আমার লিলু পুতুল

ভাই/বোন (মে ২০১৪)

Hilmi Fairooz
  • 0
  • ৭৪
আমি পৃথিবীর বহু সৌভাগ্যবান মানুষের মাঝে একজন যাকে সৃষ্টিকর্তা একটা লক্ষী-বুদ্ধিমতী বোন আর সবার আনন্দের উৎস হয়ে ওঠা একটা ভাই দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। আমরা দুটি বোন পিঠাপিঠি।দেড় বছরের ছোট হওয়া স্বত্তেও আমার বোনটাই আমার কাছে বড় হয়ে রইল- বুদ্ধিতে আর উচ্চতায়ও।আমাদের দুজনের একসাথে বেড়ে ওঠার পথে অগুনতি স্মৃতির কোলাহল। একসাথে গুনগুন করা,কাটাকাটি,গোল্লা-গোল্লা,হ্যাংম্যান খেলে খেলে দিস্তা দিস্তা কাগজের বিসর্জন তো সেই ১৬-১৭ বছর আগেকার ইতিহাস। আমার বোনকে আমি বলি “মেন্টর”। আসলে আমার যাবতীয় কর্মকান্ডের বিচক্ষণ বুদ্ধিদাতা সেই তো,তাই।তবে আজ আমার মেন্টরকে নিয়ে আড্ডা হবে না। গল্প হবে দুই বোনের নয়নের নিধি আনন্দ রাজ্যের ছোট্ট রাজকুমারের।আমি আদর করে লিলু পুতুল বলি, কিন্তু পৃথিবীতে আগমনের পর থেকে আদরের ফর্দতে তার নামের আধিক্যের অভাব হয়নি। জানমনি,মাসুম জান,মিনু,লক্ষী,বাবুটো,দাদন,ছোট পাখি,মুন্না,টুম্পামনি,আদর – এরকম কত নামেই না সারাদিনে তাকে ডাকা হয়।এত নামের ভিড়ে সে বাবা-মা আর বন্ধুদের কাছে জারিফ, শিক্ষকদের কাছে হিশাম।বিষয় খোলাসা করি, জারিফের আদুরে নামগুলোর চর্চা তার বোনদের একচ্ছত্র অধিকার,তাতে অন্যদের প্রবেশাধিকার সীমিতই।
জারিফের জীবন ঘড়ির কাঁটা আটটা বেজে কিছুদূর এগিয়েছে মাত্র।ক্লাস ওয়ান পাশ করেই সে ক্লাস থ্রির ছাত্র।বুদ্ধিমান বলেই মা তাকে ক্লাস টু এর মুখ দেখাল না।তবে যত বুদ্ধি তার কম্পিউটার আর মোবাইলের ফাংশনিংযে। মা পড়াতে গেলেই তার ঘুম আসে। মার খাওয়ার ভয়ে তাই দৌড়ে এসে ঝাঁপ দেয় আমার কোলে বা লুকায় আমার পিছনে।আমার আর জারিফের সম্পর্ক ভাই-বোনের সম্পর্কের উপরে বন্ধুত্ব,মায়া আর প্রীতি দিয়ে গড়া। ওর জন্মের সময়টাতে আমাদের দু’বোনের অদ্ভুত শংকার কথা মনে হলে আজ আমি বিব্রত হই। সেদিন আর আজকের সময়টাতে কত ব্যবধান!আমি তখন ক্লাশ টেন এর শিক্ষার্থী, আমার বোন আমার এক বছরের জুনিয়র। আম্মুর অন্তঃসত্তা হওয়ার বিষয়টি আমাদের আনন্দ দেবার বদলে মনে একটা অমূলক ভয় আর শঙ্কা তৈরি করেছিল।আমরা দুই বোন ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের এত স্নেহ পেয়ে বেড়ে ওঠেছিলাম যে নতুন ভাইয়ের আগমনে সে আদরের যবনিকা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে আযথা ভীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ছিলাম।খুব মনে পড়ে , মা আমাকে বলেছিলেন “ মানুষের হাতের পাঁচটা আঙ্গুল কোনটা ছোট,কোনটা বড়।এই আঙ্গুলগুলোর কোনটা কেটে গেলে বা ভেঙ্গে গেলে মানুষ একই রকম কষ্ট পায়,ব্যাথা অনুভব করে।এমন না যে, বুড়ো আঙ্গুলের জন্য মানুষের দরদ এক রকম আর কনিষ্কার জন্য আলাদা”।কৈশোরের সেই দিনে মায়ের সেই স্নেহমাখা কথা গুলোর কারনেই না নবাগত জারিফের নিষ্পাপ মুখটা দেখেই নতুন একটা সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে শিখলাম, বুঝিনি।ক্রমেই জারিফ আমার জীবনের সমার্থক হয়ে ওঠল, আমার জান- আমার ছোট্ট লিলু পুতুল।
জগতের আলো-বাতাস যখন জারিফকে নিয়ে খেলা করে,আমি তখন এস এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাই। আম্মু আর আয়া মিলে সংসারের ঝামেলা সারতে সারতে হাঁপিয়ে ওঠছিল।ছোট্ট জারিফ সহজে ঘুমাত না।তাকে ঘুম পাড়ানোর কৌশল বের করে ফেললাম।পায়ে বালিশ নিয়ে জারিফকে দোলাতাম আর হাতে থাকত বই।পড়ায় বিরতি দিতে ওকে শোনাতাম গান। আমাদের দুই বোনের কত বিস্ময় তখন ওকে নিয়ে! ওর নতুন হাঁটতে শেখা, ভাত খেতে শুরু করা, হাসি,ঘুম- সবই আমাদের কাছে অসীম ভালোলাগার উতস। জারিফ কার হাতে ভাত খাবে, কে জারিফকে গোসল করাবে, কে ওয়াশ করাবে এসব নিয়ে দু’বোনের ঝগড়াঝাটি কান্নাকাটির পর্যায়ে চলে গেছে কখনো কখনো ।আমাদের সাথে জারিফের বয়সের ব্যবধান এক যুগের কিছু বেশি হলেও সম্বোধনে কখনোই সে আমাদের ‘আপু’, ‘আপুনি’, ‘বুবু’ বা ‘আপা’- তে আটকে রাখেনি। আমাদের নাম ধরে ডাকার পূর্ণ স্বাধীনতা তারই।তেমনি, আমরা তিন ভাইবোন মায়া আর বন্ধুত্বকে গুরুগম্ভীর সম্বোধনের নিয়মের জালে আটকে ফেলতে চাই না, বয়সের পার্থক্য সেখানে যাই থাকুক না কেন।জারিফের উৎসুক মনে কত কত প্রশ্নের বহর।যেমন- শেয়াল কি খায়?১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা আমাদের এত মানুষ মেরে ফেলল।মানুষ মারতে ওদের ভয় করল না?ইত্যাদি ইত্যাদি।ওর অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নতুন বই পড়ি,ওয়েব সার্চ করি।আমার না শেখা অনেক বিষয় শেখার পথ আবিষ্কার করে দিল আমার লিলু জান।
জারিফের ছোট ছোট আবদার গুলো পূরণের চেষ্টা তার বোনদের সব সময় থাকে।টিভির রিমোট জয়ের ব্যাপারে জারিফ সিদ্ধহস্ত।আমার টক শো আর ছোট বোনের কোরিয়ান ড্রামার মাঝে পানি ঢেলে দেয় জারিফের ডোরেমন,আর্ট আটাক কিংবা পাওয়ার রেঞ্জার্স।বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমরা দুটি বোন তার সাথে কানামাছি,বরফ-পানি,চোর-পুলিশ,ওপেনটি বায়োস্কোপ খেলছি দেখে অনেকের চক্ষু চড়ক গাছ হতে পারে কিন্তু এটা সুন্দর সাদা বাস্তব।বাসার কাছাকাছি কোথাও এদিক সেদিক গেলে জারিফ সাথে যাবেই।না নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন তোলাই এক্ষেত্রে ভুল।কারণ এতে করে জারিফ যে জোরে কান্না জুড়ে দেবার দুঃসাহস দেখায়! সে ভয়েই উচ্চবাচ্য করার সাহস আমাদের হয় না।
আমার বোনটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে সিলেটে। তার অভাব আমাদের দু’ ভাইবোনকে খুব পোড়ায়।ছুটিছাটায় সে বাড়িতে এলে আবার ত্রিমোহনায় স্রোত আসে যেন।বাড়িতে প্রাণের সঞ্চার হয়।আমি আর জারিফ ঢাকায়,তিথি সিলেটে।স্বভাবতই সবাই ভেবে বসে জারিফকে এখন আদর করার লোক কমেছে।তাই সুযোগ নিয়ে অনেকেই জারিফকে বাজিয়ে দেখতে প্রশ্ন করে “বাবু, তোমাকে কে বেশি আদর করে?যূথী না তিথি?” ভাইটি আমার কম জ্ঞান রাখে না।তার সাফ জবাব –“ দুইটাই আমার আপু।দুইজনই আমাকে আদর করে, আমিও ওদের বেশি ভালোবাসি”।
আমার বন্ধুরা সবসময় বলে যে জারিফের বোন ভাগ্য ভালো।জানি না কথাটার সত্যতা কতটুকু। তবে জারিফের মন খারাপ দেখতে আমাদের ভালো লাগে না, জারিফ কাঁদলে কষ্ট হয়।খুব ভালো লাগে যখন এই ছোট্ট মাসুম জানটাকে এতটুকুন বয়সে মানুষের প্রতি সহমর্মী হতে দেখি। পরীক্ষা হয়ত খারাপ দিয়ে লুকিয়ে কাঁদছি।কেউ জানুক আর না জানুক,চোখের পানি দেখে জারিফ প্রথমে প্রশ্ন করবে কি হয়েছে? কিছু হয় নি বললে সারা বাড়ি রাজ্য করবে “যূথীর যেন কি হয়েছে,ও কাঁদছে”।মোনাজাতের সময়ও রেহাই নেই।আমার জোড়া হাতের উপর হাত রেখে চোখের পানি তার সংগ্রহ করাই লাগবে।এত ছোট্ট মানুষের এত খেয়ালী আদর ক্রমেই মায়া বাড়ায়।
জারিফকে ছেড়ে থাকতে পারব না বলে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ যাত্রায়ও রক্ষা নেই।আমার লিলু পুতুলটা বেশি বুদ্ধিমান।আমাকে বলে কিনা “তোমাকে বিয়ে করতেই হবে”।তার যুক্তির কাছে আমি পুরোই বোকা।সে আমায় বোঝায় “বাসায় যতগুলা মেয়ে ততগুলা ছেলে নাই।আমার দুইটা বোন শুধু,একটাও ভাই নাই।আমার দুইটা ভাই লাগবে।সেজন্য তোমাদের বিয়ে করতেই হবে!”
স্রষ্টার কাছে একটাই প্রার্থনা তিনি আমাদের তিনজনার জোটকে সুরক্ষায় রাখুন।আমার হায়াত নিয়ে হলেও আমার বোনটি আর লিলু পুতুলটা দীর্ঘায়ু লাভ করুক, জয় করুক মনের সকল ইতিবাচক চাওয়া।যত দিন বেঁচে থাকব, তিন জোড়া পা যেন একসাথে পথ চলতে পারে-এর চেয়ে বেশি আমি আর কি চাইতে পারি?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Abdul Mannan সহজ লেখনী , ভালো লাগলো। পাতায় আমন্ত্রণ....
নাজমুছ - ছায়াদাত ( সবুজ ) সুন্দর কথা দিয়ে সাজানো । বেশ ভালো লাগলো । সুভেচ্ছা অনেক ।

১৭ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী