নীরব সাক্ষী !

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

সেলিনা ইসলাম
  • ৪০
  • 0
যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে
লক্ষ মুক্তি সেনা
দে না তোরা দে না
সে মাটি আমার
অঙ্গে মাখিয়ে দে না ।।

রোজ এখানে সূর্য ওঠে
আশার আলো নিয়ে
হৃদয় আমার ধন্য যে হয়
আলোর পরশ পেয়ে ।।

সে মাটি ছেড়ে অন্য কোথাও
যেতে বলিস না
দে না তোরা দে না
সে মাটি আমার
অঙ্গে মাখিয়ে দে না

রক্তে যাদের জেগেছিল
স্বাধীনতার নিশা
জীবন দিয়ে রেখে গেছে
মুক্ত পথের দিশা
সে পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে যেতে বলিস না
দে না তোরা দে না
সে মাটি আমার
অঙ্গে মাখিয়ে দে না

যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে
লক্ষ মুক্তি সেনা
দে না তোরা দে না
সে মাটি আমার
অঙ্গে মাখিয়ে দে না ।।

রেডিওর কাছে বসে খুব জোরে গানটা শুনছে আবেদ আলী । আর বারবার চোখ মুছে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । একটু পরেই মাগরিবের নামাজ পড়তে বের হবেন । আজ মণির চলে যাবার দিন ছিল ।আদুরে আর সুন্দরী আবেদ আলীর চোখের মণি ছিল একমাত্র মেয়ে মণি- এযেন যক্ষের ধন । এমন একটা দিন নেই তিনি মেয়ের দুচোখে আদর করে বাসা থেকে বের হননি। আল্লাহকে বলেছে সবকিছু আল্লাহ তুমি ছিনিয়ে নাও তবু আমার মণিকে আমার বুকে রেখ ।

মনে হয় এইতো সেদিনের কথা - জীবনের তাগিতে আবেদ আলী শেষ সম্বল ভিটাটুকু রেখে ধানি জমি বিক্রি করে ঢাকায় এসেছিল বৌ বাচ্চা্কে নিয়ে। মণিকে ভর্তি করা হল একটা ভাল কলেজের অনার্স প্রথমবর্ষে । মেয়ে পড়াশুনায় খুবই ভাল কিন্তু আবেদ আলীর কথা পড়াশুনা ছাড়া অন্য কিছুতে নিজেকে জড়ানো যাবে না । এই সব নামীদামী কলেজে পড়াশুনার চাইতে রাজনীতি নিয়া মাতামাতি হয় বেশি । নেতা থাকে পিছনে আর সামনে রাখে নিরুহ সোজা সরল ছেলে মেয়েদেরকে । মণিও রাজি হয়ে যায় বাবার কথায় ।কিন্তু বাবাকে একটু খ্যাপানোর জন্য বলে
- "বাবা আমি কি রাজা যে রাজনীতি করব? আমিতো রানী তাই রানীনীতি করব" কথাটা বলে নিজেই হেসে কুটিকুটি । আবেদ আলী মিষ্টি ধমকের সুরে বলে
- "রানীনীতি আম্মাজান নিজের সংসারে গিয়ে করবেন ঐটাই আপনের জন্য ঠিক আছে"
কথাটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় মণি । চুপ করে থাকে আর কিছুই বলে না । পড়াশুনা নিয়ে মেতে উঠে সে । একদিন রিকশায় করে কলেজে যাবার পথে একটি বড় মিছিল সে দেখতে পায় । রিকশার চালক মিছিলটাকে জায়গা করে দিতে এক পাশে রিকশাটাকে দাড় করায় । মিছিল যাচ্ছে তো যাচ্ছে শেষই হয়না । রিকশার হুট উঠানো থাকা স্বত্বেও কেউ কেউ উঁকি দিয়ে মণিকে দেখছে । দু একজন তো মুখে ফুঁ দিতেও ছাড়ল না , বেশ বিরক্ত লাগল মনির । তাদের গ্রামেও মিছিল হয় কিন্তু মনে হচ্ছে এলাকা যত বড় মিছিলও মনে হয় তত দীর্ঘ হয় । হঠ্যাৎ মিছিলের মানুষ পিছনের দিকে ছুটে আসতে লাগল । মণি ভেবে পেল না কি হচ্ছে । চোখের সামনে ভেসে উঠলো গ্রামের স্কুলের মাঠে প্রতিবছর ষাঁড়ের দৌড় হয় । তাতে একজন মানুষ ষাঁড়কে খ্যাপানোর জন্য লাল একটা কাপড় সামনে ধরে । লাল কাপড় দেখে ষাঁড় যায় রেগে আর মানুষকে শিং দিয়ে গুঁতা দিয়ে নাড়ীভুঁড়ি বের করে দিতে চায় । মিছিলের মানুষ গুলোকে দেখে মনে হল ষাঁড় অথবা মহিষে তাড়া করেছে । রিকশা চালক বলল
-"আফা ঐদিক দিয়াও আরেকটা মিছিল আইতেছিল । মনে লয় দুই দলের মধ্যে পেজগী লাগছে ।"
বেশ ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল , চালক তার সীটে বসে মাথা উঁচু করে পিছনের অবস্থা দেখে প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে
-"আফাগো মনে লয় যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে ! পুলিশে ধাওয়া করছে , আপনি জানে বাঁচতে চাইলে নাইমা কোন দোকানে ঢুইকা পড়েন "
ছেলেটা দিল ভো দৌড় । মনি জানে না কি করবে । রিকশা থেকে নেমে সে দিগ্বিদিক্ হারিয়ে ফেলল কিন্তু সামনে এগুতে পারছে না মানুষের ভীড়ে । বহু কষ্টে একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাড়ালো কিন্তু সব দোকান ভীতর থেকে বন্ধ । কাঁদানে গ্যাস ছেড়েছে পুলিশ ,চোখ জ্বালা করছে আর দম নিতেও ভীষন কষ্ট হচ্ছে । সব কয়টা দরজায় আঘাত করল কিন্তু কেউ দরজা খুলল না ।হঠ্যাৎ মাথায় কে যেন বাড়ী মারলো , রক্তে জামা ভিজে যাচ্ছে তারপর পায়ে একটা ধাক্কা অনুভূত হল কিছু বুঝে উঠার আগেই চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেল ! মণি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।

যখন মনির জ্ঞান ফিরলো তখন সে হাস্পাতালের বেডে । পুলিশ দেখে কিছুটা ভড়কে গেল । উঠে বসার চেষ্টা করল কিন্তু মাথা অনেক ভার । খুব কষ্টে মুখ থেকে বের হল
-আমার কি হয়েছে ? নার্স এগিয়ে এসে বলল
-আপনি উঠবেন না প্লিজ আপনার মাথায় আঘাত লেগেছে আর পায়ে গুলি লেগেছে ।
-গুলি ! কে গুলি করেছে আমাকে? আর আমার এখানে পুলিশ কেন ? বিস্ময়ে হতবাক মণি । ডুকরে কেঁদে উঠে -বাবা মা তোমরা কোথায় ? নার্সের কাছে শুনতে পায় আজ দুদিন সে এখানে । বাবাকে একটা ফোন দিবে কথাটা ভাবতেই ব্যাগের কথা মনে পড়ে আরে ব্যাগ কোথায় ? নার্সকে বহু অনুরোধ করার পরে মণির কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন করা হয় আবেদ আলীকে । আজ দুইটা দিন মেয়ের কোন খোঁজ পাননি আবেদ আলী । ঢাকায় আত্মীয় স্বজন কেউ নেই । থানায় যাবে ভাবতেই মাথায় যেন বজ্রপাত পড়ে ।থানায় জানানো মানে মেয়েটা যদি বেঁচেও থাকে তাহলে নিষ্ঠুর এই সমাজের মানুষের দেয়া মানসিক কশাঘাতে মেয়ে আমার বেঁচে থেকেও মরে যাবে । রোমেলা বেগম সেই যে জায়নামাজে বসেছেন আর উঠে এসেছেন হাস্পাতালে । কিন্তু মণির অপরাধ কি ? কেন তার এই অবস্থা ? মণিকে কে বা কারা গুলি করেছে ? কারা তার জীবন নিতে চেয়েছে ? পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এসেছে হাস্পাতালে । কারন মণির দলের নেতা শুকুর মিয়া নিজে বাদী হয়ে থানায় বিরোধী দলের বিরুদ্ধে একটি " এটেম্পট টু মার্ডার " কেইস দাখিল করেছেন ।কিন্তু মণিতো কোন দলের না ! কে শোনে কার কথা ! খবরের কাগজের হেডলাইনে মণির ছবি দিয়ে শিরোনাম করা হয়েছে " কৈলাদলের কর্মী রুবাইয়াৎ ইয়াসমিন মণির উপর সরকারী মদদ দাতা ফেঁকড়াদল এবং সরকারের পোষা বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণ "! প্রতিটা টেলিভিশনের চ্যানেলেই জনাব শুকুর মিয়ার সাক্ষাৎকার ! তিনি কেঁদে কেঁদে মণির জন্য হাত জোড় করে দোয়া ভিক্ষা চাইছেন । জনগনের সমর্থন ও এই পাশবিক কার্যকলাপের বিচার চাইছেন । শুকুর মিয়া হাস্পাতালে এসেও মণির বেশ দেখভাল করছেন এবং বাবাকে আশ্বাস দিয়েছেন যেভাবেই হোক তিনি মণিকে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় নেবার ব্যাবস্থা করবেন । কিন্তু কে এই শুকুর মিয়া ? মণি তাকে এই প্রথম দেখছে । কিন্তু লোকটা বলে বেড়াচ্ছে মণি তাদের দলের একজন নিষ্ঠাবান এবং সক্রিয় কর্মী। যে কিনা দলের জন্য ,দেশের জনগনের জন্য , নিজের জানকেও কোরবানি দিতে কার্পণ্য করবেন না ।

দুমাস পরে মণি বাসায় ফিরে আসে । মণি ভেবে পায়না কে তার পায়ে গুলি করেছে আর কেনই বা গুলি করেছে ! সে মনে করার বেশ চেষ্টা করে কিন্তু পারে না । শুকুর মিয়া মণিকে ধামকি দিয়ে যায় সে যদি সাংবাদিকদের বলে যে সে তাদের দলের সদস্য না তাহলে তাকে জানে মেরে ফেলা হবে । বাসায় সব সময় দলের কেউ না কেউ থাকে । এক রকম বন্দী হয়ে গেল মণি ও তার পরিবার । সাংবাদিকরা এলে শেখানো বুলি আওড়াতে হয় । এদিকে অন্য দল থেকেও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কেইসটি তুলে নিলে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হবে যা দিয়ে বাকী জীবন আবেদ আলী সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবে । অন্য দলটিই বা কারা এবং তাদের কাজ কি তাও মণি বা তার পরিবারের কেউ জানে না । আবেদ আলী যখন কাজে যায় তার সাথে থাকে শুকুর মিয়ার লোক । আবেদ আলী ভাবে এমন করে কি দোকান চালাতে পারবে সে ! সব সময় ভয়ে ভয়ে আছে না জানি বাড়িতে কি হচ্ছে , না জানি কে না কে বাসায় এসে মা মেয়েকে খুন করে রেখে যাচ্ছে । এভাবেই কেটে যায় তিন তিনটা মাস । একদিন সকালে শুকুরমিয়া ও ফেঁকড়া দলের নেতা রনি আসে মণিদের বাসায় । দুজনে বেশ গলাগলি করে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে আসে । আবেদ আলীকে বলে

-"চাচা চিন্তার কিছু নাই সব সমস্যার সমাধান কইরা ফেলছি । কেইস উঠাইয়া নিতে বাধ্য হইছি চাচাজান। হাজার হোক আমরা দুইজন বন্ধু মানুষ হুদাই একটা ক্যাঞ্জাল কইরা লাভটা কি তাই না? এই লন " কথাটা বলে একটা খাম বাড়িয়ে দেয় আবেদ আলীর দিকে । সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে
-"এইটা কি ? এ দিয়া আমি কি করব?"
-"চাচা এর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে । দোস্ত আমার খুশি হইয়া বইনের বিয়ার খরচবাবদ দিছে , আপনেও খুশি মনে লইয়া লন । " আবেদ আলী জানে এদের সাথে মুখ লাগা ঠিক হবে না । এরা যে বাড়ী থেকে বিদায় হচ্ছে এটাই যেন এই মুহূর্তে তার নিজের কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া ।আজ মেয়ের কথা ভেবে এই অন্যায় মেনে নিতে হচ্ছে । হৃদয়ের গহীণে রক্ত ক্ষরনের স্রোত এই মানুষ গুলো বুঝবে না । বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রাখে- ঠিক যেন কচ্ছপের মত খোলশের ভীতর থেকে সামান্য গলাটা বের করে মিথ্যে বিনয়ের সুর তুলে বলে

-"আপনারা আমার মেয়ের যা ভাল হবে তাইতো করবেন ! টাকা লাগবে না , আপনারা মিলে গেছেন এতেই আমি খুশি ।" রনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলে শুকুর মিয়া বলে

-"ঠিক আছে চাচা যেইটা আপনে ভাল বোঝেন , আমি তাইলে এই টাকা পোলাপাইনেরে চা খাইতে দি । হাজার হোক আপনাগো এতদিন পাহারা দিয়া রক্ষা করছে বিপদের থাইকা " আবেদ আলী কিছুই বলে না । যাবার বেলায় আবারও বেশ গম্ভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় কাউকেই যেন কোন কিছু না বলে এবং যদি মেয়েকে জানে বাঁচাতে চায় তাহলে শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যেন চলে যায় । সবাই চলে যেতেই এই কয়টা মাসের জমে থাকা কান্না তাণ্ডবের মাতম নিয়ে আসে এই মধ্যবিত্ত পরিবারে ।

আবেদ আলী এলাকা ছেড়ে চলে গেলেও শহর ছাড়ে না । সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে তাকে যে এর প্রতিশোধ নিতেই হবে কিন্তু কিভাবে তা তিনি জানেন না । বাবা হয়ে মেয়ের এই পরিণতি তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না । মণি পা টেনে টেনে হেটে বেড়ায় । দিনে দিনে সে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে । মাথার আঘাতে সে তার স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলে । গরিব আবেদ আলীর সামর্থ্য নেই মেয়ের সুচিকিৎসা করাবেন । বাজারে যে দোকান ছিল তাও অনেক কম দামে বিক্রি করে মেয়ের পিছনে খর্চা করেন । পাগলের মত ঘুরে বেড়ান আবেদ আলী একটা কাজের জন্য কিন্তু যে দেশে যুবকদেরই কাজ মেলে না সে দেশে কে দেবে বুড়ো মানুষকে কাজ ? আবেদ আলী ভাবে আজ যদি ঐ নেতা , যুবকদের কাজ থাকত তাহলে এই সব বাজে কাজ করে বেড়াতো না ।ছাত্র রাজনীতির নামে , জনগনের অধিকার আদায়ের নামে নিজেরাই ব্যাবসা করে বেড়াচ্ছে নিরহ মানুষদেরকে উপজীব্য করে । এই সব কথা ভাবতে ভাবতে একজনের সাথে বেশ জোরে ধাক্কা লাগে
-" আরে চাচা আপনে ! ও মাইরি চাচা সাহস আছে আপনের । এখনো এই শহরে ঘুর ঘুর করতাছেন ?" বোকা সেজে যায় আবেদ আলী ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে আসে
-" বাজান মেয়েটা আমার অনেক অসুস্থ তাই চিকিৎসার জন্য শহরে রয়ে গেছি "
-"ঠিক আছে চলেন বইনরে দেইখা আসি । চলেন উডেন গাড়ীতে উডেন , আমার নিজের গাড়ী চাচা জান দোস্ত উপহার দেছেলো । আপনের মনে কইরা উইডা পড়েন" ধাক্কাতে ধাক্কাতে গাড়ীর ভীতরে তোলে । আবেদ আলী ভেবে পেলেন না কি করবেন । বাসায় পৌছাতেই শুকুর আলী ঘরের দরজা বন্ধ করে বুড়া আবেদকে একটা ঘুষি মেরে বসে নাক বরাবর
- "হালার পুত সাহস দেখাও না ? শুকুর মিয়ার লগে পলটিবাজি না ? খারাও মজা দেখাইতেছি ।" সাথে আসা ছেলেদের সাথে ফিসফাস কি সব পরামর্শ করে তারপর ছেলেগুলো আবেদ আলীকে এবং রোমেলা বেগমকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সামনে পিস্তল ধরে বসে থাকে । আর শুকুর আলী ভীতরে যায় ।

আবেদ আলী বুঝতে পারে না মণি কি তাঁকে ডাকছে ? মণি সোনা কি কষ্ট পাচ্ছে ? " বাজান , বাজান গো এই হারামির বাচ্চা আমার পায়ে গুলি করছিল । বাজান আমারে বাঁচাও । তুমি না এই দেশটারে বাইরের শত্রুগো হাত থাইকা বাঁচাইছো ? ও বাজান তুমি না পাক কুত্তা গো হাত থাইকা কত্ত মাইয়ার ইজ্জত বাঁচাইছো ? এহন কেন চুপ কইরা আছো ? দেশের এই কু সন্তানগো হাত থাইকা নিজের মাইয়ারে কেন বাঁচাও না বাজান ! তুমি না এই দেশটারে ভালবাস ? এই দেশের মানুষরে ভালবাস তাই যুদ্ধ করছিলা ! তাইলে কি তোমার মাইয়ারে ভালবাস না বাজান ? ও বাজান তুমি কি এগো ভয় পাও? কেন ভয় পাও বাজান ? এরা কি ঐ একাত্তরের কুত্তার বাচ্চাগোর চাইতে বেশী শক্তি রাহে বাজান ? ও বাজান ?" আবেদ আলী ভেসে বেড়ায় তার প্রাণপ্রিয় গ্রামের আনাচে কানাচে সাথে নিয়ে কিশোরী সোনামোণিকে ।

শুকুর আলী যাবার কালে কষে একটা লাথি মেরে যায় আবেদ আলীর গাঁয়ে । সম্বিত ফিরে পায় সে কিন্তু এ এক অন্য আবেদ আলী । ছেলেরা যাবার সময় বাঁধন খুলে দিয়ে যায় কিন্তু নিঃসাড় দেহে বসে থাকে আবেদ আলী । নিজেকে একটা জন্তুর মত মনে হয় পঞ্চাশোর্ধ্য আবেদ আলীর । সে বুঝে যায় তার আসলে গায়ের শক্তি নেই সে মরতে ভয় পায় । কিন্তু যৌবন থাকতে তো সে মরতে ভয় পায়নি । নিজের হাতের দিকে তাকায় ,এই হাতে সে কত পাক সেনা মেরেছে । কত ক্যাম্প বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে । সেতো কয়েকদিন পরে এমনিতেই মরে যাবে । তবে কেন সে ভয় পাবে? মনে পড়ে সে যুদ্ধের সময়ে কিভাবে বোমা বানাতে হয় সেই শিক্ষাটা নিয়েছিল । সে নিজেও জানে না কেমন করে যেনো তার গায়ে অনেক শক্তি আসে । উঠে দাঁড়ায় । সাদা বিছানায় মণি রক্ত রাঙ্গা বসনে সেজেছে । শুকুর মিয়া মণির সতীত্বের মুখাগ্নী করেও ক্ষান্ত হননি ,কত নিষ্টুরভাবে বুকের ঠিক মাঝ খানে ছুরিটা বসিয়েছে । আবেদ আলী জানে পুলিশ থানা এসব করে সে কিছুই করতে পারবে না কারন খানসেনাদের নেতাকে পরাস্ত্র করা সহজ হলেও শুকুরের মত দানবেরা যে নেতাদের ছত্রছায়াতে বেড়ে উঠেছে তাদেরকে কেউ নাগালে পাবে না ।

একটা বছর কেমন করে যেন কেটে গেল । এই এক বছরে আবেদ আলী শুকুরের পিছনে ছায়ার মত থেকেছে । শুকুর মিয়া এখন অনেক বড় নেতা তার এলাকার । আবেদ আলী মাত্র একটা টাইম বোমার সরঞ্জাম জোগাড় করতে পেরেছে । একটা জিনিষ সে দেখেছে , শুকুর আর কোন ওয়াক্ত নয় মাগরিবের ওয়াক্তে সে নামাজ পড়ে একটা মসজিদে । সেখানে বড়জোর আট দশজন মানুষ নামাজ পড়ে । আবেদ আলী শুনেছে এই মসজিদ শুকুর আলীর টাকায় করা । এই মসজিদে একটা গোপন ঘর আছে যেখানে আছে শুকুরের কাল টাকার সদাইপাতি ।

ওদিকে মণি চলে যাবার পর থেকে রোমেলা বিছানা নিয়েছে । আবেদ আলী তাকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে এসেছে জরুরী কাজ আছে শহরে তাই বলে । আজকে ভীষণভাবে যুদ্ধের সময়ে শহীদ হওয়া বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে । কতটা ভাগ্যবান তাঁরা । এই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে । আজকের এই দিন তাঁদেরকে দেখতে হয়নি ।সেদিন জীবন নিয়ে ঘরে ফিরে আনন্দ আর উল্লাসে মেতেছিল আবেদ আলী । এই ভেবে যে , দেশে এখন শান্তিই শান্তি হবে । ভাবেনি আবার নতুন করে ভাবতে হবে । কিছু শকুনের লাশ টেনে নিতে হবে খুবই নীরবে । সেদিন যুদ্ধ করেছিল সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মাকে বাঁচাতে । আর আজ যুদ্ধ করবে সে একা , পাশে থাকবে না কেউ ।তবুও আনন্দ মায়ের বুক থেকে বিদায় নেবে আরো একটা নব্য শকুনের শেকড় ।

গানটা শুনছে আর সারা জীবনের চেপে রাখা কষ্ট স্রোতের ধারায় বুক ভাসিয়ে হালকা করে দিচ্ছে । ঠিক যেমন করে পাহাড় তার নীরব কষ্ট ঝর্ণার ধারায় বিসর্জিত দেয় সাগরের বুকে । মণির ছবিটা বুকে নিয়ে আবেদ আলী বলে
-"মাগো , তোকে আমি রক্ষা করতে পারিনি । কিন্তু তোকে কথা দিলাম শুকুরের দ্বারা আর কোন বাবার বুক এমন করে খালি হবেনা । সেই কাজ আমি আজ করতে যাচ্ছি । তোর আত্মার শান্তির জন্য আমাকে যে এটা করতেই হবে মা । আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস মা, না হলে মরেও যে শান্তি পাব না রে মা " দুচোখে শেষ চুমু দেয় আবেদ আলী। তার মনে হল কেউ একজন গায়ে খুব বড় একটা নিশ্বাসের ঢেউ দিয়ে গেল । তারপর মণির সেই রক্তমাখা ওড়নাটা দিয়ে বুকে বেঁধে নেয় শুকুর মিয়ার মরণ দাবানল ।

মসজিদে ঢুকে দেখে শুকুর মিয়া নেই । আবেদ আলী কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে । শুকুর মিয়া আজ সামনা সামনি দেখবে আবেদ আলীকে । তার চেহারা কেমন হবে সেইটা মনে করে একটা মুসকি হাসি ফুঁটিয়ে তোলে আবেদ আলী । অপেক্ষার প্রহর কাটে না । নামাজ পড়া শুরু হয়েছে । আবেদ আলীর নামাজে মন নেই , সে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে । কেউ একজন বেশ দৌড়ে এসে দাড়ালো আবেদ আলীর গা ঘেঁসে । যেন ভুত দেখেছে "চা চা চাচা আপনে ? এই হানে? "বলেই পিছনে দৌড় দেবার মুহূর্তেই বেশ জোরে ধাক্কা লাগে আবেদের সাথে । নিমেষেই ঘটে যায় অযাচিত ঘটনা ।

দশ মিনিটের মধ্যে টেলিভীশনের ব্রেকিং নিউজ হয় এই ঘটনা । সরকারী , বিরোধী সব বড় বড় নেতাদের সাক্ষাৎকার ও মন্তব্যে যেন এক ধরনের মুখোরিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন চ্যানেলে । পরের দিন বড় বড় অক্ষরে হেড লাইন হয় প্রতিটা খবরের কাগজে " বোমা হামলায় ফুলবাড়ী জামে মসজিদে ছয়জনের মৃত্যু , এটা কোন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা , না কি অন্য কোন ষড়যন্ত্র "!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম @Kh Anisur Rahman Joti >ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য ! @ Monir Khalzee >ধন্যবাদ ভাইয়া ১৯৯৬ এ বাইতুল মুকাররম মার্কেটে যেতে কিছুটা এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল তবে করুনাময়ের কাছে কৃতজ্ঞ আমার রিকসা চালক অনেক ভাল ছিল এবং সেই আমাকে নিরাপদে বাসায় পৌছে দেয় । গল্পটি সেই ঘটনার সাথে কিছুটা মিল রেখে কল্পনার তুলিতে এঁকেছি ভাল লেগেছে জেনে অনুপ্রানিত হলাম । সবার জন্য রইল অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা !
মনির খলজি আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি ...তোমার এ-গল্প পরে যেন আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটির সেই বাস্তব দুর্দিনগুলোর কথা মনে পরে !! সতিই সুন্দর লিখেছ !
মনির খলজি হুম ... আপু, অবশেষে সুদীর্ঘ গল্পখানা পড়লাম ! এখানে মুক্তি যুধ্হ, অতপ্পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নারীর সামাজিক অবস্থান --এ কয়েকটি দিক সমন্নয়ে বাংলার আদ্য-পান্ত পরিস্থিতিকে অতি বলিষ্ঠ, সাবলীল ও নিখুত প্রস্ফুটনে তোমার সাহিত্য নিষ্ঠার প্রমান মিলে ....খুব-সুন্দর বিষয় ভিত্তিক মন-ছুয়ে যাবার একটা কাহিনীচিত্র .....প্রশংসা না করে উপায় নেই ...তোমার প্রাপ্প তুমি পাবে ....আর শুভো কামনা রইলো !
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি খুব ভালো লাগলো আপনার লেখাটি, বন্দুর জন্য শুভ কামনা।
সেলিনা ইসলাম @rakib uddin ahmed >অনেক ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য >@মন আপু- আপনার মন্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করছি । আমিও আশায় আছি একদিন সবকিছুর অবসান হবে ইনশাল্লাহ !ধন্যবাদ সবার জন্য শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
প্রজাপতি মন আপনার লিখা বরাবরই আমার ভালো লাগে, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। রাজনীতিবিদদের কলুষ রূপটা খুব সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। মিছিল-মিটিং এ কোন সাধারণ জনগণ মারা গেলেই শুরু হয় লাশের রাজনীতি। এ বলে এ আমার দলের ও বলে ও আমার দলের যা কারোরই কাম্য নয়। আর আপনি দেখালেন একজন আহত মেয়ের ছবি। যে কোন দল না করেও নির্মমভাবে প্রাণ হারালো। মানুষরূপী কতগুলো পশুর হাতে। কবে বন্ধ হবে এই নোংরা রাজনীতি। কবে ফিরে আসবে দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি? সে সময়ের প্রতীক্ষায় মন।
rakib uddin ahmed আর একটু ' স্পীড-এ্যাকশান '... আর একটু থ্রিলিং হলে .. ওফ্ !তবে বিষয়বস্তু চমৎকার ! thnx mam.
সেলিনা ইসলাম @জুয়েল দেব > "শুকুর মিয়াকে আমার নিজেরই বোমা মারতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। " সাব্বাস ভাইয়া এখানেই আমার লেখার সার্থকতা ! তবে কবে দেখব এই অগ্নিবান বাস্তবতায় ! হয়ত কখনই না ----ধন্যবাদ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
সেলিনা ইসলাম @সূর্য দা আশাকরি ভাল আছেন । আমার বড় ভায়েরও এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট এবং চিংড়ি ঘের এর ব্যবসা ছিল । সেই সুবাদে বেশ কয়েকটা ট্রলার ছিল কিন্তু এইসব পলিটিক্সের কারনে জানের ভয়ে সবার প্রেসারে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে । যদিও বেশ কিছু লোকসান হয়েছে । সত্যিই এটা দুঃখজনক । আপনি হেসেছেন আমি আপনার কষ্টটা ফিল করেছি ! যাইহোক- গল্পের শেষে সংকল্পটা দেবার পিছনে একটাই যুক্তি যেন যুবসমাজের কিছুটা হলেও আক্ষেপ হয় বা লজ্জা বোধ হয় । একজন বৃদ্ধ প্রতিশোধ নিলে আমরা কেন পারব না ! যদিও ওয়েটা ঠিক নয় তবে একা কি বা করার আছে ! গল্পটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ দাদা , শুভেচ্ছা ও শুভকামনা নিরন্তর !
জুয়েল দেব বাস্তবতার অসম্ভব সুন্দর উপস্থাপনা। আপনার গল্পের যবনিকাটাও দারুণ। শুকুর মিয়াকে আমার নিজেরই বোমা মারতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। গল্পে অনেকগুলো সুন্দর লাইন রয়েছে উদ্ধৃতি দেওয়ার মত।

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪