কোলাহল ছেড়ে কিছুদিন

মা (মে ২০১১)

শামীম আরা চৌধুরী
  • ১০
  • 0
  • ১২৫
বাস থেকে নামতে রাত আটটা বেজে গেল । এখন আবার নদী পাড়ি দিতে হবে । আবহাওয়াটা কেমন যেন লাগছে । ঝড় উঠলে নদীর মধ্যে নৌকায় বসেই ভিজতে হবে । তাছাড়া ভ্যান রিকসা কিছুই পাওয়া যাবে না । ভোগান্তির শেষ থাকবে না । এলোমেলো ভাবতে ভাবতে হাঁটছি । সমস্যা হলো না । প্রকৃতি অনুকূলই থাকলো । নদীর ঘাটে পেঁৗছাতে বেশি সময় লাগলো না । দূর থেকেই টের পেলাম নদীর অস্তিত্ব । নদীর উপর থেকে বয়ে আসা হিমেল হিমেল প্রবাহ গাঁয়ের প্রশান্তির হাতছানি দিতে লাগলো । নিকষ কালো আঁধারের বুক চিরে নৌকা তীরের দিকে ছুটলো । বিশালবক্ষা নদীর যেদিকে তাকাই শুধু নৌকা আর নৌকা । নৌকার পেটে জ্বলে থাকা হারিকেনের আলোগুলোকে জোনাকি পোকার মতো মনে হতে লাগলো । নৌকা ছেড়ে ভ্যান । বাসায় পৌছাতে বেশ রাত হয়ে গেলো ।
পাক্কা আট ঘণ্টা বাস জার্নি করেছি । শুয়ে বসে শান্তি পাচ্ছি না । মনে হচ্ছে শুধু দুলছি । সারাদিন বাসে যেভাবে দুলেছি সেভাবেই দোলাচ্ছে যেন । বাধ্য হয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমালাম । তারপরও ঘুম ভাঙলো দেরিতে । এখনও মাথাটা ঝিম ধরে আছে । সাড়ে তিনশো কি. মি. পথ পাড়ি দেয়া এখন আর সহ্য করতে পারিনা ।
একসময় খুব উচ্ছ্বাস হতো । জরিনতেও আনন্দ পেতাম । নিজেকে যেন নতুন কিছুর মাঝে আবিষ্কার করতাম । সকল কর্মব্যস্ততা পিছনে ফেলে নিজের শহরে যাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা । কয়েকদিন ধরে চলতো কেনাকাটা । গোছগাছ । তারপর একদিন খুব ভোরে উঠে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চড়ে বসা । শহরের কোলাহল পিছনে ফেলে বাস যখন ছুটে চলতো । কি যে আনন্দ হতো ! এখন আর সেই আনন্দ উচ্ছ্বাস না থাকলেও যেতে মন চায় । মন যেন পড়ে থাকে সেখানে ।
অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়না । একটু হাওয়া বদল দরকার। অস্থির হয়ে উঠছিলাম । যে লুকানো কৈশোরে পায়ের ছাপ এখনও জ্বলজ্বল করছে সেখানে যাবার উদগ্র বাসনা চেপে বসলো । মনে মনে স্থির করলাম । এবার যে কয়দিন বেড়াবো । বড় বোনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকবো । সেখানে বসে একটা গল্প লিখবো । গ্রাম্য পরিবেশে খোলা আকাশের নীচে বসে লেখার অনুভূতিটা কেমন তা পরখ করবো । গল্পের প্লট হবে তাৎক্ষনিক ।
অথচ সকালে উঠে মাথা ভার । তাই মনটাও ভার হয়ে গেলো । প্রাণ চঞ্চলতা ফিরে পাচ্ছি না । যতোটা ভালো লাগার কথা ততোটা লাগছে না । নাস্তা সেরে বাইরে চেয়ার নিয়ে বসেছি । অনেক দিন পর বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি । গল্প করছি । ইতিমধ্যে প্রতিবেশী একজন ভদ্রমহিলা দৌড়ে এসে বলতে লাগলো রাহেলা আত্মহত্যা করেছে ।
তার কথা শেষ না হতেই আমি জিজ্ঞাসা করে উঠলাম, কোন রাহেলা ?
বোনের এই গাঁয়ে বিয়ে হয়েছে প্রায় বিশ বছর হলো । সে বললো, পাশের গাঁয়ের এক মেয়ে রাহেলা । অভাবী ঘরের সুন্দরী মেয়ে হওয়াতে দুচার গাঁয়ের মানুষ তাকে চিনে ।
আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম । আবার জানতে চাইলাম, কেন আত্মহত্যা করলো ?
ভদ্রমহিলা বলে চললো, মাতবরের ছেলে উঠায় নিয়া গেছিলো । সেই অপমান সহ্য করতে পারলো না মেয়েটা । আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম । চল দেখতে যাব । বোন ইতস্তত করছে । তার আবার রান্না বান্নার সময় হাজির । আমাকে ভদ্রমহিলার সাথে যাবার বন্দোবস্ত করে দিলো । যথাসময়ে হাটা শুরু করলাম । গাঁয়ের মেঠো পথে হাটতে গিয়ে মন সবসময় অজানা এক আনন্দে ভরে উঠে । কিন্তু আজ আমি যাচ্ছি একটি মৃত্যু দেখতে । অস্বাভাবিক মৃত্যু । তাই উপলব্ধিটা অন্যরকম । হরিষে বিষাদ । মাথার ভারটা এবার বুকের মধ্যে চলে আসলো । একদিকে গাঁয়ের সি্নগ্ধ পরিবেশ । অন্যদিকে ইটের ভাঙা রাস্তা । হাটতে কষ্ট হচ্ছে । এমনভাবে হাটা হয়না বহু বছর । তবু কৌতুহল আমাকে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে অজানা এক জায়গায় । যেসব জায়গার কথা শুধু পত্রিকায় দেখি, যে সব ঘটনা সবসময় পত্রিকায় পড়ি । তা নিজের চোখে দেখার অদম্য কৌতুহল। কিন্তু কি দেখবো সেখানে । কেমন হবে পরিবেশ । ভাবতেও মনটা অস্থির হয়ে উঠছে । হাঁটছি আর কথা বলছি । একসময় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে গেলাম । দূর থেকেই দেখতে পেলাম লাশ ঝুলছে । মনের আজানতে নিজের লেখা দুলাইন কবিতা আওড়াতে লাগলাম ;
এভাবে তোমরা মরছো যুগে যুগে
তবুও থামেনি শকুনের খেলা
তবুও চলছে হায়েনার থাবা ।
গাছের সাথে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করা কোন মানুষ এই আমি প্রথম দেখছি । বুকের মধ্যে থেকে থেকে কেমন করে উঠছে । বিষণ্ণ মন নিয়ে এগিয়ে গেলাম । তারপর আরও যা দেখলাম, যা শুনলাম, তাতে কখন যেন আমার দু-চোখের কোন ভিজে উঠলো । আমার গল্প লেখার উপকরণ হলো সত্যি। কিন্তু ওদের বেঁচে থাকার উপকরণ কি ? সে প্রশ্ন আজও করি নিজেকে । বাড়ীর পথে পা বাড়ালাম ।
গল্পটা শুরু করি এভাবে-
রাহেলা স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা রেখে ঝপ করে মায়ের পাশে বসে পড়লো । মা জমিলা ঘরের মেঝেয় খেজুর পাতার পাটিটা বিছিয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল । সকাল থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে শরীরটা বেশ ক্লান্ত । একটু যেন ক্লান্তিটা তাড়িয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা । আবার তাকে কাজে বেরুতে হবে । রাহেলার কথা শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো জমিলা।
ক্যান, কি হইছে রে মা ? এই একটি মাত্র মেয়ে নিয়েই জমিলার জীবন । স্বামীকে হারিয়েছে প্রায় দশ বছর হলো । তারা চরের মানুষ । চরের মানুষের মাছ ধরা পেশা । মাছ ধরলে লাভ বেশি । জমিলার স্বামীও মাছ ধরতে যায় নদীতে । নদী থেকে গভীর সমুদ্রে । মাঝে মাঝে সমুদ্র আগ্রাসী রূপ ধারণ করে । আসে রাক্ষসী ঝড় জলোস্বাস । গ্রাস করে নিয়ে যায় জমিলাদের মতো নিরীহ মানুষদের । সর্বস্বান্ত করে দিয়ে যায় । তেমনই এক রাক্ষসী ঝড়ে ছোবল দিয়ে নিয়ে গেছে জমিলার স্বামী শাহজাহানকে ।
সেদিন জমিলা বার বার নিষেধ করছিল । নদীতে যাইতে হবে না । আকাশ জানি আইজ কেমন কেমন । জমিলার মনটাও তাই কেমন কেমন করছিল । বাধা মানেনি শাহজাহান । তখন তাদের নতুন জীবন । মাছ না ধরলে খাওয়াবে কি ?
শাহজাহান অকপটে বলে বসলো, আমারে বাধা দিসনা, জমিলা । নদী আমারে ডাকে । আমি বইসা থাকতে পারি না । এবার দেখিস মাছ বেশি ধরা পড়বো । তরে আর মাইয়ারে পোশাক কিইন্যা দিমু ।
জমিলা স্বামীর পাশে নির্বাক বসে থাকে । তার কথার উত্তরে কথা থেমে যায় । রাহেলার বয়স তিন বছর । গুটি গুটি পায়ে সারা উঠোন ঘুরে বেড়ায় আর জমিলা শাহজাহান চোখ ভরে দেখে । কি নাদুস নুদুসই না হয়েছে মাইয়াডা । আর কি সুন্দর গায়ের রং । গরীবের ঘরে এমুন মাইয়াও হয় । শাহজাহানের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় ।
বেলা পড়ে যেতে লাগলে গামছাটা কাঁধে নিয়ে শাহজাহান নদীর উদ্দেশ্যে বের হয় । জমিলা ভাবে যাবার সময় মাইয়াডারে কোলে লইয়া কতো আদর করলো আর বললো, কবে যে তগোরে দেখতে পামু । তার মাথায় মমতার হাত বুলাইয়া কইলো, ভালা থাইকো ।
রাইত নামলে আইলো সেই সর্বনাশা তুফান । রক্ষুসী নদী গিল্লা খাইলো শাহজাহান মিয়ারে । শুধু কি তাই । গ্রামটার উপরেও কেমনে হামলাইয়া পড়লো । গ্রাম ভাসাইয়া নিতে লাগলো রক্ষুসী বানে । গাছগুলো ঝপ ঝপ কইরা উপড়াইয়া পড়তে লাগলো ঘর বাড়ী মানুষ জনের উপরে। জমিলা নিজে কোনরকম রাহেলারে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ঘর থেইকা ছুটতে ছুটতে গিয়া উঠলো আশ্রয় কেন্দ্রে ।
সেই রাইত তো পোহাইলো । কিন্তু জমিলার জীবনে শুরু হইলো এক নতুন রাইতের ইতিহাস । ভাবলে শিরদাঁড়া সোজা হইয়া যায় । চোখ চক চক করে উঠে । জমিলা সোজা হয়ে বসে । মেয়ের গায়ে হাত রাখে ।
ক্যান যাবিনা মা ? ক, ক্যান যাবিনা ।
না যামুনা ।
কবি তো, ক্যান যাবিনা । আমি জানি তোরে জ্বালায় । মাতবরের পোলা তোরে জ্বালায় । ওই মাতবররে আমি খুন করমু । খুন কইরা জেলে যামু । এমুন করে বাঁচার চাইতে জেলখানাই ভালা । নিশ্চিন্তেৱ খাওন যায় । পরণ যায় । থাকনের জইন্যে চিন্তা করন লাগে না । চিল শকুনে খাবলাইয়া খাইবার পারে না । নিশ্চিন্ত ! কতো নিশ্চিন্ত !
চলো মা আমরা গাও ছাইড়া শহরে যাই ।
জমিলার সম্বিৎ ফিরে আসে । যামু । তয় তোর স্কুলে যাইতে হবে । তোরে নিয়া আমি বুকের মইধ্যে কত স্বপ্ন বুইনা রাখছি । তোরে আমি মাইনসের বাসায় কাজ করতে দিমু না । বেইজ্জতি হতে দিমূনা । মরছি আমি মরছি । তোরে মরতে দিমু না ।
মা জান, মাতবরের পোলা আমারে কইছে তুইলা লইয়া গিয়া বিয়া করবো । এতো শরমের কথা আমি কেমনে সমু মা । রাহেলা মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে । জমিলা দুইহাতে মেয়েকে সজোরে আঁকড়ে ধরে, তোর ভয় নাই । উদাস দৃষ্টিতে জমিলা বাইরে তাকায় । দৃষ্টির সীমানা গ্রাম ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেছে । যেখানে আর কিছু নেই । শুধু ধু ধু করা বালু আর বালু । যেখানে তার দৃষ্টি এখনো আটকে আছে শাহজাহান মিয়ার ফিরে আসার অপেক্ষায় ।
তারপর একদিন এই পথ চাওয়া বন্ধ করে কাজে নামলো জমিলা । মেয়েটারে বাঁচাতে হবে । এমন অন্ধ গাঁয়ে কাজ পাওয়া দুষ্কর । মাতবরের বাসায় ধান ভানার কাজ নিলো । রাইত বে রাইত ধান সেদ্ধ করতে হয় । শুকাইতে হয় । কামলা খাটন লাগে । তখন ভরা শরীর জমিলার । একপেচে শাড়ী পরে । ঘুমটা টেনে আঁচল দাতে চেপে কামড়ে রাখে । তবু মাতবরের দৃষ্টি পড়লো । ফাঁক ফোকরে ফুসলাইতে চেষ্টা করলো । কু প্রস্তাব দিতে লাগলো । সেখানে জমিলা বেশিদিন টিকতে পারলো না । আবার খাইয়া না খাইয়া দিন যাইতে লাগলো ।
এমনকি মা বাপ মইরা গেলে খালি ঘরে শুধু মাইয়াডা নিয়া থাকতে পারতো না । অন্যের বাড়ি মুরগির খোঁয়াড়ের পাশে পাশে রাত কাটাইতো । এরপর বুকে সাহস নিয়া ঘরে থাকতে লাগলো । নইলে তার ১০-১২ হাতের ছোট্ট ঘরটি ও বেদখল হইয়া যায় । দুয়ারের কাছে রাখতো বটিডা । উপরে ছনের ছাউনি করা ঘরটা দিয়া মাঝ রাইতে ঝরঝরাইয়া বৃষ্টি আইসা ভিজাইয়া দেয় দুই মা-ঝিয়েরে । কি প্রশান্তির সে বৃষ্টি । ওরা ভিজে । মন ভরে ভিজে । তবু ঘুম থেকে উঠে নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করে না । আবার কখনও চান্দের আলো ঝলমলাইয়া ঢুইকা পড়ে । তখন জমিলার মনটাও ঝলমল করে উঠে । তার রাহেলা ঐ চাঁদের আলোর লাহান তার আসমানে ঝলমল করে ঝুলবে ।
জমিলা বিছানা ছেড়ে উঠে । মেয়ের হাত ধরে টেনে উঠায় । মন শক্ত কর মা । আমাগো রুখে দাঁড়াইতে শিখতে হবে । ঘুরে দাঁড়াইলে শত্রু কিছুই করতে পারবে না ।
ক্যামনে মা । ওগো মুখের দিকে তাকানের সাহস ও তো আমার নাই । কেমুন ডর লাগে ।
কথা কয় যখন গাও দিয়া ঘাম ঝরে । কোমরে হাত বাইন্দা বেড়ি দিয়া দাড়ায় ।
আইচ্ছা । প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় লমু । দেশে এহন আইন হইছে । কড়া আইন । তুই খাইয়া ল । আমার লগে যাবি। আমরা দশ ঘর মানুষরে কথাডা কমু । দুই মায় ঝি একটা প্রতিরোধ গড়মু । এসপার ওসপার কইরাই ছাড়মু ।
কি খামু মা ?
বাসনে কয়ডা ভাত পানি দিয়া রাখছি । গুড় দিয়া খা ।
রাহেলা উঠে স্কুলের পোশাক পাল্টে নেয় । ভাতের থালা নিয়ে খেতে বসে । গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না । চোখে মুখে ধরা পড়া শাবক ছানার মতো ভয় ঠিকরে পড়ছে ।
এরপরের কয়দিন রাহেলার স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকে । মেয়ের জন্য জমিলা বোরখা জোগাড় করে । এমুন সুন্দর মাইয়াডা তার । কচুর লতির লাহান শরীলডা । মাইনষের নজরে তো পড়বোই । বোরখা পইরা গেলে আর সমস্যা হইবো না । তবু স্কুল বন্ধ দেওন যাবে না । রাহেলাকে বোরখা পরিয়ে জমিলা বিকল্প পথে স্বুলে দিয়ে আসে । যে পথে মাতবরের ছেলে রতনরা সাধারণত যায় না ।
রতন কয়েকদিন রাস্তার পাশে আড্ডা জমিয়ে রাহেলাকে না পেয়ে ক্ষেপা কুত্তার মতো হয়ে উঠে । এবার স্কুলের কাছাকাছি এসে দাড়ায় । দুর থেকে নজর দিতে থাকে । একসময় রাহেলার সে বিকল্প পথের সন্ধান পেয়ে যায় । হাজির হয় সেখানে । পথ আঁকড়ে ধরে বলে, পলায়া কয়দিন থাকবি ? শুনতাছি তোরা জনে জনে খবর করতাছিস । এইডা কি ভালা হইলো । আমার বাপের সম্মান আছে না ? গাঁয়ের মানুষ আমাগো কথায় উঠে বসে । তারা কি তগো কথা শুনবো রে রাহেলা । মর্জি করিস না । আমার সাথে চল । তোর আর তোর মায়ের কুন সমস্যা হবে না ।
তুমি আমার পথ ছাড়ো ভাই । রাহেলার কথা জড়িয়ে যেতে থাকে ।
ক্যান ? পথ কি ছাড়বার আইছি সুন্দরী ?
চল, বলেই হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মারে । রাহেলা কাটা কবুতরের মতো ছটফট করতে থাকে । চিৎকার করতে চাইলে মুখ চেপে ধরে । আসন্ন দুপুরে গাঁয়ের পথে জন মানবের সংখ্যা একেবারেই কম । তাছাড়া একপাশে বিশাল পুরানো জঙ্গল । আর এক পাশে ধু ধু মাঠ । সেই মাঠ পেরিয়ে ওপারে বয়ে গেছে ওদের গাঁয়ের নদী । তারই পাশে চরের মধ্যে রাহেলাদের বসত । এই জংলা এলাকাটা তাই প্রায় বিরান থাকে । সেই বিরান পথ ধরে রাহেলাকে ওরা কজন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকলো কোন গন্তব্যে ?

দুপুর গড়িয়ে গিয়ে রাহেলার স্কুল থেকে ফেরার সময় চলে যায় । জমিলা কাজ ফেলে ছুটে স্কুলের পানে । কাক পক্ষী ছাড়া আর কিছু নেই । স্কুল ঘরগুলো খাঁখাঁ করছে । আবার ছুটে আসে ছোট্ট কুড়েতে । পাতার তৈরি দরজাটা সজোরে টান দিলে খুঁটি থেকে ছুটে বাইরে পড়ে যায় । জমিলা দ্রুত ঘরে ঢুকে । এদিক ওদিক তাকায় । নাহ নেই । আবার বের হয় । মাতবরের বাড়ী যায় । পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে থাকে পাগলের মতো ।

এদিকে রতনের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রাহেলা ছুটতে ছুটতে ঘরে আসে । বই আর বোরখা ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলে । ছোট্ট একটা কাগজে মাকে উদ্দেশ্য করে লিখে । "মা । আমাগোর আর শহরে যাওয়া হইলো না । তোমার বুকের ভিতর যে স্বপন তুমি বুনছিলা তা উপড়াইয়া ফেলো । গোঁড়া থেইকা উপড়াইয়া ফেলো। আমাগোর স্বপন দেখতে নাই । বাপ গেছে । আমি গেলাম । ঐ জঙ্গলে । তুমিও আইসো । তোমার রাহেলা " এরপর সে ঘরের মধ্যে কাপড় মেলে দেয়া রশিটার দিকে তাকায় । ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত বাধা । হ্যাঁচকা টানে রশিটা ছিঁড়ে নিয়ে ছুটতে থাকে জঙ্গলের দিকে ।
জমিলা সারা পাড়া ঘুরে যখন কোন হদিস করতে পারলো না তখন বুঝে গেলো যা হবার তা হয়ে গেছে। ফিরে এলো ঘরে । যেন সারা জীবনের সব ক্লান্তি এই মুহূর্তে তাকে গ্রাস করে নিয়েছে । ঘরের মধ্যে বোরখা, বই আর কাগজের টুকরাটা পড়ে থাকতে দেখে । কাগজটা হাতে নিয়ে হাঁটু ভাজ করে দাওয়ায় বসে । জমিলা একেবারে অক্ষরজ্ঞানহীন ছিল না । মেয়ের লেখা সে পড়তে পারে । বাক শক্তি হারিয়ে ফেলে । জঙ্গলে যাবে । সে শক্তিও যেন নেই আর । মুহূর্তে পৃথিবীটা চোখের সামনে দুলে উঠে । জমিলা ভূপতিত হয় ।
হুস ফিরলে উঠে বসতে চেষ্টা করে । পারে না । ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখে তার রাহেলা একটু একটু করে চলে যাচ্ছে । চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে । জমিলা প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলো, 'রাহেলা তুই যাইস না মা । আমারে একা ফালায়া যাইস না । যে নাড়ি তেরো বছর আগে আমি কাইটা ফেলছি তা তুই আজ এক্কেবারে ছিনায়া লইলি । তোর গলার দড়িডা দিয়া আমার পেটের নাড়িতে আবার একটা পেঁচ দিয়া যা মা । শক্ত কইরা একটা বাঁধন দিয়া যা '। জমিলার আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে । এবার সে সর্বশক্তি দিয়ে উঠে বসে । ঘরের কোন থেকে তরকারি কাটা বটিটা নিয়ে ছুটতে থাকে মাতবরের বাড়ির দিকে । প্রকম্পিত বাতাস আর প্রলম্বিত সময়ের পিছে পিছে জমিলা ছুটছে আর ছুটছে । কেউ এগিয়ে আসছে না তাকে ধরার জন্য ।
এ পর্যন্ত লিখে খাতা বন্ধ করলাম । এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । ফিরে গিয়েই শেষ করবো । পুকুরের পাড়ে বসে লিখছিলাম । পানির দিকে তাকাতে ঝাপসা মনে হলো । এক ঝলক বাতাসে পুকুরের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ তুললো । পরদিন ভোরে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে বাসে চড়ে বসতে হবে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিন আরফান. শুধু প্রচার নয় ঢুল বাজিয়ে ভালো গল্প পড়ার আমন্ত্রণ, প্রয়োজনে খানা পিনার নিমন্ত্রণ করাসহ গল্পের দিকে ডাকতে হবে. চমত্কার একটি গল্প. ভুলতো কিছু থাকবেই সার্বিক বিবেচনায় গল্প কবিতাতে যারা অসাধারণ লিখে সেই তুলনায় কোন অংশে কম নয়. মতামত কম দেখে মনে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে গেলাম. শুভ কামনা রইল.
বিষণ্ন সুমন অনেক সাবলীল একটা লিখা, পড়তে গিয়ে এতটুকু হোচট খাইনি কোথাও. বিষয়বস্তু মনকাড়া . তবে একদম শেষ প্যরায় আত্মকথনমূলক গল্পের রূপ দেবার চেষ্টাটা এর সবটুকু সৌন্দর্যে কালী মেরে দিয়েছে. এটা বাদ দিলে এই গল্পটা নিস্সন্দেহে সেরাদের কাতারে দাড়িয়ে যেত.
অদৃশ্য ভালো লাগল। লেখা চালিয়ে যাবেন আশা রাখি।
মামুন ম. আজিজ সূর্য ভাইয়ের মন্তব্যটা যথার্থ
আনিসুল হক সূর্য ভাইয়ের কথা একদম ঠিক , ভালো লেখার কোনো দাম নাই এখানে , তাই বলে লিখা বন্ধ করলে চলবে না
sakil আমি মনে করি এটি একটি ভালো গল্প কিন্তু কেউ তেমন একটা পড়েনি. সুর্জ্হ ভাইয়ের মত আমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছে আসলে আমার মত পাঠকরাই এই গল্পটা পড়বে অন্য লেখার ভিড়ে আপনার সৃস্তিটি হারিয়ে যাবে ঠিকই . কিন্তু জয় আপনার হবে একদিন .
এস, এম, ফজলুল হাসান অনেক ভালো একটি গল্প , ধন্যবাদ
সূর্য আর একটা কথা আমার মতো কিছু নিয়মিত পাঠক লেখাটা হয়ত পড়বে, কিন্তু যাযাবর (যারা নির্দিষ্ট কিছু লেখা পড়তে আসে) পাঠকের কথা বলতে পারছিনা। এতে দুঃখ করোনা।
সূর্য সুন্দর গল্প। লেখকের একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, চরিত্রের প্রয়োজনে ভাষার প্রক্ষেপন। যখন লেখক তার নিজের বর্ণনায় লিখবেন সেখানে চরিত্র কর্তৃক ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ঠিক নয়। এই গল্পে এই টুকুই খুত {{রাইত নামলে আইলো সেই সর্বনাশা তুফান । রক্ষুসী নদী গিল্লা খাইলো শাহজাহান মিয়ারে । শুধু কি তাই । গ্রামটার উপরেও কেমনে হামলাইয়া পড়লো । গ্রাম ভাসাইয়া নিতে লাগলো রক্ষুসী বানে । গাছগুলো ঝপ ঝপ কইরা উপড়াইয়া পড়তে লাগলো ঘর বাড়ী মানুষ জনের উপরে। জমিলা নিজে কোনরকম রাহেলারে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ঘর থেইকা ছুটতে ছুটতে গিয়া উঠলো আশ্রয় কেন্দ্রে । সেই রাইত তো পোহাইলো । কিন্তু জমিলার জীবনে শুরু হইলো এক নতুন রাইতের ইতিহাস । ভাবলে শিরদাঁড়া সোজা হইয়া যায় । চোখ চক চক করে উঠে । জমিলা সোজা হয়ে বসে । মেয়ের গায়ে হাত রাখে । ক্যান যাবিনা মা ? ক, ক্যান যাবিনা ।}} ।>>> আর গল্প সম্পর্কে বলতে হলে বলব হৃদয় ছুয়ে যাওয়া একটা গল্প।
দেবব্রত দত্ত arche valo golpo ami akhane pori ni.... Kinto apnar jonno kosto hochche.... Khub olpo pathok e porbe apnar golpo.... Ami mugdho... Shuvo kamona roilo...

০৪ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪