ফিরে পাওয়া

মুক্তির চেতনা (মার্চ ২০১২)

রওশন জাহান
  • ৪৪
গড়াই নদীর কূলে নিদানগঞ্জ বাজারে হাট জমে সোমবার । দুপুর থেকে শুরু হওয়া সে হাট রাত অবধি চলে । কত জাতের মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয় নদীর নির্জন তীর । আর সবার মতই লেইসফিতা, হাওয়াই মিঠাই, মিষ্টি আলু, পানিফলওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসে । দাম শুনে একাল সেকালের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বয়স্করা । আজ হাটে স্বপ্নে প্রাপ্ত ঔষধের সর্বরোগ সারাবার গ্যারান্টি দিয়ে একঘেয়ে ক্যানভাস করে যাচ্ছে বিক্রেতা । পান খেয়ে কেউ একজন পিক ফেলেছে কারো গায়ে । এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে । এত হট্টগোলের মাঝেও নিজেকে একা বোধ করে নুরু গাজী । ছানি পড়া এক চোখ, বলিরেখাপূর্ণ মুখমন্ডলে তাকে বয়সের চাইতে অনেক বেশি বৃদ্ধ মনে হয় । মাছের আড়তে পানি দেয় সে । নদী থেকে পানি তুলে বালতিতে ভরে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল সরু পথে সে হেঁটে যায় দোকানে দোকানে বছরের পর বছর ধরে । পরিজন বিহীন রাত কাটে মাছের ঘেরের টোপ ঘরে মাছ পাহারা দিয়ে। কত নক্ষত্র উঠে, কত তারা ঝরে যায় তার দৃষ্টি সীমানার সামনে দিয়ে তাকে একবারও জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনা । বুকের ভেতর লালন করা ক্ষোভ, হতাশারা জন্মে মরে গেছে বহুদিন আগে । আর স্বপ্ন! স্বপ্ন তো সে দেখেছিল উত্তাল একাত্তরে । আজ কোন স্বপ্ন নেই । মুক্তির চেতনা তার কাছে মূল্যহীন ।
কলমিলতা বিদ্যালয়ের ঝাড়ুদার সফুরা এসেছে মাছ কিনতে । পরিবারে পুরুষ কেউ না থাকায় তাকেই বাজার করতে হয় । এই দোকান সেই দোকান ঘুরে মাছের দামে আর মিলেনা । শেষে গুঁড়া মাছের এক দোকানে এসে দাম শুনে আর সহ্য হয় না তার ।
“ এই কয়টা মাছের দাম চল্লিশ টাকা ! তুরা মাছ বেচতে আইসিস না ডাকাতি করতি ! “
তরুণ বিক্রেতার উত্তর “ এই দামে নিলে নেন নাইলে যান । “
বিক্রেতার কটু মন্তব্যে তাদের তর্ক বিতর্ক চরমে ওঠে । সফুরা তার স্যান্ডেল তুলে মারতে যায় আর বিক্রেতা থাবা দিয়ে সফুরার ভাঙ্গাডাঁটির চশমা ফেলে দেয় । মুহূর্তে এক চোখ অন্ধ সফুরার চেহারার দীনতা ফুটে উঠে ।
তরুণ ছেলেটি চিৎকার করে বলে ওঠে “ কানি কোন জাগার !......”
“যুদ্ধ, যুদ্ধ আমারে কানা বানাইছে আবাগীর পোলা ! তুরা যুদ্ধ কি জানিছ না । ” সফুরার দীন মুখ কিন্তু কন্ঠে একাত্তর ভর করে । মুক্তিযুদ্ধে গুলি লেগে চোখ অন্ধ হওয়ার কথা বলতে পেরে সে আজ গর্বিত বোধ করে ।

‘বিসমিল্লাহ’ নামের ভাতের হোটেলে রাধা দিনের বেলা মশলা বাঁটে, তরকারী কাটে । আর সময় পেলেই তার পোষা শালিখ পাখীটির সাথে কথা বলে । আজ নুরু গাজী পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনছে তাদের কথোপকথন ।
“তুমারে ধইরে নিয়ে যাবে ওরা । ঠোকর দিওনা আর মিঠু । “
মিঠু নামের সদ্য কিশোর পাখিটি গলায় অদ্ভুত ঠন ঠন শব্দ তুলে সেই কথার জবাব দিচ্ছে । যদিও রাধা জানে একটু পরই তার আশে পাশে অচেনা কাউকে দেখলেই মিঠু ঠোকর দিবে । আহ মিঠু ! যদি আরো আগে জন্মাত !
রাধার বাবার পরিচয় পাওয়া না গেলেও তার মা নিষিদ্ধ পল্লীর ছিল বলে অনেকেই কানাঘুষা করে । জন্মের কয়েক বছর পর মা তাকে রেখে নিরুদ্দ্যেশ হলে এ বাড়ির বারান্দা, ও বাড়ির রান্নাঘর, এখানে সেখানে শত সহস্র শৈশবিক, কৈশরিক ও মেয়েলী নির্যাতন সহ্য করে তার আজকের জীবন । হিন্দু, মুসলিম কেউই তাকে ঘরে নেয়নি । কোন আইন আদালত সরকার তার পাশে এসে দাড়াঁয়নি । স্বাধীন দেশ তবু স্বাধীনতার ফল রাধাদের নয় । মুক্তির চেতনা বলে কোন শব্দ জানা নেই তার ।
“ কাকা, তোতা মিয়ারে কয়ে আমার মিঠুর জন্যি একটা নতুন খাঁচা বানায়ে দাওনা । ও আজকাল আর কথা শুনতি চাচ্ছেনা । আগের খাঁচাটা তো ভেঙে গেছে একেবারে । “ নুরুকে দেখেই আজ ধরে বসল রাধা ।
“তুই নিজেই ব্যপারীরে কচ্ছিস না ক্যানো ?”
“ ও আমার ভাল্লাগেনা । বুড়া ভাম আমারে দেখলি খালি ফ্যাক ফ্যাক কইরে হাসে আর উল্টা পাল্টা কতা কয় । শালারে বাগে একদিন পাইলে ...”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় নুরু গাজী । সে জানে তারা কোনদিন কারো নাগাল পাবেনা । দেশে এখন দুই ধরনের মানুষ । ধনী আর গরীব । অথচ যুদ্ধের সময় কত কিছুই না ভেবেছিল তারা ।
হাটের পাশেই পড়ে আছে তার তারুণ্যের সঙ্গী হরিপদের বাড়ি। আজও শূন্য ভিটায় তাকিয়ে থেকে কাকে যেন খুঁজে ফেরে তার মন । হয়তো অতীতকেই । এই তো এখানে এই আঙ্গিনায় হরিপদের বউ কত যত্নে সন্ধ্যামালতীর ফুলগুলো দিয়ে তুলসীতলায় প্রণাম জানাত । দীর্ঘায়ু কামনা করত স্বামী সন্তানের । ঈশ্বর তার প্রার্থনা শোনেননি । আজ সেই নিকানো উঠান দিনের বেলায় কাল কেউটের আর রাতে ভূত-প্রেতের বাসস্থান হয়ে একাত্তরে শহীদ হওয়া হরিপদের মৃত আত্মার প্রতি অলক্ষ্যে চেয়ে থাকে ।
প্রচন্ড হট্টগোল হচ্ছে কোথাও । তবে কি যাত্রা শুরু হয়ে গেল ! কয়েকদিন থেকে মাইকিং হচ্ছে স্কুলের মাঠে প্রত্যেক বছরের মত এবারও পুতুল নাচ আর যাত্রাপালা হবে । আগে দুই একবার গেলেও টিকেট কেটে অত্যন্ত অশ্লীল যাত্রার প্রিন্সেসদের নাচ আর কুরুচিপূর্ণ সংলাপ ভরা সেই পুতুলনাচ দেখতে এখন আর নুরু গাজী যান না । অথচ এক সময় বাংলার কি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য দেখেছেন তিনি । এই তো কয়দিন আগে লোক মুখে শুনেছেন বাউল গানের আসর থেকে গায়ককে জোর করে ধরে নিয়ে চুল কেটে তওবা পড়ানো হয়েছে এই দেশেই ।
নাহ ! যাত্রার শব্দ তো নয় । কেমন যেন একটা হৈ চৈ এগিয়ে আসছে এদিকেই । তবে কি দুই গ্রামবাসীদের মাঝে মারামারি বেঁধেছে ? প্রায়ই তো বাঁধে তুচ্ছ কারণ নিয়ে । কিছুদিন আগে এ গ্রামের রমজান পাশের গ্রামে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে অপরাধীকে বাঁচাবার জন্য তার আত্মীয় স্বজনসহ গ্রামবাসী অনেকেই টোটা, বল্লম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । অবস্থা বেগতিক হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে আসা পুলিশও আক্রমনের স্বীকার হয় ।
একসময় জনতার ভিড় তার দৃষ্টিসীমানার কাছাকাছি চলে এলো । হত বিহবল চোখে তাকিয়ে নুরু গাজী দেখতে পেলেন এই গ্রামেরই প্রভাবশালী ধনী, সব বিচার সালিশের হর্তাকর্তা শামসু রাজাকারকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে । কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য নাকি বিচার হবে । তাদের পেছনে পেছনে চলেছে শত শত গ্রামবাসী । তবে কেউই শামসু রাজাকারকে বাঁচাবার বা কেড়ে নিয়ে যাবার লক্ষন প্রকাশ করছেনা ।
নুরুকে দেখামাত্রই জনতা থেকে কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল “ পাখি এইবার পরিছে ফান্দে । এত দিন মাইনষের ভুল বিচার করি বেড়াইছ শামসু । এইবার বুঝবা ঠ্যালা । এই নুরু গাজী যুদ্ধ করিছিল । তার সাক্ষীতেই কাজ হবে । “

মন্তব্য শুনে সবাই সসন্মানে তাকাচ্ছে নুরু গাজীর দিকে । এতক্ষনে হাট থেকে ক্রেতারা উৎসাহ নিয়ে যোগ দিয়েছে জনতার কাতারে । কলমিলতা স্কুলের ঝাড়ুদার এক চোখ অন্ধ সফুরাও তাদের একজন । পা থেকে স্যান্ডেল খুলে সে শামসুর দিকে ছুঁড়ে মারল । আর বলা নেই কওয়া নেই রাধার পোষা শালিখ পাখিটি এত মানুষের মধ্যেও হঠাৎ উড়ে এসে শামসুর পায়েই ঠোকর দিতে শুরু করল ।
শত অনিয়ম, দুর্নীতি আর দারিদ্র্যের পরও এতটা বছর পর জনতার ভিড়ে নুরুসহ অনেকেই মুক্তির চেতনা আবার নতুন করে আজ অনুভব করল ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রোদেলা শিশির (লাইজু মনি ) এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেললাম .... ! গল্পটি বাস্তব মনে হলো ...! কিন্তু সমাপ্তিতে হয়ত আর একটু ক্লাইমেক্স আনা আপনার পক্ষে কঠিন কিছু ছিল না ...! অসাধারণ লাগলো ... ! শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ..... !
নিরব নিশাচর সব শেষে এক চিলতে সুখ এসে ধরা দিল মুক্তিযুদ্ধার কাছে... এটাই হয় অথবা এটাই হবে... সত্য একদিন জিতবেই.. একজন মুক্তিযুদ্ধার আষ্টে-পিষ্টে বেচে থাকা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ তোমার গল্পে... গল্পের বুনন বরাবরের মত সুন্দর ছিল... বেস্ট অব লাক.. পছন্দে তুলে রাখলাম...
মনির মুকুল শামসু বেঁচে যেত, যদি এই সময়ের অনেকের মত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গড়ে তুলতো। নিজেকে আড়াল করার জন্য চমৎকার কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। গল্পে বাস্তবতার চেয়েও সরল চিত্র অঙ্কিত হলো। রাজাকারদের চিন্তা আরো শিকড়সমৃদ্ধ। গল্পের বুনন বেশ ভালো হয়েছে।
মিলন বনিক সমসাময়িক একটা ঘটনা প্রবাহ নিয়ে এত সুন্দর কাহিনী বিন্যাস...খুব ভালো লাগলো...শুভ কামনা....
প্রজ্ঞা মৌসুমী হাটের বর্ণনাটা এত সুন্দর হলো। চরিত্র বাছাই...তৈরি ভালো লাগলো। এদের মাধ্যমে অনেক বিষয় তুলে ধরেছেন; প্রশংসা করতে হয়। ইফতির মতো আমিও ভাবছিলাম যোগসূত্র কিভাবে হবে। যেভাবে দেখানো হলো ভালো লাগলো। শফরুর গরীব মাছওয়ালার দিকে স্যান্ডেল তুলে মারতে যাওয়াটা পছন্দ হলোনা। হয়তো সেরকম'কটু মন্তব্য' দেননি বলেই এরকম মনে হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মূল্যহীন হয়ে যাওয়া মুক্তির চেতনাকে আবার যেভাবে গল্পে জাগিয়ে দিলেন সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো এটা। সব মিলিয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো গল্প।
মনির খলজি সুন্দর মুক্তির চেতনায় লিখা ...'যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার' বেশ সমসাময়িক ভাবনার শক্ত বুনোনে ভীষণ নান্দনিক লিখা .....শুভকামনা রইলো আপুর জন্য !
Arup Kumar Barua বত্তমান আন্দোলনের মূলসুর উঠে এসেছে | ভালো লাগলো |
মগজ ধোলাই.কম বড়ই দুঃক্ষের কতা শোনাইলেন বুবু। সোনার বাংলার ছেলেমেয়েরা কোথায় গেলো! এখন ওরা দিব্যি ঘুমে অচেতন। দিকে দিকে কালনাগের বিষাক্ত নিঃশ্বাস, প্রলয়সঙ্কেত আসন্ন। অতএব, সাধু সাবধান।
রওশন জাহান নেটে দুইদিন ছিলাম না তাই আমার লেখাও কেউ পড়েনি। আর কত কবি লেখককে দেখি মাসের পর মাস নেটে না থাকলেও তাদের লেখা পড়া হয় এবং বিপুল পাঠক ভোট পায়। আমার ক্ষেত্রে তাহলে বলতেই হয় আমি লেখক হিসেবে এতটা মানসম্পন্ন হতে পারিনি যতটা উপস্থিতি দিয়ে পরিচিত হতে পেরেছি।

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪