পরী হিনা ও আজব দেশে আকমলl ( তৃতীয় পর্ব )

মুক্তির চেতনা (মার্চ ২০১২)

হোসেন মোশাররফ
  • ১২
  • ৫৪
বয়সটা বুড়োর আট মাস কী আশি বছর তা জানার সময় এখন মোটেও নেই আর আকমলের। বরং বলা যায় যাহা আট তাহাই আশি। সুতরাং এখন মনে মনে একটাই সাদা মাটা প্রশ্ন তাকে বার বার তাড়া করে ফিরতে লাগল ; আর তা হল এই-
এই গো- বেচারা নিরীহ বুড়োটাকে এতগুলো যণ্ডামার্কা লোক ধরে এনে এখানে বন্দি করে রেখে গেল কেন। তাও এত নিষ্ঠুরভাবে যেন তার সামনে মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন পথ আর খোলা না থাকে। তা ছাড়া এর চেয়েও ভীষণ রকম অবাক হল সে বুড়োর রহস্যময় কথাবার্তা আর আচার আচরণে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও তার আচরণ স্বাভাবিক। বরং যে তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনল তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো দুরে থাক সামান্য সৌজন্য বোধটুকুও দেখাচ্ছে না। এর উপর তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে চোখেমুখে ষোলআনা মিথ্যে কথা বলতে অভ্যস্ত সে। বড়ই রহস্যময় কাণ্ডকারখানা এখানে। মনে মনে একবার ভাবল আকমল।
শেষ পর্যন্ত মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়েই গেল আকমলের। ....আচ্ছা, সবই মেনে নিলাম। তোমার বয়সটা আন্দাজ আট মাস, পরী হিনাও দুষ্ট পরী। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে ওরা কারা? যারা তোমাকে বস্তা বন্দি করে এখানে ফেলে গেল। তোমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যাদের হাত একটুও কাঁপল না। তাদের বিরুদ্ধে তোমার কোন অভিযোগও নেই কিংবা একটু রাগ-অভিমান ! একটুও কী থাকতে নেই? '
ফোকলা দাঁতের মাড়ি বের করে বুড়োটা এবার যেন হেসে লুটোপুটি খেল। তারপর হাসিটা সামলে নিয়ে বলল, 'দেখ দেখি, রাগ থাকবে কেন? এটাই যে এ দেশের রীতি।'
তারপর কেতাবি ঢংয়ে মুখের হাসিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে বলল বুড়োটা, 'ওরা তো আমার পর কেউ না। আমারই নিকট আত্মীয়-স্বজন। ভাই ভাস্তে, ছেলে নাতি জামাই আর তাদের সাথে ক'জন পাড়া-পড়শি।'
অবাক হয়ে চেয়ে রইল এবার আকমল বুড়ো টার দিকে। মুখে কিছু না বললেও হাবভাব এবং আচার আচরণে বুঝিয়ে দিল বুড়োকে; সে তার কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছে। ভাবখানা তার এমন- বুড়ো মানুষ, অন্যায় না হয় করেছে একটু কিন্তু তাই বলে এমন করতে হয়।
বুড়োটাও কম যায় না। চেহারা দেখে আকমলের মনের ভাব আঁচ করে ফেলতে সময় লাগল না তার। ফোকলা দাঁত বের করে মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলল, 'তুমি ভিনদেশী মানুষ, তাই অবাক হচ্ছ। এ দেশের এটাই রীতি। মানুষ বুড়ো হলে কোন কাজে লাগেনা। তাই নিকট আত্মীয়রা তাকে হয় মেরে ফেলে নতুবা দূরে কোথাও ফেলে আসে।'
বুড়োর কথা শুনে বিস্ময়ের সাথে আকমল বলল, ' এত নিষ্ঠুর এরা?'
বুড়ো এবার ফোড়ন কেটে বলল, 'ওমা, এর মধ্যে আবার নিষ্ঠুরতা কোথায় পেলে তুমি? তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার চাইতে এভাবে মেরে ফেলাই কী ঢের ভাল না?'
বুড়োর কথা যুক্তি পূর্ণ কিন্তু আকমল মনে মনে মেনে নিতে পারল না। বলল, 'না না এ মেনে নেয়া যায় না। তোমার কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝলাম না।'
'মেনে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু তুমি তো নূতন এসেছ এই দেশে...তাই। কিছুদিন এদের সাথে থাকলে তুমিও তখন এদেরই মতো হয়ে যাবে। যে দেশে যে রীতি।' অত্যান্ত স্বাভাবিক ভাবেই বলল বুড়োটা।
'আশ্চর্য!' বুড়োর কথা শুনে আর তার হাবভাব দেখে বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করল আকমল।
বুড়োটা এবার পরিস্থিতি বে-গতিক দেখে তা স্বাভাবিক করতে মনোযোগী হল। দু'হাত তার সামনে পিছনে ঘন ঘন দোলাতে লাগল। কিছুৰণ পর তার হাত দোলানোর গতি কমিয়ে এনে বলল, ' এতে তো আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু দেখছি না আমি। আসলে তুমি ছেলে-পেলে মানুষ তাই এমন আশ্চর্য হওয়াটাই তোমার জন্য স্বাভাবিক। '
একটু থেমে বুড়োটা আবার শুরু করল,বয়েস টা তো আর কম হয়নি আমার, নয়মাস চলছে। আর ক'টা দিন পরেই দশমাসে পা দেব। দশমাস বাঁচা মানেই মেলা বাঁচা। এই দুই পোড়া চোখে এর বেশি তো আর কাওকে বাঁচতে দেখিনি কখনো। তাছাড়া বেঁচেই বা কী হবে। অকেজো মানুষ যত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যায় ততই ভাল। তা সে নিজের ইচ্ছায় হোক বা পরের ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়।'
বুড়োর বক-বকানি শুনে আকমলের মাথা ঘুরতে লাগল। কী বলবে বুড়োকে ভেবে না পেয়ে বলল, 'আর কিছুৰণ তোমার বক-বকানি শুনলে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যেতে আর দেরি হবে না আমার।'
তবে মনে মনে বলল সে নিজেকে; আজব দেশে কেবল নূতন পা রেখেছি; এখন মাথা খারাপ করলে মোটেও চলবে না আমার। এদিকে আবার পরী হিনাকেও দেখছি না আশে পাশে কোথাও। সুতরাং মাথা ঠাণ্ডা রেখেই চলতে হবে আমাকে। অন্তত আজব দেশের এই অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানার হাত থেকে বাঁচতে হলে। তবে আরও কিছুটা সময় অতিক্রান্ত না হলে প্রকৃত বিষয় উৎঘাটন করা মোটেও সম্ভব নয়।
দায়িত্ব মানুষ কে বড় কিংবা ছোট করে রাখে। দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অতি অল্প বয়সেই মানুষ হতে পারে দায়িত্বশীল। অথচ দায়িত্ব কাঁধে না নিয়ে সারাজীবন কাটালেও সে চিরকাল ছোটই থেকে যায়। আকমলকে তার দায়িত্ব যথেষ্ট বড় করে তুলল সহজেই। কঠিন বাস্তবতায় সামনে পথ চলার নির্দেশনা দায়িত্ব নেয়া থেকেই সে পেয়ে গেল। সামনে পথ যতই দুর্গম হোক, কোন কিছুতেই সে আর ঘাবড়াবে না।
রাত শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। পরী হিনার কথামতো কাজ সমাধা করতে হলে এখনই তাকে নামতে হবে নিচে। তারপর আজব দেশটা ঘুরে দেখে আসতে হবে রাত থাকতে থাকতেই। কাজেই আর দেরি করা মোটেও চলে না। এদিকে বুড়োকেও সঙ্গে নেয়া দরকার। কেননা এখানকার পথঘাট আর অলি-গলি সব তারই নখ-দর্পণে থাকার কথা। প্রয়োজনের তাগিদ যখন ভিতর থেকে আসে তখন তা মানুষের কাজের গতি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
আকমল বুড়ো কে বলল, 'আমি তোমাদের দেশে নূতন এসেছি। এখানকার পথঘাট আর পাড়া-মহল্লা কোন কিছুই আমার চেনা-জানা নেই। তবে তুমি যদি আমাকে পথ দেখিয়ে দাও তো আমি বেশ একবার ঘুরে দেখতে পারি তোমাদের দেশটা।'
আকমলের কথা শুনে বুড়োটা মনে মনে যেন ভয় পেয়ে গেল। মুহূর্তে মুখটা তার রক্ত শূন্য ফ্যাকাশে দেখাতে লাগল। একবার এদিক সেদিক চেয়ে নড়েচড়ে বসে বলল, 'বাবাজি, তুমি ছেলে পেলে মানুষ ; বুদ্ধি এখনো পাকেনি তোমার...তাই তুমি এমন কথা বলছ!
তারপর গুহার বাইরেটা আর একবার ভাল করে পর্যবেৰণ করে নিয়ে বলল সে, ' হিসাবে আমি এখন মরে গেছি। কেননা অবস্থা এমন বে-গতিক হলে এদেশে কেউ কাউকে বাঁচায় না। তুমি ভিনদেশী তাই হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছ। সুতরাং এখন যদি কেউ আমাকে একবার দেখে ফেলে তাহলে ভাববে নির্ঘাত ভূত হয়ে আমি আবার ফিরে এসেছি। কাজেই ও কাজ আমি পারব না।'
নাছোড়বান্দা বুড়োর চাঁচাছোলা কথাবার্তা শুনে আকমলের আর বুঝতে বাকি রইল না এ বুড়ো সহজ সরল না। আবার দেশের সামাজিক পরিস্থিতিও মোটে ভাল না। সব শুদ্ধ হ য ব র ল। সুতরাং যা করতে হবে কৌশল প্রয়োগেই করতে হবে। বিপদে বোকা-অসহায় মানুষের মাথায়ও বুদ্ধি খোলে। আকমল বা তা থেকে বাদ যায় কেন? চট-জলদি একটা কৌশল তার মাথায় খেলে গেল। তবে এই কৌশলটা মাথায় না খেললে আর কিছুৰণ পর বেশ বড় সড় বিপদেই পড়তে হতো তাদের।
কৌশলটা এই; আকমল বুড়ো কে বলল, 'দেখ, এখানে আমরা দু'জনই অসহায়। আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য-খাওয়া আমাদের-কেই যোগাড় করতে হবে। কেননা আমাদের খাওয়া কেউ এনে দেবে না আর সকাল হলেই ক্ষুধা লাগবে। এই নির্জন গুহায় সারাদিন না খেয়ে মরলেও এক আঁজলা পানিও আমাদের কেউ এনে দেবে না।'
আকমলের কথাগুলো বুড়ো এবার মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। প্রয়োজনের তাগিদই মানুষকে সমস্যার কথা শুনতে বাধ্য করা্য়। সঠিক পরামর্শ পেলে সে তা সমাধান করতেও আগ্রহী হয়। আকমলকে থামতে দেখে বুড়ো বলল এবার, 'তাহলে এখন কী করা উচিত আমাদের?'
একটু থেমে আকমল বলল, 'রাত থাকতে থাকতেই আমাদের দিনের খাদ্য সংগ্রহ করা উচিত। কেননা একবার বেলা উঠে গেলে সারাদিন আমাদের না খেয়ে অভুক্ত থাকতে হবে।'
বুড়োর মনে ধরল কথাগুলো। মাথা দোলাতে দোলাতে বুড়ো এবার বলল, 'তা তুমি ঠিকই বলেছ। বয়সটা অল্প হলেও বুদ্ধিতে তুমি আমার চাইতে পাকা।
এই প্রথম বুড়ো একটু হলেও প্রশংসা করল আকমলের। কিন্তু প্রশংসা সব সময় বিপদের কারণ। প্রশংসা কে জয় করতে হলে ফলাফলের দিকে না তাকিয়ে কাজে নেমে পড়াই সবচে' ভাল পন্থা। কেননা,
যে প্রশংসা হজম করে সে নিজের পতন নিজেই ডেকে আনে।
আর দেরি করল না বুড়োটা। গুহা থেকে বের হয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। আকমলও পিছু পিছু বের হয়ে এল। আকমলের কাছে মনে হল বিশাল এক পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে সে। রাত শেষ হয়ে আসায় অন্ধকার অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। পাহাড়ের নিচে ছোট ছোট বাড়ি ঘর গুলো আবছা আবছা দেখা যেতে লাগল। একবার আড়মোড়া ভেঙে বুড়োটা বলল, ' নাও, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রাত পোহানোর আগেই আবার ফিরতে হবে আমাদের। কেউ দেখে ফেললেই বিপদ।'
খানিকটা অগ্রসর হয়েই আবার পিছু ফিরে তাকাল বুড়োটা। আকমল ভেবেছিল বোধহয় সে ঠিকমতো পিছন পিছন আসতে পারছে কিনা সেটাই লৰ্য করার জন্য বুড়োটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আকমলের ধারণা ভুল প্রমাণ করে বুড়োটা হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে বলে উঠল, 'দেখ বাপু, আমি বুড়ো মানুষ ; বেশি জোরে দৌড়াতে পারবো না। সুতরাং যা করার তোমাকেই করতে হবে। আমি শুধু দূরে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখিয়ে দেব।'
আকমল মনে মনে শুধু একবার বলল, 'তথাস্তু'। কিন্তু উপরে উপরে বুড়োকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'যা করার আমিই করব, তুমি শুধু একটু দেখিয়ে দিলেই হবে। নূতন এসেছি, চিনিনা তাই; না হলে ওটকু সাহায্যও নিতাম না।'
উঁচু পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেল আকমল। দেহটা আকারে ছোট হওয়ার ফলাফল যে কত খারাপ হতে পারে তা ষোলআনা বুঝে গেল সে। ছোট্ট এক একটা পাথর অতিক্রম করতে গিয়েই গলদ ঘর্ম হতে হল তাকে। অথচ এমন এক একটা পাথর এর আগে সে টেনে ছুড়ে ফেলেছে অতি অনায়াসে।
যাওবা কষ্ট করে পাহাড় থেকে নামা গেল পাহাড়ের নিচে পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটাটাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াল। পাহাড়ের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে অবস্থিত বুড়োর ছেড়ে আসা পল্লিতে পৌঁছাতে তাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হল। শেষ মেশ সেখানে পৌঁছে গ্রামে ঢোকার আগেই বুড়ো একটা ঝোপের আড়ালে নিজেকে গোপন করে ফেলল। তারপর ফিস্ ফিস্ করে আকমল কে বলল, ' আমি এখন ভূত। যদিও এখনও ভূত হয়নি তবে আমার আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশিরা অন্তত তাই বিশ্বাস করবে। কাজেই আমি এখানেই লুকোলাম।'
বুড়োর আচরণে আকমল হতবাক হয়ে বলল, 'কিন্তু আমি বুঝবো কী করে কোনটা তোমার বাড়ি আর কোথায় গেলে সহজে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারব?'
বুড়ো বলল , 'অত্যন্ত সহজ।'
তারপর বুড়ো তার হাতের আঙুলের ইশারায় নিজের বাড়িটা দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে আকমল কে বলল, 'ঐ যে দেখ, ওটাই আমার বাড়ি। ঐ বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি সব আমারই। কিন্তু শুধুমাত্র একটা বিশ্বাসের কারণে আজ আমি পথের ফকির। এখন আমাকে দেখলেও কেউ বিশ্বাস করবে না ওসবের আমিই মালিক। কাজেই তুমিই যাও, আমার নিজের বাড়ি থেকে আমার জিনিস চুরি করার আদেশ আমিই তোমাকে দিলাম।'
বুড়োর কথা শুনে আকমল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। বিষয় টা আঁচ করতে পেরে বুড়ো এবার বলল, 'কেননা কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। কাজেই বাস্তবে আমি চুল পাকা দাড়ি পাকা বুড়ো হলেও বিশ্বাসে এখন সবার কাছে আমি মৃত। আর মৃত মানেই এ দেশের মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী আমি এখন ভূত। সুতরাং আর মোটেও দেরি করো না তুমি। আমি বলছি, তুমি এক্ষুণি যাও। আমার ঘর থেকে আমারই জিনিস আমার আদেশ মোতাবেক তুমি বের করে নিয়ে এসো আমার দরকারে। এতে তোমার কোন দোষ হবে না।'
তবুও আকমল একটুও চোখের পলক না ফেলে বুড়োর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। জীবনেও এমন কাজ সে করেনি। হোক বুড়োর বাড়ি, বুড়োরই ঘর, বুড়োরই সহায়-সম্পত্তি থেকে আবার বুড়োরই আদেশে নিয়ে আসবে সে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে চুরির গন্ধটা কী ঠিকই থেকে যাচ্ছে না? ধরা পড়লেই তো চুরির শাস্তি।
বুড়ো এবারও বুঝল আকমলের মনের কথা। হঠাৎ তার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে সে বলল, 'তবে ধরা পড়লে কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব না বাপু। কেননা আমি নিজেই এখন একে বুড়ো, তার উপর এদের ভূতের বিশ্বাসের কাছে সম্পূর্ণ অসহায় আমি। সুতরাং বুঝে শুনে চলো ; বিপদের আগেই তোমাকে বিপদের কথাটা জানিয়ে দিলাম। পরে যেন আমার কোন দোষ দিতে না পার তুমি।'
আকমল এবার মনে মনে বলল, বুড়োটা মোটেও খারাপ না। কেননা মন্দ লোকে বিপদের কথা কখনো আগে বলেনা বরং বিপদে পড়ার পর সে মজা দেখতেই ভালবাসে।
মন্দ লোকের এই চারিত্রিক গুণটির কথা সে মামার হাতে গুহায় বন্দি হওয়ার দিন থেকেই শিখে নিয়েছে। সুতরাং দ্বিতীয়বার আবার শেখার আর কোন দরকার নেই। মনে মনে একবার শুধু বলল 'তথাস্তু'। তারপর আর একবার ভাবল এখন এ ছাড়া আমার সামনে আজব দেশে ঢোকার আর কোন পথ খোলা নেই। কেননা অসহায় এ বুড়ো জন-বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সহজেই সে তার কাছ থেকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেতে পারে। যা অন্য কেউ হয়তো দেবে না তাকে। সে জন্য একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে ; এ ছাড়া উপায় কী!
মাথা থেকে বাকি চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আকমল বলল এবার, 'হুঁ, বুঝলাম সবই। এবার বল কোথায় যেতে হবে আর কী কী জিনিস আনতে হবে তোমার জন্য।'
এত তাড়াতাড়ি আকমলের মাথায় সব বুদ্ধি ঢুকে গেছে দেখে বুড়ো ষোলআনা খুশি হয়ে বলল এবার, 'দেখ ঐ যে আমার বাড়ির উঠোন, ঐ উঠোনের ঠিক মাঝখানে আছে একটা আপেল গাছ। আর ঐ আপেল যে একবার খেয়েছে, সে জীবনে আর তার স্বাদ ভুলতে পারেনি। আমার দাদার হাতে লাগানো ঐ গাছটি থেকে তুমি যত ইচ্ছা আপেল পেড়ে নিয়ে এসো। দেখো, বেলা ওঠার আগেই তুমি অবশ্যই আবার ফিরে এসো।'
'আর যদি আপেল পাড়তে গিয়ে আমি ধরা পড়ে যাই।' ফিস্ ফিস্ করে বলল আকমল।
'তাহলে ওরা তোমাকে এ দেশের আইন অনুযায়ী বিচারের জন্য রাজার কাছে পাঠাতে পারে। তবে সাবধান! ভুলেও যেন পালাতে যেও না। তাহলেই কিন্তু বিপদ!' চোখ গোল গোল করে বলল বুড়োটা।
কী বিপদ হতে পারে আর শোনা হল না বুড়োর কাছে। আকমল গাছে উঠায় ওস্তাদ। সুতরাং রওনা হয়ে পড়ল সে। এক পা দু' পা করে এগোয় আর এক একবার পিছন ফিরে তাকায়। বুড়োটা ততৰণে ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করে ফেলেছে। বাইরে থেকে আর বোঝা যাচ্ছে না ঐ ঝোপের ভিতরে একটা মানুষ বসে আছে।
একটু এগিয়েই আকমল গ্রামের রাস্তা ধরে ফেলল। প্রথম বাড়িটাই বুড়োর। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বুড়োর বাড়ি। বেশ কয়েকটা ঘর আর মধ্যখানে ছোট্ট একটু উঠোন। গ্রামের এই দো'চালা ঘর গুলো বেশ শক্ত পোক্ত করেই তৈরি করা। দেখেই বোঝা যায় বুড়ো কোন সাধারণ পরিবারের মানুষ না। রীতিমতো অবস্থাপন্ন পরিবারের সম্ভ্রান্ত মানুষ। নিত্যান্ত কপাল দোষেই আজ তার এই দুর্গতি। সমাজ পরিবেশ আর প্রকৃতির কাছে মানুষ রীতিমতো অসহায়। এ বুড়োই তার জলন্ত প্রমাণ।
খুব সাবধানে পা টিপে টিপে আকমল বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করল। চারদিকে গোল করে সাজানো বসত বাড়িগুলোর দরজা একইদিকে। কবুতরের খোপের মতো দরজা গুলো সব সাঁটা বন্ধ। ততৰণে ভোরের আলো ফুটে বের হয়েছে পূবের আকাশে। কিন্তু বাড়িতে একটি প্রাণিও জাগেনি। সবাই যেন বে-ঘোরে ঘুমাচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে সাধারণত এত সকাল পর্যন্ত কেউ ঘুমিয়ে থাকে না। সম্ভবত গতরাতে বুড়োকে পাহাড়ের গুহায় রেখে আসার উৎসব ছিল এদের। এতেই এই দুরবস্থা হয়ে থাকতে পারে। মদ্যপান আর অনন্দ উৎসব করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে সব যে যার ঘরে। বেলা উঠেছে তাও টের পায়নি কেউ। বড় নিষ্ঠুর এরা, মনে মনে আর একবার উচ্চারণ করল আকমল।
খুব সাবধানে চারদিকে ভাল করে আর একবার দেখে নিল আকমল। না, কেউ দেখেনি তাকে। এখন সে নিশ্চিন্ত মনে আপেল গাছে উঠতে পারে। তাছাড়া কালকে সে নিজেই নিজের চোখেই দেখেছে পাহাড়ের উপর গুহার সামনে দাড়িয়ে কীভাবে নাচছিল ওরা। সুতরাং ধরেই নেয়া যায় যথেষ্ট ক্লান্ত শ্রান্ত ওরা। সুতরাং এই মুহূর্তে ওদের পৰে মরা সহজ কিন্তু জেগে ওঠাই কঠিন।
একমাত্র সাহসী লোকেরাই নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। কেননা বুদ্ধি, সাহস এবং সততা তাদের কে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। অপরদিকে ভীতু লোকেরা নিজের ঘরে নিজেই নিজেকে বন্দি করে রাখে। ফলে তারা কোন ঝুঁকিও নিতে পারেনা। আর ঝুঁকি বিহীন জীবন, জীবন হীন মৃত মানুষের সমান।

( যারা আজব দেশ সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে চান, তারা দয়া করে অপেৰায় থেকে যান-)
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রোদেলা শিশির (লাইজু মনি ) দায়িত্ব নিতে গেলে বড়রা বলে পাকামো কর না ...।। আর না নিতে গেলে ... সহ-যাত্রিরা বলে অপদার্থ ...।।এই আমাদের দুরবস্থা ......।। গল্পে পরোক্ষ ভাষার বক্রোক্তি অতি সরস...... ! ভাল না লাগার কি উপায় আছে ...! নির্দিধায় ......চমৎকার ...।
আপনার সময়োচিত মন্তব্যটি আমার বড় ভাল লাগল.....শুভেচ্ছা নিন, ভাল থাকুন .....ধন্যবাদ আপনাকে .......
ঝরা পরি হিনা ছাড়া আর কি কি গল্প আছে ?সব পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে
পরি হিনা ছাড়া বাকি গল্প গুলো পাবেন `রূপকথার গল্প- পরী হিনাকে নিয়ে নয়টি ' বই-এ | এ ছাড়া গল্প কবিতা অন লাইন-ও পাবেন ....আরো আছে, তবে সেগুলোর জন্য অপেক্ষায় থাকুন, কেননা সবুরে মেওয়া ফলে ..জানেন তো ?......হা হা ....
বশির আহমেদ ভাল কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দোষ কি ?
দোষ কি ? দোষ তো আছেই ...তবে এখন আর বলছি না ...থাক !!! মনে মনে ধন্যবাদ নিন মন্তব্যের জন্য .....
মাহবুব খান রুদ্ধসাসে পরে গেলাম /ভালো লাগলো
আপনাকে আনন্দ দিতে পেরে আমিও আনন্দিত , ধন্যবাদ ভাই মাহবুব খান .......
sakil অপেক্ষায় তো সবসময় থাকি ভাই . এবার সেটা বলে দিয়ে আরো বেশি আগ্রহ জন্মিয়ে দিলেন. ভালো লাগছে , আগামীতে ও লাগবে .
ধন্যবাদ শাকিল ভাই......শুভ কামনা রইল ........
আহমাদ মুকুল যথারীতি সাধুবাদ। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকবো।
আহমেদ সাবের হোসেন মোশাররফ ভাই - অপেক্ষায় থাকলাম। কারন, কথায় আছে - সবুরে মেওয়া ফলে।
ভাল আছেন তো সাবের ভাই ? তবে অপেক্ষায় থাকলে সবুরে মেওয়া হয়তো ফলতে পারে ....
Abu Umar Saifullah অনেক অনেক ভালো লাগল o
অনেক অনেক ধন্যবাদ সিমুম........
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ কথার শিল্প ভাল লাগলো । কাহিনী গতিময় । আবার কবে বাকিটুকু ?
এইতো সামনেই...সে পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরুন .....

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী