মানুষটা হাত-পা ছড়িয়ে উপুর হয়ে অনড় পড়ে আছে। সারা পিঠে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। জায়গায় জায়গায় থেতলানো। কানের পিছে মাথার কাছে জমাট বেধে আছে রক্ত। ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বুঝা যায়। মুখের বামপাশটা মেঝেয় ঠেকানো। ঈষৎ হ্যাঁ হয়ে আছে ঠোঁটজোড়া। কষা বেয়ে রক্ত পড়ছে। চোখদুটো আধ-বোজা। পরনের লুঙ্গিটা কোমর অব্দি উঠানো। দু’পায়ের ফাঁকে লজ্জাস্থান দেখা যাচ্ছে। তারপরেও কেউ তা ঢেকে দিচ্ছে না। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে কখন পুলিশ এসে লাশটা তুলে নিয়ে যাবে।
পড়ে থাকা মানুষটার নাম নুরা পাগলা। কমলাপুর ষ্টেশন রোডের দেয়াল ঘেষা ফুটপাতে রাত কাটানো প্রতিটা বাসিন্দাই তাকে এ নামে চিনে। নামে পাগলা হলেও মূলত সে শান্তিপ্রিয় চুপচাপ মানুষ। এর ওর ফেলে দেওয়া খাবার আর আশপাশের হোটেলের উচ্ছিষ্ট খেয়েই জীবন চলে তার। এমনিতে কারো সাতে-পাঁচে নেই। কিন্তু, ক্ষেপে গেলেই সমস্যা। তখন চিৎকার-চেচামেচিতে মারমার কাটকাট অবস্থা করে ছাড়ে। সে কারণেই তাকে সবাই পাগলা নামে চেনে। সচারাচর কেউ তাকে ঘাটায় না। আসলে কেউ তাকে বিরক্ত না করলে, সে নিজেও কারো উপর চড়াও হয় না।
এহেন মানুষটার এরকম নির্মম পরিণতি কেউ চায়নি। কিন্তু তাই হলো। বেঘোরে গণপিটুনীঁতে প্রাণ গেল তার। অপরাধ এই ফুটপাতেরই আরেক বাসিন্দার অবুঝ শিশু সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা। যদিও তার সেই চেষ্টা ফলপ্রসু হবার আগেই সে ধরা পরে যায়। যার পরিণতিতে এমন নির্মম মৃত্যু। অদূরেই সেই শিশু সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে তার মা। দেয়ালে হেলান দিয়ে শক্ত করে বসে আছে সে। তার মাথায় কিছুতেই আসছে না, নুরা পাগলা হঠাৎ এমন একটা কান্ড করে বসল কেন। যত যাই হোক তার সোনা মানিক'কে সে ফিরে পেয়েছে, সে এতেই খুশী। নুরা পাগলার এরকম করুণ পরিণতির জন্য ভাবতে তার কোন দায় পড়েনি।
*************************************************
পুরনো দু’চালা ঘর। জং ধরে এখানে-ওখানে ফুঁটো হয়ে গেছে চাল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের জিনিসপত্র সব ভিজে একাকার। চালের ফুঁটো আর বেড়ার ফাঁক গলে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। ঘরের ভেতর দিকটায় বেশ খানেকটা উচুঁ করে মাটির প্রলেপ বেড়ার সাথে লেপে দেওয়ায় ঝরে পড়া বৃষ্টির জল বের হতে পারছে না। ফলে ঘরের মেঝেটা ধীরে ধীরে একটা জলাধারের আকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু, ঘরের বাসিন্দাদের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ছেড়া-ফাঁটা বিছানায় এক জোড়া পুরুষ-রমনী আদিম খেলায় মত্ত। তারা দুজনেই স্বামী-স্ত্রী। আশ্বীনি বৃষ্টির ঝমঝমানো সুরে মাতোয়ারা হয়ে তার দু’জনেই মেতে আছে উন্মাতাল শরীরি প্রেমে। সেকারণেই তাদের বিছানার কিনারা ঘেষে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত শিশুটি কখন যে গড়িয়ে নীচে পড়ে গেছে সেটা তারা টেরই পেল না।
শরীরী ঝড় থেমে গেল একসময়। থামলো বৃষ্টিও। ক্লান্ত নর-নারী দু’জন বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতে গিয়ে আবিস্কার করল তাদের পাশটা শুন্য। লাফিয়ে বিছানা ছাড়লো দুজনেই। মেঝেটা ততক্ষণে একটা ছোট-খাটো পুকুর হয়ে গেছে। তাতে ন্যাতানো তেনার মত ভাসছে তাদেরই সন্তান। নির্জিব শরীরটা টেনে তুলতেই বুঝতে পারলো তারা ইতোমধ্যে সন্তানহারা হয়ে গেছে।
পরদিন সকালে বাচ্চাটাকে কবর দিয়েই নিরুদ্দেশ হলো বাবা। মানূষটা আগে থেকেই একটু পাগল কিসিমের ছিল। সচারাচর সংসার তথা স্ত্রী-সন্তানের প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিলনা। কিন্তু কখনো কখনো বিশেষ মুহুর্তগুলোয় সেই হয়ে যেত অতীব ভালবাসাময় একজন স্বামী কিংবা সন্তার বাৎসল্যেভরা একজন বাবা। সে কারণেই তার শিশু সন্তানের এরকম করুণ মৃত্যুর আঘাত সে মেনে নিতে পারলো না। স্ত্রী-সংসার সব কিছুই তার কাছে খুব তুচ্ছ মনে হলো। যার দরুণ এহেন নিষ্ঠুর সংসার থেকে বাচাঁর জন্য শেষমেশ পালিয়েই গেল সে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে তার স্ত্রীও একদিন অজানার পথ ধরলো।
*********************************************
রাতভর অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। ফুটপাথে শুয়ে থাকা মানুষগুলো একটু আড়ালে যেয়ে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। যাদের সে সুযোগ নেই তারা যেখানে শুয়ে ছিল সেখানেই গায়ের উপর পলিথিন টেনে জড়সড় হয়ে বসে কিংবা শুয়ে থেকে বৃষ্টিকে আড়ালের চেষ্টায় আছে। ব্যতিক্রম শুধু নুরা পাগলা। কারণ বৃষ্টি নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। তার শুধু ভয় বৃষ্টির কারণে জমে থাকা পানিকে। সে কারণেই রাস্তার ফুলে-ফেঁপে উঠা পানি যখন ফুঁটপাত স্পর্শ করলো তখনি সে নড়েচড়ে বসলো। ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। তখনি চোখ পড়লো পাশেই দেয়াল ঘেসে শুয়ে থাকা এক জোড়া শরীরের দিকে। গাঢ় পলিথিনের নীচে তাদের নাড়াচড়ায় আদিম খেলার আভাস। পাশেই পলিথিনের ফাঁক গলে একটা শিশুর আধেক শরীর বেড়িয়ে আছে। পাতলা সরীসৃপের মত তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তায় ভেসে উঠা পানির স্রোত।
মহুর্তেই ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলল নূরা। লাফিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। ছোঁ মেরে তুলে নিল বাচ্চাটাকে। তারপর দৌড়াতে শুরু করলো কমলাপুর ষ্টেশনের দিকে। মাথায় একটাই চিন্তা, যে কোন মূল্যেই হোক তাকে প্লাটফর্মে পৌঁছুতেই হবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ
তন্ময় হয়ে পড়ছিলাম। আবেশ-জড়ানো জীবনছবি। জীবনের একান্তে কোন এক কেন্দ্রে এসে পাগলামিটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। পুরো আকাশ থেকে এক টুকরো মেঘ চশমার ফ্রেমে বন্দী হলো যেন। ভাল লাগাটা আকাশের মতই ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।