কাঁঠাল গাছে ভূতের হাড়ি

ভৌতিক (নভেম্বর ২০১৪)

মিলন বনিক
মোট ভোট ২৩ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.৮
  • ৩১
  • ২১
কাঠুরিয়া সদানন্দ মিশ্র।
সাঙ্গু নদীর পাড়ে পাহাড়ের কোল ঘেষে একটুকরো জমি। তাতে ছনের একচালা কুঁড়েঘর। নিতান্ত গরীব। কোন ধানী জমি নেই। সদানন্দর আট বছর বয়স। বাবার সাথে কাঠ কাটতে যায় সদানন্দ। নদীর পাড় ঘেষে কয়েক মাইল পথ পায়ে হেটে ঢুকে যেত গভীর জঙ্গলে। ভয়ে গা ছম ছম করত। খুব ইচ্ছা ছিল স্কুলে যাবে। লেখাপড়া করবে। কিন্তু কিছুই হলো না। একেতো অভাবের সংসার। তার উপর মায়ের ছিল কঠিন অসুখ। আর চার বছরের ছোট বোন সরলা।

একদিন মা মারা গেল। মারা যাবার সময় সদানন্দকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলল-কাঁদিস না রে বাপ। সৎ পথে চলবি। আপদে বিপদে মা দূর্গাকে স্মরণ করবি। মা দূর্গা তোকে রক্ষা করবে। সরলাকে দেখে রাখিস। তোর বাবা খুব ভালো মানুষ। আমি চলে গেলে তোর বাবার খুব কষ্ট হবে। তারপর একটা বড় ঢেকুর তুলে মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। সদানন্দ কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সদানন্দ আর সরলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাবা খুব কাঁদল।

একদিন। দু’দিন। তিনদিন। এভাবে আর বসে থাকা যায় না। দিনে দিনে বাবার শরীরটাও কেমন ভেঙ্গে পরছে। বড় হতে লাগল সদানন্দ। সাঙ্গুতে কল কল সুর তুলে জোয়ার ভাটা হয়। সদানন্দ পাড়ে দাড়িয়ে নদীর শব্দ শুনে। গুন টানা দেখে। দু’তিন জন লোক কোমড়ে কাছি বেঁধে বড় বড় বাঁশের চালি টেনে নিয়ে চলে ¯্রােতের অনুকুলে। প্রকৃতির সাথে সদানন্দের এক নিবিড় সম্পর্ক। যেদিন জঙ্গলে যেতে পারে না সেদিন সারাক্ষণ বড়শী নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকে। যা পাওয়া যায় তাতে খাওয়ার মাছ রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেয়। জঙ্গলে যাওয়ার পথে তিনকড়ি বাজার। মাছ বিক্রি করে বাজারে পাড়ার যোগেন কাকুর দোকানে একটু জিরিয়ে নেয়। যোগেন কাকু একটু মুড়ি বাতাসা খেতে দেয়। বাবা আর সরলার খোঁজ খবর নেয়। বাবার কাঁশিটা খুব বেড়েছে। দোকানদারকে বলে কাঁশির ঔষধ নেয়। ইচ্ছা ছিল সরলার জন্য একটা বাল্যশিক্ষা কিনবে। বইটা কিনতে পারলে পাশের গ্রামের অমলদা’কে একটু অ আ ক খ শিখাতে বলবে। কিন্তু পয়সা কুলাবে না। আর একদিন একটা বড় মাছ ধরতে পারলে বিক্রি করে অবশ্যই সরলার বই কিনবে।

সদানন্দ ¯^প্ন দেখে, সরলা অনেক বড় হবে। লেখাপড়া শিখবে। একটা ভালো পাত্র দেখে সরলার বিয়ে দেবে। অনেক বড় ঘর হবে। সরলা রাজরানী হবে। এতটুকুন বয়সে সংসারের পুরো দায়িত্ব সদানন্দের কাঁধে। এদিকে বোনটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বাবাও আর আগের মত জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কাটতে পারে না। এই বর্ষায় ছনের ছাউনিটা খসে খসে পরছে। ঠিক করতে না পারলে ঘরে থাকা যাবে না। বাবার সাথে নিয়মিত বনে গিয়ে কাঠ কাটাটা ভালোই রপ্ত করেছে। তুবুও বাবা সাথে থাকলে সাহসটা বাড়ে। বাবা সাথে থেকে শিখিয়ে দিত কোন গাছটা কিভাবে কাটতে হবে। ছোট গাছ কাটতে দিত না। বলত, ছোট গাছগুলো কেটে ফেললে একসময় বন উজাড় হয়ে যাবে। বনে গাছ না থাকলে আমরা খাবো কি। এখন সদানন্দ একাই বনে গিয়ে কাঠ কাঠে। তারপর মাথায় করে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বাজারে বিক্রি করে। তাতে কোন দিন একবেলা কোনদিন দুবেলা আহার জোটে। বাবার জন্য ঔষধ কিংবা বোনের জন্য আর বই কেনা হয়ে উঠে না।

নদীর ধারে বসে সদানন্দ ভাবে কি করা যায়। ক’দিন ধরে বাবার অসুখটাও বেড়েছে। ইদানীং বড়শী দিয়েও মাছ শিকার করতে পারছে না। নদীটা কেমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে চর পরে গেছে। এক শ্রেনীর প্রভাবশালী লোক সেই চর দখলের খেলায় মেতেছে। সেখানে সদানন্দরা যেতে পারে না। দু’টো শাক-সব্জী ফলাবে তারও কোন উপায় নেই। জঙ্গলগুলো চলে যাচ্ছে বন মানুষের দখলে। এখন গাছ কাটতে গেলে বলে, এখানে হাত দিবি না। এটা আমার বাগান। দেখছিস না কত টাকা খরচ করে বাগান করেছি। তাতে কয়েকটা শুকনো খড়ি কাঠ কুড়িয়ে ফেরত আসতে হয়।

আজ যেভাবে হোক বনে যেতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মা দূর্গাকে স্মরণ করে দা’টা কোমড়ে গুজে নদীর পাড়ে এসে দাড়িয়েছে। বাবা বিছানা থেকে ডেকে বলছে, ও সধু, তোর যোগেন কাকুকে বলে আমার জন্য একটু অষুধ আনিসরে বাপ। আর যে পারছি না। এই বুঝি মরে গেলাম। সদানন্দ এখন বড় হয়েছে। বাবার কথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে। বার বার বোনটার কথা মনে হচ্ছে। আজ কিছু পাওয়া না গেলে সবাইকে উপোষ থাকতে হবে। নদীর পাড়ে বটগাছে দুটো পাখি কিচির মিছির করছে। সদানন্দ পাখিগুলোর নাম জানে না। এর আগে কখনও দেখেনি। কিছু সময় বট গাছের ছায়ায় দাড়িয়ে পাখিগুলোকে দেখল। মনে হলো পাখিগুলো মানুষের মতো কথা বলছে। একটা পাখি যেন বলছে-

গঁভীর বঁনে কাঁঠাল গাঁছে
শুঁক সাঁরিদেঁর বাঁসা,
খুঁজে পেঁলে দূঁরগাঁ দেঁবী
মিঁটায় মঁনের আঁশা।

সাথে সাথে অন্য পাখিটি বলে উঠল-

যাঁ চঁলে যাঁ ত্বঁরা কঁরে
হিঁজল তঁলীর বঁনে,
শুঁক সাঁরিরা কঁইবে কঁথা
সঁদানঁন্দের সঁনে।

বলেই অমনি পাখি দু’টো সোজা পশ্চিমে উড়ে গেল। ভয় পেল সদানন্দ। এরাতো সত্যিই মানুষের মত করে নাকি সুরে কথা বলছে। সদানন্দ গ্রামে অনেক রকম ভূতের গল্প শুনেছে। এগুলো হচ্ছে মায়া ভূত। ওরা নানা রকম বেশ ধরতে পারে। মানুষের সাথে খুব ভালো ভালো কথা বলে। মায়া ভূত উপকারী বন্ধুর মত। নির্জন জায়গায় ডেকে নিয়ে যায়। তারপর গলা ছিড়ে রক্ত পান করে মেরে ফেলে। সদানন্দর ভীষণ ভয় হচ্ছে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। না গেলে বাবাকে বাঁচাতে পারবে না। হঠাৎ সদানন্দর মনে হলো ভূতেদের ছায়া মাটিতে পরে না। পাখিগুলো যদি ভূত হয় তাহলে ছায়া দেখা যাবে না। যদি সত্যি সত্যি উপকারী পাখি হয় তাহলে মাটিতে ছায়া পরবে।

সদানন্দ পাখিগুলোকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলো। কিছুদুর হাঁটার পর পথে হরি কাকার সাথে দেখা। বলল, এদিকে কাঠ পাবি কই। সব মানুষে গিলে ফেলেছে। কিছু পেতে হলে সোজা হিজল তলীর বনে চলে যা। সদানন্দ তাই করল। হাঁটতে হাঁটতে একটা শিরিষ গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছিল। একেতো উপোষ। প্রচন্ড ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে সারা শরীর নুইয়ে আসছে। খুব ঘুম পাচ্ছে। এখনও কাঠ কাটা শুরু করতে পারে নি। আরও অনেকদূর সামনে যেতে হবে। হঠাৎ উপর থেকে দু’টো কলা এসে পরল সদানন্দের সামনে। আর অমনি পাখিগুলো নাকি সুরে বলে উঠলো-

যাঁদুর কঁলা খেঁয়ে নিঁলে
বাঁড়বে মঁনোবঁল,
মিঁষ্টি হাঁড়ি দুঁষ্টু হাঁড়ির
দেঁখবি কেঁমন ছঁল।

সদানন্দ তাকিয়ে দেখল ঠিক মাথার উপরে বসে আছে পাখি দু’টো। তার ছায়া পরেছে মাটিতে। সদানন্দ কলা দু’টো কুড়িয়ে মা দূর্গার নাম নিয়ে খেয়ে ফেলল। এত সুন্দর পুষ্ট আর মিষ্টি কলা বাগানে কখনও দেখেনি। অনেক বড় একটা তৃপ্তির ঢেকুর উঠল। ওদিকে পাখিগুলো হিঁ হিঁ করে একসাথে হেসে উঠল। আবার উড়ে গেল অন্য বনে। সদানন্দ মনোবল ফিরে পেয়েছে। পাখিগুলোই যেন সদানন্দকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কখনও থেমে থেমে ডেকে বলছে-

আঁয়রে বাঁচা আঁয়,
হিঁজল তঁলী যাঁয়।

হিজল তলীর বনে পা দিয়ে সদানন্দর গা ছম ছম করে উঠল। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। সামনে দেখতে পেল এক সুদৃশ্য মনোরম ঝর্ণা। ঝর্ণার পানি পান করে আরও কিছুদূর এগিয়ে গেল সে। সূর্য তখন মাথার উপরে। প্রচন্ড রোদ। সারা শরীর ঘামে চুপসে গেছে। এবার একটু জিরিয়ে গাছ কাটা শুরু করতে হবে। বাবা আর বোনের জন্য খুব খারাপ লাগছে। কাঠ কেটে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে। বাবার ঔষধ নিতে হবে। আজ অনেক কাঠ পাবে। কিন্তু এত বড় বোঝা একা কিভাবে বয়ে নিয়ে যাবে তাই ভাবছে। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

জ্যোষ্ঠ মাস। নাকে পাকা কাঁঠালের গন্ধ লাগছে। সদানন্দ তাকিয়ে দেখল যে গাছটার নীচে সে বিশ্রাম নিচ্ছে সেটি একটি বড় কাঁঠাল গাছ। গাছে অনেকগুলো পাকা কাঁঠাল। পাকা কাঁঠালের মিষ্টি গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করছে। হাত বাড়ালেই পাকা কাঁঠালের নাগাল পাচ্ছে। সদানন্দর জিবে জল আসল। দাড়িয়ে একটি পাকা কাঁঠাল ছিড়তে যাবে অমনি অন্য একটি গাছ থেকে পাখি দু’টো চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠল-

কাঁঠাঁল ভূঁতের মিঁষ্টি হাঁড়ি
মঁগডাঁলেতে বাঁধাঁ,
হাঁতের কাঁছে দুঁষ্টু কাঁঠাল
ছিঁড়িস নাঁরে গাঁধাঁ।

সদানন্দ বুঝতে পারছে সে ভূতের ডেরায় পা দিয়েছে। মা দূর্গার নাম স্মরণ করল। মা বলেছে, মা দূর্গা সবকিছু থেকে রক্ষা করবে। খুব সাবধানে বুদ্ধির জোড়ে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মাথায় বুদ্ধি এলো, এই পাখি দু’টোর সাথে সখ্যতা করলে কেমন হয়। পাখি দু’টো এই পর্যন্ত বন্ধুর মত পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। বন্ধু হলে হয়তো অনেক কিছু জানা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল-
- তোমরা কে গো? সেই কখন থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছো।
- হিঁ হিঁ করে হেসে বলল, আমরা সুখ সারি।
- ইস! তোমরা কত ভালো। আমার বন্ধু হবে।
- তোমার বুঝি বন্ধু নেই? আর তুমিতো মানুষ। আমরা কেন তোমার বন্ধু হতে যাবো। আমরা তো পাখি।
- আমার মন বলছে তোমরাও একদিন মানুষ ছিলে। এতক্ষন তোমরা নাকি সুরে কথা বলেছো। এখন দেখছি তাও না। দিব্যি মানুষের মত কথা বলছো। ব্যাপারটা কি।
- এই বনে এলে আমরা আমাদের মেয়ের সাথে মানুষের মত কথা বলতে পারি। বনের বাইরে গেলে ভূতের ভাষায় কথা বলতে হয়।

তারপর পাখিরা কেঁদে কেঁদে অনেক কথা বলল। তারা বলল- সত্যিই আমরা একসময় মানুষ ছিলাম। বনে বনে কাঠ কাটতাম। একদিন এক অমাবস্যায় কাঠ কাটতে এসে এই কাঠাল তলায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। সাথে ছিল পরী। আমাদের মেয়ে। ভীষণ তেষ্টা আর ক্ষুধা পেয়েছিল। এখন যে কাঁঠাল দেখছো তখনও ওরকম কাঁঠাল ছিল। পাকা ঠসঠসে কাঁঠাল। খাওয়ার জন্য একটা কাঁঠাল পেরে যেই মুখটা খুললাম অমনি কতগুলো কঙ্কাল ভূত বের হয়ে এলো কাঁঠাল থেকে। এবার একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল-তুমি বুঝি ভয় পাচ্ছো।

সত্যিই সদানন্দ ভয় পাচ্ছে। তবুও বলল-না তেমন না। আমি তোমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি। আর আমার বাবা আর বোনের কথা ভাবছি। বাবার জন্য ঔষধ আর বোনের জন্য বই নিয়ে যেতে হবে। কাঠ না পেলে আমার ঔষধ আর বই কেনা হবে না।
- তোমার বুঝি মা নেই।
- না। অসুখে মরে গেছে। তারপর কি হলো বললে না তো।
- ও, তাই বলি। ভূতগুলো সব কঙ্কালের মত। কি বিশ্রি। সবাই আমাদের দু’জনকে চড় থাপ্পর আর কিল ঘুষি মারতে লাগল। আর বলতে লাগল আঁজ তোঁদের ঘাঁড় মঁঠকে রঁক্ত খাঁবো। তাঁরপঁর এঁকটুঁ এঁকটুঁ কঁরে মাঁংসঁ খেঁয়ে হাঁড়গুঁলো রেঁখে দেঁবো। আর উচ্চ¯^রে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। কিন্তু কি জানো, আমার পরীর গায়ে একটা চড় থাপ্পরও মারেনি। পরীতো শুধু ভয়ে কাঁদছে আর কাঁদছে। আমাদের তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমাদের কষ্ট দেখে পরী কঙ্কাল ভূতদের বলল-দোহায় তোমাদের, আমার মা বাবাকে আর মেরো না। ছেড়ে দাও। আমি আর কিছু খাবো না। আমার ক্ষুধা নেই বলে কাঁঠালের ভাঙ্গা অংশটা জোড়া লাগিয়ে দিল। সাথে সাথে সব ভূতগুলো নীরবে কাঁঠালের ভিতর ঢুকে গেল। আমরা ছাড়া পেয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য যেই দৌড়াতে গেলাম অমনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ইয়া লম্বা এক কঙ্কাল ভূত সামনে এসে হাজির। হাতের আঙ্গুলগুলো পাটকাঠির শলার মত লিক লিক করছে। পা জোড়া সুপারি গাছের মত লম্বা। চোখ দু’টো আগুনের মত জ্বল জ্বল করছে। মাথায় কালো হাড়ির মতো একটা পাগড়ী। কাঁঠাল গাছের উপরে তার মাথা। মাথা নীচু করে বললো-আমি এই হিজল তলীর রাজা। এই কাঁঠাল গাছে আমার বাস। এই সব দুষ্টু কাঁঠালগুলো আমার সৈন্য সামন্ত। আমি কাউকে মারি না। ছোট ছেলেমেয়েদের আমি খুব ভালোবাসি। আজ এই ছোট মেয়েটা তোদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। আজ থেকে ও পাখি হয়ে আমার মিষ্টি ভূতের হাড়ি পাহারা দেবে। আর তোদের শাস্তি হিসেবে পাখি বানিয়ে তোদের ছেড়ে দিলাম।

কাঠুরের মেয়েটি ছিল খুব বুদ্বিমতি। সে ভূত রাজাকে সাহস করে বলল-মহারাজ, আমার মা বাবা যদি পাখি হয়ে থাকে, আমাকেও পাখি হয়ে আমার মা বাবার সাথে থাকতে দিন। মা বাবাকে ছাড়া কি কোন ছেলে মেয়ে বাঁচতে পারে। আপনিই বলুন।
ভূত রাজা কিছুক্ষণ ভাবলেন। সত্যিইতো। ছোট মিষ্টি মেয়েটা মোটেও মিথ্যা বলেনি। তবুও ভূতরাজ বলে কথা। নিয়ম মানতেই হবে বলে গর্জে উঠল ভূত রাজ। পরী একটুও ভয় পেল না। বলল-
- মহারাজ, আপনি একটা উপায় বলে দিন না। কিভাবে আমি আমার মা বাবার সাথে দেখা করতে পারবো। কথা বলতে পারবো।
- হুম! উপায় একটা আছে। তোর মা বাবা পাখি হয়ে ঐ পাশে হিজল গাছের ডালে এসে বসবে। তবে কাঁঠাল গাছে বসতে পারবে না। ওখানে বসে তোর সাথে কথা বলতে পারবে। আর যেদিন অমাবস্যায় শনিবারে চৌদ্দ থেকে পনেরোয় পা দেওয়া কোন ছেলে ঐ দুষ্টু ভূতের হাড়ি থেকে কালো ভ্রোমরটাকে ছেড়ে দিয়ে তোকে উদ্বার করতে পারবে সেদিন তোরা আবার মানুষ হবি। মা বাবার সাথে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবি।

এই বলে ভূতরাজ কোথায় যেন মুহুর্তে মিলিয়ে গেল। এবার পাখি দু’টো সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল। বলল- তুমি আমাদের পরম বন্ধু। আজ অমাবস্যা। বারে শনিবার। আজই তুমি চৌদ্দ বছর পেরিয়ে পনেরোতে পা দিয়েছো। এই শুভদিনে একমাত্র তুমিই পারবে আমাদেরকে মুক্ত করতে। মিষ্টি হাড়িটা পেলে তুমি সারাজীবন সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে।
- কিন্তু কিভাবে। জিজ্ঞাসা করল সদানন্দ।
- আমরা বলছি। শোন। তুমি চারপাশে যে সব কাঁঠাল দেখছো আসলে ওগুলো কাঁঠাল নয়। সব দুষ্টু কঙ্কাল ভূতের হাড়ি। দেখতে অবিকল ঠিক কাঁঠালের মত। এতগুলো হাড়ির মধ্যে কেবল একটি হাড়িতে আছে একটি কালো ভোমরা। একটা কাঁঠাল দেখিয়ে বলল, ঐ যে কাঁঠালটা দেখছো, তার নীচে একটা কালো দাগ আছে। আসলে দাগ নয় ওটা একটা গর্ত। গর্তের মুখটা মাকড়সার জাল দিয়ে বন্ধ করা আছে। ঐ জাল ছিড়ে ভোমরাটা বের হতে পারে না। জালটা ছিড়ে ভোমরাটাকে মুক্ত করতে পারলে দুষ্টু হাড়ির ভূতগুলো সব তোমার বশ্যতা ¯^ীকার করবে। বিপদে আপদে তোমাকে রক্ষা করবে। আর মিষ্টি হাড়ি থেকে আমাদের মেয়েটাকে বের করে আনতে পারলে মিষ্টি হাড়িটা তোমার হয়ে যাবে। হাড়িটা যতক্ষন উপুড় করে ধরবে ততক্ষন সু¯^াদু মিষ্টি পরতে থাকবে। তোমার কোন অভাব থাকবে না। এমন সু-¯^াদু আর ভালো মিষ্টি পৃথিবীর কোথাও পাবে না। তোমার যত খুশী বিক্রি করে মা বাবা নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারো।

সদানন্দর সাহস বেড়ে গেল। মা কে বাঁচাতে পারেনি। অসুস্থ বাবা আর বোনের জন্য কিছু করতে পারছে না। আজ যেভাবে হোক মিষ্টি ভূতের হাড়িটা পেতেই হবে। সেই সাথে পরীকেও মুক্ত করবে। সদানন্দ দা’টা শক্ত করে কোমড়ে গুজে নিয়ে বলল-
- সবিই তো বুঝলাম। এবার তোমরা আমার জন্য একটা কাজ করতে পারবে।
- কি কাজ বলো।
- একজন গিয়ে ঐ কাঁঠালের গর্তের মুখ থেকে জালটা কেটে দাও।
- আমাদের তো কাঁঠাল গাছে যাওয়া বারণ আছে। তবে এখন ভর দূপুর। দুষ্টু ভূতগুলো সবাই ঘুমাচ্ছে। তুমি যদি সাবধানে গাছে উঠে জালটা ছিড়ে দিতে পারো।
- যদি সৈন্য সামন্তরা জেগে যায় তখন কি হবে।
চুপ হয়ে গেল সুখ সারি। কোন কথা বলতে পারল না। জেগে গেলে হয়তো সবার রক্ত মাংস খেয়ে কঙ্কাল বানিয়ে রাখবে। এটাই ¯^াভাবিক। আমি বুঝেছি তোমাদের মাথার ঘিলু কম। তাই বুদ্ধিও কম। ব্যাঙ্গ করে বলল সদানন্দ। আমাকে এবার বল, লম্বা বাঁশ ঝাড় কোথায় আছে।
- ঐ, ঐদিকে। চলো আমরা তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।

সদানন্দ সুখ সারির পিছু পিছু বাঁশ বনে গেল। অনেক লম্বা একটা মুলি বাঁশ কেটে নিল। বুদ্ধি করে বাঁশের মাথার ঝুটিটা রেখে দিল। যাতে সহজে মাকড়সার জালটা পেঁচিয়ে ছিড়ে ফেলতে পারে। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বেলা পরতে শুরু করেছে। হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই। বাড়ী ফিরতে হবে। পাশে হিজল গাছের মগডালে বসে মেয়েকে দেখছে সুখ সারি। আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে, হে ঈশ্বর, তুমি সদানন্দকে সাহায্য করো। আমরা যেন মানুষ হতে পারি এবং আমার মেয়েকে ফিরে পেতে পারি। সদানন্দ মায়ের কথা ভেবে মা দূর্গার নাম নিয়ে বাঁশটা হিজল গাছের সাথে ঠেস দিয়ে রাখল খুব সাবধানে।

এবার খুব সাবধানে হাতের নাগালের মধ্য থেকে একটা কাঁঠালের গায়ে হাত রাখল। অমনি সুখ সারি চেঁচিয়ে উঠল-
কাঁঠাঁল ভূঁতের মিঁষ্টি হাঁড়ি
মঁগডাঁলেতে বাঁধাঁ,
হাঁতের কাঁছে দুঁষ্টু কাঁঠাল
ছিঁড়িস নাঁরে গাঁধাঁ।

সদানন্দর মনে হলো পৃথিবীটা যেন দুলছে। কেঁপে উঠল হিজল বন। কিন্তু একটুও সাহস হারায়নি। খুব সাবধানে কাঁঠালটা ছিড়ে সবুজ ঘাসের উপর আস্তে করে বসিয়ে রাখল। যাতে কাঁঠালের মুখটা কোনভাবে ছিড়ে না যায়। এবার মুলি বাঁশটা অতি সাবধানে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁচু করে ধরে ঐ কাঁঠালটার নীচের কালো অংশটায় নিশানা ঠিক করল। নিশানা ব্যর্থ হয়নি। বাঁশের ঝুটির সাথে প্যাঁচ লেগে খুব সহজে মাকড়সার জালটা ছিড়ে গেলো। আকাশটাকে প্রচন্ড কাঁপুনি দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা কালো ভোমরা। ভোঁ ভোঁ শব্দে ভোমরাটা উড়ে গেলো আকাশে। ঘুম ভেঙ্গে গেল দুষ্ট হাড়ির ভূতদের। চারিদিকে গোঁ গোঁ শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলল। ঘুম ভেঙ্গে গেলো মহারাজের। প্রচন্ড রাগে গর্জনে পুরো হিজল বন ভেঙ্গে চূড়ে তছনছ করে মহারাজাকে আসতে দেখে ভয় পেল সদানন্দ। কান্নার রোল পরল সুখ সারির। সদানন্দ আস্তে করে নীচে বসিয়ে রাখা কাঁঠালের মুখটা খুলে দিল। সাথে সাথে বেরিয়ে এলো হাজার হাজার কঙ্কাল ভূত। আনন্দে নাচতে লাগল ওরা। আর বলতে লাগল-
- হে মান্যবর। আদেশ করুন। আপনার জন্য কি করতে পারি।
সদানন্দ আদেশ করল-সবাই মিলে ঐ ভূতরাজাকে এক্ষুনি তাড়িয়ে নিয়ে যাও। সে যেন আর কখনও এই বনে আসতে না পারে। তারপর সদানন্দ একটা দুষ্টু ভূতের হাড়ি বাদে হাতের কাছে যে ক’টা পেয়েছে সবগুলোর মুখ খুলে দিয়েছে। হাজার হাজার দুষ্টু ভূত তাড়িয়ে নিচ্ছে ভূতরাজকে। ভূত রাজ দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে। এবার গাছে উঠে মিষ্টি ভূতের হাড়িটা খুব সাবধানে নামিয়ে আনল। আর সুখ সারিকে বলল, গাছে আর যে ক’টা হাড়ি আছে তোমরা সবগুলোর মুখ খুলে দাও। সুখ সারি তাই করল। এবার মিষ্টি হাড়ি থেকে মুক্ত করল ছোট পাখি রুপী পরীকে।
পরী মানবী হয়ে জেগে উঠল। পরীকে জড়িয়ে ধরতেই পরীর মা বাবাও মানুষ হয়ে গেলো। এত সুন্দর মেয়ে সদানন্দ কখনও দেখেনি। অপলক তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। এবার ফিরতে হবে। আর একটু পরে সন্ধ্যা নামবে। সুখ সারি বলল-
- এবার আমাদের বিদায় দাও বাবা।
- সে কি! আপনারা কোথায় যাবেন।
- তা তো জানি না। এই বনেই কোথাও জায়গা করে নেবো।
- তা কি করে হয়। আপনারা আমার সাথে চলুন। আমরা সবাই একসাথে থাকবো।
সদানন্দ সবাইকে নিয়ে বাড়ী ফিরল। পরীও এখন সরলার সাথে ভালো স্কুলে লেখাপড়া করে। গঞ্জে সদানন্দর অনেক বড় দোকান হয়েছে। বাবা দোকানে বসে সদানন্দকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়। মানুষের উপকারে সদানন্দ এগিয়ে যায় সবসময়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সৃজন শারফিনুল অভিনন্দন ভাইয়া.., শুভেচ্ছা অফুরন্ত..।
রোদের ছায়া অনেক অভিনন্দন জানাই বিজয়ে।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অনেক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা।
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ..........
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪
তানি হক অনেক অনেক অভিনন্দন ভাইয়া ।
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ..........
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ শুভেচ্ছা রইল ।
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ..........
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪
রেনেসাঁ সাহা অনেক অভিনন্দন।
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ..........
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪
আফরান মোল্লা অভিনন্দন ভাইয়া॥
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ...........
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
সেলিনা ইসলাম অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা !
ভালো লাগেনি ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ...........
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
নেমেসিস অভিনন্দন।
ভালো লাগেনি ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪
ধন্যবাদ...........
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১১৩ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.৮

বিচারক স্কোরঃ ৩.২৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৫৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪