এক.
লেখকরা নিষ্ঠুর কল্পনা বিলাসী হয়- ঠিক এমনতরই একখানা ডায়ালগ শুনিয়েছিল একদা আমার গার্লফ্রেন্ড। আমি সেদিন এক দীর্ঘ মুচকি হাসি দিয়ে ভাবার সময় কিছুটা প্রলম্বিত করে প্রতি উত্তরে খুব যুতসই কিছু না বলতে পারলেও বলেছিলাম- লেখকরা সয়ম্ভু জাতীয় কোন কিছু নয়, তারা সাধারণ মানুষই বটে, তারা নিষ্ঠুরতা বাস্তব দৃশ্যমন্ডলী হতেই পরিঃগ্রহণ করে থাকে। আরও বলেছিলাম, প্রিয়া তুমি বরং লেখকদেরকে ভাবতে পার ঠিক সোনার হারের বিচ্ছিন্ন প্রান্তর দুটির মাঝে ঠিক সেই অংশ যা বাস্তবতা আর কল্পনাকে সংযুক্ত করে এবং যেখানে নিষ্ঠুরতা জীবন নামক সোনার হারের নানান কারুকার্জের আবশ্যকা তো বটেই।
প্রিয়তমার সুন্দর ঠোঁট দুটো বেঁকে গিয়েছিল, বলেছিল, থাক আমারই ভুল হয়েছে, আমি ভুলে গিয়েছিলাম লেখকরা যখন পরাজিত হবার ভয়ে ভীত হয় তখনই বাক্যকে কঠিন করে গভীর এক ভাব ফোটানোর ভাব ধরে। আমিও ভেবে নিয়েছিলাম ভুল হয়েছেইতো , না হলে আমি আরও একধাপ এগিয়ে বলতে শুরু করেছিলাম প্রায়- লেখকরা হলো একদি দিবসের ঠিক সেই অংশটি যার নাম ‘ভোর’, যে ক্ষনটি দিবসের তেজ আর রাতের গভীরতাকে সংযুক্ত করে...
অথচ আজ ভোরে হঠাৎ যখন ঘুম ভেঙে গেলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম রাত তার কালো পোষাক দেহ হতে পরিত্যাগ করতে করতে দিনের আলোর অন্তরে প্রবেশ করছে, কতিপয় মিষ্ঠি কণ্ঠের পাখি সেই দিবারাত্রির সংগম দৃশ্যে উত্তেজিত হয়ে উত্তাল সুরের একটানা বন্যা বইয়ে দিচ্ছে এবং এক গভীর নীরবতা আমার প্রাণে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে , তখন আমি পা দুটো বিছানা হতে নিচে নামিয়ে হাত দুটো শক্ত করে বিছানায় ভর দিয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তারপর বউয়ের বাহুতে মৃদু ঠেলা দিয়ে বললাম, মনে আছে একদা বলেছিলে লেখকরা নিষ্ঠুর কল্পনা বিলাসী হয়...কিন্তু বিশ্বাস কর লেখকরা নিষ্ঠুর হয় না, বিশ্বাস কর, সারা রাত জাগরণ ক্ষণ আর স্বপ্নের কুহোর উভয়ের মাঝে আমি নিষ্ঠুর হবার প্রাণন্ত চেষ্টা করেছি, সাভার বাজারে রানা প্লাজা ধ্বসে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের অন্যতম ভয়াবহ দূর্ঘটনা এবং অপমৃত্যু নিয়ে কিছু একটা আকার দিয়ে একটা, অন্তত একটা গল্প ফাঁদার চেষ্টা করেছি। পারি নি। পারি নি। আমি আসলে লেখকই নই। আমি নিষ্ঠুর কল্পনা বিলাসী নই মোটেও।
বউ ঘুম ঘুম চোখটা খানিকটা মেলে বলল, দূর ওসব ডায়ালোগ তো প্রেমের চাহিদা ছিলব, বাদ দাও তো , তুমি লেখক না হলেই শান্তি , ভোরের এই মিষ্টি ঘুম থেকে ডেকে তোলা বন্ধ তো হবে অন্তত।
সত্যি কি আমি লেখক নই?
তুমিই তো বললে, আবার আমাকে কেনো ...দূর ঘুমাও না, সূর্য উঠল বলে।
আমি তবে কি ? বিবেকহীন এক দর্শক...
দূর, ঘুমাবা, কী যন্ত্রনা! আসলে তুমি মানে সব লেখকই এক একটা অরবোরস...
দুই.
বউ ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁথা টেনে ঘুমের সাথে মজে গেলো। বাধ্য হয়ে ভোরের প্রতি আজন্ম প্রেমের টানটা না ভোলার সুখ খুঁজতে বারান্দায় এগিয়ে গেলাম। অদ্ভুত এক মায়া গন্ধ ভোরের। এ গন্ধ কি সবাই পায়? না কেবল লেখক বলেই। কিন্তু লেখকরা
...অরবোরস...ওইউআরওবিওআরওএস...বউ তো লেখক নয়, নিষ্ঠুর নয়...কল্পনা বিলাসী নয়...তবে কেনো বললো!
ঐ যে সূর্যটা দিগন্তের ভূমিতে ঠেস দিয়ে ঠেলে উঠার পায়তারা করছে। আঁধারের ছায়াগুলো বাতাসের প্রকোষ্ঠে মিয়ে যাচ্ছে প্রায়। সকাল কী সময় রূপী কোন সাপের মাথা, আর ধরটা তার রাত এবং সন্ধ্যা...আর ভোর মুখের ভেতরে আপন লেজ; কল্পনা গুলিয়ে যাচ্ছে। অরবোরস এক কঠিন প্যারাডোক্স, রিয়েলিষ্টিক নয়, তবে বউ কেনো লেখকদের উদ্দেশ্যে বলল... সে কি ভোরের ঘুম ভাঙার অপরাধে...কি জানি?
টিভিটা ছেড়ে খবর দেখে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, তিনদিন হয়ে গেলো , নয়টি ধ্বসে পড়া ছাদের স্যান্ডউইচের ফাঁকে ফাঁকে জীবন্ত কত মানুষ এখনও নাকি টিকে আছে, উফ! আমার হার্টটা এত দূর্বল আমি জানতাম না। টিভি ছাড়ার সাহস পাই না। কত লাশের দৃশ্য বল ধারণ করা যায় এই নিরীহ বুকে?...এতো লেখকের নিষ্ঠুর কল্পনা নয়, যেখানে ঘটনার প্রাবল্য প্রবল হতে পারে কিন্তু আদৌতে তো তা স্পেস লেস, চোখে পানি আনতে পারে কিন্তু বাস্তব লাশতো নয় কল্পনা। ওমন লাশের পর লাশের অভিশাপ নিয়ে এক জাতির ক্ষুদ্র লেখকেরও কোন গল্প আসলে গল্পই হতে পারে না।
শুধু লেখক কেনো পুরো জাতিটাই স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনের অপব্যবহার আর দূর্নীতির ক্রম আধ্যিকে বিবেক শূন্য হয়ে নিজেকেই নিজে গিলে চলেছে। অবশ্যই এতো অরবোরস বটেই। এতো সেই কল্পিত ড্রাগণ যে নিজের লেজ নিজেই গিলতে শুরু করে , তারপর ...
তিন.
লেজটা কেটে দিতে হবে, তবেই যদি ব্যথা হয়, টনক নড়ে, অরবোরস হতে মুক্তি আসে। দুর! সে কে কাটবে। অত সোজা হলে কবেই হতো। সূতোর গুটিতে প্যাচ অনেক বেশি লেগে গেছে। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেলো। মানুষ তো, কষ্ট লাগেই...সূর্যটা উঠে গেছে...ভোরটাও হারিযে গেছে...বিবেক হারিয়ে গেলে বেঁচে থেকেই কি লাভ!
বউ, আমি বের হচ্ছি। দরজাটা লাগিয়ে যতক্ষণ খুশি ঘুমিয়ে নাও। ঘুমেই শান্তি । বাকী সব আশেপাশে ভয়াবহ!
কোথাও যাও এত সকালে?
কোথায় আবার, সাভার, আর না গিয়ে পারছি না।
তুমি গিয়ে কি করবে?
কিছু একটা তো করতে পারব, এক ব্যাগ রক্ত , অন্তত একটা কঠিন ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের স্বাক্ষী। রাগ করো না তাড়াতাড়ি চলে আসব। মন মানে না।
বিবেক টানে।
গিয়ে আরও ঝামেলা বাড়াবে। শুধু শুধু ভীড়...
সে কথা শোনার আগেই আমি বের হয়ে গেলাম।
...বাস পেতে দেরি হলো না। এটা প্রত্যুষের সুবিধা। কিন্তু সাত সকালেও দেখলাম বাসে লোক সংখ্যা কম না। আসলে যে হারে লোক বাড়ছে-কোথাও, কোন সময়ই আর লোকের কমতি হবে না। যেমনি দূর্ঘটনা গুলোতেও মরে যাওয়া লোকের সংখ্যাও অগণিত হয়ে উঠেছে। একটা সিট অবশ্য পাওয়া গেলো।
একটু ঝিম ঝিম ভাব আসছিল। হঠাৎ লোকজনের উত্তেজিত আওয়াজে সেটা কেটে গেলো। দুতিনজন কথা বলছে। বিষয় বস্তু নিঃসন্দেহে সাভার ট্রাজেডি।
একজন বলল, সব সরকারের দোষ। সরকাররে খুশি করতেই ঐ নেতা তার অসুস্থ বিল্ডিংয়ে জোড় করে শ্রমিক ঢুকিয়েছে। আরেকজন বলল, আরে না ভাই, দোষ হলো শ্রমিকদের গরীব হাল, মালিক ডাকলে না গিয়ে
...সে কথা শেষ হবার আগেই আমার পেছনের সিট থেকে একজন লোক বলে উঠল, আরে ভাই এসবই গজব...
আরেকজন কে যেন বলে উঠল, আর তাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যে সেকিং থিউরী দিলো ঐডারে কি কোন কারণের মধ্যে আনবেন না আপনারা। সে কথায় আবার নিশ্চুপ শ্রেণীর কয়েকজন হেসেও উঠল।
কিন্তু বাসটা যে থেমে গেছে সেদিকে সবার খেয়াল হলো মাত্র। নড়ছেই না। দশ মিনিট পরে জানা গেলো বাস আসলে খুব নিকট সময়ের মধ্যে নড়বেও না। সামনে বেশ বড় সড় একটা দূর্ঘটনা হয়েছে। একটা ট্রাক একটা সিএনজিকে পিষে গেছে, ভেতরে চারজন ছিলো। সবার জীবন যাত্রা মুহূর্তেই থমকে গেছে। প্রাণবায়ু বাস্তবতার এই জগত ত্যাগ করেছে। শুধু তাই নয়, ট্রাকের পেছনে থাকা একটা মাইক্রো বাসও বেশ গতিতে থাকায় পেছনে থেকে ট্রাকের সাথে বাড়ী খেযেছে, সেখানেও হত কিংবা আহত হয়েছে শোনা গেলো।
একে একে অনেকেই নামছে দেখে আমিও নেমে গেলাম। কতক্ষণ আর বসে থাকব। ভীড় ঠেলে এক ঝলক সেই প্রত্যুষের ভোর গিলে খাওয়া সদ্যজাত তরতাজা সূর্য্টার ঝরঝরে আলোতে স্পটে তাকিয়ে একটা লাশের বিকৃত মস্তিষ্কের যে দৃশ্য দেখলাম, তা না দেখতে হলেই মনে হয় নিজেকে অতি ভাগ্যবান মনে করতাম। দ্বিতীয়বার ওদিকে তাকানোর সাহস আমার হলো না। কাছেই একটা জটলার সামনে পুলিশের হুইসেলের আওয়াজ পেলাম। শুনলাম ট্রাকের ড্রাইভারকে ধরা হয়েছে। হালকা গণপিটুনি দেয়াও শুরু হয়েচিল, কিন্তু ও বেচারা এতটাই বেসামাল, ওরে পুলিশের কাছে সপোর্দ করাই ও মুহূর্তেও সফল কাজ। সেটাই করছে দেখলাম। সচারচর একসিডেন্টের পর ড্রাইভার ধরা পড়ে না, মাল খেয়ে কতটা তাল সেটা তার ধৃত হবার অবস্থা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। না হলে আবার এত সহজে তারা ধরা পড়ে নাকি!
আমি উল্টো দিকে হাঁটা ছাড়া আর কোন উপায় সে মুহূর্তে খুঁজে পেলাম না। বুঝলাম এই একসিডেন্টের দিকে দ্বিতীয় বার চোখ ফেরানোর সাহসই আমার নেই, আমি কেমন করে এই চোখ সাভার ট্রাজেডির দিকে ফেরাব!
নিজের বিবেকের মাঝে নিজের অরবোরস প্যারাডোক্স রূপ ছাড়া আসলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ফিরতে পথে হাঁটতে হাঁটতে অরবোরসের সেই ড্রাগনের চিত্র টা চোখে ভাসছে বারবার। আর মনে পড়ছে ভার্সিটির হলে এক বন্ধু খুব রেগে গেলে সম্মুখের কাউকে যে গালিটা না দিয়ে পারত না, যে গালি এতই অশ্লীল , আমি লেখকপ্রায় হয়েও বাংলায় তা প্রকাশ করতে অপারগ, বরং ইংরেজী রূপটাই বলা সহজ- ‘পুট ইউর ওন *** ইনটু ইউর ওন ***’।