মৎস্যপুরাণ

কষ্ট (জুন ২০১১)

জুয়েল দেব
  • ৩৭
  • 0
উপজেলা পরিষদের পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে । মাছ ধরা তদারক করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বয়ং । উপজেলা নির্বাহী অফিসের তত্ত্বাবধানে এই পুকুরে মাছ চাষ করা হয় । শখানেক লোক ভিড় করে মাছ ধরা দেখছে । আমার বাবা ইউএনও সাহেবের পিছে পিছে ঘুরছেন । ইউএনও অফিসের পিয়ন বলে বাবাকে সারাক্ষণ ইউএনও সাহেবের হুকুম তামিল করতে ছুটতে হয় । আমি যেহেতু এরকম কোন ঝামেলায় নেই, তাই আমি নিশ্চিন্ত মনে মাছ ধরা দেখতে পারছি । বাজারের ক্যানভাসারদের মজমার মত এখানেও ছোটরা সামনে, বড়রা পিছনে । জেলেরা জাল টেনে বিশাল বিশাল মাছ তুলছে । বড় বড় মাছ দেখতেও একধরনের আনন্দ আছে । ইউএনও সাহেব উপজেলার সব অফিসারদের বাসায় বাসায় মাছ পাঠাচ্ছেন । একটি বিশাল সাইজের কাতল মাছ বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইউএনও সাহেব বললেন, ‘যাও, এটা মৎস্য অফিসারের বাসায় দিয়ে আসো ।’ বাবা মাছ নিয়ে দৌড়াচ্ছেন । আমিও মাছ ধরা উৎসব বাদ দিয়ে বাবার পিছনে পিছনে দৌড় লাগালাম । এতবড় মাছ আমাদের বাড়িতে কখনো কেউ আনে নি । আমি মাছের পাশে পাশে থাকছি । যতক্ষন থাকতে পারা যায়, ততক্ষনই আনন্দ । বড় মাছের পাশে পাশে থাকতেও অনেক সুখ । লোকজন হাঁ করে মাছ দেখছে । এত্ত বড় মাছটা আমার বাবা নিয়ে যাচ্ছে বলে বাবার জন্য আমার একধরনের গর্ব হল ।
মৎস্য অফিসারের কোয়ার্টারে এসে দেখা গেল সদর দরজায় তালা মারা । পাশ থেকে একজন জানালেন, মৎস্য অফিসার ছুটিতে আছেন । বাবা কী করবে বুঝতে পারছে না । আমি মাছ দেখা বাদ দিয়ে পাশের কোয়ার্টারের জানালায় তাকিয়ে থাকি । আমারই বয়সী একটি মেয়ে হাঁ করে বিশাল মাছটা দেখছে । কোনো অফিসারের মেয়ে হবে । আমার খানিকটা অস্বস্তি লাগতে থাকে । মেয়েটা যদি এখন আমাকে দেখে তাহলে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবো । ও কী সুন্দর একটা জামা পরে আছে । আর আমি পরেছি অনেক পুরনো প্যান্ট-শার্ট । প্যান্টের পিছনে একটা তালিও আছে । অবশ্য এটার জন্য আমি বাবার উপর রেগে থাকি সবসময় । বাবাই তো বছরে একবারের বেশী প্যান্ট-শার্ট কিনে দিতে পারে না ।
মেয়েটা আমার দিকে তাকানোর কোন লক্ষণ দেখায় না । সে একমনে মাছ দেখতে থাকে । আমার দিকে তাকানোর কোন কারণও নেই । আমি খেয়াল করেছি, যারা ময়লা, পুরনো জামা-কাপড় পরে মানুষ তাদের দিকে তাকায়, কিন্তু দেখে না । দেখলেও খুব করুণার চোখে দেখে ।
বাবা মাছটা নিয়ে আবার ছুটলেন । আমিও বাবার পিছনে পিছনে ছুট লাগাই । বাবা ইউএনও সাহেবকে গিয়ে বললেন মৎস্য অফিসার ছুটিতে গেছেন । ইউএনও সাহেব একমুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে বললেন, ‘ঠিক আছে, এটা তুমি নিয়ে যাও ।’
বাবা বোধহয় প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেন নি । কিছুক্ষন বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলেন । অবশ্য আমার বাবা এমনিতেই খুব সহজ-সরল মানুষ । সম্বিৎ ফিরতেই বাবা দৌড় লাগালেন । আমিও বাবার পিছনে পিছনে দৌড় লাগালাম । আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না ইউএনও সাহেব মাছটা বাবাকে একেবারে দিয়ে দিয়েছেন। যদিও এরকম মাছ আরও অনেক ধরা পড়েছে । আমি বাবাকে বললাম, ‘বাবা, ইউএনও সাহেব মাছটা সত্যি সত্যি দিয়েছেন ? পরে আবার নিয়ে নেবে নাতো ?’
বাবা হেসে ফেললেন, ‘ধুর বোকা, মাছ কি মিথ্যা মিথ্যা দেয়া যায় নাকি ! এটা এখন আমাদের । আজকে রাতে আমরা এটা দিয়ে ভাত খাবো ।’ শুনে আমি খুশীতে লাফাতে থাকি ।
মাছ দেখে আমার মা আর ছোট ভাইও খুশীতে লাফায় । আমাদের বাড়িতে এত বড় মাছ আগে কখনো আসে নি । শুধু বাবা যেদিন বেতন পায় সেদিন মাঝারি সাইজের কোন মুরগী বা মাছ নিয়ে আসে । তারপর সারা মাস আমরা শাক, ডাল, আলুভর্তা দিয়েই ভাত খাই ।
মা বেশ আয়োজন করে মাছ কুটতে বসে । বাবাও আজকে বাইরে না গিয়ে মায়ের পাশে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করতে থাকে । ঘরের মধ্যে অনেক আনন্দের পরিবেশ । অন্যান্য দিন মা শুধু নিজেদের দরিদ্রতার কথা ভেবে ভেবে সারাদিন গজ গজ করতে থাকে আর বাবাকে গালমন্দ করে । আমরা দুভাই মনখারাপ করে বসে থাকি । একটি বিশাল আকারের কাতল মাছ আমাদের চিরচেনা সেই পরিবেশটা কাটিয়ে দিয়েছে ।
বিকেল বেলাটায় ঘরে আমার একদম মন টিকে না । আমি মাঠে খেলতে যাই প্রতিদিন । কিন্তু আজকে আর খেলতে যাবো না । আমি বই নিয়ে পড়তে বসে পড়ি। রান্না হলে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা মাছের তরকারী দিয়ে ভাত খেতে হবে । পেটপুরে গরম ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা । তখন পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হয় । অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে ।
আমার দেখাদেখি আমার ছোট ভাইও পড়তে বসে যায় । আমাকে কখনো পড়তে বসতে বলতে হয় না । আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, সামনে বৃত্তি পরীক্ষা । ক্লাসে আমার রোল এক । স্যারেরা আশা করছেন আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাবো ।
রান্না শেষ হলে মা আমাদের ভাত খাওয়ার জন্য ডাক দিলেন । আমরা সবাই মাটিতে গোল হয়ে খেতে বসি । রান্নাঘরের চালের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে । আজকের আকাশে কী সুন্দর জোছনা ! আজকের সবকিছুই সুন্দর । আমার অদ্ভুত ভালো লাগতে থাকে । আজকে আমরা অনেকক্ষণ সময় ধরে ভাত খাই । অন্যান্যদিন তরকারী থাকে না বলে তাড়াতাড়ি আমাদের ভাত খাওয়া শেষ হয়ে যায় । আজকে তরকারী শেষ হয় না । আমরা সবাই ইচ্ছেমত খেতে থাকি । গলা পর্যন্ত খেয়ে আমরা উঠে পড়ি ।
মা সবকিছু গোছগাছ করে শোয়ার আয়োজন করে । অনেকক্ষণ হারিকেন জ্বালিয়ে রাখলে কেরোসিন বেশী খরচ হয় বলে আমরা খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি প্রতিদিন ।
শোয়ার সাথে সাথেই বাবা আর মা নাক ডাকাতে থাকে । দুইজনই সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে । আমার ঘুম আসে না । যতক্ষণ এই আনন্দের ক্ষণগুলোকে ধরে রাখতে পারা যায় ততই লাভ । কাল থেকেই হয়তোবা আবার আগের মত দিনগুলো সব শুরু হয়ে যাবে ।
রাত কতক্ষণ হয়েছে আমি জানি না । হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । আমি তীব্র ব্যাথায় চিৎকার করে জেগে উঠি । মা ধড়ফড় করে ওঠেন, ‘কী হয়েছে তোর ?’
আমি পেট চেপে ধরে বলি, ‘পেটে খুব ব্যথা করছে মা ।’ মা-বাবা কী করবে বুঝতে পারছে না । আমার পেটের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে রকেটের গতিতে । আমি মাকে বলি, ‘কাতল মাছটা পেট থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে মা ।’
মা একটু হতভম্ব হয়ে যান, ‘ এসব কী বলছিস !’
‘হ্যাঁ মা, আমি স্বপ্নে দেখেছি মাছটা আমাকে বলছে, তোরা আমাকে খাওয়ার যোগ্য না । তোর বাবা তো আমার মত একটা মাছকে কখনো কিনে আনতে পারবে না । আজকে যা খেয়েছিস সেটা তো আরেকজনের দান । আরেকজন তোদেরকে করুণা করেছে ।’
মা আমাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘ওসব দুঃস্বপ্ন বাবা, মনে রাখিস না । তোর কিছু হবে না ।’
আমি মাকে বলি, ‘আচ্ছা, আমরা এতো গরিব কেন মা ?’ মা কোন উত্তর দিতে পারেন না । ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে । তারপর লজ্জায় মাথাটা নিচু করে ফেলেন ।
আমি দেখেছি দরিদ্র মানুষের কোন আত্মসম্মানবোধ থাকে না । দরিদ্রতা মানুষকে শুধু লজ্জিত হতেই শেখায় ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জুয়েল দেব Shahnaj Akter, অনেক ধন্যবাদ।
জুয়েল দেব সুর্য, অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আদৌ লিখ্তে পারি কিনা সেটাই এখনো বুঝ্তে পারি না।
জুয়েল দেব খোরশেদুল আলম ভাই, শেষ লাইনটা অনেক কষ্ট থেকে লেখা। সব মানুষেরই লজ্জা থাকে। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তখন জীবন বাচানোর জন্য হয় তোবা লজ্জা-শরম গুলো বিসর্জন দিতে হয়।আপনি বুঝেছেন দেখে ভালো লাগলো।অনেক ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
সূর্য গল্পটা চমৎকার ভাবে সামনে এগিয়েছে। লেখার হাত বেশ ভাল। এই গল্পকারকে কোন উপদেশ বা বুদ্ধি দেয়া বোকামী।
খোরশেদুল আলম গল্প পড়লাম মন্তব্য গুলিও দেখলাম। একবার মনে হয়েছে শেষপর্যন্ত মাছটি মনেহয় তাদের খাওয়া হবেনা গরীব থাকার কারনে যাইহোক শেষ পর্যন্ত খাওয়া হলো। মন্তব্যে শেষ লাইনার মানতে পারেনি অনেকে লেখক কিবোঝাতে চেয়েছে পাঠক কিবুঝেছে তা আমি বলতে পারবোনা আমি যাবুঝেছি তাতে শেষ লাইনটির সাথে ১০০% এক মত এতে বিন্দু পরিমান দ্বিমত নেই বরং লাইনটি উপযুক্ত একটি লাইন এই লাইনটির অনেক মূল্য আছে এই গল্পে।এখানে হয়তো সৌজন্য দেখানোর জন্য বলেছে যে এটা মানিনা, এক মতনই, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ১০০% সত্যি। এখানে, তাই আমি বলব লেখকের দেখাই সঠিক। সবকিছুমিলে লেখাটি অসাধারণ।
জুয়েল দেব রওশন জাহান, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...
রওশন জাহান লেখার হাত ভালো. শুভকামনা রইলো.
জুয়েল দেব রনীল ভাইয়া, অনেক ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য... খুব ভালো লাগলো..

১২ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী