অতীতকে পিছনে ফেলে নতুন

নতুন (এপ্রিল ২০১২)

লিয়া ferdous
  • ২২
  • ৬৫
সারা ঘর ব্যাপি হইহুল্লর পড়ে গেল। মিষ্টি আন......মিষ্টি কই? চিৎকার চ্যাচামেচীতে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। তবুও সবাই আনন্দ করছে মন ভরে। সবারই যেন তাড়াহুরা। এ কাজ সে কাজ নিয়ে সবাই ব্যাস্ত। আর ফোন তো বিজি বিজি বিজি। কেউই এ বাসার ফোনে লাইন পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সবাইই ফোনে কারো না কারো সাথে কথা বলছে। এ ঘরের প্রায় প্রতিটি মানুষের মুঠোয় ফোন। কেউ কারো কথা শুনছে না। সবাই নিজের মত বলেই যাচ্ছে। আর কিছুক্ষন পর পর হাসির দমক উঠছে। প্রথমটায় আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাড়ির দরজা হাট করে খোলা ছিল। যদিও দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়। যেন আমি এই বাড়িরই সদস্য কিংবা তাঁর অনেক দিনের চেনা।
ঘরে ঢুকে এরকম আনন্দঘন পরিবেশে এসে পড়ে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। সবার মুখে মুখে একটা সুসংবাদ খেলা করছে। হয়তো এ বাড়ির কেউ ভাল রেজাল্ট করেছে। অথবা কেউ চাকুরী পেয়েছে, এমন কেউ যে তাদের সবারই খুব প্রিয়। আমি এতক্ষন বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবার একটু খেয়াল করে শুনলাম। কথার মধ্যে কেমন একটা নতুন নতুন গন্ধ। এ বাড়ির কারো নতুন সন্তানের জন্ম হয়েছে তাই সবার এত আনন্দ। কেন যেন হঠাত আমার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। এদের আনন্দ যেন আমাকেও সংক্রামন করেছে।
আমি শাওন। বয়স ১৫। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। ঢাকায় আমার আসার কখনই কোন ইচ্ছে ছিল না। তবুও শুধুমাত্র একটি ইচ্ছা পূরন করতেই ঢাকায় আসা। আমি জানি না সেটা পূরন হবে কিনা। তবুও যদি হয়! ঘরের একদম মধ্যবর্তী সোফায় বসে থাকা মধ্যবয়সী হোম্বা চোম্বা লোকটা প্রথমে আমাকে খেয়াল করলেন। তাঁর হাসি হাসি মুখ ধীরে ধীরে মলিন হতে হতে চিন্তায় গিয়ে ঠেকল। আমাকে দেখে তিনি যেন বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে যেতেই বললেন “কে তুমি বাবা? কার সাথে এসেছো? কোথা থেকে এসেছো।” আমি মুখে জবাব খুজে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, কি বলব? কে আমি? আর সেটা উনারা কিভাবেই বা নিবেন? উফ মা যে আমাকে কি একটা জটিল অবস্থায় ফেলল? না আসতাম সেটাই ভাল ছিল। অবশ্য আসা টা একরকম আমার ইচ্ছার উপর ডিপেন্ড করেছিল। তবুও মা যদি আমাকে না বলত তবে হয়ত কোন ইচ্ছাই জাগ্রত হত না।
ওনার কথায় ভাবনার ছেদ কাটল। “কি খোকা? বল। কোথা থেকে এসেছো?”
“আমি শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই।”
“শহীদ? ও হো হো হো...।” তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। এতক্ষনে খেয়াল করলাম ঘরের বাকি সবাইও আমার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। তারাও হেসে উঠল।
“শহীদকে আজকে পাবে? আরে ও তো আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। ও আজ প্রথম বাবা হল।জানো না তো বিয়ের আজ বারো বছর পর প্রথম সন্তান। ছেলে হয়েছে ছেলে। আমাদেরই জাত বুঝলে?অনেক চেষ্টার পর......” আর চোখে দেখলাম একজন মধ্যবয়সী মহিলা ইশারায় তাঁকে চোখ রাংগালো। চোখ রাংগানি খেয়ে ভদ্রলোক কথা ঘুরালেন। “ও...ও...সব তুমি বুঝবে না। থাক সে কথা। আচ্ছা শহীদের কাছে তোমার কি কাজ? কে পাঠালো তোমাকে?”
“আমি শিয়ালডাঙ্গা থেকে এসেছি।”
“শিয়ালডাংগা? এই ছোট্ট! শিয়ালডাংগায় শহীদের কেউ থাকে নাকি?” অন্যপাশে বসা রোগা করে একটা লোককে উনি জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটি একটু ভেবে ঠোট উলটে মাথা নাড়ল। তারপর বলল,“তবে ভাইয়ার তো ওখানে একবার পোস্টিং ছিল। তাইনা বড় ভাই”।
এ কথা শুনে লোকটি চিন্তায় পড়ল। আমাকে ইশাড়ায় বসতে বলল। আমি চুপচাপ একটা ফাঁকা জায়গায় বসে পড়লাম। বললাম, “আমার মা শিউলী”। লোকটি যেন আবারও ভাবনায় পড়ল। সেই মধ্যবয়স্ক মহিলাটি সম্ভবত উনার স্ত্রী ইশারায় উনাকে ডাক দিলেন। লোকটি উঠে অন্য ঘরে চলে গেল। ছোট্ট বলে যাকে সম্বোধন করা হয়েছিল তিনি আমাকে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন ওমনি তাঁর একটা ফোন এল। তিনি আবার সেই হাসি হাসি মুখে ফিরে গিয়ে এ বাড়ির নতুন সদস্যের কথা বলতে লাগলেন।
কিছুক্ষনপর সেই লোকটি তাঁর স্ত্রীসহ ফিরে এল। উনার থমথমে মুখ দেখে আমি অনুমান করতে পারলাম উনি আমার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। একটু পিছন ফিরে স্ত্রীকে দেখলেন । উনার স্ত্রী উনাকে চোখের ইশারায় আমাকে কিছু বলতে বললেন। লোকটি আমাকে উঠে এসে উনাকে অনুসরন করতে বললেন। আমি উনার পিছু পিছু গিয়ে এ বাড়ির কোন এক বারান্দায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমার পিছনে ভদ্র লোকের স্ত্রীও ছিলেন। এ দিকটা খুব চুপচাপ। বাড়ির কোন কোলাহলই এখানে এসে পৌচাচ্ছে না। আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে উনিও বসলেন।
লোকটি শুরু করলেন, “ইয়ে মানে। তুমি শহীদের সাথে কি ব্যাপারে কথা বলবে? তোমার কি কিছু দরকার? মানে তুমি কি কিছু চাও?” আমি চুপ করে রইলাম। উনি আবারও উনার স্ত্রীর দিকে একবার তাকালেন। বললেন, “না...। তুমি যদি কিছু চাও তবে নির্দ্ধিধায় বলতে পার। লজ্জা করার কিছু নেই।আর শহীদের তো আসতে দেরীও হতে পারে।”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছিল। বললাম, “আমি শুধু উনাকে একবার দেখতে চাই।”
এবার ভদ্র মহিলাটি মুখ খুললেন, “নাকি তুমি অন্য কিছু চাও? খুলে বল। আমাদের সামর্থে থাকলে অবশ্যই তোমাকে দিব।”
“আমি অন্য কোন কিছুই চাই না।শিয়াল্ডাঙ্গায় আমরা খুব ভাল আছি। আমি আর মা খুব ভালভাবেই চলছি।”
লোকটি “হুম” করে একটা শব্দ করলেন। একটু কঠিন শ্বরে বললেন, “তা এত বছর পর কি মনে করে তাঁকে দেখতে চাইলে তা তো বুঝলাম না।”
“আমি উনার কথা জানতাম না যে উনি এ দেশেই আছেন। আমি শুনেছিলাম উনি দেশের বাইরে থাকেন। যখন জানলাম এ দেশেই আছেন তখন আর নিজেকে বাঁধ মানাতে পারলাম না। কেন জানি খুব দেখতে মন চাইল।”
“কিন্তু না দেখা করাটাই ভাল। দেখলে না আজ ওর বাচ্চা হল। বিয়ের বারো বছর পর এই প্রথম...... বলতে গিয়ে উনি থেমে গেলেন।”
ভদ্রমহিলাটি বললেন, “থাক ওসব কথা। আর শোন ওটা শহীদের একটা ভুল ছিল। ঠিক সময়ে ও ভুল থেকে সরে আসতে পেরেছে। তুমি বাবা ওর সাথে দেখা করতে চেও না। জানই তো আজ আমাদের বাড়ির সবাই কত আনন্দিত। এই আনন্দের মাঝে তুমি আর কোন ঝামেলা করো না বাবা। চাও তো তুমি ওকে দূর থেকে দেখে যেতে পার। এই তো আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা চলে আসবে। তুমি দূর থেকে দেখেই চলে যেও কেমন? তোমার যাওয়ার ভাড়া আছে তো? এসেছো কি দিয়ে?” আমি উত্তর দিতে না দিতেই গাড়ির শব্দ পেলাম। “ঐ বুঝি ওরা চলে এল” বলেই ভদ্র মহিলা প্রায় দৌরে চলে গেলেন। ভদ্রলোকটিও উঠে দ্রুত বের হয়ে গেলেন।
আমিও নিঃশব্দে বাইরে এলাম। এ বাড়ির সমস্ত সদস্য তাদের “নতুন মুখ” টিকে ঘিরে উল্লাস করছে। এত ভিড়ের মধ্যে মানুষটিকে আমি খুজে পাচ্ছি না। কিন্তু আমার চোখ জোড়া শুধু তাকেই খুজছে। হঠাত সাদা শার্ট পড়া মানুষটির সাথে আমার চোখাচোখী হয়ে গেল। কিন্তু তিনি খেয়াল করেন নি। আবার চোখ ফিরিয়ে উল্লাসে যোগ দিলেন। আমি তৃষনার্ত চোখে তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। ইনি আমার “বাবা” যাকে দেখার জন্য আমার এতটা দূর ছুটে আসা। বাবাকে আমি যত দেখছি অবাক হচ্ছি। তাঁর উষ্ণ হাতের স্পর্শ যেন এখনো আমার গায়ে লেগে আছে। সকলের আনন্দ ছাপিয়ে চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছে করছে “ইনি আমার বাবা”।
আমি চলে আসছি। নতুন কে বরণের আনন্দকে পিছনে ফেলে আমি চলে আসছি। আমি বাবার অতীত। আমার তীব্র হাহাকার এখন তাঁর কানে পৌছাবে না। আমার অতীতের একটুকু মুহুর্ত হাতের মুঠোয় ধরে চলে যাচ্ছি। বাবা হয়ত আমার আসার কথা জানতেও পারবে না। ফিরার পথে সেই দারোয়ান আবারও হাসি মুখে আমাকে গেট খুলে দিল যেন আমি তাঁর অনেক দিনের চেনা, এ বাড়িরই কোন সদস্য!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লিয়া ferdous আমি জানি না কিভাবে আমার লেখা সবার চোখে পড়ে না। সেক্ষেত্রে আমার কি করা উচিত? সকলকে ধন্যবাদ
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি গল্পটা খুবই ভালো লাগল.....তবে কিছু কিছু অসংগতি রয়েছে তার পরও ভালোকে ভালো বলতে দোষ কি.........? ...সুতরাং প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিলাম......লিয়া আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ...
সূর্য চমৎকার একটা গল্প। লেখককে অভিনন্দন রইল। (মন্তব্য ছোট হলো কিন্তু ভোট পুরোই দিয়েছি)
Israt থিমের সাথে মিলিয়ে এমন গল্প আসে কিভাবে মানুষের মাথায় বুঝি না. গল্পের ভাষা খুব সুন্দর আর প্লটটা তার চেয়েও সুন্দর.
শাহ্‌নাজ আক্তার oh my god ! really this is tragedian story .......I Like it .
পন্ডিত মাহী লেখাটি আগেই পড়েছি। চমৎকার গল্প। তবে আগে থেকে টুইস্ট ধরে ফেলেছি বিধায় সে দিকে আকর্ষণ কম মনে হয়েছে।
ঝরা সবার সাথে একমত।
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইফতেখার অনেকদিন হলো কারো লেখা পড়ছি না। আড্ডা পাতায় সালেহ ভাইয়ের পোস্টটা না দেখলে হয়ত আপনার গল্পে আসাই হতো না। কাহিনী দারুণ, বর্ণনাভঙ্গিও হৃদয় ছুঁতে পেরেছে। কিছু জায়গায় টাইপিং ভুল চোখে পড়েছে, আগামীতে সচেতন হবেন আশা করি। প্রত্যাশা করি, আপনার লেখাটি যোগ্য স্থান পাবে।
মোঃ আক্তারুজ্জামান প্রথমেই সালেহ ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি| আমার কাছেও অসাধারণ লেগেছে তাই প্রিয়তে রইলো হয়ত মনেও থাকবে অনেক অনেক দিন| লেখকের পথ চলা শুভ হোক|
আহমেদ সাবের সত্যি চমৎকার একটা গল্প। সাবলীল লেখা। গল্প-কবিতায় এমন কত অসাধারণ লেখা পাঠকের অগোচরে থেকে যায় বলে সঠিক ভাবে মূল্যায়িত হয় না।

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪