বাবা

বাবা (জুন ২০১২)

মৃন্ময় মিজান
  • ৩২
জানালার পাশের কৃষ্ণচূড়ায় ফুটেছে বুঝি থোকা থোকা লাল। পাখির কিচির মিচির কানে আসছে। খোলা জানালা গলে সুখের সওগাত হয়ে বাতাসের হুটোপুটি চলছে অনেকক্ষণ। মা পুকুরঘাটে। কলেজের পাট চুকিয়ে আমার এখন অখণ্ড অবসর।

অনেকদিনের সাধনায় একটি ছবি এঁকে মেলে ধরেছি নিজের সামনে। আঙ্গুলের ছোঁয়ায় অনুভব করার চেষ্টা করি তার মায়াময় সযত্ন চাহনী। শৈশবের ঘ্রাণ নাকে বাড়ি দেয়। এক চিলতে উঠোনের পরতে পরতে লেগে আছে আমার চপল পায়ের মৃদু আওয়াজ। বৌ-চি, কানামাছি, কুতকুত, দাড়িয়াবাঁধার ঘর পেরিয়ে হাতে খেলা করে কড়ি আর ধাপ্পার ঘুটিগুলো।

না-দেখা নানা বাড়িও হাতছানি দেয় একবার। আহ্ নানা বাড়ি ! কখনো যাইনি সেখানে। মায়ের কাছে শুনেছি, নানার বেশ নাম ডাক ছিল পাঁচ গ্রামে। ও বাড়ি যাবার বায়না ধরলেই চুপসে যেতেন মা। অনেক পরে জেনেছি, নানার অমতে বিয়ে করেছিলেন- লুকিয়ে, বংশের মুখে চুনকালি মেখে।

নাহ্, আমার কোন অভিযোগ নেই। ছোটবেলায় মা যেমন শিখিয়েছেন - প্রতিবাদ আমার ধাতে সয়না। মাকে দেখেছি চারপাশের বিস্তর অভিযোগের মুখে অবলিলায় হাসি ধরে রাখতেন। বাবাকে দেখিনি কোনদিন। শুনেছি আমি গর্ভে আসার সাতমাস পর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছিল বাবার। বাবার মৃত্যুতে মায়ের একূল ওকূল সবই গেছে। আমিই ছিলাম তার আশার প্রদীপ।

জন্মেই জেনেছি পিতৃহন্তারক এক অনাথ আমি! আমার আগমনে কালসিটে পড়ে সকল শুভ প্রয়াসে। দাদীর ‘বাপ খাওয়া ছেমড়ী’ বকুনী খেয়ে বুঝতে পারিনি কিছু। চাচীদের চতুর্মুখী কলরবে একদিন আবিষ্কার করি সত্যিই আমি খুনী। পিতৃহন্তারক অপয়া! ছোট কা’র ঘর আলো করে তুলতুলে ময়ুরী যখন আসে ওকে একটু আদর করার জন্য কতদিন চোখের পানিতে ডুবিয়েছি দিন-রাতের আবর্তন! মৃত বাবাকেই জেনেছি চিরশত্রু। ঘৃণীত এক শব্দ হয়ে সুখের অন্দরে ঝুলে থাকল সে! আমার এ জীবনে ‘বাবা’ তাই নিতান্তই শত্রুবাচক শব্দ এক। মা-ই আমার জগৎ।

স্বামীহীন সংসারে প্রতি পদে পদে কাঁটা, বিদ্রুপ আর প্রতারণার ফাঁদ গলে মা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে নিয়ে। বাড়ির লোকজন যখন তখন বিদ্রুপ করত আমাকে, মাকে, আমার জন্মকে। মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত। ইচ্ছে করত বাবাকে কবর থেকে তুলে ইচ্ছেমত বকাবকি করি। বেঁচেই যদি না থাকবে বাবা হলে কেন এমন অপয়া মেয়ের!

তবু মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর একবুক জেদ এগিয়ে নিচ্ছিল আমাকে। বান্ধবীরা পরীর রাণী বলে দুষ্টুমি করত। মাঝে মাঝে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতাম। কেমন বিবর্ণ পাংশুটে এক অসুখী মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত সেখানে। কখনো রাতের নিসীম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বোবা কান্নায় ভাসাতাম বুক। আজন্ম এক অসুখী আত্মার বসবাস যেন আমার ভেতরে!

কলেজের রঙিন দিনগুলো পাংশুটে হয়ে গেল দ্রুত। পথে নানামুখী অশ্লীল মন্তব্য শুনে গা ঘিনঘিন করত। প্রতিদিনই ওরা বিরক্ত করত। কখনো হাত, কখনো ওড়নার প্রান্ত ধরে টান দিত। প্রথম প্রথম বেশ কান্না পেত। বাড়িতে ফিরে মাকে লুকিয়ে কেঁদেছি অনেক। বখাটেদের উল্লাস আর নপুংশকদের সহানুভূতি - একটা সময় নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। আমি ধীরে ধীরে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি।

অসভ্যতার আদলে গড়ে ওঠা আমাদের এ সভ্যতায় বুঝি কোন ভাল মানুষের বসবাস অসম্ভব কোন ঘটনা! লোক দেখানো নানা আয়োজন শুধু অসভ্যতাকে লালনের জন্য! আমার ভেতর মহলে ধীরে ধীরে প্রতিবাদের সাইক্লোন তৈরী হতে লাগল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই পুরুষ জাতির মুখে থু দেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছিল তীব্র।

আইন-আদালত-প্রশাসনের নির্লজ্জ চাটুকারিতা ওদেরকে সীমাহীন সাহসী করে তুলেছে। লাম্পট্যের তেষ্টা মেটাতে একদিন ছুটে আসে বাড়ি। দিনে দুপুরেই যেন ওরা সারতে চায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। বাড়িভর্তি এতগুলো মানুষের ভেতর শুধু এক পিতৃহন্তারক অপয়া-ই দা হাতে তেড়ে আসে নিজের সম্ভ্রম রক্ষার লড়াইয়ে। আমার প্রতিবাদহীন শান্ত অবয়বে হঠাৎ প্রতিহিংসার দাউ দাউ আগুণে বুঝি বাড়ির লোকগুলোও ভয় পায়। গ্রামে গ্রামে ডাইনী নাম ছড়াতে সময় নেয়না খুব।

আমার দিন রাতের নিকষ আঁধার হয়ে ভাসতে লাগল। মা-মেয়ের কান্নার দাগ মোছানোর কেউ নেই কোথাও। চারদিকে শুধুই হতাশা। তবু পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে আবারো চেনা পথের অচেনা নিয়তীকে মাথায় নিয়ে শুরু হয় আমার বিপদ বরন।

সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায় ওরা। সাহসে ভর করে এগিয়ে যাই। অশ্রাব্য খিস্তি খেউড় উড়তে থাকে বাতাসে। মাথা নত করে পার হচ্ছি জাগতিক পুলসিরাত। হঠাৎ আমার সমস্ত শরীরে অচেনা অনুভব ছুঁয়ে যায়। তীব্র জ্বালা শক ওয়েভের ক্ষিপ্রতায় ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেহে। থমকে যায় আমার চিন্তা ! জীবনে প্রথম উচ্চারণ করি 'বাবা তুমি কোথায়!' মৃত বাবাই একমাত্র অবলম্বন হয়ে তার অনুপস্থিতিকে গাঢ় অন্ধকারে ভাসিয়ে দিল!

আজ আমি সূর্য দেখিনা, সবুজ দেখিনা- অন্ধকার দেখি। আমার চারপাশে কেবলই আঁধারের উৎসব। নিজের জন্য আর ভাবিনা কিছুই। মায়ের দেখানো স্বপ্ন আর টানেনা আমাকে। বোধহীন, চেতনাহীন, অস্তিত্বহীন জড় আমি এক। মাঝে মাঝে শুধু মায়ের জন্য বুকের কোণে কষ্টরা ডানা ঝাপটায়। মায়ের জীবনের একমাত্র বাতিঘরটাও দিকভ্রষ্ট হয়ে গেল !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মুহাম্মাদ আবদুল গাফফার মাঝে মাঝে শুধু মায়ের জন্য বুকের কোণে কষ্টরা ডানা ঝাপটায়। মায়ের জীবনের একমাত্র বাতিঘরটাও দিকভ্রষ্ট হয়ে গেল ! ভাল লিখেছেন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি Khub valo laglo golpota pore....sundor kabbo moyotar vetor fute uthechhe golpo.....mrinmoy mijan suvo kamona apnake..............
নীলকণ্ঠ অরণি সত্যি বলতে কি গদ্যের মধ্যে কাব্য ধারাটা আমার ভালো লাগে, গদ্যের চেয়ে কাব্যের প্রতি বেশি টানের কারণেই। আপনার গল্পটা এবারেও ভালো লাগার সীমারেখা স্পর্শ করেছে দারুণ ভাবে...শুভকামনা
সূর্য জন্মের পর বাবা হারানোর গল্পটা বাদ দিলে বাকিটার পুরোই একটা মেয়ে বয়ে বেড়ায় সব সময়। আর এই বয়ে বেড়ানোয় যদি যুক্ত হয় ঘরের মানুষদের অবহেলা, সেটার কতটা ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তারই সুন্দর একটা কাব্যিক উপস্থাপন।
Sisir kumar gain বেশ সুন্দর গল্প।শুভ কামনা।
জাকিয়া জেসমিন যূথী নারী শরীরের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি গরিব ধনী নির্বিশেষে সব সমাজের মেয়েদেরই নির্যাতন সহ্য করতে হয়। গরিব পরিবারগুলো এক্ষেত্রে বেশি অসহায়; ওরা মুখ বুজে থাকে বেশি আর বিচারও পায়না বলে। সামাজিক সমস্যাকে গল্পে নিখুঁতভাবে টেনে এনেছেন। আপনার লেখনী সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। ভালো লাগলো গল্পটা; হৃদয়ে আমারো প্রতিবাদ স্পৃহা জেগে উঠছে। ইচ্ছে করছে ঐ অসহায় মেয়েটির, বা অসহায় মেয়েগুলোর পাশে দাঁড়াই। জানেন এক সময় আমার এই ইচ্ছে ছিলোও। একটা সময় এসে বুঝতে পারলাম, আমিও অসহায় একজন, ওদেরই মতন; করার ক্ষমতা খুবই সীমিত। এখন শুধু কলম আছে। পরোক্ষভাবে ওদের কারো কারো কথা বাকিদের জানানোর জন্য।
মিলন বনিক আপনার ক্ষুরধার লেখনীতে সত্যিই মুগ্ধ মিজান ভাই..অসাধারণ গল্পের বুনন..প্রতিটা পারা এভাবে টার্ন অফ করেছে এবং সমাজের বাস্তব চিত্রগুলো তুলে ধরার এক নিপুন কুশলী হাত..দীর্ঘজীবি হোক...
শাহ্‌নাজ আক্তার অসাধারণ , এভাবে যদি প্রতিটি মেয়ে সাহসী হতে পারত তাহলে কিছুটা হলে ও সমাজে পাপ কাজ কমে যেত , তবে সব কিছুর পরে ও বাবারা যে মাথার উপর ছায়া দিয়ে আমাদের আগলিয়ে রাখে তাই প্রমানিত হলো |
প্রজ্ঞা মৌসুমী গল্পের থিমটা সুন্দর। মেয়েদের বেশকিছু সমস্যা তুলে ধরেছেন মা-মেয়ের গল্পের ভেতর দিয়ে। ইদানিং গল্পে "এই সময়টাকে" যে তুলে আনছেন এটা ভালো লাগছে। মেয়েটার কলেজ অভিজ্ঞতায় আমার নিজের একটা ঘটনা মনে পড়লো। একদিন এত বিরক্ত করছিল...স্যার ছিলেন বলে রক্ষা। সেদিন যে পারফিউম ইউজ করেছিলাম, এটার ঘ্রাণ শুনলেই অস্থির লাগতো। ঐদিনের জামা জুতো জীবনেও আর পড়িনি; এমনকি রবিবারে বাইরে বেরুতে ভয় লাগতো। তো ইমোশোনাল হলাম গল্পটা পড়ে। প্রতিবাদহীন মেয়েটার মুখে প্রতিহিংসার আগুন, দা হাতে তেড়ে আসা দেখে মনটা ভরে গেল আবার শেষে এসে মন খারাপ। লেখনীতে গভীরতা আছে। মামুন ভাই বলছিলেন 'কাব্যিক প্রকাশ'... আচ্ছা এটা কি একটা মেয়ে চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন বলেই... আমার গল্পেও অনেকে এটা বলছিলেন। ইদানিং আমার সমস্যা হচ্ছে গল্পে কাব্যিক ভাব থাকাকে পজিটিভ নাকি নেগেটিভভাবে নেব। আপনি কি মনে করেন?
আমি অনেক আগে একটা গদ্য লিখেছিলাম চিঠির আদলে- নীরার শেষ চিঠি- ভিন্ন নামে। একটা মেয়ে আত্মহত্যার আগে বন্ধুকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছে ' জীবন যেখানে জীবনের প্রতিভু নয়...মানুষ যেখানে স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়ে ফেলে, সেখানে মৃত্যু ছাড়া মুক্তির আর কী পথ থাকতে পারে'। আমার গদ্য চর্চার শুরু বলা যায় ওখান থেকে। বলাবাহুল্য থেমে থেমে থমকে থমকে। কথাসাহিত্যের চলমান গদ্য ধারায় কেন যেন আমার মন ভরত না। আমি চাইতাম কাব্যিক কিছু। আমাদের লিটল ম্যাগে কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হলে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিল ওগুলোকে গল্প বলছি কেন।তবে গদ্যের মধ্যে কাব্য থাকাটা দোষের নয়, আমি যতদুর জানি, বরং অনেকেই পজিটিভলি দেখেন। আর আমার চেষ্টা থাকে সাধারণত গল্পকে কাব্যের মত উপস্থাপন করা। চাই গতি থাকুক। থাকুক কাব্যের দ্যোতনা।এই প্যাটার্ণে অনেকেই এখন গদ্য লিখছেন।আপনারগুলোও অনেক সমৃদ্ধ কাব্যদ্যোতনা সমৃদ্ধ গল্প।আপনার গদ্যের এই প্যাটার্ণ আমারও অনেক ভাল লাগে।এটাকে দোষের বলছে এমন কাউকে আমি এখনো পাইনি।
মামুন ম. আজিজ নারীত্বের অসহায়ত্ব সুন্দর কাব্যিক প্রকাশ.......

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪