অনিতার মধ্যে একটা গর্ব আছে!তাঁর ছেলে আদিত্যকে নিয়ে।কিন্তু গর্বটা তাঁর নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।ছেলের প্রশংসা সে কোনো দিনই কারও কাছে কখনও করেনি।কারও কাছে ছেলের প্রশংসা করা মানে অহংকার করা।সে তার ছেলেকে নিয়ে গর্ব করতে চায়;কিন্তু অহংকার নয়।কারণ,তাঁর কাছে গর্ব আর অহংকার এক নয়।গর্ব হল,আত্মানুভূতি,আত্ম তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ।অহংকার কুলষিত;যা শয়তানের অনুপ্রেরণা।
আদিত্যর বয়স যখন দুই বছর,তখন তার বাবা সুব্রত মারা যায়!মারা যায় বললে ভুল হবে,তাকে মেরে ফেলা হয়।শুধু মাত্র, নামের মিলের কারণে তাঁকে শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে ক্রসফায়ার এ ফেলা হয়।সে ২০০৩ সালের ২৫ জানুয়ারী।এখন ২০১০।
আদিত্যকে নিয়ে অনিতার যে গর্ব,তার কতগুলো দিক আছে।এর মধ্যে একটা আদিত্যর বাবা সুব্রত।সুব্রতকে নিয়েও অনিতার গর্ব ছিল।সুব্রতর কর্ম ও তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য ছিল অনিতার গর্ব।সে বিষয় গুলো অনিতা,তাঁর ছেলের মধ্যেও দেখতে পায়।
আদিত্য এবার Class three তে Admission test দেবে।সে নিয়মের মধ্যে থেকেই চলে।মা’র কথা কখনও অমান্য করে না। “মা”যখন যা করতে বলে,যে ভাবে চলতে বলে,সে ভাবেই চলে।class এর 1st boy বলে শিক্ষকরাও তাকে খুব পছন্দ করে।ছেলেকে নিয়ে অনিতার গর্বটা এখানেই।
আদিত্যর সব কিছুই ভালো।লেখা-পড়ায় কখনও কখনও একটু অসুবিধা হয়;তারপরেও সে কষ্ট হলেও সামলে নেই।তবুও অনিতা মাঝে মাঝে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায়,caching center এর প্রশ্ন-পত্র দেখে।এই যেমন ছেলেকে translate
করতে দিয়েছে,”১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে”।অনিতার মধ্যে প্রশ্ন,বাংলাদেশের কতজন মানুষ এ translate করতে পারবে?অনিতার মনে সন্দেহ আছে...১০০ জনের মধ্যে হয়ত ১০০ জনই পারবে না।যে দেশে ১০০ জনের মধ্যে ১০০ জনই পারবে না,তাহলে class two এর ছাত্রের জন্য এমন কেন হবে?
অংকগুলোর বিষয়েও তার আপত্তি আছে।অংকের ধারাগুলো যেন কেমন?”পিতা ও পুত্রের বয়সের ব্যবধান ১০ বছর। পিতার বয়স ৪১ বছর,পুত্রের বয়স ১৪ বছর।যখন পিতার বয়স ৫৭ হবে, তখন পুত্রের বয়স কত হবে?” এটা একজন class two এর ছাত্রের জন্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য-অনিতার মধ্যে এটা সংশয়ের কাজ করে।অনিতার সন্দেহ হয়,যারা প্রশ্নপত্র তৈরী করে এবং caching center এর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে।তাদের মধ্যে বড় ধরণের টাকা আদান-প্রদান হয়।না হলে এত কঠিনতর প্রশ্ন হবে কেন?class three জন্য ভর্তি Admission test ত class two এর board বই পড়ালেই ত হয়!
অনিতাদের বাড়ির পাশে সফিক চৌধুরীর বাড়ি।সে একজন রাজনৈতীক ব্যক্তিত্ব।তাঁর ছেলেও এবার Class three তে Admission test দেবে।ফান্টু তাঁর নাম।নামের সাথে তার কর্মের মিল আছে।সবসময় তার হাতে কিছু না কিছু থাকেই।সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায় এবং সুযোগ বুঝে একে ওকে মেরেও দেয়।লেখা পড়ায় গোল্লা।এ নিয়ে তার মা-বাবার মাথা ব্যাথাও নেই।বাবা রাজনীতি নিয়ে,মা বিউটি পার্লার নিয়ে ব্যস্ত।আদিত্য,ফান্টু দু’জনেই একই caching center এ caching করে।
প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু আনন্দের ঘটনাপ্রবাহ থাকে।কিছু, “দিন” থাকে।যেটাকে মানুষ স্মরণীয় করে রাখে।সে সব দিন গুলো মাঝে মধ্যেই মানুষ স্মরণ করে,মনকে একটু সজীব করে তোলে।অনিতার জীবনে এ রকম একটা দিন হল,আদিত্যের জন্মদিন।অনিতা যেদিন প্রথম “মা” হল।তাঁর জীবনের পরিপূর্ণতা এল।
আদিত্যের যেদিন জন্ম হল,তাঁর অনুভূতিটা কেমন হয়েছিল,সে অনুভব করতে পারে;কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না।তবে, সে এটুকু বুঝাতে পারে যে,সেদিনটা ছিল অনেক অনেক আনন্দের দিন।সে বার বার তাঁর ছেলেকে দেখছিল,বুকে জড়িয়ে তাঁর ছেলের শরীরের গন্ধ শুঁকছিল।সে যে মা হয়েছে,এ অনুভূতিটা তাঁর তখন হল,যখন আদিত্য তাঁর বুক থেকে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছিল।তখন তাঁর গর্ব হল, সেও “মা” হয়েছে!
আদিত্যের জন্ম দিনই যে,তাঁর আনন্দানুভূতির দিন ছিল, তা নয়।যেদিন সুব্রতের সাথে তার বিয়ে হল,সে দিনটিও ছিল তাঁর আনন্দানুভূতির দিন,আত্ম গর্বের দিন।সুব্রতের সাথে তাঁর তিন মাসের পরিচয়ে বিয়ে হয়েছিল।এ তিন মাসে সে সুব্রতকে চিনেছিল,জেনেছিল,এ মানুষটির মধ্যে কোনো আত্মাহংকার নেই;কখনও কোনো বিষয় নিয়ে গর্ব করতেও দেখেনি তাঁকে।
অহংকার বিষয়টা সে একদম পছন্দ করতে পারে না।এই মানুষিক প্রক্রিয়াটাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে তাঁকে,তার বাবার চরিত্র।তাঁর বাবা ছিল,পুলিশে 2nd officer.।অবসরে যাবার আগেই তার চাকুরী চলে গেছে।থানায় এক আসামীকে মারতে মারতে,আসামীর এমন বেহাল দশা করল,আসামী মারাই গেল।সেদিন তাঁর বাবা,গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছে আর,তাঁর মাকে হাসতে হাসতে ঘটনাটার বর্ণনা করছে।total বিষয়টা তার বাবার আত্মাহংকার বলে মনে হয়েছিল।সেদিন তাঁর বাবাকে তাঁর কাছে হিংস্র পশুর মত মনে হয়েছিল।শুধু সেদিনই নয়;অনেক দিনই তাঁর বাবাকে এ রকম আচরণে দেখেছে সে।অহংকার ও হিংস্র আচরণে তাঁর বাবার চাকরি গেছে,এটা সে ভালো করেই জানে।এ থেকে তাঁর ধারণা ছিল,পুরুষ বোধহয় এ রকমই হয়।কিন্তু যখন সুব্রতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল এবং সুব্রতকে এক অন্য মানুষ মনে হল!সেদিনই সে ঠিক করেনি,সে সুব্রতকে বিয়ে করবে।এ সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর তিন মাস সময় লেগেছে।
অনিতা সুব্রতকে কোনো দিন মন খারাপ অবস্থায় দেখেনি।কেউ যদি অসন্মানজনক কথা বলেছে বা তাকে কেউ দুঃখ দিয়েছে,তাতেও তার মনকে টলাতে পারেনি,সবসময়ই হাস্যোজ্জল থেকেছে।এ বিষয়ে তাকে স্মরণ করানো হলে, বলত,এতে আমার কোনো ক্ষতি নেই;ক্ষতি যা তার।অনিতার মাঝে মাঝেই মনে হত,এ মানুষটা এত আনন্দ পায় কোথায় থেকে?
সে সব পুরনো দিন।আজ আদিত্য আছে;কিন্তু সুব্রত নেই।আছে সুব্রতের স্মৃতি যন্ত্রণা-যা’দিনের পর দিন অনিতা বহন করে চলেছে।শুধু যন্ত্রণা বললে ভুল হবে,উচ্চতর গণিতের মত,উচ্চতর যন্ত্রণা আর এ উচ্চতর যন্ত্রণার বাহক যে,তার বাবা,দেরীতে হলেও সে জানতে পেরেছে।শুধু মাত্র তার বাবার শত্রুতার কারণে সুব্রতকে সন্ত্রাসী বানিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
অনিতার বাবা, ব-পুলিশের পাশে, আজ কেউ নেই।স্ত্রী ছিল,সেও মারা গেছে।মেয়ে অনিতা!অনেক দূরে সরে গেছে।তাপরেও মেয়ের বাড়ি আসে।অনিতার ইচ্ছে হয়না,বাবার সাথে কিছু সময় ব্যয় করার।তবুও বাবা ত;অনিচ্ছা সত্ত্বেও
সময় দেয়।আজ আদিত্যের Admission test,আজকেই result ।
রাত বারটা বাজে।বাবা ব-পুলিশ result জানতে গেছে।এখনও সংবাদ আসেনি।অনিতার কাছে,আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের মত নয়।আজকের দিনটা,তার কাছে একটা বিশেষ দিন।এ দিনের ওপরেই নির্ভর করছে,তার ছেলের ভবিষ্যত।দিনটা আত্মবিশ্বাস নিয়েই কেটেছে তার।result জানার জন্য উৎসুক মনে অপেক্ষা করছে।তার কাছ থেকে যেন,কোনো ভাবেই সময় যাচ্ছে না।Vase নিয়ে তার ময়লাগুলো পরিষ্কার করছে।এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল।মোবাইল ফোন তুলে দেখল,তার বাবা।উদগ্রীব মন তার আনন্দে ভরে গেল।বিলম্ব না করে,ফোনটা receive করল।
ওপার থেকে তার বাবার কন্ঠস্বর ভেষে এল, মারে,তোর ছেলেটার হল না;সফিক চৌধুরীর ছেলে,ফান্টুর হয়েছে......
অনিতার হাত হতে ফুল দানিটা পড়ে গেল।বিছরী এক আওয়াজ করে,ফুল দানিটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।অনিতা এক পাহাড় ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল.........