একজন কদম আলী

মুক্তির চেতনা (মার্চ ২০১২)

বিষণ্ন সুমন
  • ৩০
প্রতিটা মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন নিজেকেই তার নিজের কাছে বোঝা মনে হয়। আর যদি মানুষটা হয় শারীরিকভাবে পঙ্গু ও বাকশক্তিহীন, তবে তো তার জীবনটা আরো ভয়াবহ। আজ ক'বছর যাবত এরকম একটা দুঃসহ জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু, এই জীবনটা সে আদৌ চায়নি। তার কণ্ঠ এমন করে নীরব হয়ে যাবে এটা সে কখনোই আশা করেনি। ভেবে অবাক হয়, যে কিনা অনেক মানুষকে মুক্তির স্বাদ পাইয়ে দিতে একদিন এই জীবনটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল, সেই কিনা আজ নিজ ঘরে বন্দী হয়ে আছে। যার কারণে এই দেশের অজস্র মানুষ আজ গলা ছেড়ে কথা বলতে পারছে, সেই তাকেই কিনা আজ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু, এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়। আবার নিজের ইচ্ছেয় এ জীবন থেকে মুক্তি নেবে তাও সম্ভব নয়। আর তাই কিছু একটা করতে হবে। এমন কিছু যাতে তার এই নগণ্য অথর্ব জীবনটায় একটা পরিবর্তন আসে। কিন্তু করবেটা কি। যেখানে নিজ থেকে নড়াচড়া কিম্বা খাওয়া-দাওয়া কিছুই সে করতে পারেনা, সেখানে নতুন করে ভিন্নতর কিছু করবার ইচ্ছে থাকলেও শারীরিক সামর্থ্য তো তার নেই।

এই হল কদম আলী। একাত্তরের সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, যার কারণে একদিন অত্র এলাকার মানুষ গর্ববোধ করতো। আমাদের একজন কদম আলী আছে, এই কথাটা হরহামেশা মুখে মুখে রটে যেত সবার। তাইতো বিশেষ দিনগুলোতে ফুলে ফুলে ছেয়ে যেত তার আঙ্গিনা। কিন্তু সেই মানুষটাই আজ বড় একা হয়ে গেছে। আশেপাশের মানুষতো বটেই, একান্ত প্রিয়জনেরাও আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। একমাত্র ছেলেটার কারণেই আজ তার সবাই পর হয়ে গেছে। অভাবের সংসারের টানা-পোড়েনে রোগ-শোক আর জীর্ণতা বাসা বেঁধেছে শরীরে। আজ তাই কদম আলী একজন রোগাক্রান্ত নিঃসঙ্গ মানুষের নাম। তবে শারীরিকভাবে অক্ষম বা বাকশক্তিহীন হলেও সে কিন্তু বধির কিংবা অন্ধ নয়। বাতাসে ভেসে আসা ফিসফাস আর টুকরো-টাকরা শব্দের বদৌলতে সে স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছে ছেলেটা তার অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছে। ইদানীং ওর মুখ কদাচিৎ সে দেখতে পায় কিনা সন্দেহ। আজকাল তার চলাফেরাতেও একটা চোরাচোরা ভাব এসেছে। প্রায়শই অনেক রাত করে বাড়ী ফিরছে। আবার কোনোদিন ফেরেও না। নিজের জমি বলতে তো তেমন কিছুই নেই। একমাত্র সম্বল বলতে এই বাড়িটাই আছে কেবল। তাই বাধ্য হয়েই দু'মুঠো অন্নের সংস্থান করার জন্য বৃদ্ধা বউটা সারাদিন এবাড়ি-ওবাড়ি ছুটে মরছে। ছেলের সেদিকে বিন্দুমাত্রও খেয়াল নেই। সবই বুঝে সে, কিন্তু কিছুই করার নেই। সময়ের ফেরে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কাছে আজ সে বড় অসহায়।

এই যেমন এখন তার প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। হাতের কাছের ছোট্ট টেবিলটায় পানি ভর্তি জগ সমেত একটা গ্লাসও রাখা আছে। তারপরেও সে পানি পান করতে পারছে না। কারণ একটাই, জগ পর্যন্ত পৌঁছুবার জন্য কার্যকর একটি সক্ষম হাত তার নেই। সত্যি বলতে কি তার দুটো হাতই এখন অকেজো। নিজের হাত দিয়ে কিছু করবার শারীরিক সামর্থ্য সে অনেক আগেই হারিয়েছে। মাঝে মাঝে সে বেঁচে আছে কিভাবে, এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়। প্রতিটা দিন সকাল থেকে রাত অবধি বিছানায় শুয়ে থেকে বৃদ্ধা বউয়ের সাহায্যে প্রাত্যহিক সবকিছু করার নাম যদি জীবন হয়, তবে সেই জীবনকে এমন করে টেনে নেবার নাম অবশ্যই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায়। তার বৃদ্ধা বউয়ের ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। সে ফেরা মানেই দু'মুঠো খাবারের ব্যবস্থা। সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি টুকটাক ফাইফরমাশ খেটে কিংবা ভিক্ষে করে কিছু চাল-ডাল, নুন আনাজ জোগাড় করে আনে। রাতে তাই দিয়ে কিছু একটা রেধে উদর পূর্তি হয় বুড়ো-বুড়ির। ছেলেটার একটা দিক ভাল। অন্তত: তাদের খাবারে ভাগ বসায় না। উচ্ছন্নে গেলেও অন্তত: নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজে করতে পারছে এটা ভেবেই সে সুখ পায়। তাই ছেলেকে নিয়ে এখন আর ভাবে না। আর এই মুহূর্তে তো ভাববার প্রশ্নই আসে না। কারণ এখন তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন করেই হোক একটু পানি তার পেতেই হবে। তার মানে যে কোন ভাবেই হোক জগের কাছে পৌঁছাতেই হবে তার হাতটা। কিন্তু কিভাবে ? পরক্ষণেই তারা স্মৃতিতে দোলা দিয়ে গেল ৭১ এর সেই উত্তাল সময়টার কথা। সেদিনও কি তারা ভেবেছিল এই দুর্বল শক্তি নিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করতে পারবে। কিন্তু শেষমেশ ঠিকই পেরেছিল। সহসা তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি দোলা দিয়ে গেল। সেদিন পারলে আজ পারবে না কেন। পারতেই হবে তাকে। সহসা মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিল। একাগ্র চিত্তে মনোযোগ দিল ডান হাতটার উপর। ভুলে যেতে চেষ্টা করলো ওটা অক্ষম। মনের সবটুকু শক্তি দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলো। পারুক বা না পারুক, অন্তত বুড়ি পৌঁছুবার আগ পর্যন্ত নিজেকে ব্যস্ত তো রাখা যাবে।

ফস্ করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলে উঠায় মনোযোগ নড়ে গেল তার। অন্ধকার এরই মধ্যে বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। আলোর একটা শিখা ধীরে ধীরে টেবিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা খুশী হয়ে উঠলো তার। বুড়ি তাহলে এসে পড়েছে। পরক্ষণেই টেবিলের উপর রাখা কুপি বাতিটা ঘরময় একটা মলিন আলো ছড়িয়ে দিল। সেই আলোয় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটাকে দেখে সে ভীষণ আশ্চর্য হল। বউ নয়, ফিরে এসেছে তার ছেলে। কিন্তু, এসময় তো ওর আসবার কথা নয়। আরো অবাক হল যখন আবিষ্কার করলো ছেলে এবার খালি হাতে আসেনি। হাতে একটা চটের ব্যাগ ঝুলে আছে তার। বারকয়েক তার দিকে চোরা চাউনি হেনে ব্যাগটা মেঝেয় নামিয়ে রাখলো ছেলেটা। ইতি-উতি তাকাল সাবধানী চোখে। তারপর ব্যাগ থেকে সাবধানে বের করে আনলো মোমসদৃশ জিনিসগুলো। উঁবু হয়ে বসে বান্ডিলাকারে ওগুলো সাজিয়ে রাখতে লাগলো টেবিলের তলে।

ভয়ের একটা ঠান্ডাস্রোত বয়ে যেতে লাগলো কদম আলী বুক জুড়ে। জিনিসগুলো চিনতে তার বিন্দুমাত্রও অসুবিধে হয়নি। মারাত্মক এক্সপ্লোসিভ সমৃদ্ধ ডিনামাইট ষ্টিকস ওগুলো। যুদ্ধকালীন সময়ে এরকম সে অনেক ব্যবহার করেছে। এগুলোর ভয়াবহতা মনে করে রীতিমত আঁতকে উঠলো। কিন্তু এগুলো তার ছেলের কাছে কেন ? তাহলে এদ্দিন সে যা শুনে এসেছে সবি তবে সত্যি ! ছেলে তার সত্যিই তবে আন্ডারগ্রাউন্ড দলে নাম লিখিয়েছে ? কদিন যাবত কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছিল বর্তমান সরকারকে নাড়া দেবার জন্য একটা বড়রকম স্যবটাজ হতে পারে। তবে কি তার ছেলেও ওদের সাথে জড়িয়ে গেছে ! ওই ষড়যন্ত্রের হোতাদের সেও একজন ? চিন্তাটা মাথা এলোমেলো করে দিল তার। নিমেষেই একটা কিছু করার ইচ্ছে তার ভেতরে প্রবলতর হয়ে উঠলো। যারই প্রচণ্ডতায় অমানুষিক শক্তি বলে একটু একটু করে নাড়াতে লাগলো শরীরটাকে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঠেলে দিতে লাগলো খাটের কিনারার দিকে।

ছেলেটা ডিনামাইট ষ্টিকগুলো সব সাজিয়ে শেষ করে শরীরটাকে খাড়া করতে শুরু করেছে সবে। এমনি সময় ধুপ আওয়াজটা শুনতে পেল সে। পরক্ষণেই তার পিঠে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কদম আলীর পতিত শরীরটা সোজা তার পিঠে আঘাত করেছে। যার দরুণ সেও হুমড়ি খেয়ে পড়লো টেবিলটার উপর। তার হাতের ধাক্কায় কেরোসিনের কুঁপি বাতিটা উল্টে গেল। গড়িয়ে যেতে লাগলো টেবিলের কিনারার দিকে। থাবা দিয়ে ওটাকে আটকাবার চেষ্টা করলো ছেলেটা। কিন্তু ওকে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি ওপাশের কিনারা গলে সোজা নীচে নেমে গেল। নিয়তির অমোঘ বিধানের মতই ওটা আশ্রয় নিল সদ্য সাজিয়ে রাখা ডিনামাইটগুলোর উপর।

দলে দলে লোকজন এসে ভিড় করতে লাগলো মুক্তিযোদ্ধা কদম আলীর আঙিনায়। একনাগাড়ে কড়াত শব্দে আওয়াজ ফুটবার প্রচণ্ডতা তারা আগেই শুনতে পেয়েছে। কিন্তু এর সাথে এই জীর্ণ বাড়ীটার দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাবার কি সম্পর্ক কেউই বুঝতে পারলো না। তবে এই জন্য তাদের কারোই কোন দুঃখবোধ হল না। বরঞ্চ একজন দেশদ্রোহীর উপযুক্ত সাজা হয়েছে ভেবে সবাই আত্মতৃপ্তি বোধ করতে লাগলো। অদূরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করতে থাকা জবুথবু বুড়িটাকে তাই আমলেই আনলো না কেউ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মৃন্ময় মিজান কদম আলীরা এভাবেই দেশের জন্য নিজেদের উজাড় করে দেয়। যদিও তাদের মূল্যায়ন হয়না সেভাবে। গল্প ভাল লাগল।
মনির মুকুল শেষ? বাস্তবতার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে বুঝতেই পারিনি কখন শেষ করে ফেললাম। কদম আলীদের মনের জোর অনেক বেশি। এরাই পারে নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে। সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা বেশ সুন্দর একটি গল্প।
সেলিনা ইসলাম খুব সুন্দর কাহিনী ...অসাধারণ উপাস্থাপনা ...এমন করে হাজারো সন্তান ভুল শিক্ষা ও সঙ্গ দোষে বিপথে যাচ্ছে কিন্তু কদম আলীর মত একজন মুক্তিসেনার আজ ৪১ বছর পরে এসে আবারো দেশের জন্য , ঘরের শত্রুকে নির্মূল করে শহীদ হওয়া সত্যিই বিরল । ধন্যবাদ সুন্দর গল্পের জন্য
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ যাদের রক্তের স্রোত বেয়ে স্বাধীনতা আমাদের হলো তাদের উত্তর প্রজন্ম বিপরীত স্রোতে হাঁটবে কেন? একি আমাদের অক্ষমতা নয়? আমরা দেশ স্বাধীন করেছি কিন্তু প্রজন্মের জন্য আদর্শ হতে পারলাম কোথায়? হাজারো এরকম কদম আলীর ছেলে আছে সুস্থ ও চেতনা সম্মৃদ্ধ মানুষ করে গড়ে তুলতে পারি না? হতে পারে না আরেকটা মানুষ গড়ার যুদ্ধ? এখনে বিবেককে প্রশ্ন করতে হবে আমরা নিজেরা ক'জন মানুষ? ধন্যবাদ ও শুভকামনা বিষন্ন সুমন। আমি কিন্তু আমার প্রশ্নগুলোর জবাব আশা করছি। বিমুখ করবেন না যেন ভাই।
মামুন ম. আজিজ বিষয়বস্তু এবং পরিণতি ভাল লা করে লাগায় পর্যবসিত না করে পারলনা এই দূর্বল পাঠককেও। মন্দের দমনে ভালো মানুষের আত্মত্যাগ অনেক প্রয়োজন যেটা আজকাল আর দেখা যায়না।
মুহাম্মাদ মিজানুর রহমান কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে এলো......অসাধারণ............
মোঃ আক্তারুজ্জামান দারুন গল্প| একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ কোনদিন থেমে থাকে না| অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ চলতেই থাকে......কদম আলীর হাত দুটি অচল হলেও বিবেক ন্যায় বিবর্জিত নয়|
মারুফ মুস্তাফা আযাদ গল্পটা শেষ করার পর ফ্রান্সের সেই গ্রাম্য বালিকাটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই জোয়ান অফ আর্ক, যার নেতৃত্বে ফ্রান্স মুক্ত হয়েছিল কিন্তু তার কিছুকাল পরই তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ডাইনী আখ্যা দিয়ে। খুব ভালো লেগেছে সুমন ভাই।

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী