বাবা ও সোনার মোহর

বাবা (জুন ২০১২)

রওশন জাহান
  • ৪৫
“হ্যাঁ রে সোনা, চাইলেই হারিয়ে যাওয়া যায় বুঝি ! কত খোঁজে আজ পেলাম তোকে ! মোবাইলটাও বন্ধ করে রাখলি । “
বুবুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে । বুবুকে আগে কাঁদতে দেখিনি । মা যখন মারত আমরা দৌড়ে পালাতাম কিন্তু সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেত । পালাতনা আবার কাঁদতও না । এমনই একরোখা জেদি মেয়ে ছিল সে । আজ তাকে কাঁদতে দেখে আমার বুকের ভিতরে কি যেন কি হয়ে গেল ।
“ বারবার তোকে দেখতে চাচ্ছিল । পাগলের মত বলেছে , সোনাকে ফিরিয়ে এনে পড়ালেখা করাবি তোরা । আর কটা দিন আগে তোকে যদি পেতাম ......“
আমার ছাইবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বুবু চুপ করে গেল । হাত টেনে বলল “ বাড়ি চল । “
বাড়ি ! কোন বাড়ি যাব আমি ? যে বাড়ীতে বাবা নেই সেটা তো আমার বাড়ি নয় । কয়েকটা ইট কাঠের দেয়াল দেখতে আমি কেন যাব ?
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি এক সকালে দুই কন্যাসন্তানের পর আমার মা যখন তৃতীয় বার কন্যা সন্তানের জননী হয়েছিলেন শ্বশুর বা বাবার বাড়ির কেউই খুশি হলেন না । মুরুব্বীরা গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগলেন, বংশের বাতি দিবে কে ! শুধু আমার নানু উৎফুল্ল হয়ে আমার বাবাকে বললেন “ দেখো, কেমন চাঁদের মত মুখ হইছে মেয়ের ! এই মেয়ে তোমার ঘরে সোনার মোহর নিয়া আসব । বড় ভাগ্যবান হইব এই মেয়ে । “
কালো মেয়েকে এত আহ্লাদ দেয়া দেখে কেউ কেউ নানুর দিকে বাঁকা হেসে তাকালেও মুখে কিছু বলার সাহস পায়নি। সত্যিই চন্দ্রের মত মুখ মেয়ের ।
তাঁর অল্প কিছুদিন পরেই আমার মা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা পদের বহু আকাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পেয়ে গেলেন । এত বছর শুধু ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছিলেন চাকরী আর হচ্ছিল না । আমার নানু বিজয়ীর ভঙ্গীতে বলেছিলেন, “ আমার কথা সত্যি হল তো ! আগেই বুঝেছিলাম এই মেয়ে বড় ভাগ্যবান । “
অজ পাড়াগাঁয়ে থেকেও সেই আমলে লেখাপড়া জানা, বিজ্ঞ, আমার অশতিপর বৃদ্ধা নানুর কথা বাবা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন । আস্তে আস্তে আমার নাম সোনার মোহর থেকে সোনাতে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল । পরে আমার দুটি ভাই জন্ম নিয়ে বংশের বাতি দেয়া সমস্যারও সমাধান করেছিল ।

কিছু কিছু মানুষ থাকেই পৃথিবীতে যাদের কাছে সমস্ত পার্থিব বিষয় একদিকে আর হৃদয়াবেগ আর একদিকে । আমার বাবা তেমনই একজন মানুষ । বাইরের দিক দিয়ে অত্যন্ত বৈষয়িক তিনি কিন্তু তাঁর সন্তান বাৎসল্য ছিল সব কিছুর উপরে । সন্তানের জন্য করতে পারতেন না এমন কোন কাজ নেই । লোক সম্মুখে স্নেহ প্রকাশে অনেকটা লজ্জা পেতেন । তাঁর ভালবাসা ছিল গোপনে , অনেক গভীরে । মনে পড়ে, গ্রামে থাকতে বাবা আমাকে কাঁধে করে প্রায়ই খোকন ভাইয়ের লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছটির পাশে সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকতেন চুপচাপ । পাগল হয়ে মারা যাওয়া আমার তরুণ চাচাত ভাইটিকে সেখানেই কবর দেয়া হয়েছিলো । সেই থমকে যাওয়া সময়ে কোথা থেকে ডাহুক ডেকে যেত অনবরত, জোনাকিরা ঝাঁক বেধে আলো জ্বালিয়ে আমাদের চারপাশে উড়ে বেড়াত, দু একটা বোকা জোনাকি অবশ্য পূর্ণিমার রাতে জোছনার বহর দেখে আলো নিভিয়েও ফেলত । কবরের পাশে আধো অন্ধকারে আমার গা ছমছম করত, বাবাকে অনেক দূরের মানুষ মনে হত তখন । আমি অস্থির হয়ে উঠতাম ঘরে ফেরার জন্য । বাবা তবু দাঁড়িয়েই থাকতেন ।
আজ চোখ বন্ধ করে সেই হাজার বার দেখা দৃশ্যটি আমি আর একবার দেখতে চাইলাম । কিন্তু বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল । এক ফোঁটা জলের জন্য চোখ দুটি মরুভূমির বেদুঈনদের মত হাহাকার করছে । বাবা কোথাও নেই , এর চেয়ে অসম্ভব মিথ্যা আর কি হতে পারে ! আমার অস্তিত্ব ধরে কেউ টান দিচ্ছে কি !
কিন্তু পৃথিবী আগের মতই চলছে ! বিপনি বিতানে ভিড় বাড়ছেই । ঈদের আর দেরী নেই বেশি । ক্রেতার সাথে বিক্রেতার দর কষাকষি হচ্ছে । পাশের দোকান থেকে কেউ বুবুকে ডাকছে “ আসেন আপা, মাজাককলি, আনারকলি সব আছে আমার দোকানে । এই দোকানে আসেন ।
পাঁচ ভাই বোনের পড়ালেখা, দাদীকে টাকা পাঠানো, সংসার খরচ সব মিলিয়ে টানাটানি লেগেই থাকত আমাদের । বাবার অফিসের অবস্থাও ভাল না । লসের কারণে যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে । এর মধ্যেও আমার বড় দু‘বোন সেইবার ঈদের জামা আদায় করল জোর করে । সেই অসম্ভব অর্থকষ্টের দিনে আমার কোন দাবীই ছিল না । নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আমি বিব্রত ছিলাম সবসময় । কারো বিন্দুমাত্র সমস্যা আমি সৃষ্টি করতে চাইনি । কেউ আমার দিকে খেয়ালও করেনি । তবু মনের কোন একটা অংশ ঈদে নতুন জামা পাওয়া বোন, বান্ধবী বা অন্যদের দেখে নিশ্চয় কাঁদছিল । মা আমার হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বলেছিলেন পরের ঈদে তোর জন্য সবার আগে জামা কিনব দেখিস । কিন্তু সেদিনই গভীর রাতে বাবা ফিরলেন নতুন জামা নিয়ে আমার জন্য । নিছক জামা নয় সেদিন জামার রুপ ধরা ভালবাসা নিয়ে এসেছিলেন আমার জন্য । বলেছিলেন , “ দিন কি আর এমন থাকব সবসময় ! আমার সোনার মোহর অনেক বড় হইব । ওর নানীর কথা ভুল হইবনা । “
আমার এস এস সির রেজাল্টের দিন গুরুগম্ভীর বাবা একেবারে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন । অসম্ভব ভাল ফল করায় টানাটানির সংসারেও সেদিন বাবা বাইশ কেজি মিষ্টি কিনে বিলিয়েছিলেন। পরে মা বলেছিল , বাবা আনন্দে কেঁদেছিলেন সবাইকে লুকিয়ে ।
“ মেয়েরে ঢাকা পাঠাইলে কলেজের , হোস্টেলের খরচ দিব ক্যামনে ? ”
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেছিলেন “ রক্ত বিক্রি করে হইলেও আমি আমার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাব । ভাত রান্না , কাপড় ধোয়া , ঘর গুছানো এসব তো সবাই পারে । অশিক্ষিত, কাজের লোকেরাও এই কাজ করতে পারব। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবাই হইতে পারেনা । যতদূর ও পড়তে চাই আমি পড়াব । “
মেয়েরা দেখতে বাবার মত হলে নাকি ভাগ্যবান হয় । আমি দেখতে তাঁর মত এবং আচরনেও তাঁরই মত হয়ে উঠতে লাগলাম । অন্তর্মুখী আমি কিছুতেই নিজের কথা কাউকে বলতে পারতাম না । তাই তো ভুল এক মানুষ কে ভালবাসলাম । ভুল যে তখনই জানতাম । আমার মনে হত বাবা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ভাববে , “ সুনু , তুই এ কি করলি ! “ তাই বাবার সামনে সেই ভুলটুকু নিয়ে দাঁড়াবার সাহস পাইনি । মনে ছিল ভালবাসা দিয়ে অসুন্দরকে বদলে দেয়ার নাটকীয় বাসনা । সেই অশুভ মানুষটিকে শুদ্ধ করার সব দায়িত্ব যেন একা আমিই নেবার মত ছিলাম । তাই সব ছাড়লাম । সব । কিন্তু নীলকণ্ঠী না হতে পেরে অবশেষে হলাম দোকানের সেলস গার্ল ।
অনেকক্ষণ পর বুবু আবার কথা বললেন , “ খোকনের লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই শুয়ে আছে । ওখানেই যাবি চল্ । “
আমার বুকের ভেতরের মরুভূমিটা এতক্ষণে উদ্দাম নদী হয়ে ছুটে চলেছে । দুকূল ভাসানো দুঃখ প্লাবন আমাকে বাবার আকাঙ্ক্ষার সত্যিকারের সোনায় পরিণত করে তবে থামুক । পোড়া চোখ দুটি বুঝি জীবনে এই প্রথম সমুদ্রের দেখা পেয়েছে । সমুদ্রের জল লোনা , চোখের জলও কি কম !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
পারভেজ রূপক দারুণ, দারুণ, দারুণ গল্প
রোদের ছায়া পড়ব পড়ব করেও দেরী হয়েই গেল গল্পটা পড়তে , খুব ভালো লাগলো , কাহিনী আর বর্ণনা সবই সুন্দর . শুভকামনা থাকলো...
রওশন জাহান বেশ কিছু নতুন পাঠক এবং পুরনো পাঠক সহ যারা আমার লেখা পড়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি.
গাজী হানিফ কি তীব্র আবেগ, মোহিত holam
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি চমত্কার লেখনী! বেশ ভালো লাগলো|
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি আমার বুকের ভেতরের মরুভূমিটা এতক্ষণে উদ্দাম নদী হয়ে ছুটে চলেছে । দুকূল ভাসানো দুঃখ প্লাবন আমাকে বাবার আকাঙ্ক্ষার সত্যিকারের সোনায় পরিণত করে তবে থামুক । পোড়া চোখ দুটি বুঝি জীবনে এই প্রথম সমুদ্রের দেখা পেয়েছে । সমুদ্রের জল লোনা , চোখের জলও কি কম ! // osadharon laglo apnar golpo......rawson jahan suvo kamona roilo....................
মোহাম্মদ আশিকুর রহমান আমি কানছি/ লেখাটা তীব্রভাবে আমার মনকে ছুয়ে গেল/ শুভকামনা আপনাকে, অনেক বড় লেখক হন/
ওবাইদুল হক আসলে বাবা হলেই বুঝা যায় বাবার আসল বাস্তবতা । আপনাকে তার জন্য আরেকবার ধন্যবাদ ।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা অসম্ভব হৃদয়বান এক বাবার চরিত্র এঁকেছ শৈল্পিক ভাবে । খুব ভাল লাগলো ।
মোঃ সাইফুল্লাহ খুবই সুন্দর ধন্যবাদ কবিকে।

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী