স্মৃতির বর্তমান

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

এ কে এম মাজহারুল আবেদিন
  • ৩৩
  • 0
  • ১৬
অনামিকা অনেকক্ষণ যাবত খেয়াল করছে জিনিসটা. যত সময় যাচ্ছে, তত রাগ বাড়ছে ওর. পথিকের যেন আর কিছুতে মন নেই. জলজ্যান্ত অনামিকা অর পাশে বসে আছে, সেটা যেন ও দেখতেই পাচ্ছে না. একনিষ্ঠ হয়ে শুধু ছবিটার দিকে চেয়ে আছে. ওদের ছোট্ট বেলাকার একটা ছবি, অনামিকা পথিক একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোটের কনে দুজনের ই হাসি.

ছবিটা তুলে দিয়েছিলেন অনামিকার আব্বা. পথিক ছাড়া কিছুই বুঝতেন না তিনি. তখন বয়েস কত হবে ওদের, ১৩ কি ১৪. দুজনেই তখন লেভেল ৭ ই পড়ে, দুর্দান্ত ছাত্র ছাত্রী, পুরো স্কুল ওদের প্রতি বাকা চোখে তাকাত. কারণ একটাই, স্কুল এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত, ওরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড, ফার্স্ট সেকন্ড দুইজনের জন্য বাধা, অথচ দুইজনের মধ্যে কোনো হিংসা নেই, কোনো ঝগড়া নেই.

অনামিকার জন্মদিনে পথিক ওকে একটা বই উপহার দিয়েছিল, ইউরোপিয়ান রূপকথার গল্প, তখন অনামিকা লেভেল ৫ এ পড়ে. ওই জন্মদিনেই কেক খাওয়াতে গিয়ে হঠাত অনামিকার বাবা, হায়াত সাহেব এর মাথায় আসল একটা আনকমন ছবি তুলবেন, যেটা ওরা আজীবন মনে রাখবে. আচমকা পেয়েও গিয়েছিলেন তেমন একটা মুহূর্ত, কি কারণে যেন দুজন হাসছিল, হঠাত ফ্লাশ এর আলো ওদের ধ্যান ভাঙালো. আলতো হেসে হায়াত সাহেব বলে উঠলেন, "এই ছবি আজ থেকে বহু বছর পরেও তদের কে আজকের দিনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে দেখিস."

১৭ বছর পর, সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আসলেই হারিয়ে গিয়েছিল পথিক. কেমন করে দিন চলে যায়, স্মৃতি থেকে যায়. জন্মদিন এর পরে, এক ঈদের দিন সালাম করতেই দুজনকে দুটো গিফট প্যাকেট দিয়েছিলেন, অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দুজন. অনামিকা মনে করতে পারছিল না, বাবা কোনদিন সালাম করার পর ওকে কোনো গিফট দিয়েছেন, আজ ই প্রথম. দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, " তোদের একটা সেরা ঈদ উপহার দিলাম, খুলে দেখ".

খুলে ছবিটা দেখে দুজনেই অবাক আর খুশিও হয়েছিল. এত সুন্দর উঠেছে ছবিটা! ভাবতেই পারেনি বাবা এত কিউট একটা গিফট দেবেন. একই ছবি, দুটো কপি, দুটো আলাদা ফ্রেমে বাধানো. পথিকের খুব অবাক লেগেছিল তখন, ভেবেছিল, কি অদ্ভূত একটা ঈদ উপহার.

১৭ বছর পরে আজ হায়াত সাহেব থাকলে, ওদের স্মৃতি হাতড়াতে দেখলে হয়ত খুশি হতেন, ওনার ছব তলা সার্থক হয়েছে দেখে. আজ সাত বছর হলো, মারা গেহ্হেন তিনি, অথচ কি একটা বন্ধনে যে আজ বেধে রেখেছেন, কাটানো দায়. পথিকের বাবা বরাবরই হায়াত সাহেব এর ভক্ত ছিলেন, অথচ দুজনেই ছেলে বেলার বন্ধু, একসাথেই আর্কিটেক্ট হয়েছিলেন বুয়েট থেকে. মনে পড়ে, ছবিটা দেখে প্রথম রহমান সাহেব বলেছিলেন, "তোদের জীবনের চির স্বরণীয় জিনিস পেলি রে পথিক,আন্কেল কে আজীবন মনে রাখিস".

আজ হায়াত সাহেবের মৃত্যু দিবসে এই ছবিটা সকাল থেকে খুঁজে বার করেছে পথিক নিজেই. কেন যেন মনে হচ্ছিল, এই দিনে আর কিছু দেখার মানে হয় না, এই ছবিটা ছাড়া. আর এই ছবিটা হারিয়ে গেলে হয়ত জীবনটাই হারিয়ে যাবে. অনামিকার দিকে ফিরে তাকাতেই রাগী মুখটা দেখতে পেল পথিক. সারাদিন বাবা কে মনে করে কেদেছে অনামিকা, গালটা এখনো ভিজে আছে. কি মনে করে যেন পথিক কে বলেছিল মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, অনেকক্ষণ অর কোনো সাড়া না পেয়ে, শরীর ঘুরিয়ে তাকাতেই ওকে ছবি নিয়ে বসে থাকতে দেখে রেগে গিয়েছিল. বুঝতে পারেনি যে ও এই ছবিটা দেখছে. আচমকা পথিক ওর দিকে ঘুরতেই ছবিটা দেখে অবাক হলো অনামিকা, " তুই সকাল থেকে এই ছবি খুঁজে বার করেছিস? এই ছবি কোথায় ছিল? কোথায় রেখেছিলি?".

আঙ্গুল ছুইয়ে গালের পানির ফোটা মুছিয়ে দিয়ে ছবিটা অনামিকার হাতে দেয় পথিক, " আমার আলমারি তে ছিল, ভুলেই গিয়েছিলাম, সাড়া বাড়ি খুঁজে এসে আলমারিতে পেয়ে মনে পড়েছিল, এখানেই রেখেছিলাম অনেক দিন আগে. তুই এখনো ঠিক সেই রকম ই আছিস, পাগলি পাগলি, ছটফটে, এই হাসিটা কোনদিন মুছে যায় নি তোর, সেটাই আমাকে অস্থির করে রাখে. তোর এই হাসি, তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ধরে রাখতে পারবে তো, আজীবন?"

পথিকের কথাগুলো অদ্ভূত লাগে অনামিকার. বাবাকে আবার মনে পড়ে যায়. চুপ চাপ নিরিবিলি এক মনখারাপ রাতে, নিরবে মাথায় হাত রেখেছিলেন বাবা. বাবার গায়ের গন্ধ পেতেই, নিজের সবকিছু আত্মসমর্পিত হেয়ে যেত অনামিকার,বাবা যে কত বিশাল, তখন শুধু এটুকুই বুঝতে পেত, আর ভাবত, বাবা না থাকলে ওর পৃথিবীর শুন্যতা কি করে কাটবে? হায়াত সাহেবের সেই কথাগুলো আজ নাড়া দিয়ে যায় অনামিকাকে,"পৃথিবীতে বন্ধু পাওয়া বড় কঠিন রে,সবাই বন্ধু হতে পারেনা,বন্ধুত্ব ছাড়া পৃথিবীর সব সম্পর্কই শূন্য".

তখন শুধু বাবার স্নেহটাই বুঝতে চাইত অনামিকা, কত বড় আশ্রয় বাবা. বাবাকে তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে চাইত না, বাবাকে পৃথিবীর সব কিছুর উর্ধ্বে ভাবত.

"কিরে, আমি কি পারছি অনামিকা? আমি কি পারব আজীবন তোর মুখের এই হাসি,এভাবে ধরে রাখতে?" - পথিকের কথায় নিজের ঘরে ফিরে আসে অনামিকা. পথিকের মুখের দিকে তাকায়. ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত, মনে পড়েনা, এক ফোটা জুস কোনদিন অনামিকা কে না দিয়ে খেয়েছে পথিক. ম্যালেরিয়া জ্জরে টানা দুটো সপ্তাহ যখন হুশজ্ঞান কিছু ছিল না, জ্ঞান ফিরে পেয়ে পথিক কেই শুধু মাথার কাছে দেখেছে. সেরে উঠলে, শুনেছিল পথিক ১৪ দিন বাসায় যায়নি, শুধু ওর সেবা করে গেছে. অনার্স এ পড়ার সময় একদিন গভীর রাতে ঝালমুড়ি খাওয়ার বায়না ধরেছিল একবার আচমকা, কোত্থেকে কিভাবে ঝালমুড়ি যোগাড় করেছিল পথিক, জানেনা অনামিকা. শুধু ফোন পেয়ে ১ ঘন্টার মাথায় রাত দুটোর সময় বাসায় এসে হাজির হয়েছিল প্যাকেট নিয়ে. ওর বন্ধুত্বের কোনো প্রতিদান কোনদিন দিতে পারবে,ভাবতেই পারেনা অনামিকা.

বাবা মারা গেছেন আজ ৩ বছর হলো, রহমান সাহেব পুরো পুরি নিরব হয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু হারানোর শোকে. ছোটবেলা থেকে দেখেছে পথিক, বাবার কাছে হায়াত আন্কেল ছিলেন সবকিছু. হয়ত বন্ধুর টানেই, রহমান সাহেব ও চির বিদায় নিলেন বছরখানেক পর.

আচমকা হেসে ওঠে অনামিকা, সারাদিন পরে ঝরনার মত সেই হাসি শুনে অবাক হয়ে তাকায় পথিক,"কিরে পাগলি,হাসছিস কেন,এই হাসি সারাদিন কোথায় ছিল?" পথিকের দিকে ফিরে ওর নাক টা টেনে দেয় অনামিকা, পথিকের ফর্সা নাক ক্ষনিকের জন্য লাল হয়ে যায়. " তুই যে একটা অদ্ভূত, টা কি জানিস?এই ছবির একটা যে আমার কাছে,ভুলে গিয়েছিস? আমাকে বললেই তো হত." - স্নিগ্ধ হাসিটা ধরে রেখে প্রশ্নটা করে অনামিকা. একটু যেন লজ্জিত হাসি দেয় পথিক.

হায়াত সাহেব এর বুনে যাওয়া স্বপ্নটা অনেক বড় আজ. ওদের দিকে তাকিয়ে আজও হিংসায় জ্জলে মানুষ,এত দিন ধরে, কেমন করে, কেমন করে ধরে রেখেছে ওদের এই পাগল বন্ধুত্ব, ভেবে পায় না মানুষ. অনামিকার চোখে একটা অদ্ভূত ভাবনা স্বপ্ন খেলে যায়.

হায়াত সাহেব তার স্বপ্ন বীজ বুনেই ক্ষান্ত হননি, মৃত্যুর আগে ওদের বন্ধুত্বের স্বপ্ন চারাগাছ দেখে গেছেন তিনি. ছোট বেলার তুই সম্বোধন আজ এই ত্রিশোর্ধ বয়সেও ওদের বন্ধুত্বকে কতনা আপন করে রেখেছে.

মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয় অনামিকা. বাবা যেন জানতেন, ওনার শূন্যস্থানে কাউকে আসতে হবে, অনামিকার বিপদে আপদে, সুখে দুখে, ওনার মত আশ্রয়স্থল হয়ে. বাবার প্রতিনিধি মনে হয় পথিককে.

ওদের বন্ধুত্ব, মানুষকে অবাক করে দেয়, আজও নতুন কারো সঙ্গে পরিচিত হলে,প্রথম পরিচয়টাই হচ্ছে - " ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড,ছোটবেলা থেকে". হয়ত ওই ছবিটাই ওদের মনে করিয়ে দেয় বন্ধুত্বের দাবি. আজও অনেকের বুঝতে বড় কষ্ট হয়, ৫ বছর হতে চলল ওদের বিবাহিত সংসার জীবনের.
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিলাঞ্জনা নীল চমত্কার গল্প....
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১২
amar ami গভীর রাতে ঝালমুড়ি যোগাড় ! অসাধারণ কোনো কথা নয় তবু এমন টা সাধারণ বন্ধুত্বে সম্ভব নয়, অমন বন্ধু কে না চায় কিন্তু পাওয়া কি যায় ?
নিরব নিশাচর ............. এত কম মন্তব্য কেন আপনার গল্পে... ভালো লিখেছেন... আরো পাঠক পাওয়ার অধিকার ছিল আপনার...
Akther Hossain (আকাশ) বন্ধু ও ভালবাসা সুন্ধর একটি রোমান্টিক গল্প !
এ কে এম মাজহারুল আবেদিন ভাই সূর্য, আপনার কথা বুঝলাম | আমার মোটেও রুপকথা লেখবার কোনো ইচ্ছে নেই, লিখিও নি | আসলে একজন লেখক যখন লেখেন, তখন কোনো অবস্থা কাল চিন্তা করে লেখেনা, এটা আমার মনের এমন একটি কল্পনা, যেখানে আমি ভাবি, আমাদের সমাজ বদলাবে | খুব সুন্দর করে বদলাবে, যেখানে বন্ধুত্বের দাম থাকবে, লিঙ্গ বিভেদের নয় | যতই চিহ্ন আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না প্রথমে, ওটা আমার ফন্ট এর ভুলে হয়েছে | মার্জনা করবেন | অনেক ধন্যবাদ |
সূর্য তোমার এ সংখ্যার দ্বিতীয় গল্প পড়লাম। আগেরটায় অনেক বড় মন্তব্য করেছি। তাই এখানে ছোট করে বলি *ফরমেটিংটা একটু দৃষ্টিকটু (যতি/বিরাম চিহ্নের কারণে) *লেখার হাত খুবই ভাল, *এ গল্পে কিছু সমন্বয়ের অভাব আছে। *রূপকথা বললেও সেটাকে বিশ্বাস যোগ্য করে তুলতে হয়। এগুলো একটু নজর দেয়ার জন্য বলব। ........................চমৎকার প্রাণবন্ত একটা গল্প
বিন আরফান. দাড়ির স্থলে ফুল স্টপ দেখে মনে হলো ফনেটিক এ লিখেছেন. যা খুব কষ্টকর ও ধৈর্য্যের ব্যাপার. সে জন্য ধন্যবাদ. আর গল্প আমার খুব ভালো লেগেছে.
মোঃ আক্তারুজ্জামান প্রাঞ্জল কথায় সুন্দর গল্প লিখেছেন অনেক অনেক শুভ কামনা|
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) স্মৃতির বর্তমান,করেনিকো অভিমান /

০২ জুন - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪