আন্দালিব ও আবুআলি

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

হোসেন মোশাররফ
  • ২৮
  • 0
একদিন, এক সময় ছিল যখন দেশে দেশে মানুষ বেচা কেনার হাট বসত। একজন মানুষ অপর আর একজন মানুষ কে হাটে নিয়ে যেত বিক্রি করতে। মোটা অর্থের বিনিময়ে চলত মানুষ বেচা-কেনা। আর যেসব মানুষেরা বিক্রি হয়ে যেত তাদের কে বলা হত ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী। সেই ভয়াবহ যুগটি অনেক আগেই আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছে। অতিক্রানত্দ হয়ে যাওয়া সেই সময়ের কিছু গল্প কিন্তু আজও শেষ হয়ে যায়নি। তেমনি একদিনের গল্প এখন বলছি আমি।
সময়টা মধ্যযুগ বলা যায়। ইরাকের রাজধানী বাগদাদই ছিল তখন পৃথিবীর সব চাইতে গুরম্নত্বপূর্ণ নগরী। ধনে জনে জ্ঞানে মানে সবদিক দিয়েই বাগদাদ ছিল তাবৎ পৃথিবীর সবার স্বপ্নের শহর। সেই শহরেরই এক বাসিন্দা, নাম তার আবুআলি। আর সবার মতো আবুআলিও ছিল বাগদাদের এক সম্ভ্রানত্দ বাসিন্দা। ব্যবসায়ী ছিল সে। কিন্তু তার ব্যবসাটা ছিল বড়ই অদভুত আর রকমারি। তার কাজ ছিল অল্প দামে বাজে পণ্য কিনে তা কৌশলে বেশি দামে মানুষের কাছে বিক্রি করা। কথার চাটুকারিতায় সে সবাইকে হারিয়ে দিত অনায়াসে। কেনার আগে কেউ টেরই পেত না যে সে নিতানত্দই গো-হারা ঠকে যাচ্ছে। কিন্তু বেচা-বিক্রির পর আবুআলি যখন চোখের আড়াল হয়ে যেত তখন সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসত। আফসোসের আর সীমা পরিসীমা থাকতো না তার। মনে মনে বিড় বিড় করে শুধু একটা কথাই বলতে শোনা যেত ক্রেতাকে, "হায়! হায়! এ কী করলাম!"
কিন্তু তখন তো আর হায় হায় করে কোনই লাভ হত না। কেননা আবুআলি শুধু যে কৌশল বাজ ছিল তাই না; রীতিমতো সে ছিল খুব ধুরন্ধরও। কাজ একবার উদ্ধার হয়ে গেলে সহজে আর কেউ তার কাছেই ভিড়তে পারত না। কিন্তু কথায় আছে, 'সাত দিন চোরের আর একদিন গৃহস্থের।'
ঠকবাজি করে ব্যবসা কতদিনই বা চালানো যায়। ক্রমে তার ব্যবসায় মন্দা পড়তে লাগল। লোকেও জেনে গেল আবুআলির কৌশলগুলো। ফলে ব্যবসা বদল করেও আবুআলি আর বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। শেষে সে একটা নূতন ফন্দি বের করল মাথা দিয়ে। সে ঠিক করল এবার সে মানুষ বেচা-কেনার ব্যবসা ধরবে। কেননা এ ব্যবসায় লাভটা নেহাত মন্দ না, একটু কৌশল খাটাতে পারলে তো কথাই নেই। যেই কথা সেই কাজ, আর সাধারণত যারা ঠকবাজ হয় তারা আপন কাজে যেমন সব সময় ব্যসত্দ থাকতে পারে তেমনি চটপটেও হয়। কোন কাজে দেরি করা তাদের ধর্মে মোটেও সহ্য হয় না। আবুআলিও তার কোন অংশে ব্যতিক্রম ছিল না। পরদিন থেকেই সে কাজে নেমে পড়ল।

লোকালয় ছাড়িয়ে শহরের প্রানত্দে, পাহাড়ের ঠিক নিচে; যেখানটায় মানুষ বেচা-কেনার হাট বসত সেখানে সে যেয়ে ধরনা দিল। সারা হাট ঘুরেও সে তার পছন্দ মোতাবেক ক্রীতদাস একটাও খুঁজে পেল না। অন্য কোন সাধারণ মানুষ হলে হতাশ হয়ে যেত নিশ্চয় কিন্তু আবুআলির জীবনের অভিধানে হতাশ নামে কোন শব্দ লেখা ছিল না। চালাকদের জীবন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়; আর যাই হোক তারা নিরাশ কিংবা হতাশ হয়ে পড়ে না কখনো। শেষে সন্ধ্যা নামার আগে আগে হাট ভাঙার উপক্রম হল। ক্রীতদাসদের মালিকেরা তাদের সদ্য ক্রয় করা অথবা হাটে এনে বিক্রি না হওয়া ক্রীতদাসদের নিয়ে ফিরতে শুরম্ন করল। একে একে ক্রীতদাসদের তারা তাদের ঘোড়ার গাড়িতে তুলে দূরদূরানত্দের পথে রওনা দিতে লাগল। আবু আলিও এই সময়টার অপেৰায় এতৰণ ধৈর্য ধরে ছিল। তারপর সে খুঁজে বেরও করে ফেলল তার কাঙ্ক্ষিত ক্রীতদাসটিকে।
একজন বুড়ো ক্রীতদাসকে তার মালিক ঠেলা গুতো মেরে গাড়িতে তুলছিল। দুর থেকে মুখ চোখের অঙ্গ ভঙ্গি দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল ক্রীতদাসটির উপর মনিব মোটেও সন্তুষ্ট নয়। বিড় বিড় করে সে যেন নিজের কপালকেই বার বার দায়ী করছিল। আবুআলিও এমন একজন বুড়ো অকর্মণ্য ক্রীতদাস আর তার সাথে তার অসন্তুষ্ট মনিবকেই যেন মনে মনে খুঁজছিল।
বুড়ো ক্রীতদাসকে গাড়ির পাদানিতে বসিয়ে তার মনিব কেবল গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় আবুআলি তার সামনে যেয়ে দাঁড়াল। তারপর তাকে বলল সে, 'ভায়া, এই বুড়ো লোকটি কী তোমার ক্রীতদাস?'
এমনিতেই রাগে আর দুঃখে মনিবের মাথায় রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। আবুআলির কথাগুলো যেন সেই গরমে তার মাথার আগুন কে আরেকটু উসকে দিল। আবুআলির দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে রাগে অগি্নশর্মা হয়ে লোকটি বলল, 'দেখতেই যখন পাচ্ছ সব আবার এত ভণিতা করা কেন? আমার কষ্ট দেখে খুব মজা লাগছে তোমার তাই না ?'

লোকটির রাগ দেখে আবুআলি মনে মনে খুশি হল। মনে মনে বলল সে এমন না হলে কী আর ব্যবসা জমে। বিক্রেতার রাগ যত বেশি হবে দানটাও তত খাসা মারা যাবে। তারপর গলাটা আরো মোলায়েম করে এনে বলল সে, 'আমি মনে মনে এমনই এক বুড়ো ক্রীতদাস খুঁজছিলাম তো- তাই আর কী , জিজ্ঞেস করা।'
মনিব এবার আবেগের আতিশয্যে চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'নেবে তুমি এ কে?'
'নেব তো বটেই; তবে দামটা কত হাঁকিয়েছ তার আগে সেটা জানতে হবে না।' বড় জোশের সাথে বলল এবার আবুআলি।
'কত দেবে তুমি, সেটাই আগে শুনি?' বলল মনিব।
'তাই আবার হয় নাকি? জিনিস যার নিয়ম অনুযায়ী সেই দাম হাঁকাবে। এটাই তো নিয়ম।'
আবুআলির কথা শুনে তখন বুড়ো ক্রীতদাসটির মনিব তাকে বলল, 'সবই জানি ভায়া, এতো আর কম দুঃখে বলিনি। আজ দিয়ে পাঁচ হাট ফেরত নিয়ে যাচ্ছি ওকে। মনে মনে আজ সংকল্প করেই ঘর থেকে বের হয়েছি; আজও যদি হাটে না বিকোয় তো সোজা আরব সাগরে যেয়ে ফেলে আসব ওকে।'
আবুআলি তখন মনে মনে বলল, আমি কী এখনো আমার বিছানায় শুয়ে রাতে দেখা স্বপ্নের মধ্যেই আছি? নাকি রাত শেষ হয়ে বেলা উঠেছে আর আমিও হাটে এসে পড়েছি। ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে গোপনে তার হাতে একটা চিমটি কেটে নিল। এতে সে নিশ্চিত হয়ে গেল সে সত্যি সত্যিই হাটে এসেছে। তারপর মওকা বুঝে কোপ মারল বিক্রেতার ঘাড়ে। বলল, 'দেখ, বেচারা বুড়োও হয়েছে। কাজেও অকর্মণ্য বুদ্ধিতেও মরা। তাছাড়া তুমি তো ওকে আরব সাগরে ফেলে আসলে কানা কড়িটাও পেতে না। তারচে' এক'শ দিনার দিচ্ছি আমাকেই দিয়ে দাও।'
আবুআলির কথা শুনে মনিবের চোখ কপালে উঠল। বলল, 'তুমি কী আমাকে পাগল পেয়েছ? আজকাল একটা ভাল দুম্বাও কেউ একশ দিনারে বিকোয় না। বুড়ো হলেও এ যে ক্রীতদাস, হাতি মরলেও কিন্তু দামটা নেহাত কম পাওয়া যায় না।'
দর-দস্তুরের সব রকম কৌশল আবুআলির ভালই জানা ছিল। তখন সে বলল, 'ঠিক আছে তুমি তাহলে মরা হাতির স্বপ্নই দেখ আর আরব সাগরেই ফেল; যা খুশি তাই কর আমি চললাম।'
আবুআলি চলে যাচ্ছিল। লোকটি আবার তাকে ডেকে ফেরাল। তারপর বলল, 'দেখ হাজার দিনার হলে এই শেষ বেলা করে ওকে তোমার হাতে দিয়ে যেতে পারি।'
বাজার দর অনুযায়ী দরটা খুবই মামুলি কিন্তু চতুর আবুআলি তাতে মোটেও রাজি না হয়ে বলল, 'ফেলা জিনিস বাজারে বিকোয় না তবুও আমি তোমার দিকে তাকিয়ে আর ঐ বুড়ো লোকটির সম্মানে আর এক'শ দিনার বাড়িয়ে দিতে পারি; এর বেশি আর কিছুতেই না।'
বুড়ো লোকটির মনিব তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, 'মানুষ কী কখনো ফেলনা হয়! ওটা তো ছিল আমার কথার কথা। ঠিক আছে বলছ যখন পাঁচশ দিনারে পারলে নিয়ে যাও। এর কমে মরা মানুষও জুটবে না তোমার কপালে, এই বলে রাখলাম।'
আবুআলিও বুঝল এর কমে আর কিছুতেই নামবে না বুড়ো লোকটির মনিব। অগত্যা পাঁচশ দিনারেই সে কিনে নিল বুড়ো লোকটাকে। তারপর সে মনে মনে বলল এখন আমাকে আর পায় কে, পাঁচ পাঁচে পঁচিশ হাজার দিনার এই বুড়োকে দিয়ে কীভাবে লাভ করতে হবে তা আবুআলির ভালই জানা আছে।
বুড়ো লোকটাকে কেনার পর আবুআলির আনন্দ আর দেখে কে! গুন গুন করে একটা গান ভাঁজতে ভাঁজতে বুড়োকে নিয়ে সে বাড়ির পথে রওনা দিল।
এই বুড়ো ক্রীতদাসটির নাম ছিল আন্দালিব। তার পূর্বপুরম্নষরা ছিল আফ্রিকান। কোন একসময় তার পূর্ব পুরম্নষদের কেউ ক্রীতদাস হিসাবে এ দেশে বিক্রি হয়েছিল। তারপর থেকে বংশ পরম্পরায় তারা এদেশে থেকে গেছে ক্রীতদাস হিসাবে। আন্দালিবের পরিবার পরিজন কে কোথায় সে জানেনা। আর ক্রীতদাসদের জীবনটাই এমন। কখনো মালিকের অপছন্দ হলে কিংবা অর্থ সংকট দেখা দিলে সে ইচ্ছেমতো ক্রীতদাসদের বিক্রি করে দিতে পারে। ফলে তাকে একাকী চলে যেতে হয় অন্য কারো অধীনে। খুব কম মালিকই আছে যারা এমন নিষ্ঠুর কাজ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
আবুআলি যেখানে থাকত সে জায়গাটা শহর থেকে বেশ দুরে। ছোটখাট একটা পাহাড়ের উপত্যকায় তার একটা খামার বাড়ি ছিল। সেখানে সে বুড়ো আন্দালিব কে নিয়ে যেয়ে তুলল। তারপর সে তাকে বলল, 'দেখ তুমি বুড়ো অকমর্ণ্য একজন ক্রীতদাস হলেও আমার কাছে যে তুমি কত দামি তা অল্পদিনেই টের পাবে।'
বুড়ো আন্দালিব তার নূতন মালিকের মন মর্জি ভাল দেখে বলল, 'গোসত্দাকি মাপ করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি হুজুর।'
আবুআলি চালাক হলেও মোটেও নিষ্ঠুর ছিল না। বলল, 'তুমি আমাকে তোমার মনিব মনে করো না, আমি তোমার বন্ধু। তাই আমাকে একটা কেন হাজারটা কথাও জিজ্ঞেস করতে পার।'
'বলছিলাম আমি বুড়ো হয়েছি। কাজে কর্মেও অকর্মা, আমার মতো নাদান কে কিনে এনে তোমার লাভ টা কী হল।' বড় বিনয়ের সাথে বলল বুড়োটা।
যদিও কঠিন প্রশ্ন। আবুআলি কিন্তু বুড়ো আন্দালিব কে মোটেও নিরাশ করল না। সে বলল তাকে, 'লাভ তো হামেশাই আছে, আমি ব্যবসায়ী; লাভ না বুঝে পন্য কেনার ঝুঁকি মোটেও নিই না। তবে তুমি যদি আমার কাজ উদ্ধারের আগেই মরে না যাও তাহলেই আমার লাভ টা ষোলআনা হতে পারে।'
বুড়ো আন্দালিব বলল, 'জীবন মরন তো সব ঐ খোদা তা'লার হাতে। কিন্তু আমি একজন খাঁটি মুসলমান। আমাকে তুমি কোন অন্যায় কাজ করতে বলো না।'
আবুআলি তাকে আশ্বসত্দ করল, ' সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিনত্দ থাকতে পার।'
আন্দালিব ক্রীতদাস হলে কী হবে বয়সটাতো তার আন্দাজ আর কম হয়নি। ফলে আবুআলি কে সে মনে মনে একরকম প্রথম দিনেই পড়ে ফেলল। তাই ভয়ে ভয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক তার। আর সে জন্যই বোধহয় প্রথম দিনেই 'বেড়াল মারার' কাজটা সেরে ফেলল সে।

কিন্তু আন্দালিবের জানা ছিল না চালাক লোকের কথার ফাঁদে বেড়াল ঠিকই পার পেয়ে যায়। সময় মতো খোল নৈচে পাল্টে রূপ বদল করতে মোটেও সময় লাগেনা তাদের।

পরদিনই বোঝা গেল আবুআলির কৌশলটা ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম; যা আন্দালিবের পৰে বোঝা মোটেও সম্ভব ছিল না। তার বয়সের দ্বিগুণ সময় পার করলেও আবুআলির কৌশল বোঝা যে আন্দালিবের কর্ম নয় তা পরিস্কার হল তার কাছে।
আবুআলি আন্দালিব কে সাজাল বুড়ো যাদুকর। তাকে সে পরাল লাল হলুদ নকশা কাটা ঢিলেঢালা একটা আলখালস্না; গলায় একটা বড় জপমালা। মাথায় বড় বড় জটা ধরা নকল চুলের টুপি। খাইয়ে দিল একটুখানি জ্ঞান লোপ পাওয়ার আরক মিশ্রিত সুরা। তারপর তাকে তার ঘোড়ার গাড়িতে তুলে সে শহরের অভিজাত পলিস্নতে যেয়ে হাজির হল। সেখানে সে একটা অভিনব কাজ করল। সে পাড়ায় পাড়ায় যেয়ে চেঁচাতে শুরম্ন করল, 'বুড়ো আছে গো , বুড়ো ক্রীতদাস আছে। তোমরা কেউ নেবে নাকি গো।'
দুপুর রোদে আবুআলির এই অভিনব হাঁকডাক আর চিৎকারে সবাই অবাক হল। এমন কথা কেউ কোনদিন শোনেনি। ক্রীতদাস বিক্রির আলাদা হাট আছে কিংবা রাসত্দার মোড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো হল। পাড়ায় এসে এমন হাঁকডাক তো মোটেও শোভা পায় না। উপরন্তু একজন বুড়ো মানুষ কে নিয়ে এমন তামাশা কারই বা সহ্য হয়।
শেষে এক বুড়িমেয়ে, সে আবুআলির বিশেষ পরিচিত ছিল। মেয়েটি বাইরে এসে চেঁচিয়ে আবুআলিকে বলল, 'বাবা আবুআলি, তোমাকে আমরা এতদিন ভাল লোক বলেই জানতাম। কিন্তু আজ তুমি কাণ্ডটা কী করছ বল দেখি? বুড়ো মানুষ! হলোই বা তোমার ক্রীতদাস। তাই বলে তাকে নিয়ে পথে পথে তামাসা করে বেড়াতে হয়?'
আবুআলিও এমন একটা মওকা ধরার জন্যই অপেৰায় ছিল। বুড়ির কথা শুনে সেও চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'থাম থাম বুড়িমা, অল্প সাধে এমন করছি ? একি যে সে বুড়ো ! নিতানত্দই দায়ে পড়ে বিক্রি করছি। একে যে পাবে সেই বড়লোক হয়ে যাবে।'
'এঁ্যা বল কী, সে আবার কেমন কথা!' অবাক হয়ে বলল বুড়ি।
তার কথা শুনে আবুআলিও ঝোপ বুঝে কোপ মারল। বলল তখন সে , 'শোন তাহলে, শোনঃ

এ বুড়ো তো জাদুর বুড়ো, যে-সে বুড়ো নয়।
দেখলে পরে পরখ করে বুঝবে পরিচয়
যাদু-বিদ্যা তন্ত্র-মন্ত্র সবকিছু তার জানা
ইচ্ছে হলেই নিতে পার নেইযে মোটে মানা।


আবুআলির কাছ থেকে সব শুনে বুড়ি মেয়েটা চারদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, 'তাহলে তো বাবা আমার একটা কথা জানার ছিল।'
'উঁ হুঁ, সেটি হচ্ছে না বুড়িমা, জানতে হলে একটাই উপায়। আর সেটা হল এ বুড়ো কে আগে কিনতে হবে।' সোজা সাপ্টা বলে দিল আবুআলি।
বুড়ি বুঝল আবুআলি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। তাই বুড়ি বুদ্ধি করে বলল, 'বাড়ির কর্তা ফেরত না এলে তো আমার এখন কেনার উপায় নেই, তাও একবার দামটা শুনে রাখি। কত চাও তুমি ঐ অচল অথর্ব ক্রীতদাস বুড়োটাকে?'
আবুআলি তখন বলল, 'সে তুমি অচল অথর্ব যাই বলো না কেন, আমার বুড়োটাকে নিতে চাইলে দিতে হবে তোমাকে একশো একটা মোহর।'
শুনে বুড়িতো চোখ মাথায় তুলে বলল, 'বলি তোমার মাথায় কী পোকা লেগেছে, আর আমাকেও এদিকে পাগলা কুকুরে কামড়েছে; যে তুমি বললেই এনে দেব। মোহর তো আর ছেলের হাতের মোয়া না যে তুমি চাইলেই তোমার হাতে তা তুলে দিলাম।'
তারপর তার নেকাবের ফিতে টেনে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বুড়ি আপন মনেই গজড়াতে লাগল, 'কোথাকার কোন বুড়ো হাবড়া ; যাকে কেউ চেনে না জানে না তার দাম হাঁকিয়েছে একশ এক মোহর। যেন গাছের খেজুর, পেড়ে এনে দিলেই হল।'
বুড়িও তো আর যে সে বুড়ি না। বাগদাদের এক ধণাঢ্য পরিবারের কর্ত্রী সে। স্বামী বুড়ো হয়ে গেলেও বাণিজ্যের নেশা আজও কাটেনি তার। সময় সুযোগ পেলেই বণিজ্য বহর নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রায় পাড়ি জমায় সে। আর তখনকার দিনে সমুদ্র যাত্রায় পাড়ি জমানো মানেই ফিরে আসা প্রায় অনিশ্চিত। কেননা যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গেলে তেমন কিছু ছিল না। যাত্রা পথে সমুদ্রে ঝড় কিংবা জলদসু্যদের কবলে পড়ে প্রাণ হারানো ছিল নিতানত্দ মামুলি ব্যাপার। তাও সে খবর পেঁৗছানোটা ছিল আরও ঝক্কি। অনেকদিন নিখোঁজ থাকলে ধরে নেয়া হতো হয় কোথাও ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে নতুবা জলদসু্যদের হাতে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সুতরাং প্রিয়জনের খবর জানার উপায় ছিল একটাই আর তা হল ফিরতি কোন বাণিজ্য বহর যদি ঐ পথ দিয়ে ফেরত আসে। তাও সেটা ছিল অনিশ্চিত। আর তাছাড়া অন্ধকারে বসে থেকে থেকে গণক-কবিরাজের কাছে যেয়ে ধরনা দেয়া। তাদের করা তন্ত্র-মন্ত্র ও জাদু-টোনার উপর বিশ্বাস করেই মানুষ দিন গুণত। বুড়ির স্বামী দীর্ঘ দিন হল প্রবাস যাত্রা করেছে। খোঁজ-খবর তেমন নেই তার। আবুআলিরও সেটা আগে থেকেই ভাল জানা ছিল। আর চালাকি ব্যবসায় সবার খোঁজ-খবর রাখাটাই সবচেয়ে জরম্নরি। আবুআলির কাজই ছিল সবার হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করে বেড়ান। তাই বুড়ির বাড়ির সামনে এসে পন্য বিক্রির হাঁকামানা ডাক দিয়েছিল সে মোৰম মতই। কৌশলটা কাজেও লেগেছে তার, এখন শুধু শিকার ধরার অপেৰা। কিন্তু আবুআলি লৰ্য করল শিকারটা তার অতি সহজেই হাতছাড়া হয়ে চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে।

'যায় যাক্। সবুরে মেওয়া ফলে।' মনে মনে বলল আবুআলি। তারপর হাট্ হাট্ করে ঘোড়া হাঁকিয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে পড়ল সে। মনে মনে আবার বলল, 'বাগদাদ তো আর একদিনে পৃথিবীর সেরা নগরী হয়ে যায়নি। সময় লেগেছে। আবুআলিও শেষ দেখতে জানে, কে আছে এমন বাগদাদে; কৌশলে যে আবুআলিকে হারাবে।'

দুষ্ট লোকেরা সাধারণত ধৈর্য ধরতেও জানে। ধৈর্য ধরা ছাড়া ভালমন্দ কোন কিছুই যে লাভ করা সম্ভব না এ কথাটা দুষ্ট লোকেরা ভালই জানে। সৎ লোক ধৈর্য ধরে পরহেজগারি লাভের জন্য আর দুষ্ট লোকেরা তা কাজে লাগায় লোক ঠকানোর জন্য।
এদিকে আন্দালিব বুড়ো হলেও একেবারে অথর্ব হয়ে যায়নি। আবুআলি তাকে যতই আরক মিশ্রিত সুরা পান করাক না কেন পুরো জ্ঞান তার কখনোই লোপ পায়নি। ফলে গাড়ির মধ্যে বসে সে আবুআলির কৌশল গুলো লৰ্য করেছে আর মনে মনে তাজ্জব হয়েছে । কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারেনি যেহেতু সে ক্রীতদাস।
বাড়ি ফিরে এসে আন্দালিব আবুআলিকে বলল, 'দেখ, তোমাকে আগেই বলেছি আমি একজন খাঁটি মুসলমান। আমাকে তুমি মানুষ ঠকানোর কাজে লাগালে সেটি হবে খুবই অন্যায়। তোমার মত বন্ধু পাওয়ার চেয়ে আমার কাছে নিষ্ঠুর মনিব অনেক ভাল।'
আবুআলি তাকে বলল, 'এটা হল আমার ব্যবসার কৌশল। কৌশল না খাটালে ব্যবসায় বেশি লাভ করা যায় না। আর আমি তোমার বন্ধু; তাই তোমাকে আমি একজন ভাল লোকের হাতে তুলে দিতে চাই।'
'মিথ্যা কথা বলে প্রতারণা করার নাম কৌশল হতে পারে না। ' বলল বুড়ো আন্দালিব। তারপর তার স্বভাবসুলভ খুক্ খুক্ করে একটু কেশে নিয়ে আবার বলল সে, 'হতে পারি আমি একজন বুড়ো ক্রীতদাস। কিন্তু জ্ঞানবুদ্ধি তো একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি আমার। অন্যায়টুকু বোঝার ৰমতা তো আছে আমার, নাকি?'
তার কথা শুনে আবুআলি মনে মনে ভীষণ চটে গেল। কিন্তু চালাক লোক তার রাগ সহজে প্রকাশ করে না। তাকে সহজে রাগানোও যায় না। আবুআলিই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন। কিছু একটা ভেবে নিয়ে সে বলল, 'ঠিক আছে অন্যায় যদি হয়েই থাকে আমার তাহলে এবারই শেষ। তোমার সাথে এমনটা আর করব না।'
বুড়ো মানুষ। সহজ-সরল; তা ছাড়াও সে একজন ক্রীতদাস। আবুআলির চাটুকারিতাপূর্ণ কথায় বিশ্বাস করে চুপ করে রইল। আবুআলি কিন্তু মনে মনে আরেক ফন্দি এঁটে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।
পরদিন আবুআলি আন্দালিব কে বাড়িতে রেখে একাই বের হল বাগদাদের রাসত্দায়। এই দিন সে ছোট এক বাচ্চা ছেলেকে বুড়ো সাজিয়ে তুলে নিল তার গাড়িতে। গরিব এই ছেলেটিকে কিছু অর্থের বিনিময়ে রাজি করাল তার সাথে যেতে।
ওদিকে বুড়ি কিন্তু তার নিখোঁজ স্বামীর খোঁজে প্রাণানত্দকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। সবে মাত্র আবুআলির কাছ থেকে জাদুর বুড়োর সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই তার মনটা যারপরনাই আনচান শুরম্ন করেছিল। বিশেষ করে গতদিন আবুআলি কে বিদায় করে দেয়ার পর থেকেই তা আরও তীব্র হয়েছে। বার বার রাগে তার নিজের মাথার চুল নিজেইর্ িছঁড়তে ইচ্ছা করছিল। রাতে ভাল ঘুমও হয়নি তার। আবুআলিও বুড়ির খবর ভালই জানত। চালাকি যারা করে তাদের ওটুকু জ্ঞান না থাকলে চালাকিটা ষোলআনা জমেও না। আবুআলির তা ছিল।
সে বুড়ির বাড়ির ফটকের কাছাকাছি এসেই একবার জোরে হাঁক দিল, 'বুড়ো আছে গো , বুড়ো ক্রীতদাস আছে।'
আর যায় কোথায় বুড়ি সে কথা না শুনেই ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে আবুআলিকে সামনে পেয়েই বলল, 'কই তোমার সেই বুড়ো?'
শুনে আবুআলি যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, 'কোন বুড়ো?' তারপর ভান ভণিতা করে বলল, 'ও তোমার কালকের সেই বুড়ো? সে বুড়ো তো বিক্রি হয়ে গেছে কালই। আজ এ অন্য বুড়ো, সামান্য দামে পেয়েছি; তাই বিক্রি করে দিচ্ছি। কেউ যদি অল্প দামে কিনতে চায় কিনতে পারবে। সবাই তো আর বেশি দাম দিয়ে ক্রীতদাস কেনার সামর্থ রাখেনা। তা তুমি চাইলে কিনে রাখতে পার। খুব কম দাম, মাত্র একশ এক দিনার। একশ দিনারে কিনেছি আর এত খাটুনি খেটে লাভ থাকবে আমার মাত্র এক দিনার।'
সব শুনে বুড়ি বলল, 'যাহ্! কার কাছে বিক্রি করে এসেছ ঐ জাদুর বুড়োটাকে?'
বুড়ির কথা শুনে আবুআলি তখন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলল। তারপর সে নাকের পানি আর চোখের পানি মুছে বলল, 'সে আর কী বলি বুড়ি মা , তোমাকে দিতে চাইলাম মাত্র একশ এক মোহরে তুমি নিলে না। তারপর সারাদিন ঘুরে যখন আমার বাড়ি ফেরার সময় হল তখন এক আরব ব্যবসায়ীর নজরে পড়ে গেল বুড়োটা। আর যাই কোথায় সে শুধু বলল, তুমি কত চাও? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম পাঁচশ মোহর হলেই আমি দিতে পারি। কোন কথা তো নেইই দাম দস্তুরও করল না সে। তার কোমরে বাঁধা চামড়ার থলি খুলে সঙ্গে সঙ্গে গুণে আমাকে পাঁচশোটা মোহর বের করে দিল। সেই সাথে আরও একশ মোহর বেশি দিল বখশিশ হিসাবে।'
আবুআলির গাল গল্প শুনতে শুনতে এদিকে বুড়ির কিন্তু ভিতরে ভিতরে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ না হতেই বুড়ি চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'পাঁচশ কেন দরকার পড়লে হাজারটা মোহর দেব কিন্তু যে ভাবেই হোক আমার সেই বুড়ো কে চাই।'

আবুআলি তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় করে বলল, 'কিন্তু তা কী করে সম্ভব ? সেই আরব ব্যবসায়িদের কাফেলা তো গতকালই তাদের তাবু গুটিয়ে দামেস্কের পথে রওনা হয়ে গেছে।'

বুড়ি তো এমনিতেই রেগে ছিল। আবুআলির কথায় তাতে যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়ার উপক্রম হল। ভিষণ ৰেপে গিয়ে সে আবার বলল, 'তারা দামেস্কেই যাক আর পারস্যেই যাক আমার সেই বুড়োকেই চাই।'

আবুআলি মনে মনে বুঝল মওকা ভালই মেরেছে সে। এবার শিকার ধরার পালা তার। তাই বিড় বিড় করে একটা হিসাব কষতে শুরম্ন করে দিল সে বুড়ির সামনেই। 'এঁ্যা এঁ্যা দামেস্কের পথে রওনা হতে গেলে চাই আমার একটা দ্রম্নতগামী ঘোড়া আর পথ খরচ যা আসে তাই। আরব ব্যবসায়ী কী রাজি হবে তাকে বেচতে? দামটা আবার কত নেবে কী জানি?' ইত্যাদি ইত্যাদি।
বুড়ি বুঝল আবুআলি অগ্রিম কিছু চায়। তাই আর দেরি করল না সে। বলল, 'একটু দাঁড়াও আমি এক্ষুণি ভিতর থেকে আসছি।'
ভিতর থেকে আসছি মানেই চতুর আবুআলির আর বুঝতে বাকি রইল না শিকার তার হাতের মুঠোয়। মনে মনে সে একটা গান ভাঁজতে শুরম্ন করল। বেদুইনরা সাধারণত পাহাড়ে, গিরি-কন্দরে কিংবা উপত্যাকায় পশু চরাতে যেয়ে যে গানগুলো করে আবআলির তা খুবই প্রিয়। মনে মনে সে এক দানেই বিশাল বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন যেন দেখতে শুরম্ন করল।
কিছুৰণের মধ্যেই বুড়ি ফেরত এসে আবুআলির হাতে এক হাজার মোহরের একটা থলিয়া তুলে দিয়ে বলল, 'নাও এখানে পুরো একহাজার মোহর আছে। লাগলে আরো দেব কিন্তু যে করেই হোক কালকের সূর্যাসত্দের আগেই আমার সেই বুড়োকে এনে দিতে হবে। গর্দানের উপর মাথা যদি রাখতে চাও তাহলে এর বাইরে অন্য কোন কথা আর হবে না তোমার সাথে আমার।'
আবুআলি কম্পিত হাতে মোহরের থলিয়াটা নিয়ে বলল, 'আমার গর্দান আর তোমার জবান এর বাজি থাকল নিশ্চয় সে বুড়ো কে আগামী কাল সন্ধ্যার আগেই এখানে এনে হাজির করব। তবে এর মধ্যে খোদা-তা'লার অন্য কোন ইচ্ছা যদি না থাকে।'
বুড়ি আবার চোখ পাকিয়ে বলল, 'কিন্তু সাবধান কথার যেন একটুও নড়চড় না হয়।'
আবুআলি বলল, 'তা তো নিশ্চয় হবে না। তবে একটা কথা ও বুড়ো খুবই ধর্ম প্রাণ আর সৎ-মানুষ। তার সামনে তাকে নিয়ে দর-দস্তুর করাটা মোটেও ঠিক হবে না। তাহলে হয়তো এখানে সে আর থাকতেই চাইবে না।'
বুড়ি তাকে আশ্বসত্দ করে বলল, 'সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। দাম-দস্তুর যা হবে তা শুধু তোমার আর আমার মধ্যেই থাকবে। বাইরের কাক পৰিটাও জানতে পারবে না।'


আবুআলি মোহরের থলিয়াটা হাতে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরে এল। তারপর আন্দালিব কে ডেকে বলল, 'তাহলে তোমার কথাই থাকল। অন্যায় মোটেও করা যাবে না। আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি মিথ্যা বলা আর প্রতারণা করা একেবারেই ছেড়ে দেব আমি। আমি এতদিন ভুল করে যা করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে কালই আমি তোমাকে কোন বিনিময় ছাড়াই ঐ বুড়ির হাতে তুলে দেব। এটাই আমার শেষ সিদ্ধানত্দ।'
আবুআলির এ কথা শুনে বুড়ো আন্দালিব মনে মনে নাখোশ হল। বলল, 'তুমি আমাকে অর্থ-ব্যয় করে কিনেছ। প্রাপ্য অর্থ বুঝে নিয়েই দাও অথবা নিজের কাছেই রেখে দাও। আমার জন্য ৰতি করো না নিজের। খোদা আমার জন্য যা ব্যবস্থা করে আমি তাতেই সন্তুষ্ট।'
বুড়ো আন্দালিবের কথা শুনে আবুআলি কেঁদে ফেলে বলল, 'তা হয় না আন্দালিব; এ আমার পাপের ফল। এর প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে। আমার কাজে তুমি আর বাধা দিও না আন্দালিব। তবে একটা কথা বুড়ি তোমাকে সেই বেশবাসেই আবার দেখতে চেয়েছে।'
আন্দালিব এবার অবাক হয়ে তাকাল আবুআলির দিকে। আবুআলিও বুড়ো আন্দালিবের মনের ভাষা বুঝে নিয়ে বলল, 'ঐ সেদিন যে পোশাকে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে।'
মৃদু হেসে আন্দালিব বলল, 'আমি একজন সামান্য ক্রীতদাস। আপনি আমার মনিব। আপনি আমাকে যে পোশাক পরাবেন তাতেই আমি আনন্দিত। যে খানা খাওয়াবেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট।'
পরদিনই আবুআলি আন্দালিব কে আবাার যাদুকর সাজিয়ে বুড়ির কাছে রেখে এল। তারপর তফাতে যেয়ে বুড়িকে বলল, 'সেই আরব ব্যবসায়ী তো বুড়ো কে দেবেই না। অনেক বলা-কওয়ার পর শেষে দিতে রাজি হল ঠিকই কিন্তু দামটা কত হাঁকায় জান তুমি? পুরো পাঁচ হাজার মোহর।'
বুড়ি শুনে তো চোখ মাথায় তুলে বলল, 'বাপস্ এটা কী মগের মুলুস্নক ? যে যা ইচ্ছা তাই চাইবে?'
'কিচ্ছু করার নেই বুড়িমা, এটা ব্যবসা। আবার এদিকে আমারও বুড়োকে চাই। দাম সে যাই হাঁকাক। তাই বাধ্য হয়েই মোহরের থলিয়াটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম এর বেশি আর কিছুতেই পারব না।' বলল আবুআলি।
'তারপর?' উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠে বলল বুড়ি।
'তারপর আর কী, সে তখন বলল; বুড়ো কে তাহলে রেখে যাও। বিক্রি করব না। ভাগ্যিস মনে মনে পকেটে করে আরও একহাজার মোহর সংগে নিয়েছিলাম। সেটা বের করে দিয়ে পকেট উল্টে দেখিয়েও দিলাম আর কিছু নেই পকেটে, তারপরও সে নাছোড়বান্দা। শেষে আর কী করা জামার গোপন জায়গায় সেলাই করে রাখা ছিল পাঁচশো মহর; সেটা বের করে দিলাম, তবেই শুনল সে।' বলল আবুআলি।
আবুআলির কথা শুনে বুড়ি মনে মনে বুঝল আরও দেড়হাজার মোহর খসবে তার মোহরের ঝোলা থেকে। বুড়ো আন্দালিব কে পাওয়ার আনন্দে বুড়ি তাই খরচ করতে রাজি হয়ে গেল সেদিনও। তারপর আবুআলি আরও দেড়হাজার মোহর পকেটে পুরে বাড়ির পথে রওনা হয়ে পড়ল।

এদিকে বুড়ি আন্দালিব কে পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে তার খেদমতের কোন ত্রম্নটি রাখল না। শেষে যখন রাত নামল বুড়ি তখন আন্দালিব কে বড় বিনয়ের সাথে বলল, 'আমার গৃহস্বামী আবু তালিব আজ ছ'মাস হয়ে গেল সমুদ্র যাত্রায় যেয়ে নিখোঁজ। তার কোন সংবাদ যদি তুমি দিতে পার তাহলে আমার জীবনটা ধন্য হয়ে যায়।'

বুড়ো আন্দালিব মনে মনে বুঝল আবুআলি আবার তাকে ঠকিয়েছে। কিন্তু অসহায় আন্দালিবের তখন কিছুই করার নেই। এমনিতে সে বুড়ো তার উপর ক্রীতদাস। ভয়ে কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল সে, 'আমি সামান্য ক্রীতদাস। নাদান মূর্খ, বুড়ো হয়েছি সত্যি কিন্তু আজও আমার সাবালকত্বের নিদর্শন সরূপ একটা চুলও গজায়নি। যাদু টোনাও কিছুই জানি না। আমার পৰে কীভাবে সম্ভব তোমার এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেয়া।'

বুড়ি নাছোড়বান্দা। বলল, 'পির-দরবেশদের এমন কৌশলের কথা আমি আগে থেকেই জানি। তারা নিজেদের লোকচক্ষুর অনত্দরালে আড়াল করে রাখে। সব জেনেও না জানার ভান করে। কিন্তু আজ আমি অসহায়, না হলে আর এমনি করে কষ্ট দিতাম না। তোমার জন্য আমি অনেকগুলো মোহর খরচ করে ফেলেছি , একটু কী দয়া হয় না আমার জন্য।'
বুড়ির কথা শুনে আন্দালিব কেঁদে ফেলল। এমন কঠিন বিপদে সে জীবনে আর কখনো পড়েনি। উদ্ধার পাওয়ার পথও তার জানা নেই। বৃদ্ধ হয়েছে সে ঠিকই কিন্তু ক্রীতদাস বৃত্তি করতে করতেই জীবন গেছে। কৌশল-রসিকতা-চালাকি, এ সবের কিছুই সে আজ পর্যনত্দ জানে না। কান্না থামিয়ে একসময় সে বলল, 'মালিকিন্ আমি নাচার। আমাকে তুমি মাফ করে দাও। আমি এ কাজ পারব না।'
কিন্তু বুড়ি মালিকিন এতকিছুর পর আর কী শুনতে চায় সে কথা। সে নাছোড়বান্দার মতো আবার বলল, 'না না তা হয় না। তোমাকে বলতেই হবে, আমি মোটেও শুনছি না কোনই ওজর আপত্তি। আজ না পার রাত ভোর করে কাল সকালে, তাও যদি না হয় আগামী কাল সন্ধ্যায়। কিন্তু তোমাকে যে পারতেই হবে।'
বুড়ির কথা শুনে আন্দালিব বুঝল বাঁচার শেষ আশ্রয়স্থল টা তার অনেক আগেই শেষ করে রেখে গেছে চতুর আবুআলি। এখন তার সামনে শেষ একটাই উপায় আছে আর তা হল খোদার কাছে আশ্রয় চাওয়া। আন্দালিব তাই করল। সারারাত না ঘুমিয়ে সে খোদার কাছে এর প্রতিকার চেয়ে কঠিন এবাদতে মশগুল হয়ে পড়ল। না, আবুআলির সে কোন ৰতি চায় না। তার একটাই চাওয়া; এই কঠিন বিপদের দিনে খোদা যেন তাকে অপদসত্দ হওয়ার হাত থেকে রৰা করে।
এদিকে আবুতালিব জলদস্যুদের হাতে বন্দি হয়ে আটকা পড়েছিল দীর্ঘদিন। কাকতালীয়ভাবে সে রাতেই তার ফিরে আসার দিনৰণ ঠিক হয়েছিল। রাতভোর না হতেই আবুতালিব স্ব-শরীরে ভূত দেখার মতই হাজির হল নিজ বাড়িতে। আর এই ঘটনার পর পরই চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল। বুড়ির নূতন কেনা ক্রীতদাস ছদ্মবেশী পির আন্দালিবেরই কাজ এটা। ফলে সবাই ছুটে এল বুড়ির বাড়িতে। দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরা সদ্য জলদসু্যদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া আবুতালিব কে দেখতে নয়; বরং আন্দালিব কে দেখতেই ছুটে এল সবাই। অনেকে পানি পড়া আর তাবিজ কবচ নিতেও ছুটে এল। কিন্তু বুড়ির কড়া নির্দেশ থাকায় বুড়ো আন্দালিব এক প্রকার সাময়িক বেঁচে রইল তাদের হাত থেকে।
এর পরের ঘটনা অতি সংৰিপ্ত। আন্দালিব প্রমাদ গুণল। আবুআলির চাপিয়ে দেয়া কিমভুতকিমাকার পোশাক আসাক আর অদভুত বেশবাসই আরও কাল হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। এর উপর বাড়তি যা চেপেছিল তা হল সম্মান, একজন ক্রীতদাসের পৰে যা কখনো আশা করাও পাপ। অথচ তার আসল পরিচয় প্রকাশ পেলে কী যে নাকাল অবস্থা হবে তা ভেবে সে ছিল উদ্বিগ্ন।
শেষে এক রাতে গৃহস্বামী আবুতালিব কে একাকী পেয়ে আন্দালিব তার মনের কথা সবই খুলে বলল। আবুতালিব সাতঘাটের পানি খাওয়া আর দেশ বিদেশ চষে বেড়ান লোক। আন্দালিবের কথার মর্মার্থ সবই বুঝল; আর এও বুঝল এখন আন্দালিবের এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য আর কোন উপায় নেই। যোগ্য লোক যোগ্য কাজই করে। সেই রাতেই আবুতালিব আন্দালিব কে মুক্ত করে দিল। এরপর তার আসত্দাবল থেকে সবচে' দ্রম্নতগামী আরাবি ঘোড়া আর সাথে একশ মোহর আন্দালিবের হাতে তুলে দিল। তারপর বলল, 'আজ রাতেই তুমি যে ভাবেই পার এই বাগদাদ ছেড়ে পারস্যের পথে রওনা হয়ে পড়। আর কোনদিন এ মুখো হয়ো না যেন।'
আন্দালিব আবুতালিবের হাত থেকে ঘোড়া আর মোহরের থলিটা বুঝে নিয়ে মনে মনে বলল, 'একজন ক্রীতদাসের জীবনে কোন বন্ধু নেই; কিন্তু বন্ধু যদি কেউ থাকে তার তবে সে আবুআলি নয় আবুতালিবই।' তারপর সে আর দেরি করল না। সেই রাতেই আরবি ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা হয়ে পড়ল পারস্যের পথে। আমাবস্যার রাত , দেরি করা তো মোটেও যায় না আর। কেননা সকাল হওয়ার আগেই তাকে পারস্যে ঢুকে পড়তে হবে। এই প্রথম সে মুক্ত জীবনের স্বাদ মনে মনে উপলব্ধি করতে লাগল।

আন্দালিবের ঘোড়া আজও ছুটছে কালও ছুটছে। তোমরা কেউ যদি তাকে দেখতে চাও। তবে খুব সহজ একটা পদ্ধতি হল এই। সোজা চলে যেতে হবে বাগদাদ। তারপর খুঁজতে হবে গিরিপথ ধরে পারস্যে রওনা হওয়ার সহজতম পথটি। এরপর ওঁত পেতে বসে থাকতে হবে রাত-বিরেতে। কপালে থাকলে দেখা মিলে যাবে আন্দালিবের।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Rahela chowdhury লেখাটি পড়ার সময় অমার মনে হচ্ছিল লেখক নিজে যেন সেই সময় উপস্থিত ছিলেন।অসাধারণ লেখা।
বিন আরফান. আপনাকে আমি রূপ কথার গল্পকার হিসাবেই চিনি. বরাবরের মত অসাধারণ ই লিখেছেন. শুভ কামনা রইল. আবার এসব আসতে যে হবেই শিক্ষার ব্যাপারটি তো প্রবীনদের নিকট থেকেই আসে.
Ruma অনেক অনেক ভালো ।
প্রজাপতি মন অনেক সময় এবং ধৈর্য সহকারে আপনার গল্পটি পড়লাম, মনে হচ্ছিল আমার শৈশবে পড়া আরব্য রজনীর কোনো গল্প পড়ছি, অনেক ভালো লাগলো. লেখনি এবং কল্পনাশক্তিও যথেষ্ট প্রশংসনীয়.
আহমেদ সাবের ভাই, আপনার কোন লেখা এবারই আমি প্রথম পড়লাম এবং সাথে সাথেই আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম। দেখলাম, আপনার লেখার সংখ্যা ৬টি। কি করে আপনার বাকী লেখা গুলো মিস করলাম, বুঝতে পারছি না। ঠিক করেছি, বন্ধু সংখ্যার সব গুলো লেখা পড়ার পর (আরো প্রায় ৬০ টি লেখা বাকী), আপনার সব গুলো লেখা পড়বো।
সূর্য বরাবরের মতই আপনি আপনার ধারাটা ধরে রেখেছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন, এখানে আপনি আপনার একটা স্টাইল সৃষ্টি করতে পেরেছেন? তবে আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করব: গল্পের পরিসর (আয়তন) ছোট করলে সুবিধে হয়, মনিটরে বেশি বড় গল্প পড়তে কিন্তু বেশ অসুবিধে।
এমদাদ হোসেন নয়ন Anak sundar akta golpo. Sab samoy bhalo thakun.Anak sundar akta golpo. Sab samoy bhalo thakun.
মোঃ মুস্তাগীর রহমান অনেক অনেক ভালো লাগল.....
নিরব নিশাচর ......................বরাবরের মত অদ্ভুত... বানানে কিছু ভুল আছে... এবার কিন্তু দাদা আমার ঠিকানায় গেলেন না... আসবেন আশা করি ভালো লাগবে...

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী