অক্ষরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শেষ| তবে, প্রতিবারের মত এবার গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়নি বড় ভাই রাব্বির সামনে এস.এস.সি পরীক্ষা তাই|সকাল বিকাল স্যারের বাসা, স্কুলে বিশেষ কোচিং, মডেল টেস্ট নিয়ে রাব্বি ব্যস্ত এবং সৃজনশীল পরীক্ষাতঙ্কে আতঙ্কিত।
উপর তলার ভাড়াটিয়ার মেয়ে ফারজানার কাছ থেকে সিক্সের গণিত ও ইংরেজী বই এনে অক্ষরের আম্মু 'সুমি' অক্ষরকে দিয়েছে|সকাল সন্ধ্যা সে বই দুটি পড়ে, হাতের লেখা প্র্যাকটিস করে, কম্পিউটারে গেইমস খেলে, নিয়মিত নামায পড়ে, ছবি আঁকে আবার বিকেলে গানও চর্চা করে|আর এমনি করে তার অখন্ড অবসর খন্ডে খন্ডে কেটে যাচ্ছে।
নাতিদের যাওয়া হয়নি তাই অক্ষরের নানু চালের গুড়া ও খেজুরের রস জাল দিয়ে গাঢ় করে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুমি ভাপা পিঠা তৈরী করছিল| আর অক্ষর গান করছিল 'গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত শীত বসন্ত, ছয়টি ঋতু ছয়টি রূপে এসে বাংলাদেশে, ছয়টি সুরে করে মাতামাতি ......'|
সুমি শুনছিল আর ভাবছিল গ্রামে প্রতিটি ঋতুরই রং, রূপ, রস, গন্ধ আলাদা আলাদা ভাবে অনুভব করা যেত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে|আজ এই ইট পাথরের বস্তিতে শুধু বর্ষাটাই টের পাওয়া যায় হাড়ে হাড়ে জলাবদ্ধতার কারণে|গ্রামে শীতের ভোরে ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাপা(ঢুপি)পিঠা, চিতই(খোলা)পিঠা, ম্যাড়া(কোণা)পিঠা, পাটি সাপটা, পাক্কন, পুলি ইত্যাদি পিঠায় শীত তাড়ানোর মজাই ছিল অন্যরকম|খালি পায়ে শিশির সিক্ত ঘাস মাড়িয়ে বকুল শিউলি কুড়ানোর আনন্দত আজ বইয়ের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে|যদিও এখন বার মাসই শহরের রাস্তার ধারে ধারে ভাপা পিঠা চিতই পিঠা পাওয়া যায়।বেকারি আর ডিপার্টমেন্ট স্টোরে শোভা পায় পাটি সাপটা, পাক্কন।অসময়ের পাওয়া বলে সময়ের সেই স্বাদটুকু পাওয়া যায় না।
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পুলি, নকশি কাঁথা গ্রামের সীমানা পেড়িয়ে শহরে; শহর ডিংগিয়ে মেগাসিটিতে এবং দেশের বাইরেও পাড়ি জমিয়েছে। তাতে করে আমাদের ঐতিহ্য দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে।এটা ভেবে সুমির ভাল লাগছে। তবে, এর সংগে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত গ্রামীণ জনপদের শিল্পী শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা হতে যেন বঞ্চিত না হয় সে বিষয়টিও সবার বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার - সুমি ভাবছিল।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠায় সুমি বর্তমানে ফিরে আসল|বলল, দেখত অক্ষর, কে এসেছে!দেখেই দৌড়ে এসে অক্ষর বলল, আম্মু পাশের বাসার আন্টি এসেছে|সুমির পিঠা বানানো প্রায় শেষ আর দুটি বাকী|হাত ধুয়ে উঠে গেল সুমি|বলল, ভিতরে আসেন ভাবি, বসেন।
দরজার বাইরে থেকেই ভাবি বললেন আজ না আরেকদিন|কেন আসলেন কী বিষয় সেটাইত বললেন না|তাইত!ময়নার মা আসছে কিনা জানতে আসলাম|বলল ভাবি।
সুমি বলল, না ভাবি গতকালও আসেনি আজও না| কি জানি আবার অসুস্থ হল কিনা!ভিতরে আসেন, ভাবি| পাশাপাশি থাকি শুধু জানালায় জানালায় কথা হয়| এসেই যখন পড়েছেন বসেন দুটো কথা বলি।
ভাবি ভিতরে এসে বসলেন|সুমি বলল, পিঠা বানাচ্ছিলাম একটু বসেন, আসছি|
রান্না ঘরে এসে কয়েকটা পিঠা আর এক গ্লাস পানি ট্রেতে সাজিয়ে অক্ষরকে বলল বাবা, তোমার আন্টিকে দিয়ে আস| এরই মধ্যে বাকী পিঠা দুটো তৈরী করে বসার ঘরে এসে সুমি দেখে ভাবি আনমনে পিঠার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটি ছলছল|সুমির আসা টের পাননি তিনি|সুমি ক্ষানিকটা বিব্রত।
পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য সুমি পিঠার প্লেটটা ভাবির হাতে দিয়ে বলল, আরে ভাবি পিঠা মুখে দেন।কী ভাবছেন অত!না, কিছুনা; বলল ভাবি। সুমি বলল, ময়নার মাকে খুঁজছিলেন কেন?
কয়েক রকমের ভর্তা আর কিছু পিঠা বানিয়েছিলাম, ময়নার মাকে দিয়ে আমার ছোট মেয়ে তিন্নির জন্য পাঠাব ভেবেছিলাম, বলল ভাবি।
ময়নার মা আসেনি কী হয়েছে! আপনার ছোট ছেলে শাকিবকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন, বলল সুমি।
সেটা সম্ভব না; আমরাও যাইনা ওরাও কেউ আসেনা মেয়েটাকেও আসতে দেয়না, বলল ভাবি।বলেন কি!কয়েক মাস আগেওত তিন্নিকে দেখলাম আপনার বড় মেয়ের ছোট ছেলে দুটিকে নিয়ে বেশ হৈ-হুল্লুড় করছিল।আমরাত মনেকরি দুই মেয়ে আর বড় মেয়ের জমজ দুই পিচ্চি নিয়ে বেশ আমোদ ফুর্তিতে আছেন আপনারা। আপনার নাতি দুটির কিচিরমিচির আর আধো আধো বোলে আমরাও আনন্দিত হই, এরই মধ্যে এমন কী ঘটল,বলল সুমি।
আর বলবেন না, ভাবি বলতে শুরু করলেন, আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ।বড় মেয়েকে বিয়ে দিলাম ভাসুরের ছেলের সাথে।নিজেদের মধ্যে থাকবে চোখের সামনে থাকবে।নিজেদের মধ্যেই আছে চোখের সামনেই আছে, ছেলে দুটিকে নিয়ে মেয়ে সকালে চলে আসে নাওয়া খাওয়া সব আমার এখানে রাতে শুধু ঐ বাসায় গিয়ে ঘুমায়।জামাই আমাদের এখানে আসেনা।কেন, কী তার চাওয়া তাও বলেনা।
ছোট মেয়েকে বিয়ে দিলাম ছেলে সরকারি চাকরি করে।আকদ হয়েছিল।ছেলেপক্ষের ৫০জনসহ দুপক্ষের মোট ১৫০ জনের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে হয়েছিল।তখন মেয়ে উঠিয়ে নেয়নি।পরবর্তীতে যখন মেয়ে উঠানোর আলাপ হল তখন ওরা বলল ছেলেপক্ষের অনেক আত্মীয়-স্বজন ২৫০জনের কম আসতে পারবেনা।মেয়ের বাবা বলল সবেমাত্র বাড়ির কাজ শেষ করেছি হাতে আমার সামান্য কিছু আছে।দুপক্ষের প্রায় শ'পাঁচেক লোকের খাওয়ার আয়োজন করা একেবারেই সম্ভব নয়।যাদের না বললেই নয় এমন ৫০/৬০ জন নিয়ে আপনারা আসেন; আমিও আমার এখানে মুরুব্বীদের বলি। তাতে করে শ'দেড়শ লোকের আয়োজন কোনরকমে আমি করতে পারব।এর বেশী কিছু এ মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব না। ছেলেপক্ষ ভীষণ রাগ করল, বিশেষ করে ছেলের মা।কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ওরা মেয়ে তুলে নিল।
আমরা আমাদের সাধ্যমত মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে সমাজ রক্ষা হয় এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছি।মেয়ে নিয়ে গিয়ে ওরা বেশ বড় করে ছেলে ও মেয়ের বিবাহ উত্তর গায়ে হলুদ এবং বৌ-ভাত এর আয়োজন করেছে।বলল ভাবি।
সুমি বলল, অনুষ্ঠানে আপনারা কতজন গেছেন?আমরা কেউ যাইনি।কারণ, আমরা কিছু করতে পারিনি, তাছাড়া আমাদের অপারগতায় ওরা অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে সমালোচনা করেছে।উঠতে বসতে মেয়েকে নানা কথা বলে খোঁটা দেয়। অনুষ্ঠানে গিয়ে আবার কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়!এইসব ভেবে আমাদের যাওয়া হয়নি।
এখন কী তিন্নির সাথে আপনাদের যোগাযোগ নাই? সুমি জানতে চাইল।
মেয়ের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয়।এরই মধ্যে সে প্র্যাগনেন্ট হয়েছে জানতে পেরে মনটা খুশীতে ভরে উঠে।সব ভুলে নানারকমের পিঠা এবং আরও আনেক খাবার-দাবার নিয়ে মেয়ের শশুড় বাড়িতে সপ্তাহ দুয়েক আগে গেলাম চলে।বেয়াইন দেখেই আগুন, যেন বাঘিনীর সামনে পড়লাম।
বেয়াইন বলে, ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি ফকিরের মেয়ে।কয়েকশ মানুষ খাওয়ানোর মুরদ নাই । মান সম্মান আর রইল না!আসছে ফকিরের বউ ফকিরের মেয়েকে দেখতে।কী নিয়ে আসছেন এগুলো?আপনাদের কিছুই আমি, আমার ছেলে বা আমরা কেউ খাব না।আপনার মেয়েকে খাওয়ান।বাকীগুলো ফেরত নিয়ে যাবেন।আমি বললাম এটা কি বলছেন বেয়াইন, এতগুলো খাবার ফেরত নিয়ে আমি কী করব? আমার ইজ্জত থাকবে? আপনারা না খান আপনাদের পাশে মেয়েদের যে মাদ্রাসা আছে সেখানকার এতিমদের না হয় দিয়ে দিবেন।বেয়াইন বলে, আপনাদের ওখানে নিয়ে কুকুর বিড়ালকে দিয়ে দিবেন।আমাদের এখানকার কাকপক্ষীও এসব খাবেনা।
ভাবি বলল, তাকিয়ে দেখি মেয়ের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি মেয়েকে নিয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়লাম। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মা-মেয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে হালকা হলাম।আমাকে খুশি করতে মেয়ে কয়েকটা পিঠা খেল।খেতে খেতে আমাকে বলল, মা, তুমি আর এসোনা।কিছু প্রয়োজন হলে আমি জানাব।ময়নার মা-ত বাসা চিনে, কাজ করতে আসলে ওকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও।একবুক কষ্ট নিয়ে সেদিনের মত চলে আসলাম|
সুমি জানতে চাইল, এত কথা শুনাল বেয়াইনকে আপনি কিছু বলেননি?
ভাবি বলল, না|মেয়েটার কথা ভেবে কোন জবাব দেইনি।
সুমি বলল, খুব ভাল করেছেন।দুই বেয়াইনে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লে তিন্নিও উত্তেজিত হত, তার মানসিক অশান্তি বেড়ে যেত।এ সময়ে মেয়েদের মনের প্রশান্তি খুব জরুরী।এরপ্র কি আর তিন্নির সাথে যোগাযোগ হয়েছে? কেমন আছে সে?-সুমি জানতে চাইল।
ভাবি বলল, গত রাতে মেয়ে মোবাইলে জানাল কয়েকদিন যাবত কিছুই খেতে পারছেনা।সবকিছুতেই কেমন যেন গন্ধ পায়।বমি বমি লাগে।ভাত খেতে ইচ্ছা করেনা।খেলেই বমি হয়।নানা রকম ঝাল ভর্তা খেতে ইচ্ছা করছে|
এ সময় এ ধরণের সমস্যা গুরুতর কিছু না।অনেকেরই গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস কারো কারো মাঝামাঝি বা শেষের দিকেও এমনটি হয়।আপনাতেই সেরে যায়।তবে, বমি বেশী হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।আমারও হয়েছে।চিন্তার কোন কারণ নাই বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছি।আর সকালে উঠেই ঝাল মরিচ দিয়ে শুটকির ভর্তা, সরষে দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা, কচু শাক ভাজি ও কিছু চিতই পিঠা বানালাম।ভাবলাম ময়নার মাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।কিন্তু ময়নার মা যে আজ এলোনা!মেয়েটা অপেক্ষায় থাকবে।ভাবির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
সুমি দেখল ভাবির চেহারাটা খুব মলিন হয়ে গেছে।ব্যথার অশ্রু ভাবির হাতে ধরা প্লেটের ভাপা পিঠায় ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে।সুমি অনুভব করল তার দুচোখও ঝাপসা হয়ে আসছে।