পরী হিনা ও আজব দেশে আকমল (ষষ্ঠ পর্ব )

সরলতা (অক্টোবর ২০১২)

হোসেন মোশাররফ
  • ১৪
মামার বাড়ি। আর এটা শুধু বিষ্ময়করই নয় রীতিমতো বিশ্বাস করাও বেশ কঠিন। তা হলেও আকমল আবার এসে হাজির হলো তার মামার বাড়িতে। তবে এত সহজে মামার বাড়িতে ফেরা যায় আকমলের তা জানা ছিল না। তা ছাড়া এটাও তো বলার অপেৰা রাখে না, ফিরতে চাইলেই তো আর যেখানে সেখানে ফেরা যায় না। বিশেষ করে আকমলের মামার বাড়ি বলেই কথা। তাও যেখানে তার ঢিলে ঢালা জামার পকেটে এখনো বর্তমান আজব দেশের জীবনত্দ বুড়োটা। বিষয়টা একবার প্রকাশ হয়ে পড়লে কী অঘটন টা ঘটতে পারে মামার বাড়িতে তা কল্পনা করতে পারলো না আকমল। এদিকে পরী হিনার টিকিটাও দেখা গেল না আশ-পাশে কোথাও। সম্ভবত তাকে এখন আর পাওয়া যাবে না সহসা। আর এ কথা কেউ বিশ্বাসও করতে চাইবে না পরী হিনা নামে আদৌ কেউ কোথাও আছে। শুধু আকমলকে দেখেই মামা যা একটু অবাক হবে। মামীও হয়তো মনে মনে অসন্তুষ্ট হবে। এতে কিছুই করার নেই আকমলের। তবে তার ছোট্ট মামাত ভাইটি যে তাকে দেখে যারপরনাই খুশি হবে তাতে কোন সন্দেহই নেই আকমলের মনে। কেননা সে আকমল থেকে এক বছরের ছোট হলেও তার ভীষণ নেওটা। এর উপর বেশ ক'টা দিন সে অনুপস্থিত ছিল, সুতরাং তার অখুশি হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেল না আকমল।

শেষে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে বাড়ির আঙিনায় ঢুকল আকমল। না, কেউ কোথাও দেখে ফেলেনি তাকে। আর দেখবেই বা কী, এই কাক ডাকা ভোরে কেউ এখন পর্যনত্দ ঘুম থেকেই ওঠেনি। কিন্তু আকমল এতৰণ পর্যনত্দও খেয়াল করেনি তার ছোট্ট মামাত ভাই সোলাইমান জানালার ফোকর গলিয়ে ঠিকই তাকে দেখছে । শুধু বেশি বেশি অবাক হওয়ার কারণেই সে কোন কথা না বলে চুপ করে আছে । তারপর হঠাৎ করেই ঘটিয়ে ফেলল সে অঘটন টা, এক ঝটকায় দরজা খুলে বাইরে এসেই সে চেঁচিয়ে উঠল 'ভাইয়া'। আর দেরি না করে সে সজোরে জড়িয়ে ধরল আকমলকে। একটু দম নিয়ে সে আবার বলল, 'ভাইয়া, তুমি লুকিয়েছিলে কোথায় আমাকে বলতে হবে ।'
আকমল বলল,'আমি একটা পাহাড়ের গুহায় বন্দি হয়ে পড়েছিলাম। ব্যস, এর বেশি আর বলা যাবে না।'
তারপর মনে মনে বলল কেননা এর বেশি বলতে গেলেই একদিকে বিশ্বাসে যেমন কুলাবে না তেমনি মামার মান-সম্মানের ৰতি হওয়ারও জোর সম্ভাবনা.........সুতরাং এর চেয়ে বেশি না বলাই ভাল । কিন্তু নাছোড়বান্দা সোলাইমান তা মানতে মোটেও রাজি হলো না।
শেষে আকমলের ঢিলে-ঢালা আলখালস্নার পকেটে হাত দিয়ে বলল, 'নরম নরম এটা কী, ভাইয়া?
ব্যস, এতেই হলো; আকমলের গোমর ফাঁস হতে আর দেরি হলো না। বুড়োটার সন্ধান পেয়ে গেছে সোলাইমান। সত্যি বলা ছাড়া এখন আর উপায় থাকল না আকমলের। কিন্তু সত্যিটা বলার চাইতে (যদি উপায় থাকে) চাৰুষ দেখানো অনেক ভাল। কেননা তাতে বিশ্বাসের বাকি ঘাটতি টুকু পূরণ হতে আর দেরি হয়না। সুতরাং আলতো করে ধরে বুড়োটাকে বের করে ফেলল আকমল। আকমলের আলখালস্নার মোটা পকেটের ওম পেয়ে বে-ঘোরে ঘুমাচ্ছে তখনও বুড়োটা। বোধহয় এতৰণ জানেই না ঘুমের মধ্যে কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েছে সে। নিশ্চিত মৃতু্যর মুখ থেকে একবার ফিরে আসতে পারলে অবস্থা যা হয় , ঠিক তাই হয়েছে বুড়োটার। রাজার দেয়া মৃতু্যদন্ডাদেশের ফাঁক গলিয়ে সে এখন নিশ্চিনত্দে ঘুমাচ্ছে। সুতরাং ঘুমটা বে-ঘোরে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।
বুড়োটাকে দেখে সোলাইমান চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'ওমা, এযে ছোট্ট এক বুড়ো!
তারপর ওর দিকে অবাক বিষ্ময়ে কিছুৰণ চেয়ে থেকে বলল সোলাইমান, 'এত্তো ছোট্ট মানুষটাকে তুমি কোথায় পেয়েছ ভাইয়া?'
মৃদু হেসে আকমল বলল, 'সে অনেক কাহিনী; পরে সব শুনো।'
সোলাইমান চুপ করে গেল। কিন্তু তর সইছিলো না মোটেও দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুরি করে দেখতে থাকা আকমলের মামার। সে এতৰণ ধরে শুধু অবাক না বরং বিষ্ময়ের সাথে আকমলের কান্ড-কারখানা লৰ্য করছিল। আকমল আজও বেঁচে আছে আর সে স্ব-শরীরে ফিরেও এসেছে। পাড়ার লোকের কাছে মুখ দেখানো তার দায় হবে ভেবে সে ভিতরে ভিতরে এতৰণ মরে যাচ্ছিল। বুড়োটাকে দেখার পর মনে মনে এতৰণে স্বসত্দির নিশ্বাস ফেলল মামা। দুষ্ট লোক খোঁজে শুধু একটা মওকা যা দিয়ে সে ভাল লোককে আটকাতে পারবে। আর সেই মওকা ধরার জন্য ছোটখাট একটা ছুতোই যথেষ্ট। তবে আকমলের কাছে থাকা ছুতোটা মোটেও ছোটখাট কোন ছুতো না, রীতিমতো বড় সড়ই। এখন শুধু দরকার একটু কৌশল; তাহলেই তার পূর্ব কৃত অন্যায় যেমন ঢাকা পড়বে। হেসে-খেলে পাড়া-প্রতিবেশিদেরও ঠান্ডা করা একানত্দই সহজ হবে। সুতরাং স্বসত্দির নিশ্বাস ফেলে মোটেও ভুল করেনি সে।
এখন দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে আর দেরি করা মোটেও চলেনা তার। কিছুৰণের মধ্যেই স্ব-শরীরে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর ঘরের উঠোনে আকমলকে দেখে একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়ল সে। যেন এই প্রথম আর এই মাত্র সে আকমল কে দেখল। চোখ কচলে আরও ভাল ভাবে দেখে নিয়ে বলল, 'এতদিনে মনে পড়ল আমাদের?'
প্রশ্নের ধরন আর চোখ মুখের ভাবখানা দেখলে মনে হবে আকমল বোধহয় নিজেই কোথাও লুকিয়েছিল।
ওদিকে মামাকে দেখে বুড়োকে আবার তার আলখালস্নার পকেটে লুকিয়ে ফেলেছিল আকমল। কিন্তু আকমল তো জানে না মামা সেটা আগেই দেখে ফেলেছে। এখন শুধু বাকি আছে ইঁদুর-বেড়াল খেলার বাকি অংশ টুকৃ । আকমল বলল, 'মনে তো ছিলই তবে গুহার মুখে পাথর চাপা থাকায় আর বের হতে পারিনি মামা।'
মামা মনে মনে বুঝল বেশি বেশি ঘাটলে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়বে শেষে। তার চে' চুপ থাকাই ভাল। কেননা চুপ থেকে অনেক বোকা লোকও বুদ্ধিমানের পরিচয় দিতে পারে।
তারপর মামা ঘটা করে চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'ওগো তোমরা কে কোথায় আছ গো, এদিকে এসো দেখে যাও; আকমল কে বাঘে খায়নি, সে ফিরেছে।'
তার হাঁক ডাক শুনে তার স্ত্রীই প্রথমে ছুটে এসে বলল, 'ওগো, এই সাত সকালে তোমাকে কী পাগলা কুকুরে কামড়েছে যে তুমি আবোল তাবোল বক্ছ?'
'আবোল তাবোল কোথায়? চোখে দেখেই বিশ্বাস কর না.....' বলল মামা। মামার কথা শুনে মামি খানিক অবাক বিষ্ময়ে আকমলের দিকে চেয়ে থেকে বলল, 'তু- মি আকমল না, কোথায় ছিলে এতদিন? আমরা যে এদিকে খুঁজে মরছি শেষে ভাবলাম বোধহয় বাঘেই খেয়েছে তোমাকে...'
মামির কথায় আকমলের মন গলে গেল। এমন আদর করে আগে কখনোই কথা বলেনি মামি তার সাথে। তাই সে ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলল, 'বাঘে কোথায় খেয়েছে, আমি তো গুহায় আটকে পড়েছিলাম।' তারপর চোখ মুখ কঠিন করে বলল, 'যেই না আমি গুহায় ঢুকেছি, ব্যস অমনি দেখি পিছন থেকে কে যেন গুহামুখে একটা ভারি পাথর চাপা দিয়ে দিল.......।'
ভীষণ অবাক হয়ে মামি বলল, 'তারপর....?'
'তারপর আর কী , আমি আটকা পড়ে গেলাম ওর মধ্যে।' বলল আকমল।
'ওমা, সে কী? বের হওয়ার চেষ্টাটুকুও করলে না?' বলল মামি।
'চেষ্টা করলাম না মানে? কত চেষ্টা করলাম। শেষে মামার নাম ধরে ডাকতে লাগলাম।'
'তারপর?'
'তারপর মনে হল কে যেন ঠিক মামার গলায় বলল তুমি ওর ভিতরেই পঁচে মর।'
শুনে মামির চোখ মাথায় উঠল। মনে মনে বলল তাহলে তো আকমলের সবই মনে আছে দেখছি। তাহলে এখন উপায়?....হঁ্যা, উপায় একটা আছে বৈকি.....মনে মনে আবার বলল মামি।
তারপর আকমল কে বলল, 'তাহলে ঠিক শয়তান ভূতের কাজ ওটা....বোধহয় সেই তোমাকে কোন অসৎ উদ্দেশ্যে বন্দি করে রেখেছিল এতদিন।'
মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আকমল। যাক বাবা, পরী হিনার কথা তোলার দায় থেকে তো বাঁচা গেল। কেননা পরী হিনার কথা কাওকে বলা যত না সহজ, কিন্তু বিশ্বাস করানোটা তার চে' অনেক কঠিন। সুতরাং ভালই ভালই এ যাত্রা রৰা পেলেই বেঁচে যায় সে। অনত্দত আজব দেশের বুড়োর প্রা্ণটা বে-কসুর রৰা পায় কঠোর মনের মামার হাত থেকে। কেননা পরী হিনার প্রসঙ্গ তোলা মানেই বুড়োর কথা আলগোছে প্রকাশ পেয়ে যাওয়া। আর প্রকাশ পাওয়া মানেই তো পকেট থেকে তাকে বের করে সবাই কে দেখিয়ে তার জীবন বিপন্ন করে তোলা। সুতরাং পকেটের মধ্যে বেচারা গোপনে যেমন ঘুমিয়ে আছে সেখানেই পড়ে থাক। তাকে এখন বিরক্ত করা মোটেও ঠিক হবে না।...মনে মনে বলল আকমল।
তারপর মামি একটু চোখের আড়াল হলে সোলাইমানকে আকমল তফাতে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলল, 'খবরদার! বুড়োর কথা যেন কাউকে বলো না, এমন কী আম্মুকেও না। কেউ জানতে পারা মানেই বুড়োর প্রাণ নাশ হওয়া।'
আকমলের কথা শুনে সোলাইমান খুশি হয়ে বলল, 'ঠিক আছে, আমি ও-কথা কাউকে বলব না। কিন্তু তার আগে বলতে হবে অতটুকুন মানুষটা তুমি কোথায় পেয়েছ?'
'সেসব পরে হবে, সব বলব তোমাকে। তবে এখন ওর প্রাণ রৰা করাটাই সবচে' জরম্নরি আমাদের জন্য।' বলল আকমল।
বুড়োকে আবার বের করল আকমল তার ঢিলে ঢালা আলখালস্নার পকেট থেকে। এতৰণে ঘুম ভেঙেছে বুড়োর। পিট্ পিট্ করে তাকাতে লাগল সে। সকালের রোদ এসে পড়েছে তার চোখে মুখে। তাতে আারও তাজা আর সুস্থ দেখাতে লাগল তাকে। আকমল তাকে আলতো করে ধরে মুখের কাছে এনে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কী ৰুধা পেয়েছে?'
উত্তরে বুড়ো কী বলল তার মাথামু- কিছুই বোঝা গেল না। তবে তার হাব ভাবে বোঝা গেল যে আকমলের কথাও সে কিছুই বোঝেনি। তাহলে এখন উপায়? পরী হিনাও নেই আশ পাশে কোথাও! ভাষা বোঝার যাদুটা তো তারই শুধু জানা আছে। তবে বুড়োর ৰুধা পাওয়ার ব্যাপারে কারও দ্বি-মত থাকার কথা নয়। কেননা বুড়োর বয়স হিসাবে হিসাব কষলে সময়টা তো আর কম পেরোয়নি। নেহাত ক্লানত্দ শ্রানত্দ থাকায় সে পকেটের মধ্যে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
পাড়া-প্রতিবেশী ঘুম থেকে ওঠার আগে আর মামা-মামি টের পাওয়ার আগেই আকমল বুড়োর একটা ব্যবস্থা করে ফেলল। তাকে খাদ্য-পানীয় প্রয়োজন মতো দেয়া হল। আর পড়ে থাকা একটা টিয়া পাখির শুন্য খাঁচায় তার থাকার ব্যবস্থা করা হল। খাঁচাটা সোলাইমানই যোগাড় করে দিল আকমল কে। বেড়াল কুকুর কিংবা অন্য কোন মাংসাশী প্রাণীর হাতে থেকে নিরাপদ রাখতে বুড়োর জন্য খাঁচার কোন বিকল্প নেই। খাঁচাটা রাখাও হল ঘরের এক গোপন স্থানে। বিষয়টা যেন শুধু সোলাইমান আর আকমল ছাড়া অন্য কেউ ঘুণাৰরেও জানতে না পারে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তাই কী কখনো হয়?
পুরো ঘটনাটা আদ্যপ্রানত্দ সম্পূর্ণ চুরি করে আকমলের মামি আড়াল থেকে দেখে ফেলল। তারপর যা হওয়ার তাই হল।
সারাদিন দলে দলে পাড়া-প্রতিবেশী একে একে ছুটে এল আকমল-কে দেখতে। দেখে দেখে সবাই বলল বাহদুর ছেলেই বটে। বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলল বাঘ কোথায় শয়তান ভূতের কবল থেকে ফেরত এসেছে। যে যা শুনেছে তাই তাই মনত্দব্য করে একে একে চলে গেল সবাই।
এদিকে পাড়ার লোকে যখন আকমল কে নিয়ে ব্যসত্দ ঠিক তখনই কোমরে ওড়না বেঁধে মামি বলল, 'দাঁড়াও! আমাকে না জানিয়ে কোথাকার কোন ধুমসো বুড়ো এনে ঘরে তোলা, এখনি দেখাচ্ছি মজা!'
তারপর যা হতে পারে তাই হল। ঘরে পোষা বেড়ালটাকে সেদিন আর খেতে না দিয়ে দেয়া হল বুড়োর খাঁচা তার সামনে। ৰুধার্ত বেড়াল মোৰম মতো খাওয়া সামনে পেয়ে খুশিতে খাঁচার চারপাশে ঘুরতে লাগল আর লেজ নাড়তে লাগল। কিছুৰণের মধ্যেই বুড়োর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলেই দেখতে পেল সে খাঁচায় বন্দি আর খাঁচার চারপাশে ঘুরছে এক বাঘ। দেখতে বাঘের মতো হলেও গায়ের রং অবিকল বেড়ালের মতো। অবাক হয়ে বুড়ো চারপাশের কা--কারখানা দেখতে লাগল।
এমন সময় কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে সেখানে এসে হাজির হল আকমলের মামি। বুড়োকে জেগে উঠতে দেখে তার রাগ আরও চড়ে গেল। সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল, 'বলি তোমাকে কী ভীমরতিতে ধরেছে? বলা নেই কওয়া নেই পরের ঘরে ঢুকে নিশ্চিনত্দে ঘুমিয়েছো? বুড়ো ভাম কোথাকার! দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি মজা...'
ভাষা না বুঝলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় বুুড়ো নিশ্চিত হল কেয়ামত এবার সত্যিই তার সামনে। দুই হাত জোড় করে ৰমা চাওয়ার ভঙ্গি করেও নিজেকে আর রৰা করতে সৰম হল না সে। নিষ্ঠুর মামি খাঁচার দরজা খুলে দিতেই বেড়াল তার সহজ শিকার মুখে নিয়ে দেয়াল টপকে পালাল। আর এভাবেই আকমলের অজানত্দে বুড়োর স্বল্প আয়ুর জীবনের অবসান ঘটে গেল।
এদিকে বেলা একটু বাড়লে পাড়া-প্রতিবেশিদের আনাগোনাও অনেক কমে এল। আকমল ভাবল এই সুযোগে বুড়ো কে একটু দেখে আসি। বেচারা অনেকৰণ না খেয়ে আছে।
কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়, বুুড়ো ততৰণে অন্যের পেটের খাদ্যের উপকরণ হয়ে নিশ্চিনত্দে হজম হচ্ছে। আকমল সেখানে যেয়ে দেখতে পেল শুন্য খাঁচা আর তার চারপাশে রক্তের ফোঁটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। আকমলের আর বুঝতে বাকি রইলো না আবার সে গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়েছে। বুড়োকেও সে চিরদিনের মতো হারিয়েছে।
সৎ লোকের পদে পদে বিপদ। কিন্তু তাই বলে সৎ লোক কখনো সত্য পথ থেকে সরে আসে না। বরং বিপদে পড়ার অভ্যাস টা রপ্ত আছে বলেই সে সৎ থাকতে পারে।
আকমল ভেবে দেখল খাঁচায় বন্দি বুড়োর খবর একমাত্র সোলাইমানই জানত। তাহলে বিষয়টা তার কাছেই জানা যেতে পারে। হয়তো কোন সঠিক তথ্যও পাওয়া যেতে পারে................
আকমলের অনুমান সত্যি হল। সোলাইমান বুুড়ো খুন হওয়ার কিছুৰণ আগে ঘরে ঢুকে পুরো বিষয়টা দেখে ফেলেছিল; তাই সে আকার ইঙ্গিতে পুরো বিষয়টা আকমল কে বুঝিয়ে দিল। আকমলের বুঝতে আর বাকি রইল না কে এর পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছে। নিশ্চয় গোপনে সে তাদের কার্যকলাপ দেখেছে, আর এটাই তাদের জন্য কাল হয়েছে। বুড়োর প্রাণটাও গেল, সেই সাথে অনেক রহস্য তাদের অজানাই রয়ে গেল। কিন্তু ওর জন্য আফসোস করে লাভ নেই। কেননা অতীত কখনো ফিরে আসে না আর অতীতের জন্য বর্তমান সময়টিকে নষ্ট করাই সবচে বড় বোকামির পরিচয়।
পরদিন থেকে আকমল আবার ফিরে গেল আগের জীবনে। বুড়োর প্রাণের বিনিময়ে আকমল জানতে পারল মামা মামির ভালবাসা উপরে যতটা না, ভিতরে ঠিক ততটাই অন্ধকার। মনে পড়ল তার আবার মায়ের হারের কথা। আবার মামার সামনে যেয়ে দাঁড়াল আকমল। তারপর বলল,'গুহার মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মায়ের গলার হারের চিহ্নটুকুও পায়নি মামা ।'
উপায়নত্দর না দেখে মাথা চুলকে মামা বলল, 'কিন্তু আমি তো ওটা ওখানেই ফেলে এসেছিলাম। নিশ্চয় তাহলে ঠিক ওটা শয়তান ভূতের কাজ । সে ওটা চুরিও করেছে আবার তোমাকে সেখানে গুহার অন্ধকারে এতদিন বন্দিও করে রেখেছিল ।'
সহজ-সরল লোককে ঠকানো সহজ। বিশেষত সে যদি আপন আত্মীয় কিংবা নিকট প্রতিবেশী হয়। কারন এদের কথা সহজেই বিশ্বাস করে সহজ-সরল লোকেরা।
মামার কথা সহজেই বিশ্বাস করে নিল আকমল। আর এই সুযোগে মামাও বলল, 'এখন শয়তান ভূতের কবল থেকে ওটা উদ্ধার হলেই কেবল তুমি তা ফেরত পেতে পার।'
'শয়তান ভূতের কবল থেকে ওটা ফিরিয়ে আনতেই হবে,মামা....' দৃঢ়তার সাথে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল আকমল। তারপর মনে মনে বলল সে ..কেননা ওটা কোন সাধারণ জিনিস না ...মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ এবং একমাত্র উপহার।
আকমলের গলার সাথে গলা মিলিয়ে বলল মামা, 'নিশ্চয় তা ফিরিয়ে আনব আমরা, তবে তার আগে ঐ শয়তান ভূতটার আসত্দানা কোথায় তা আমাদের ভাল ভাবে জানতে হবে।

একদিন যায়, দুইদিন যায়....পাহাড়ে-পাহাড়ে আর গিরি-কন্দর উপত্যকায় যেয়ে মামা-ভাগ্নের শয়তান ভূতের আসত্দানা খোঁজার অভিযান চলতে লাগল। শেষে অবশেষে একদিন মামাই খোঁজটা নিয়ে এল। এটাই স্বাভাবিক, দুষ্ট লোকের মিথ্যা বাহানার মোটেও অভাব হয়না। আর মিথ্যেটাকে সত্যি বানানোর জন্য সে নিছক খেল তামাসার আশ্রয় নেয়। শেষে তার স্বার্থ উদ্ধার হলে পিছন থেকে সে সরে পড়ে।
আকমল বরাবরের মতো মামার এই কথাটিও বিশ্বাস করল । সুতরাং আর মোটেও দেরি করা যায় না। পরদিন সকালেই মামা ভাগ্নে আবার একসাথে বের হল শয়তান ভূতের আসত্দানার খোঁজে। সহজেই তা পাওয়া গেল। একটা পাহাড়ের নিচে জংলায় পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন আগের এক পরিত্যক্ত কূপ। সম্ভবত বহুদিন আগে এখানে কোন মনুষ্য বসতি ছিল। তাদের বাস উঠে যাওয়ার কারণেই সবকিছু পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। সেখানে যেয়ে মামা আকমলকে বলল , 'আমি এক গণকের কাছ থেকে জানতে পেরেছি এখানেই সেই শয়তান ভূতটা বাস করে। এখন তুমি যদি তোমার মায়ের হারটা ফেরত পেতে চাও; তাহলে তোমাকে এই কূপের মধ্যে সেই শয়তান ভূতটাকে পরাজিত করতে হবে। তবেই তুমি তা পেতে পার। অবশ্য আমি উপরে থেকে যতটুকু সাহায্য করার, তা তোমাকে করব। এখন দেখ এই কঠিন কাজটা তুমি পারবে কিনা?
দাঁতে দাঁত চেপে আকমল বলল, 'খোদা সহায়, আমি পারব মামা। তুমি উপরে থেকে আমাকে একটু সহায্য করো, তাহলেই হবে।'
কিন্তু একটু পরেই আকমলের মোহভঙ্গ হল। আকমল যেই কূয়ার মধ্যে নেমেছে অমনি উপর থেকে তার কোমরে বাাঁধা দড়ির অপর প্রানত্দ ঝপাস করে নিচে পড়ল। আর ঠিক তার পর পরই উপর থেকে গুরম্ন গম্ভীর গলার স্বর ভেসে এল... আর তা তার মামারই গলার স্বর। মামা তাকে উপর থেকে বলল, 'আকমল বড় জ্বালা জ্বালিয়েছিস তুই আমাকে। এবার মওকা মিলেছে আমার। আর তোকে সুযোগ দিচ্ছি না। পঁচা কূয়ার মধ্যে ডুবে মর আর মরতে মরতে তোর মায়ের গলার হারের স্বপ্ন দেখ.....'
আকমল বুঝল এতৰণ সে মিথ্যা স্বপ্নের মধ্যে ছিল। মামা আবার বিপদে ফেলার উদ্দেশ্যেই তাকে এখানে এনে বন্দি করেছে। অথচ উপরে থাকতে মামার কাছেই সে সাহায্যর জন্যে দরখাসত্দ করেছিল। এই ভুলের জন্য সে মনে মনে ৰমা চাইল খোদার কাছে। অন্যায় কারীর কাছে সাহায্য চাওয়াও বড় অন্যায়। সাহায্য একমাত্র খোদার কাছেই চাওয়া যায়। তার জন্যে মায়ের শেষ উপদেশও তাই ছিল। মানুষ ভুল করার জন্যেই বিপদে পড়ে; আকমলের অবস্থাও তাই হল।
কিছুৰণের মধ্যেই কূয়ার উপরে ভারি কিছু চাপা দিয়ে আটকে দেয়া হল। উপর থেকে যেটুকু ৰীণ আলো আসছিল তাও বন্ধ হল। পঁচা পানির ঘুরঘুট্টি অন্ধকার কূয়ায় আকমলের দম আটকে আসতে লাগল। মৃতু্য খুব কাছাকাছি এসে তার দরজায় কড়া নাড়তে লাগল। মনে মনে খোদাকে ডাকতে লাগল আকমল। তার ভুলের জন্য বার বার ৰমা চাইতে লাগল খোদার কাছে... এই বুঝি জীবন শেষ হয় তার।

অন্যায় যে করে আর অন্যায়কারী কে যে সাহায্য করে তারা উভয়ে সমান পাপে পাপী। সুতরাং তাদের শাসত্দিও একই। কিন্তু না বুঝে, ভুলে অথবা ধোঁকায় পড়ে কেউ যদি অন্যায় কাজে সামিল হয়ে পড়ে তার জন্যে ৰমা চাওয়াই একমাত্র মুক্তির পথ। হয়তো এতে তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের পরে মুক্তি মিললেও মিলতে পারে । পাপের জন্যে স্রষ্টার কাছে ৰমা চাওয়ার মধ্যে কোন অসম্মান নেই বরং তা সৃষ্টির জন্য গৌরবেরই কারণ। আর এতে স্রষ্টার কাছে সৃষ্টির আত্ম-মর্যাদা,সম্মান আরও বৃদ্ধি পায়। কেননা বিনয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা। ৰমা চাওয়াটা বিনয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপকরণ যা খুব কম মানুষের মাঝেই পাওয়া যায়।
তবে সহজ সরল অতি সাধারণ মানুষের সরলতাই তাদের এমন গুণের অধিকারী করে থাকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য পরী হিনাকে তো তাড়াতাড়ি আসতে হয়। আকমল না হলে উদ্ধার হবে কিভাবে? বরাবরের মতোই সুন্দর লিখেছেন।
হয় তো তাই ; তবে আকমল কিন্তু পরী হিনার আগমনের অপেক্ষায় বসে নেই মোটেও ...ধন্যবাদ আপনাকে >
তানি হক পাপের জন্যে স্রষ্টার কাছে ৰমা চাওয়ার মধ্যে কোন অসম্মান নেই বরং তা সৃষ্টির জন্য গৌরবেরই কারণ। আর এতে স্রষ্টার কাছে সৃষ্টির আত্ম-মর্যাদা,সম্মান আরও বৃদ্ধি পায়। কেননা বিনয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা। ৰমা চাওয়াটা বিনয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপকরণ যা খুব কম মানুষের মাঝেই পাওয়া যায়। .......অনেক দিন পর ভাইয়ার লিখা পেয়ে খুসি হলাম ...আর পরী হিনা ও আজব দেশে আকমল এই পর্বে ..অন্য পর্ব গুলোর চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে পেলাম ...অনেক অনেক ভালো লাগা রইলো ...গল্পের শেষ প্যারাতে অসাধারণ কিছু ...উপদেশ উঠেছে ...সুভেচ্ছা আর সালাম ভাইয়াকে ;;;
আপনার সুচিন্তিত মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করল .....আপনার সুস্থ ও সুখী জীবন কামনা করছি ....সেই সাথে আপনার জন্য রইল আমার শুভেচ্ছা ও সালাম ........
অষ্টবসু পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম...এই পর্বটাও বেশ জমাট...।
আপনাকে আমার অশেষ ধন্যবাদ আপনার এই মন্তব্যটির জন্য,সুখে থাকুন ...ভাল থাকুন..... পরবর্তী পর্বেও আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম.....
আহমাদ মুকুল মোশাররফ ভাইয়ের রূপকথা না থাকলে কেমন যেন অপূর্ণ লাগে প্রতিটি সংখ্যা। যাক, আপনাকে আবার পেয়ে এই অপূর্ণতাটুকু ঘুচলো!....সাথে আছি ভাইজান, ভাললাগা নিয়ে।
আপনারা ছিলেন, আপনারা আছেন...আপনারাই থাকবেন .....যদি থাকে আর কি লাগে ....( ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য ....)
রোদের ছায়া বেশ ভালো লাগলো , বিষয়ের সাথেও এবার গল্পটি মানানসই ........অনেক শুভকামনা ...
অনেক ধন্যবাদ .....ছায়া .....সেই সাথে শুভ কামনাও রইল .....
রোদেলা শিশির (লাইজু মনি ) বিনয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা .... চিরন্তন ...সত্যি কথা ... !!
কথাটি আবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ......
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ...............................কিরে ভাই, এবার দুই মাস নাকি একমাসের ধাক্কা? সাই-ফাই ছাই চাইনা, পরী হিনা বিনা আকমলের প্রাণ যে যায়। শুভেচ্ছা রইল।
....খুক..খুক ..খুক...{ ভয় পাবেন না, এ হল নিছক কাশির শব্দ ( ঠান্ডা লেগে এই অবস্থা -)} পরী হিনার প্রসঙ্গে বলছিলাম ...খুক.. খুক.. খুক.. এই যা- আবার ! হল তো..?...ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি বাকিটা পরের মাসেই হবে...... .... ( ধন্যবাদ আপনাকে -)
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে আবার দেখা মিলল । গল্পচ্ছলে অনেক শিক্ষনীয় কথা । ভাল লাগলো অনেক অনেক ।
দেখা দিতে দেরী হল সেজন্য অনেক দুঃখিত, আসলে আমার কোন দোষ নেই , কারিগরী কিছু ত্রুটির জন্যই দেরিটুকু হযেছে অর্থাৎ তৈরী গল্প জমা দেয়াই সম্ভব হইনি এতদিন...তবে আপনার অপেক্ষা এবং ভাল লাগা দুটোর জন্যই রইল কৃতজ্ঞতা এবং অনেক অনেক ধন্যবাদ .........
নৈশতরী আকমল কি মরে গেলো............? গল্পের আগামাথা ঠিক বুঝলাম না ! তবে গল্পটা পড়তে কিন্তু জটিল মজা পাচ্ছিলাম......যদিও বানানে খটকা লাগছিল তবুও.............! শুভকামনা রইলো !
আকমলের ভাগ্যের লিখন জানার জন্য পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থকতে হবে আপনাকে........আর বানানের খটকা টুকু কারিগরী জটিলতা , ওতে আমার কোন হাত নেই .......ধন্যবাদ আপনাকে .....
ওবাইদুল হক আবারো আসলাম আপনার পরী হীনায় তো কেমন আছেন আপনি । আশা করি আবারো দেখা হবে পরী হীনা নিয়ে । ধন্যবাদ আপনার গল্পকে ।
ভাল আছি , আপনিও নিশ্চই ভাল আছেন .....ধন্যবাদ আপনাকে ....

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী