্যা আববা...ঐ দ্যাকো পানি হইচ্ছে ........................
বেশ কয়েক বার ডাকা ডাকির পর শুকুর মুন্সি হকচকিয়ে জেগে উঠে.....টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির সেই চিরচেনা আওয়াজ আর পানির কল কল শব্দ শুনে বিমোহিত হয়ে যায় মূহুর্তে। কি করবে আর কি বলবে ভেবে পায়না শুকুর মুন্সি। মেয়ের চোখে খুশির অশ্রু দেখে আর চুপ থাকতে পারেনা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আবেগে কেঁদে উঠে.......................
সুখের কান্না কেঁদে বুকের গভীরে জমে থাকা চাপা মনের ফাঁপর কিছুটা হালকা করে। তারপর দু’হাত তুলে আল্লাহ’র দরবারে শুকরিয়া আদায় করে নেয় শুকুর মুন্সি। বাইরে অঝর ধারায় তখন একটানা বৃস্টির ঝমঝম বর্ষণ। কল কল করে পানি নামছে কামত্মা বিলের মোহনায়। এভাবে প্রায় ৪/৫ ঘন্টা অবিরাম বর্ষণ হতে থাকে তপ্ত পাথারের বুকে.........অবশেষে রাতের শেষ প্রহরে দিকে দুর থেকে ভেসে আসে আস্সালাতু খয়রুম মিনান্নার।
ফজরের নামাজ আদায় করে জায়নামাজে বসে বসে দোয়া দরুদ পাঠ করতে থাকে শুকুর মুন্সি। আন্ধকারের রেশ তখনো কাটেনি । তবে বৃষ্টির ধারা কিছুটা কমে এসেছে। প্রকৃতির ডাকে কাজলী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে,.....উঠোনে নেমে দু এক পা সামনে এগুতেই আচমকা পিছলে পড়ে যায় উঠোনে। সেদিন কালাচাঁনের পায়ের সাথে অাঁচল পেচিয়ে পড়ে যাওয়ার কথা মনে করে ঘুলি অন্ধকার ভোর বেলা একা একা উঠোনে পড়ে থেকে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যায় কাজলী...........................................
ইতি মধ্যে কখন যে অন্ধকার কেটে ফর্শা হয়ে গেছে টের পায়নি। বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে কাদা মাটি মাখা কাপড় চোপড় সামলে স্বলজ্জে বাবার মুখের দিকে তাকায় কাজলী। ঘটনা বুঝতে পেরে এবার বাবা মেয়ে উভয়ে আবার হো হো করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে কাজলী বাবার হাতটা ধরে উঠার চেস্টা করে, কিন্তু না আবারও পড়ে যায় উঠোনে।
কাজলী এবার দম ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ে...হাসির বান ডেকে যায় ওদের ছোট্ট উঠোনের আঙ্গিনায়। হাসতে হাসতে শেষে বাবার কথায় সম্ভিত ফিরে পায়......দম নিয়ে বাবাকে বলে উঠেঃ হামি হাসিচ্ছি কিসোক জানিন আববা......................................?ঃ
হু..হু..জানি.. লে.. হচে লে..পাগলীর মুতো আর হাসা লাগবি ন্যা...যা তো...গুসল করে আগে ভিজা কাপড় চোপড় ছাড়েক........

হাসি মাখা শাষনের সুরে কথা গুলো বলে...মনে মনে শুকুর মুন্সি ভাবে কালাচাঁন ছোড়াটা নেহায়াত মন্দ না। কাজলীর আত্ম বিশ্বাস আছে ছোড়াটার উপর। না হলে কাজলী আজ রাতে বৃষ্টি হওয়ার কথা এতোটা জোর দিয়ে বলতে পারতো না....সুতরাং কাজলী আর কালাচাঁনের মিলন হতে দোষ কি। বৃষ্টির ফলে অজন্মার হাত থেকে ফসল রক্ষা পাওয়ায় শুকুর মুন্সির মনোবল বেরে যায়। তাই হাসতে হাসতে মেয়ের মন বোঝার জন্য বলে .............................................................ঃ

কালাচাঁনেক তুর কিঙ্কা লাগেরে মা...হামাক কিন্তু ভালই লাগে ছাওয়াল ডাক। ছাওয়ালডার মুকোত বরকত আছে.....তা ছাড়া ছাওয়ালডা দেকতে শুইনতেও মন্দ না ....না কি কইচ্চু.................................
বাবার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে কাজলী নীচু গলায় বলে উঠে........................ঃ
লেহ বাবা.... হামি কি কমো...(হামার যা কওয়ার ঐ বিন্দুকুটীর ঝোপেকই কমো ) কথা গুলো বলতে বলতে..........................
ছুটে গিয়ে কলমির জলে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে থাকে কাজলী। শুকুর মুন্সি মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বাইরে বেরিয়ে যায়। বিন্দুকুটীর ঝোপটার আড়াল থেকে তখন নব বিবাহিত ব্যাঙা ব্যেঙি দুটো ঘ্যাঙ..ওর ঘ্যাঙ..ওর... করে ডাকতে থাকে ।
’’কাজলীর জীবনে এ যাবৎ যা কিছু ঘটেছে সবই ছিল ওর সরল মনের আত্ম বিশ্বাসের ফসল...। জীবনে অলৌকিক অথবা দৈবাৎ এমন কিছু ঘটনা অবচেতন মনের আড়ালে ঘটে যায়..যেখানে নিয়োম নীতি কিম্বা বিশ্বাস অবিশ্বাসের যৌক্তিকতা খুজে পাওয়া যায়না’’
হয়তো কাজলীর জীবনেও এমনি কিছু ঘটনার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তবুও যে বিন্দুকটীর ঝোপকে স্বাক্ষী রেখে কোন কিছু কামনা করে রঙিন কাপড়ের তেনা বেধে দিলে মনের আশা পূর্ণ হয় কালাচাঁনের এ কথাটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চায় কাজলী। আর তাই...........
কলমির জলে ভালো করে গোসল সেরে নিয়ে সমত্মর্পনে এগিয়ে যায় কাজলী বিন্দুকুটীর ঝোপটার দিকে । চোখ বন্ধ করে মনে মনে কি যেন কামনা করে। তারপর ওর কলাবেনী চুলের লাল ফিতাটা খুলে বিন্দুকুটির ঝোপটার ডালে বেধে দেয়। এরপর হাসি মুখে বাড়ির পথ ধরে সামনে এগুতে থাকে সরল মনের নীরব স্বাক্ষী হয়ে থাকা সেই চিরসবুজ ’বিন্দুকুটীর ঝোপ’টাকে পেছনে ফেলে.....................................................................................................................................................

টীকা [ বিন্দুকুটীর ঝোপ হচ্ছে ইংরেজ সাহেবদের নীলকুট’’র একটি পরিত্যাক্ত ধবংশ স্ত্তপ। পরবর্তিতে যা কাটা গুল্ম এবং শ্যাওড়া গাছ দ্বারা একটি ঝোপে পরিনত হয়েছে। অত্যাচারিত হয়ে বিন্দু নামে একজন নীলচাষী এ কুটীরে প্রাণ হারায় বলে লোকে এটিকে বিন্দুকুটীর ঝোপ বলে ]
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক অনেক অনেক ভালো লাগলো ভাইয়ার গল্পটি ...বোনাস হিসেবে শুকুর মুন্সির মোনাজাত হিদয় কেড়েছে ...সালাম ও ধন্যবাদ রইল ///
tani sukur munshir monajat j tomar hridoy kereche se jonno ami dhonno ....tomar salam grohon korechhi .....nirontor suvo kamona tomar jonno.....
অনেক অনেক ধন্যবাদ ...ভাইয়া
এফ, আই , জুয়েল # একের ভিতর অনেক । বেশ ভাল গল্প ।।
সূর্য খুব সুন্দর বুনটে গল্পটা অনেক ভাল লাগার। মুগ্ধ হলাম
স্বাধীন অনেক অনেক সুন্দর একটা গল্প। কাকতালীয় ভাবে পরের মাসের িবষয় বৃিষ্ট। গল্পটা বৃষ্টি সংখ্যার জন্য একেবাের দুধে আলতা হত।
thiki bolechhen tobe bristi bisoyta sobujer sathe khub jay kina tai golpoti likha...sadhin apnake osesh dhonnobad....
শফিক বাংলার প্রকৃতির উপর সুন্দর গল্প গল্প কবিতা উপহার দিয়েছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ..................... শুভ কামনা রইল.......................
খন্দকার মশিউর রহমান প্রকৃতির সাথে একাকার...মন ছুয়ে গেল... অসাধারণ...অনেক ধন্যবাদ কবিকে...
অষ্টবসু gramya bhasar bes baro galpati amar parte bes samai laglo.galpati sundar sabalil
o hai tika ta kaje legeche
sonjib da tikata kaje legechhe jene khushi holam....apnake suvo kamona...
are amake dada bolben na anisur babu ami apnar cheye 22 yr choto
Tobe tai hok tomar ichchhatai puron hok ...snjib tomake osesh dhonnobad....
সিয়াম সোহানূর গ্রামীণ প্রকৃতি ও সংস্কৃতির একটা ঝলমলে ছবি যা ঠোঁট মেলে না কিন্তু কথা বলে। অনেক সুন্দর গল্প কথন।
আহমেদ সাবের গ্রামের সরল মানুষের সরল বিশ্বাসের গল্প। ব্যাঙা ব্যেঙির বিয়ে দিলে বৃষ্টি নামে, এই প্রচলিত রেওয়াজকে ভিত্তি করে বিন্দুকুটীর 'এর সবুজ ঝোপকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় কালাচাঁন আর কাজলির মন দেয়া নেয়া। অসাধারণ গল্প। গল্পের আঞ্চলিক ভাষাটা বেশ লাগল। এটা কি রাজশাহী অঞ্চলের?

১০ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী