একজন সামন্ত প্রভু

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

রওশন জাহান
  • ৯৮
  • ১৪৯
শামসুল আলম একজন রাজাকার। নবগঙ্গা নদী তীরের গঞ্জে যখন হাটবারে নৌকা ভীড়ে, ব্যস্ত মাঝি আর কুলী কামিনের ডাকাডাকি চরমে উঠে, মালামাল আগলে শামসুল আলমের মতো ছোটখাটো সামন্ত প্রভুরা চলে যায় লাভ লোকসানের ঝাঁপি বন্ধ করতে করতে । নুরু তার ভাংগা রিকশার প্যাডেল চাপে শরীরের সব শক্তি দিয়ে, মাঝে মাঝে সওয়ারীর কটু বাক্যও শুনে । শামসুল আলম তখন তার এই হঠাৎ পাওয়া জীবনের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান । জীবন! এই জীবন তার অনেক মুল্য দিয়ে কেনা । অনেক রক্ত ঋন । এই ঋন পরিশোধ করা এই জীবনে সম্ভব হবেনা এবং শামসুল আলমের সেজন্য কোন পরিতাপ ও নেই।
তবু অনেক সময় মনে হয় শামসুর কথা । বোকা ! এক গ্রামের দুজ়নের ডাক নাম শামসু । একজন শামসুল আলম, অন্য জন শামসুর রহমান । গায়েঁর মানুষ ভালো নাম নিয়ে মাথা ঘামায় না । দুজনের এক নাম হওয়াতে কি বিড়ম্বনাতে যে পড়তে হতো সেই ছোট বেলা হতে । হয়তো কারো বাগানের আম চুরি করেছে এক শামসু, দোষ হতো আরেকজনের । একজনের চিঠি আরেকজনের বাড়িতে যাওয়া তো স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো ।

ঘটনার কাল ১৯৭১ সাল । যুদ্ধের দামামায় সারা বাংলাদেশ কেপেঁ উঠে । ছোঁয়া লাগে অজ পাড়াগাঁর কিশোর তরুনদের রক্তে ও । তাস খেলা, ষোলগুটির ছক কাটা ঘর, ডাহুক উড়ানো, বাপে তাড়ানো মায়ে খেঁদানো ছেলেগুলি গ্রামছাড়া হয় রাতারাতি । সঙ্গী হয় তিন ছেলেমেয়ের বাপ নুরু । সবাই মিলে দেশের সীমানা পাড়ি দিয়ে ওপার । ট্রেনিং করে ফিরে আসে । আর অংশ নেয় গেরিলা যুদ্ধে এক গ্রাম থেকে অপর গ্রামে । আর নীল পাড়ার শামসুল আলম যোগ দেয় রাজাকার বাহিনীতে । সে কতকাল আগের কথা । স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসে, তবু ঠিক মনে আছে তার ।
দুর্দ্দান্ত প্রতাপে মুক্তিযোদ্ধারা নীল পাড়ার আশে পাশে যখন অপারেশন চালাতো, আর্মি ক্যাম্পে বসে নিজেকে নিরাপদ মনে হলেও, বাড়িতে যাবার সময় রাস্তাটাকে মনে হতো পুলসিরাতের পথ । আর ফুরায়না । সারাক্ষন মনে হতো এই বুঝি মুক্তিযোদ্ধা নুরু আক্রমন করল পিছন থেকে । কিন্ত কোনদিন তা হয়নি । হয়তো পিছন থেকে কাপুরুষের মতো আক্রমন করাটা তাদের স্বভাবে ছিলো না ।
একদিন শীতের গভীর রাতে শান্তিবাহিনীর দেয়া নতুন পাম্প সু মস্ মস্ করে সে যখন ফিরছিলো গ্রামের দুই তরুনীকে ক্যাম্পে তুলে দিয়ে, কাছে কোথাও বুনো হাঁসনাহেনার ঝোপঁ থেকে মাতাল করা গন্ধে সে নিজেকে রাজা বলে ভেবেছিলো ।
এই তো কিছুদিন আগের কথা । হরিশদের বাড়ী লুট করার সময় কি মজার কান্ডটাই না করেছিলো সঙ্গী কালা । সবাই ব্যস্ত সোনা রুপা খুঁজতে, কাসাঁর প্লেট গ্লাস হাড়িঁও বাদ যাচ্ছেনা । কৃষক কালা মিয়া সোনা নয়, রুপা নয়, এমনকি কাসাঁ পিতল ও নয় দুটি ভারি ধানের বস্তা মাথায় নিয়ে পালিয়ে এসেছিলো হিন্দু বাড়ী থেকে। তারপর থেকে সবার কাছে ধান চোর হিসেবে কালা’র নাম রটে গিয়েছিলো । আর তিনি লুট করা দামী অলংকার পকেটে করে দিব্যি ভালো মানুষ সেজে বাইরে এসেছেন । যুদ্ধ রাজা বানিয়ে দিয়েছিলো তাকে।
শুধু একটা সকাল । আতঙ্কের একটা প্রহর । তারপর সব ঠিক । মনে পড়ে, সেদিন ঝরঝর বৃষ্টি পড়ছে । তিনি কয়েক মাইল পথ হেটেঁ সবে পৌছে গেছেন বনগাঁ । এমন সময় হঠাৎ যেনো মাটি ফুড়েঁ কয়েক সূর্য সন্তান বেরিয়ে এসে শামসুলকে নিয়ে গেলো মুক্তিবাহিনীর আস্তানায় । হিম হয়ে আসা শরীরটাকে ঠেলে এগিয়ে দিল কমান্ডারের সামনে । মেরে ফেলার আদেশ দেওয়া হল দেশের প্রতি অকৃতজ্ঞতা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য । এমন সময় বোমা ফাটালো তার একটি মাত্র বাক্য ।
“আমি শামসুল আলম না , শামসুর রহমান । ভুল মানুষ ধরে এনেছেন আপনারা “ উপস্থিত বুদ্ধিটা তার বরাবরই ভালো । বেচেঁ গেলো সেই বুদ্ধিতে । ভাগ্যিস তার এলাকার কেউ ছিলোনা কয়েক মাইল দূরের সেই ক্যাম্পে । তাকে চেনে এমন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো অন্য এলাকার ক্যাম্পে ।
তাকে ছেড়ে দেয়া হলে গ্রামে পৌঁছে শামসুর রহমানের বউকে জানালো বনগাঁর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে অনেক ঔষধ এসেছে ইন্ডিয়া থেকে । পোলিওর ঔষধও আছে। শামসুর চাইলে নিয়ে আসতে পারে । গিয়ে পরিচয় দিবে সে নীল পাড়ার শামসু । তাহলেই হবে । আরও দুজন যাবে সাথে ।
শুনে শামসুর রহমানের বউ তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলো । এতদিন পর বুঝি আল্লাহ মুখ তুলে চাইলো । মেয়েটাকে নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই । হাঁটতে শেখার আগেই পোলিও হয়ে পা বাঁকা হয়ে গেছে । যদি ইন্ডিয়ার ঔষধে ভালো হয় ।
পরদিনও ভোর থেকেই বৃষ্টি পড়ছে । কোথাও যাবার আগে নাকি বৃষ্টি হলে শুভ হয় । সকাল সকাল শামসুর রহমান বেরিয়ে পড়েছে বনগাঁর পথে পোলিওর ঔষধ আনতে । প্রথমে মনটা কেমন করেছে । শামসু রাজাকারের কথা বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে তো । তারপরই মেয়েটার কথা মনে হয়েছে । আর তিনি তো মুক্তিযোদ্ধা না যে শামসু রাজাকার তাকে বিপদে ফেলবে । সারাবছর কৃষিকাজ করে কত টাকা আর থাকে যে মেয়েটার ভালো ডাক্তার দেখাবে । ঔষধ নিয়ে সোজা গ্রামে চলে আসবে ।

শামসুর রহমান আর ফিরে আসেনি । শুধু নোয়া পাড়ার হাশেম মিয়া দেখেছিলো নৌকা করে রাজাকার শামসুল আলমের দুজন লোক তাকে নিয়ে যাচ্ছে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে । সেখানে তাকে রাজাকার শামসুল পরিচয় দিয়ে রেখে আসা হয় । তার তীব্র আপত্তির মুখে তাকে বলা হয় কেউ যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে তার গ্রাম থেকে এসে সাক্ষী দেয় যে সে রাজাকার নয়, তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে । তুমুল বৃষ্টি আর কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কেউ আসেনি তাকে ছাড়াতে। সবচেয়ে বড় কথা তার পরিবারের কেউ জানতেও পারেনি সে আটকে আছে । সন্ধ্যার পর রাজাকার মনে করে তাকে হত্যা করা হয় । এভাবেই রাজাকার শামসুল আলম রক্ষা পায় আরেক শামসুর রহমানের নাম দিয়ে ।
আর মুক্তিযোদ্ধা নুরু যুদ্ধে আহত হয় । পায়ে গুলি লাগে । সে এখন মোটামুটি পঙ্গু । প্রায় অচল এক পা নিয়ে গঞ্জে রিকশা চালায় । গুলি লাগা পা-টা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে লুঙ্গি দিয়ে । অচল রিকশাওয়ালার রিকশায় কে উঠতে চায় । ছেলে একটা রাখালী করে চেয়ারম্যানের বাড়ীতে । আরেকজন কুলী । আজকের নুরুকে দেখে হাসি পায় রাজাকার শামসুলের । এই নুরুর ভয়েই সে একবার বিলের গলা পানিতে ডুবে ছিলো শীতের গভীর রাতে ।
এখন রাজাকার শামসুলের জীবনে সব আছে । সম্পত্তি, প্রতিপত্তি, সম্মান । শুধু একটা আক্ষেপ তার এই জীবনে, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা নুরু তাকে রিকশায় উঠতে দেয়না । তীব্র শীত, কাঠ ফাঁটা রোদ কিংবা শত অভাব অনটনেও ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের একজন সামন্ত প্রভু ছাড়া গল্প-কবিতায় প্রকাশিত আপনার সব লেখাই আমি পড়েছি। আপনার লেখার একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে আবার এলাম আপনার ভুবনে এবং এ গল্পটাকে পেয়ে গেলাম। গল্পটা পড়ার সময় ভাবতে পারিনি যে, এটা একটা সত্য ঘটনা। মন্তব্য গুলো পড়ার পর সেটা জানলাম। মানুষ যে কত নীচ হতে পারে, এ গল্পটা তারই সাক্ষ্যবহ। শামসুল আলম প্রাণে বেঁচে এসেছে। একজন নিরপরাধ মানুষ (শামসুর রহমান)কে মরণ ফাঁদে ফেলার তার কোন প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু মানুষ যখন পশু হয়ে যায়, তার মাথায় যুক্তি কাজ করে না। অসাধারন লেখা। শুধু গল্পটার নামকরণটা আমার তেমন পছন্দ হয়নি। এটা সামন্ত প্রভুর গল্প নয়, একজন অমানুষের গল্প। আমি হলে হয়তো নাম দিতাম, “একজন অমানুষের গল্প” অথবা “অমানুষ”।
রনীল N/A UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# চমৎকার... এই গল্পটা ভালো কোন পত্রিকায় ছাপা হলে আরো বেশী পাঠক পড়তে পারতেন। শুভ কামনা রইল...।
মিজানুর রহমান রানা একটি অন্যরকম গল্প। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ
রওশন জাহান জাকারিয়া , আপনার মন্তব্যের ধরন আরো বেশি অসাধারণ.
জাকারিয়া এক কথায় অসাধারণ, দুই কথায় অসাধারণ , সব কথায় অসাধারণ
সূর্য নুরু যে রাজাকারটাকে রিকসায় উঠতে দেয়না এটা জানতে গেলে বারবার যে আসতেই হয় বোন। হা হা হা হা
রওশন জাহান বৃষ্টি ঝরা রাত ,মুক্তিযোদ্ধা বলতে সবাই ভাগ্য বিড়ম্বিত , অবহেলিত এক বীরকে বুঝাতে না চাইলেও বাস্তব চিত্র কিন্তু অনেক সময় এরকমই. অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য.আপনি নিজেকে ক্ষুদ্র পাঠক ভাববেননা.কারণ সব লেখকদেরই সবার আগে ভালো পাঠক হতে হয়.
রওশন জাহান সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, আমার লেখা আপনার মতো একজন গুণী সমালোচক বার বার পড়েছেন এ আমার সৌভাগ্য।
বৃষ্টি ঝরা রাত গল্প টা ছোট্ট পরিসর এ লেখা একটা সুন্দর উপস্থাপনা । কিন্তু এটা সত্যি দুক্ষজনক মুক্তিযোদ্ধা বলতে আমাদের মনে শুধু ভাগ্য বিড়ম্বিত , অবহেলিত এক ছবি ভেসে ওঠে। জানিনা এর বাতিক্রম কেউ আছে কিনা । প্রশংসা রইলো। প্রেরণা দেওয়ার সাহস হলোনা। আমি একজন ক্ষুদ্র পাঠক । আপনার লেখাই আপনাকে প্রেরণা যোগাবে বিশ্বাস করি।
সূর্য লেখাটা বেশ কবারই পড়েছি। ভালো হয়েছে অনেক-----

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪