রাতের প্রথম প্রহরে বারান্দায় কিছুক্ষন বসে থাকাটা অত্রির একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার অপরাজিতা ফুলগুলো বারান্দার গ্রীল জুড়ে লতায় পাতায় রাজত্ব ছড়িয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। এই একচিলতে বাগানে ঘেরা বারান্দার কোনে বসে আকাশ দেখা অত্রির খুব প্রিয় একটা কাজ। অত্রি অপরাজিতার এক অদ্ভূত সুগন্ধ পায়.. গোলাপের সাথে বেলী ফুল আর লেবু পাতা মেশালে সব মিলে যেমন গন্ধটা হয়, ঠিক সেরকম! কিন্তু আজ কিছুতেই মন ভালো হচ্ছেনা, অপরাজিতার অপার্থিব গন্ধেও না। দুপুরবেলার সেই বৃদ্ধ লোকটিকে কিছুতেই ভূলতে পারছেনা সে। আর কোনদিন হয়তো তার গল্পের পুরোটা শোনা হবে অত্রির। এবারের ঈদের আনন্দেও হয়তো কাটবেনা তার এই বিষন্নতা।
* * * *
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আজীজ মিয়ার। একটু বেলা হলেই আবার রিকশা নিয়ে বেরোতে হবে তাকে। কিন্তু দেহটা আজকাল বেইমানী করছে তার সাথে। যে হাতে রাইফেলটা সুনিপুণ ভাবে চালাতো সে, এখন সেই হাতে কিছুতেই রিকশার হাতল ধরে রাখতে পারেনা ঠিকমত। সব ভুলেই একরকম কাটছিল তার দিন। কিন্তু গতকালের খুঁচিয়ে জাগানো স্মৃতিগুলো আজ খুব যন্ত্রনা দিচ্ছে তাকে। মনে পড়ছে বাবুলের কথা, কি ছটফটেই না ছিল তার ছেলেটা। সে যুদ্ধে গেছে এই অপরাধে খুন হয়েছিল ছোট্ট বাবুল। পাকিস্তানীরা তার স্ত্রী রাহেলাকেও মেরেছে, তবে অত্যাচার করার পর। কাল দুপুরে রিকশায় বসে থাকা কৌতুহলী মেয়েটিকে এইসবই বলেছিল সে। আর বলেছিল তার যুদ্ধ-জীবনের টুকরো কিছু ঘটনা। বাচ্চা মেয়েটির মায়াভরা মুখ মনে পড়লো তার.. আজ যদি বাবুল বেঁচে থাকতো, তবে সে হয়তো এরকম একটি পরীকন্যার বাবা হতো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আজীজ মিয়া। কালকের খরতপ্ত রোদে তার ঘর্মাক্ত দেহের প্রানান্ত পরিশ্রম দেখে মেয়েটি তাকে প্রশ্ন করেছিল, কেন সে এই অসুস্থ শরীরে রিকশা চালায়। উত্তরে সে বলেছিল, একাত্তরে যুদ্ধ করতে পারলে রিকশা চালাতে পারবেনা কেন। তাই শুনে মেয়েটির সে কি পরিবর্তন.. প্রথমে বিস্ময়, তারপর একে একে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সবশেষে বেদনা ও লজ্জা। আজীজ মিয়া বুঝেছিল, একজন মুক্তিযোদ্ধার চালানো রিকশায় বসে ভেতরে ভেতরে মেয়েটি লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছিল। আহারে, বড় ভালো মেয়ে। আবার যদি একদিন তার দেখা পেতো, তাহলে কোনদিন কাউকে না বলা সেইসব গল্পের বাকিটুকুও তাকে শোনাতো সে।
* * *
অত্রিও আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রীনে চোখ রাখলো সে। ঈদ এসে পড়েছে দোরগোড়ায়। তার আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটা শেষ করতে হবে তাকে। খুঁজে বের করবে বৃদ্ধ লোকটিকে। মেইল করলো সবগুলো বন্ধুকে। ফেসবুকে অনলাইনে থাকা সবার সাথে আলোচনা করলো ব্যপারটা নিয়ে। জানালো মুক্তিযোদ্ধাটির নাম, বর্ণনা আর সম্ভাব্য ঠিকানা। তাকে খুঁজতে সাহায্য করতে বললো সবাইকে। কয়েকদিন পর। বিকেলের শেষের দিকে ফোন দিলো মৌরী। কনফারেন্সে আছে আরো দুইজন, ঈশান আর কুন্তলা। সুখবরটা ঈশানই দিলো হাসতে হাসতে। সে আর বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে অনেক খোঁজার পর শেষপর্যন্ত পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আজীজ মিয়ার বাসার ঠিকানা। অবশ্য ওরা যখন সেখানে যায়, তখন তিনি রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাই তার সাথে দেখা হয়নি ওদের। অত্রির উচ্ছাস আর হড়বড় করে বলা ধন্যবাদ শুনে সবাই বুঝলো, এই প্রথমবারের মত অত্রিকে সবচেয়ে বড় উপহারটি দিয়েছে তারা।
* *
আজ আর রিকশা নিয়ে বের হয়নি আজীজ মিয়া। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর, বাইরের ঈদের কোলাহল তাকে স্পর্শ করছেনা। তীব্র ঘোরে তার চারপাশে অতীত রূপ নিতে থাকে বর্তমানে.. সে দেখতে পায়, পাশে বসে খেলা করছে নতুন জামা পরা বাবুল। কি জানি রাধছে রাহেলা। ঈদের দিন তো আজ, মনে হয় সেমাই। ঝুপড়ি ঘরের অন্ধকারে নোংরা খাটে শুয়ে থাকা আজীজ মিয়ার দুর্বল দেহ জ্বর আর অতীতের ঘোরে কেপে ওঠে। ঘরের দরজাটা খুব ধীরে খুলে যেতেই একচিলতে রোদ্দুর এসে পড়ে তার মুখে। চোখ মেলে সে। লাল সবুজ শাড়ি আর হলদে পাথরের গহনায় সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটিকে আজ কি অসম্ভব স্নিগ্ধ এক মায়াবতী মনে হচ্ছে.. ঠিক যেন তার সেই কবেকার হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার পতাকা। বহুদিন পর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। এতগুলো বছর ধরে জমিয়ে রাখা অভিমানের বরফ হঠাত্ করেই গলতে শুরু করলো। সেই জলের আবেগে ভিজতে ভিজতে আজীজ মিয়ার মনে হলো, হাসিমুখে দরজায় দাড়ানো এই মেয়েরোড টি যেন কিশোরী বাংলাদেশ হয়ে এতদিন পর ঋনশোধ করতে এসেছে॥
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
জলধারার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক।না হলে যে মোহনা শুকিয়ে যাবে। ভীষন ভালো রাগলো একজন দেশের কারীগর মুক্তি যোদ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য।আপনার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাক এই শুভ কামনায়........... ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।