শৈশবিক কষ্টের ঘ্রাণ

কষ্ট (জুন ২০১১)

প্রজ্ঞা মৌসুমী
  • ৪৭
  • 0
  • ১৪৫
কি বললেন? আমার কষ্ট জানতে চান? চুয়ান্নতম জন্মতিথি যোগ হলো জীবনের খাতায়। কম করে হলেও পৃথিবীতে কাটিয়েছি ১৯,৭১০ দিন- ৪৭৩,০৪০ ঘন্টা। তার মধ্যে কত মিনিট, সেকেণ্ড সুখের ছিল? যদি সুখ-কষ্ট সমানো হয় তবে ২,৩৬,৫২০ ঘন্টার গাঢ় কষ্টের হিসেব। কতরকম কষ্ট; কতো তার ছড়ানো পর্যায়। অতো সময় হবে আপনার আজকে? তাছাড়া ভাবতেও সময় লাগে বৈকি; বয়সতো কম হলোনা বাপু। ঐ দেখো কি বলে। খুব আপন কিছু কষ্ট; যা এতবছর পরেও ঠিক মনে আছে সেরকম কিছু শুনতে চান? আপনি ভীষণ কৌতূহলী পাঠক। এর সংখ্যাও কি কম! কিছু কষ্টের চুলে পাক ধরেছে, দাঁত পড়েছে আমারই মতো, কোন কষ্ট আমার মেয়ের বয়সী। আবার একরত্তি নাতীটার সমান কষ্টও আছে। পুরনো ভীষণ কষ্ট মেলে নাড়াচাড়া করাও তো একধরনের কঠিন কষ্ট পাঠক। ও্‌, বললে হালকা হওয়া যায়! মেঘ দেখতে হালকা, কিন্তু সেলাই ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ভেতরের ভারী জলের দলা। ভারী মেঘে মেঘে ঠোকাঠুকি; আসে দুঃখের বাজ। এতসব সত্ত্বেও বলতে বলছেন? আপনাকে কি বিশ্বাস করা যায় পাঠক? কাউকে বলিনি সেসব কষ্ট কোনোদিন। আমি নিশ্চুপ হতে শিখেছিলাম সেই কবে। স্তব্ধতার কষ্ট আছে জানেন, শব্দেরো যে কষ্ট আছে সেটা জানেন? হয়তো জানেন হয়তোবা না...

আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে তাই না! যাকে বলে বৈশাখী গরম। পাঠক, বর্তমানের আলোটা আরেকটু কমিয়ে দিবেন কষ্ট করে? বড্ড চোখে লাগছে। জানালাটা একটু খুলে দেবেন...একি, কি সুন্দর পূর্ণিমা আজ‌! পৃথিবী কত বদলে গেল, কত দূষিত প্রকৃতি। অথচ দেখুন এত শতাব্দী পরেও চাঁদ কলঙ্ক বুকে নিয়েও সেই একই রকম আছে- তার আলো এখনো কত শুদ্ধ! পূর্ণিমার সাথে হাস্নাহেনার এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। আপনি দেখবেন এই রাতেই ফুলগুলো অন্যরকম হয়ে যায়- আমি বলি 'জ্যোৎস্নার ফুল'। সেইরাতে গন্ধটাও হয় আলাদা- আর সব রাতের মত না- কেমন একটা সুখী সুখী গন্ধ। শব্দ কিভাবে সৃষ্টি হয় পড়েছি বইয়ে, ফুল গন্ধ কি করে সৃষ্টি করে লেখা আছে কোথাও? কষ্ট পেলে আমি জ্যোৎস্নার ফুল হতে চাইতাম, সারা শরীরে ধরে রাখতে চাইতাম সুখী সুখী গন্ধ। একটা জ্যোৎস্নার ফুল না হওয়ার কষ্ট লেগে আছে বুকে...

ঠিক আমার ঘরের জানালার কাছটায়, একটা হাস্নাহেনার ফুলের গাছ ছিল। তার এক ডাল লেগে থাকত জানালার শিক ঘেঁষে। কিশোরী মেয়ের মত কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বলত 'কি করিস?' কখনো বলতো 'তুই আমার সই হবি? রাতে আসিস, তোকে জ্যোৎস্না ফুলের গন্ধ দেব!" রাতে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে হতোনা আমার। কিন্তু বুবুর কঠিন আদেশ জানালা খোলা রাখা চলবেনা- "আইন্ধারে আত্না, জ্বীন-ভূতেরা ঘুইরা বেড়ায়।" ভাবতাম "আত্নারা কি খারাপ?" আমার হাস্নাহেনার ডালে থাকা সেই সইয়ের আত্না- সে কি খারাপ? ও আমায় জ্যোৎস্না ফুলের গন্ধ দেবে। আমি খুব চাইতাম জানালাটা খোলা থাকুক। আমার সই কথা বলুক রাতভর। বাতাসের ভেতর জেগে উঠুক জ্যোৎস্না ফুলের গন্ধ। রাতের আঁধারে সইয়ের সাথে জোলাভাতি না খেলার কষ্ট আছে আমার...

আমার জন্ম সন্ধ্যায়; সেদিন পূর্ণিমা ছিলনা। থাকলে হয়তো আমি হতাম জ্যোৎস্নার ফুল; গায়ে সুখী সুখী গন্ধ। সেবার ছিল দুর্যোগ যাপনের বছর। সারাদেশ জুড়ে উলট-পালট বন্যা। আমরা আটকে পড়লাম 'সুরপুর' গ্রামে। ফুলে তখন লেগে থাকে বিষ। মানুষগুলো হয়ে উঠেছে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। সেবছরই আমার বাড়ির পাশে স্ত্রীর হাতে খুন হলো স্বামী। হয়তো পরকীয়া, হয়তো অব্যক্ত কোন কষ্ট থেকে... আপনি সেদিনো যদি পাঠক হতেন, ঘটনাটা আপনার খুব ভাল জানা থাকত। আপনি জানতেন ওদের ভেতরের কষ্ট। হয়ত গর্ভে থেকে কান পেতে শুনেছি সেসব; পোকায় কাটা ফুলের গল্প শুনে শিউরে উঠেছি।

মাঝে মাঝে স্মৃতি মনে করার খেলা খেলি। কোথাও পড়েছিলাম চাইলে মানুষ জন্মক্ষণ মনে করতে পারে; তবে শুদ্ধ মানুষ হতে হয়। অত শুদ্ধ মানুষ তো নই; অতদূর অতীতে আমি যেতে পারিনা। আমার প্রথম স্মৃতি- আমার পরের বোনটির জন্মদিন। তখন আমি দুই বছরের। ঝাপসা মনে পড়ে- সুন্দর একটা সকাল, শোবার ঘরের বন্ধ দরজা, সেই তালা আটকানোর জন্য সোনালী রঙের কড়া। এ দরজা বহুবার বন্ধ হতে দেখেছি। অদ্ভুত সব রহস্য নিয়ে এ দরজা বন্ধ হত। দরজার ওপাশে যেমন পৃথিবীতে শিশুর আসা নিশ্চিত হয়েছে, তেমনি শিশুর না আসাও নিশ্চিত হয়েছে। 'সুখী পরিবার মানেই ছয় সন্তান' এ মন্ত্রে বিশ্বাসী কিংবা সন্দেহগ্রস্থ বাবা তার অতিরিক্ত পুত্রের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, গর্ভধারিণী করেছে গর্ভনাশ ঠিক ওখানে; বন্ধ দরজার ওপাশে। অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে এক গর্ভজাত ছেলের কোমল হাত-পা; অনেকটা মুরগীর মত করে। সেই মা কতদিন মুরগী খেতে পারেনি, অপরাধবোধ নামক কষ্ট বয়ে বেড়িয়েছে জীবনে। কষ্ট বড় হতে হতে, কত বড় হতে পারে? সেই বন্ধ দরজার কষ্ট আর আমার কষ্ট এক হয়ে যায়।

আমি সেই কয়েক ইঞ্চি শিশুটির কথা এখনও ভাবি। সে কি শুদ্ধ মানুষ হয়ে জন্মাত, বড় হতো? নাকি দূষণের হাওয়া তাকেও দূষিত করত...তার আত্নাকে? তাকে না জানার কষ্ট আছে আমার। শরীরের ভগ্নাংশকে চাপা দেয়া হয়েছিল পুরোনো লেবুগাছের নিচটায়। সে গাছের কড়া লেবুফুলের গন্ধ এখনো যেন পাচ্ছি। আচ্ছা, লেবুগাছের কষ্ট আছে কিনা আপনি পড়েছেন কোথাও? বেশি কষ্ট হলে ওর গন্ধ খুব তীব্র হয় অথবা কষ্টের তারতম্যে গন্ধেরো রকমফের হয় কিংবা মাটি থেকে শুদ্ধ শিশুর গন্ধ নিয়ে জন্মাতে পারে লেবুফুল...এরকম কিছু আপনি পড়েছেন?

আচ্ছা, কি যেন বলছিলাম? দেখুন তো সব উলট-পালট করে ফেলছি। কি বললেন? ওহ্‌ খুনের কথা...হ্যাঁ, সেই খুন না হলে আমার জন্মই হতোনা। জবাই করে শরীরটা পুঁতে ফেলা হয় বটগাছের নিচে আর মাথাটাকে ভাসিয়ে দেয়া হয় বন্যার পানিতে। প্রায় ভাবি সেই শরীরবিহীন চোখের দৃষ্টি কেমন ছিল? বন্ধ ছিল নাকি তাকিয়ে ছিল কারো দিকে বিস্ময়কর কষ্ট নিয়ে? বসতির ইতিহাসে সে ছিল এক আশ্চর্য ঘটনা। খুনের বাড়ি স্বচক্ষে দেখতে লোক আসছে...যাচ্ছে। আমিও আসতে চাই চাঞ্চল্যকর এই পৃথিবীতে মানুষের কষ্ট দেখতে। আম্মা কষ্টে মাটিতে উঠি-বসি করছে। আব্বা বন্যার জন্য আটকে পড়েছে দূরের কোন এক জেলায়, রাজশাহীতে বোধহয়। আম্মার কষ্ট দেখে বাচ্চা ভায়েরা কাঁদছে। আশেপাশের মানুষ মৃত্যু নিয়ে আপ্লুত; তারা নতুন জন্ম নিয়ে ভাবছেনা। বাবা-মা চাইলেই পৃথিবীতে সন্তান আসেনা। জীবন দিতে লাগে আরো দুটি হাত। আবার সেইসাথে দরকার হয় ঈশ্বরের হাত। দাইয়ের জন্য ছুটোছুটি হচ্ছে, দাই মিলছেনা। একজন পাওয়া গেলো, তিনি আসতে পারবেন না কারণ তিনি ব্যস্ত নতুন ঘরে টিনের চাল তুলতে। কষ্টের সেকেন্ড পার হয়...পার হয় দুদিন। পৃথিবীতে আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রতি সেকেণ্ডে।

অতঃপর অমাবস্যার ফুলকে পৃথিবীতে আনতে, চলে এলো ঈশ্বরের হাত আর প্রিয় এক জ্যোৎস্নার ফুল- আমার দাইমার হাত। তিনি নিঃসন্তান মেয়েকে নিয়ে ফকির বাড়ি যাচ্ছিলেন। মেয়ের শখ হলো খুনের বাড়ি দেখবে। ফেরার পথে এক অদ্ভুত রহস্যময় জীবনের টানে তিনি এসে দাঁড়ান আমার ঘরের সামনে, জিজ্ঞেস করেন "কি হইছে এইখানে? এত তামিশ কেন্‌?" এক নারী- সন্তান নেই বলে কষ্ট পাচ্ছে, ফকিরের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে; আরেক নারী সন্তান ধারণ করেও পৃথিবীতে আনতে পারছে না। একজনের মৃত্যু আরেকজনের জন্ম নিশ্চিত করে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত পৃথিবীর তামিশ... জন্ম হল 'আমি' নামক অস্তিত্বের এই দুঃখময় পৃথিবীতে কষ্টের অভিজ্ঞতা নিতে। পৃথিবীতে এসে আমি কিন্তু কাঁদিনি। 'এত কষ্ট কইরা মরা বাচ্চা!' চিনচিনে কষ্ট আম্মার মুখে ঘামের সাথে লেপ্টে পড়ছে। পানি ঢালা হচ্ছে আমার উপর। সবাই প্রার্থনা করছে 'কাঁদো, কাঁদো, মেয়ে তুমি কাঁদো!" মিনিট দশেক পরে শোনা যায় কান্নার শব্দ। নিশ্চিত আশ্বাস দিই 'এই দেখ আমি কাঁদছি! আমি বেঁচে আছি মা, আমি বেঁচে আছি।" পৃথিবীতে এসে আমরা প্রথমেই কাঁদতে শিখি। না কাঁদা মৃত্যুর সমান। কাঁদা মানেই বেঁচে থাকা। নতুন কান্না শুনব বলে অপেক্ষায় থাকা আমাদের। অথচ দেখুন জীবনের পরের মুহূর্তেগুলোতে কান্না কেমন অস্বাভাবিক। কান্নার ভার কত ভারী!

নীরব থাকার অভ্যাস আমার জন্মগত। নীরবে দাঁড়িয়ে দেখেছি আম্মাকে পেটাতে। বিছানায় ফেলে ছোট একটা কাঠের চেয়ার দিয়ে অনবরত পেটাতে। ঘরময় দমবন্ধ মদের এক কড়া গন্ধ ঘুরে বেড়াত, লাফাতো, হুমড়ি খেতো। সেই গন্ধ আমার মাথাটাকে পাথর করে দিত। ছোট চেয়ারটা পিঠে পড়ত, পিঠ থেকে লাফ দিয়ে উঠে আসত কষ্টের এক গন্ধ। ঠিক যেন কাঁঠাল কাঁঠাল গন্ধ। কষ্টের গন্ধ আমার মাথার পাথরটাকে ভাঙত। একটা পাথর লক্ষ পাথর হত। সেই কষ্টের গন্ধটা আমার কত চেনা। সেতো ঐ চেয়ারের গন্ধ...ঐ চেয়ারটা আমার ছিল; ভীষণ প্রিয় ছিল।আব্বা হেকমত চাচাকে দিয়ে চেয়ারটা বানিয়ে দিয়েছিল। এই চেয়ারেই আয়েস করে বসে সকালে মুড়ি ছড়িয়েছি উঠানে 'আয়রে আয়, বাক্‌বাকুম, বাক্‌বাকুম...' চেয়ারটাও ডাকত 'বাক্‌বাকুম'... আমি বুঝতাম। একসাথে পাখির ডানা ঝাপটানোর রোমাঞ্চকর শব্দ শোনার সাক্ষী ছিল সেও। আয়নার সামনে বসে তার সাথে কত কথা বলেছি সন্ধ্যা-দুপুর। ওর প্রিয় ছিল লালফিতে; সেটা দিয়ে বেণী বাঁধলেই হেসে উঠত। ও দেখেছে সবার সাথে তুলনা করতে করতে, কিভাবে নিজেকে আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করেছি। ভীষণ আক্রোশে হাতের নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছি কালো মুখে। সেই আঁচড়ের শব্দ সেও শুনেছে। এক সাদা গন্ধরাজ হতে না পারার যন্ত্রণায় আমি কেঁদেছি। সেই যন্ত্রণা সেও জেনেছে এবং কেঁদেছে। একটা মুখ কিভাবে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে তার স্পর্শে- সে বুঝেছে এবং কষ্ট পেয়েছে।

আপনি বিশ্বাস করছেন না? কেন নয়? গাছেরো তো জীবন আছে! আপনারাই তো বলেন। আমার চেয়ার শুধুই গাছের মৃত কঙ্কাল ছিল তাই বা ভাবছেন না কেন? কোথাও না কোথাও কঙ্কালের গায়ে আটকে ছিল এক টুকরো জীবন। আটকে ছিল এক টুকরো কষ্ট। সেই কষ্টে ছিল কাঁঠাল কাঁঠাল গন্ধ।

আমি নীরব হবার কষ্ট নিয়ে ঘুরতাম। আমি খুব চাইতাম পিঠের উপর ঝাপটে পড়ে কষ্টের গন্ধ নিই নিজের গায়েও। কিন্তু পারতাম না। ভীতু হবার কষ্ট নিয়ে ঘুরতাম। নীরবে কাঁদতাম। কারো সামনে কাঁদতে আমার লজ্জা হতো। আমি চাইতাম না কেউ আমার কান্না দেখুক, কেউ আমার চোখের পানি মুছে দিক। আমি গোসল-ঘরে কল ছেড়ে দিয়ে কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে কাত হয়ে পড়তাম। কলের জল, চোখের জল এক হয়ে চলে যেত অচিন ছিদ্রে। আমার জোরে কাঁদতে না পারার কষ্ট ছিল।কলের জলের দিকে তাকিয়ে কখনো চাইতাম মদের ভারী গন্ধটা মরে যাক। দূর ছিদ্রের ভেতর দিয়ে চলে যাক দূরে কোথাও- খুব চাইতাম!

কখনো চাইতাম আম্মাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কোনদিন অসহ্য হয়ে আম্মা গোলাপী রঙের ঝুড়িতে কাপড় গোছাতে গোছাতে বলত 'আজকে আমরা চইল্লা যাব।' আহা, 'চলে যাওয়া' শব্দ দুটি কি তীব্র আনন্দের। আমি চলে যেতে চাই বন্ধন ছেড়ে, ছোট্ট একটা পাখির মত। পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে থাকতে আমার দম বন্ধ লাগত। আমার শরীরে মেঘ যেন ভর করত। আমি নৌকা ডাকতে ছুটে যেতাম। কিন্তু কখনই আমাদের যাওয়া হতো না। আব্বা আমাদের যেতে দিতনা। ঘাট থেকে ফিরে যেত কাজীচাচা নৌকা নিয়ে। একটা কষ্টের গুহায় আটকা পড়তাম অসহায় হরিণ ছানার মত। আমরা ভয় পেতাম, আম্মা হয়ত একদিন আমাদের ফেলেই চলে যাবে একা। ছোট ভাই সাদা সুতা দিয়ে হাতের আঙুলের সাথে, আম্মার আঁচল বেঁধে রাখতো। আম্মা উঠলেই যেন টের পাওয়া যায়। একদিন ভোর বেলায় ভাইজান আম্মাকে রেখে আসে নানা বাড়ীতে। আমরা তখন ঘুমে। ঘুম ভেঙে দেখি আম্মা নেই। সাদা রঙের নরম সুতো পড়ে আছে বিছানায় অপরাধীর মত। ঘুম ভেঙে মাকে না দেখার তীব্র কষ্ট নিয়ে বেঁচেছি অনেকদিন। সংসার নামক বস্তুটি কারো অভাবে থেমে থাকেনা। কেউ এসে শূণ্যতা পূরণ করে। একজন নতুন কেউ ঘুমোয় আব্বার ডান পাশের নীল ফুলওয়ালা বালিশটায়, যেখানে আম্মার চুলের মিষ্টি সেই গন্ধ লেগে আছে। অন্ধকার ঘরে ক্ষয় হতে থাকা জোৎস্নাফুলের জন্য বালিশের কষ্ট আপনি কি বুঝতে পারছেন পাঠক?

আম্মা খুব সুন্দর কাঁথা বানাত। খানিকটা ছিড়ে যাওয়া শাড়ি দিয়ে বানানো হতো কোমল কাঁথা বর্ষার দুপুরে। অবশ্য আম্মা খুব যত্ন করে কাপড় পড়তেন; সহজে ছিড়তনা। আম্মা বছরে একটা কাপড় নিত; সেটা রোজার ঈদে। কখনো কখনো তাও নিতনা। রোজার ঈদে আমরা সব ভাইবোন কিছু না কিছু পেতাম। এক ঈদে জুতা নিলে,পরেরবার জামা। দুটো কখনো এক সাথে পাইনি। এতে আমার অবশ্য খারাপ লাগতনা। আমার প্রিয় ঈদ ছিল, যেবার সবাই এমনকি আব্বা-আম্মাও কিছু কিনেছিল। বড়ভাইজান আব্বার জন্য এনেছিল পাঞ্জাবী আর গামছা। আম্মা কিনেছিল বেগুনী রঙের একটা শাড়ি; ছোট ছোট সাদা ফুল বেগুনী জমিনে। কি সুন্দর মানিয়েছিল আম্মাকে। একটু পরপর দৌড়ে এসে পাকের ঘরে আম্মাকে দেখে যেতাম। গলা জড়িয়ে ধরতাম। আম্মা পান মুখে হেসে বলত 'পাগলী আমার, কি করে দেখ। ছাড়্‌ ছাড়্‌, আগুনে পড়বিতো।' আমি আগুনে পড়িনি। তবে প্রিয় বেগুনী শাড়িটা আগুনে পুড়েছিল। আব্বা আম্মার সিন্দুকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। শাড়ির নিচটা অনেকখানি পুড়ে যায়। সেই পোড়া শাড়ি দিয়ে আম্মা সুন্দর এক কাঁথা বানিয়েছিল আমার জন্য। কাঁথাটা ছুলেই আম্মার গায়ের গন্ধ পেতাম। এই কাঁথা গায়ে জড়িয়েই আমি লিখেছিলাম আমার জীবনের প্রথম কবিতা 'আমার চেয়ে ভাল কে জেনেছে তোরে?/ তুই যে আমার নক্ষত্র, আমি আছি তোর বুকেরই 'পরে/ আমার আচঁল উড়েই গেছে রূপকথারই দেশে/ কে বলেছে তোরে?/ হাত ছুঁয়ে দেখ, আমার আঁচল তোর শরীরে ভাসে/ এই যে আমি এখানটাতে বুকের মধ্য জুড়ে...' আম্মার আঁচল জড়ানো কাঁথা বুকে নিয়ে ঘুমাতাম। কষ্টের পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াত সাদা মশারীর ভেতর।

এই দেখো, কষ্টগুলো কখন যে আমার থেকে আমাদের হয়ে গেল। আমরা তো নির্ভরশীল। আমাদের চারপাশ নিজস্ব সুখ-কষ্টগুলোকে প্রভাবিত করে। আমি হয়তো পিছে-আগে করে ঘটনা বলছি। আমি আসলে কখনোই দিন-তারিখ মনে রাখতে পারিনা। আজ কত তারিখ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবনা। সময়েরর হিসেব করা অনেক আগেই ছেড়েছি। পৃথিবী কিংবা জীবন নিয়ে আমার মোহ নেই। পৃথিবীতে এসেছি, দেখেছি। এখন টুপ করে চলে গেলেই বাঁচি। ঠিক যেন একটা মেঘের মত। মেঘের জন্মের খোঁজ কজনে রাখে? বৃষ্টি হলে মেঘ মরে যায়। এতে দুঃখ পায় কে বলুন?

তবে আমি 'বার' মনে রাখতে পারি। আমার জন্ম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। আম্মা যেদিন চলে গেল, সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। সাথী একদিন কেরোসিন খেয়ে ফেলেছিল- দিনটা ছিল শুক্রবার। মুন্সী পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল বুধবারে... আমার প্রথম মৃত্যু দেখার কষ্ট। এক সোমবারে কি সুন্দর একটা গন্ধ ভাসছিল ঘরে, হয়ত ঝোল ঝোল করে রান্না করা কৈ মাছের কোন তরকারী। আমি আপনমনে খেলছি ক্যারামের লাল গুটিটা দিয়ে। গুটিটা আমার খুব প্রিয় ছিল; প্রিয় এক স্বপ্নের মত। হঠাৎ পাশের বাড়ির মকবুল ভাই এসে ছোঁ দিয়ে তুলে নিল প্রিয় লাল গুটিটা। বুকের ভেতর খচ করে উঠল। আমার ছোট হাত সে স্বপ্নের নাগাল পাচ্ছিলনা। মকবুল ভাই বলল ' আমার লগে আয়। এইডা করলে তোরে দিয়া দিমু।' আমি লালগুটিটাকে খুব ভালবাসতাম। একটা লালরঙের স্বপ্নের কাছে পরাজিত হলাম। ভাই সেদিন গোপন খেলার মন্ত্র শিখিয়েছিল...এঁটেল মাটি নিয়ে খেলা। তখন আমার বয়স কত? আট কিংবা নয়। ঠিক করে সব মনেও আসছেনা। না বলতে বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, পানসে অনুভূতি নিয়ে বলছি হয়ত আপনাকে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল। আপনাকে বিস্তারিত বলার দরকার নেই। কারণ এরকম ঘটনা আপনি অনেক পড়েছেন অনেক জীবনে।

ঠিক কতদিন পর জানিনা। এক বৃহস্পতিরবার রাতে সবাই ঘুমে, আমার জেগে থাকার রাত। আম্মা কুলায় করে চাল ঝাড়ছিল। আতপ চালের মিষ্টি গন্ধ আম্মাকে ঘিরে রেখেছিল। আমি বললাম এঁটেল মাটি নিয়ে খেলার কথা 'হে আমার গতরো হাত দেয়। আমার ভাল লাগেনা।' আম্মার মুখে কী অদ্ভুত কষ্টের ছায়া পড়েছিল। মেয়েকে নিরাপদে না রাখতে কষ্ট কতটা প্রকট হতে পারে বুঝেন আপনি পাঠক? ছেলেটিকে আম্মা কি করেছিল আমি জানিনা। আমি আর কোনোদিন সেই লালরঙের গুটিটা দেখেনি। শুধু জানি আম্মা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করত। এক সময় মনে হত আম্মা আমাকে বিশ্বাস করেনা। কারো সাথে কথা বললে সন্দেহের চোখে দেখত। আমার কখনো কোন বান্ধবীর বাড়িতে থাকা হয়নি। আমি নিজেকে আটকে ফেলি এক দমবন্ধ অবিশ্বাসের চার দেয়ালের ভেতর। অবিশ্বাসের বোঝা বয়ে বেড়ানোর কষ্ট আপনি কি বুঝতে পারছেন পাঠক? আমার ভায়েরা হতো চম্পা, পুরুষ নয়। পুরুষকে মানুষ ভাবতে না পারার কষ্ট কি যে তীব্র। আমার স্বপ্নে কোন পুরুষ থাকতো না। যদিও বা থাকতো, আমি দেখতাম তারা আমাকে উপুড় করে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মাটির উপর দিয়ে। আমি কাঁদছি' আমারে ছাইড়া দাও...ছাইড়া দাও।' মানুষকে বিশ্বাস করতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে আমি বড় হয়েছি...

আব্বা ঘটনাটা জেনেছিল আম্মার কাছ থেকে। আমাকে কি যে সব তেতো ঔষধ গেলানো হয়েছিল...আব্বা বোধহয় মনে করেছিলেন আমার গর্ভে বাচ্চা এসে পড়বে। কি বললেন? সেটা তার বোকামী। আট বছরের মেয়ে আবার মা হয়? হবে হয়তো। তবে আট বছরের মা গর্ভবতী হতে পারে। হ্যাঁ, আমিতো হয়েছি। আমার গর্ভে জন্ম নিল যে ভ্রুণ, তার নাম 'পাপ'। আচ্ছা আপনি কি কোথাও পরেছেন পাপ ছেলে না মেয়ে? কি বললেন? পাপের অস্তিত্ব কেবল আমাদের বোধে। কিন্তু আমি তো দেখেছি তার শরীর। কোমল ভ্রুণ, তের বছরের কিশোরী, পয়তাল্লিশ বছরের নুয়ে পড়া শরীর- অনেকটা দেখতে আমার মত। আমার বোধে নয়- আমার ভেতরে বাস। আমি পুণ্যও দেখেছি- আমার ভেতর। পবিত্রতার রঙ আপনারা বলেন শুভ্র। আমি দেখেছি তার রঙ সবুজ; গন্ধটা পায়েস পাতার মত। একটু স্পর্শে সারা জীবন ভরে উঠে। তাকে আমি স্নেহ করে দুমুঠো ভাত বেশি দিয়েছি, পাতে মুড়ো দিয়েছি। কিন্তু আমার পাপ মেয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে দূরে। আমি তার মুখে ছাই দিয়েছি, ঘৃণা করেছি। ঝড়ো বৃষ্টিতে তাকে আমি সারারাত দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। অনুতাপের আগুনে তার মুখে ছ্যাঁকা দিয়েছি। এতে আমার গ্লানি ছিলনা। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি আমার পাপ মেয়ে যেন মরে যায়। আমার পাপকে, আমার সেই মেয়েকে বুকে তুলে না নেবার কষ্ট আছে বুকে। কেমন এক অচেনা গন্ধ তার, কোনকিছুর সাথে মেলেনা...

পাঠক, আপনি কি কাঁদছেন একজন শিশুর শৈশব না থাকার কথা শুনে? এতো সবে শুরু। বাকি রয়ে গেল আমার কিশোরী না হতে পারার কষ্ট। আপনি শুনবেন না মেয়েটাকে কিভাবে ঠকানো হলো, তাকে কিভাবে বিপর্যস্ত করা হলো? কিভাবে বয়সী হবার অপরাধে মেয়েটি কষ্ট পেয়েছিল? আপনি শুনবেন না তার সংসার জীবনের কষ্ট, তার বৃদ্ধ হবার কৃষ্ট! আসলে এক দিনে কত বৃষ্টি চাইতে পারে মানুষ? বর্ষা মাত্র দুমাসের। বারোমাসী বর্ষা কতজন চায়, মিনিটে কতগুলো বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, কতগুলো বৃষ্টির ফোঁটা নিতে পারে মানুষ একসাথে? আজ আপনি অনেক ভিজেছেন।আজ আর নয়। তবে আমি আপনাকে বলব পাঠক। আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। আপনি দূর্বলতা জেনে দূর্বল করতে আসেননি। আপনি এসেছেন কষ্টের খোলস ভাঙতে। খোলস ভাঙার বিস্ময়কর শব্দ আমাকে মুগ্ধ করছে। আপনি পাশে থাকুন। একদিন আমিও আপনার পাঠক হবো। আপনার কষ্টের, সুখের বিস্ময়কর খোলস ভাঙব। আজ বৃহস্পতির রাত। এই চাঁদ-রাত জেগে থাকার রাত। আসুন পাঠক, ভরা পূর্ণিমায় আমরা জ্যোৎস্নার ফুল দেখি। গায়ে মাখি সুখী সুখী গন্ধ...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজাপতি মন :( কিছুই বলার নেই. ভাষা হারিয়ে ফেলেছি.
বদরুল আলম এত্ত বড় গল্প । পরার ধৈর্য নেই ।আরেকদিন পড়ব ।
মনির মুকুল লেখার ধরণটা একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। একবারই মনে হয়নি আমি গল্পটা পড়ছি, সব সময়ই মনে হয়েছে আমি গল্পটা শুনছি। অনেক অনেক শুভকামনা আপুর জন্য........
প্রজ্ঞা মৌসুমী গল্প পড়ার সাথে ধৈর্যের একটা সম্পর্ক আছে। আছে সময়েরো। আপনারা আর সময় আর ধৈর্য নিয়ে যে পড়ছেন, গল্পের প্রতি আপনাদের ভালবাসারই প্রমাণ। তার প্রশংসা না করে আমি পারিনা। যখন দেখি তরুণ পাঠক, অনুভূতিটা অন্যরকম হয়ে যায়। আমি কিভাবে এপ্রিসিয়েট করব আমি জানিনা। আমি কৃতজ্ঞ। এই ভালবাসা আর ভাললাগা আপনাদের লেখার জগতে অনেক দূর নিয়ে যাক এই প্রার্থনা।
মোঃ আক্তারুজ্জামান নিজেকে বাকহীন মনে হচ্ছে- অন্য কোনো দিন আপনার অন্য কোনো লেখায় এই লেখাটা নিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করব|
ঝরা কখন যে তোমাকে আমি এত ভালোবেসে ফেলেছি জানিনা তাইতো আজকে খুঁজে নিলাম তোমার লিখা আর আবারও মুগ্ধ হলাম।
আহমেদ সাবের মামুন ম.আজিজ আমার প্রানের কথা গুলো বলে দিয়েছেন। ahmad mukul এর মতো আমারও দ্বিধা ছিল কিছুটা। "শেষ যতিচিহ্নটি পার হওয়ার পর মনে হলো কষ্ট পুষিয়েছে। "। অসাধারন গল্প। অসাধারন উপস্থাপনা। আসাধারন বিন্যাস।
junaidal এই ডট কমে আমার আসার পর কোনদিন এমন গল্পের দেখা মেলেনি। আমি মুগ্ধ। আমি এতে হারিয়ে গিয়ে ছিলাম। অনেক্ষণ পর আমায় খুজে পাই যখন আপনার গল্প পড়া শেষ হয়। অসাধারণ বলা আরো উপরে।
বাহারুল আজিম পুরোটাই পরলাম, অসাধারণ। খুব ভালো লাগলো
অজানা আমি KHURSHED ALAM ধন্নবাদ আপু পরিপূর্ণ একটি গল্প উপহার দেবার জন্য ........ কমেন্ট নয়......শুভকামনা রইল......

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী