সোনালী ডানার চিল

বাবা দিবস (জুন ২০১৩)

ম্যারিনা নাসরিন সীমা
  • ৮৭
চৈত্রের খরায় টিনের চাল আগুনের মত তেতে আছে । ভ্যাপসা গরমে শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। লোডশেডিঙের না আছে মা-বাপ, না আছে কোন স্টেশন । একবার শুরু হলে চার-পাঁচ ঘণ্টা গুহা মানবের মত অন্ধকারে বসে থাকা । ছোট এই মফস্বল শহরের মানুষ মিজান সাহেব । তাই কারেন্টের লুকোচুরির সাথে শরীর আর মন দুটোই অভ্যস্ত হয়ে গেছে । এখানে কত ঘণ্টা লোডশেডিং, সে হিসাব না করে কত ঘণ্টা কারেন্ট থাকল, সে হিসাব করাই বেশি সহজ । তিনি বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন । হাতে একটা নকশি করা হাতপাখা অনবরত ঘুরছে । তারপরও শরীরের ঘাম কমে না । কারণ শুধু যে গরম নয় সেটা তার কপালের ভাঁজ দেখলেই বুঝা যায় ।
বছর ত্রিশেক আগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত এই বেনাপোল শহরে পাঁচ কাঠার একখণ্ড জমি প্রায় পানির দরে কিনেছিলেন মিজান সাহেব । জমিটির চারদিকে প্রাচীর তুলে দিয়ে এক পাশে চার রুমের একটি টিনের ঘর তৈরি করে সেখানেই সংসার পেতেছিলেন । স্থানীয় একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক তিনি । বেনাপোল শহরে মিজান সাহেবই বোধ করি একমাত্র ইংরেজি শিক্ষক যিনি কিনা ক্লাসের বাইরে ছাত্র পড়িয়ে টাকা আয় করেন না । তার বাসায় অনেক ছাত্রকেই তিনি পড়ান । তবে, সেসব দরিদ্র ছাত্রদের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেন না । বরং প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে বই-খাতা কিনতে তাদেরকে সাহায্য করেন । এদের অনেকেই এখন নিজেদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত । তিনি মনে করেন এটাই তার বড় প্রাপ্তি । তার সাহায্য ছাড়া দরিদ্র এসব ছেলেদের অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পার হবার আগেই হয়ত ঝরে যেত।
বেসরকারি স্কুলের বেতন আর কত ! এতে সচ্ছল ভাবে সংসার চলে না । এখন সংসার বড় হয়েছে । খরচ বেড়েছে । কিন্তু আয় তেমন বাড়েনি । তাই সংসার চালানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে । দুই মেয়ে রুমকি চুমকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে । তাদের পিছনে টাকার বড় একটা অংক বেরিয়ে যায় । ছেলে রঞ্জু কোথাও চান্স পায়নি । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য বায়না ধরেছিল বাবা সেটা মেটাতে পারেনি । সেও দুই বছর আগের ঘটনা। ভর্তি হতে প্রায় চার লাখ টাকার দরকার ছিল । আবার মাসে মাসে বেতন, নানা ফি । তার মত একজন সামান্য আয়ের শিক্ষকের জন্য এটা গরিবের ঘোড়া রোগ ছাড়া কিছু না ।
মিজান সাহেব উঠে অস্থির ভাবে পায়চারী করতে থাকেন । বারবার বারান্দার শেষ মাথার ঘরটির বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন আবার ফিরে যাচ্ছেন । এটি তার ছেলের ঘর । ছেলে নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি । তাই অনেক চেষ্টা করেও তাকে আর কোথাও ভর্তি করা যায়নি । তার একটাই জেদ, সে আর পড়াশুনা করবে না । সেই থেকে বাবা ছেলের মধ্যে একটি অদৃশ্য দেয়াল উঠে গিয়েছে । ছেলের সাথে এই দূরত্ব ঘোচাতে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি ।
তিনি আবার বন্ধ দরজার সামনে এসে একটু ইতস্তত করে ধীরে ধীরে দরজার কড়া নাড়েন । ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার কড়া নাড়েন কিন্তু নাহ ! কোন আওয়াজই আসছে না ঘরের ভেতর থেকে । শুধু তার কড়া নাড়ার শব্দই প্রতিধ্বনিত হছে । তিনি বিড়বিড় করতে করতে নিজের জায়গায় ফেরত এলেন । কিছুক্ষণ পরে পাঞ্জাবি পাজামা পরে স্কুলের দিকে রওনা দিলেন ।
গনগনে সূর্যের রশ্মি থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায় দিয়ে মাথাটা নিচু করে হাঁটছেন মিজান সাহেব । আর কিছুক্ষণ পরপর তার হাতঘড়িটা দেখছেন । ১০:৫০ টা । আর মাত্র দশ মিনিট । আজকেও অ্যাসেম্বলির আগে স্কুলে পৌঁছাতে পারবেন না । লাল দাগ পড়ে যাবে উপস্থিতি রেজিস্টারে । সময় বদলে গেছে । আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল । এখন সেখানে নিয়মকানুনের বেড়াজালে ঠাটবাট জায়গা করে নিয়েছে । ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অনেক গুলো কিন্ডারগার্টেন আর হাইস্কুল । শুধু নামেই । ছাত্র পড়ানোর চেয়ে বিজ্ঞাপন-বিপণনেই তাদের বাজেট বড় থাকে । থাকে শিক্ষার্থী আকর্ষণের জন্য নানাবিধ চটকদার আয়োজন । প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে তাদের স্কুলেও নানা নিয়ম চালু হয়েছে ।
স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক তারই স্কুলের কয়েক বছরের জুনিয়র ছিলেন । কোন এক বিচিত্র কারণে মিজান সাহেবকে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না । তাকে তিরস্কার করার কোন সুযোগই তিনি হারাতে চান না । সেদিন পিওনের ডাকে প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকতেই তিনি মুখ বিকৃত করে ফেলেন ।
মিজান সাহেব সালাম দিয়ে সামনের একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন । প্রধানশিক্ষক হুম বলে একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন । মিজান সাহেব উসখুস করতে থাকেন । তিনি বুঝতে পারেন, এটা অপমান করার একটা তরিকা । তিনি বেশ স্পষ্ট করে বলেন,
স্যার, আপনি মনে হয় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ।
ও হ্যাঁ, আপনি কেমন আছেন ?
জী, ভাল । আলহামদুলিল্লাহ্‌ ।
আপনাকে দেখে তো মনে হয় না, খুব একটা ভাল আছেন । কোন সমস্যা আছে নাকি ?
না, কোন সমস্যা নেই ।
আমি তো শুনলাম, আপনার ছেলেকে নিয়ে কি যেন গোলমাল চলছে । একই শহরের মানুষ আমরা । একটু খোঁজখবর তো পাই ।
মিজান সাহেব একটু বিচলিত হয়ে বলেন, না না । কি বলেন স্যার ? ও কিছু না ।
আচ্ছা । কিছু না হলে তো খুব ভাল । যাই হোক, যে কারণে ডেকেছি সেটা বলি , আপনি নিশ্চয়ই জানেন, যে আমাদের স্কুলে কিছু নিয়ম আছে । শিক্ষকরা অ্যাসেম্বলির আগে আসেন । ছাত্ররা ঠিকমত ড্রেস পরে আসে কিনা সেটা দেখেন । ক্যাম্পাস পরিদর্শনেরও একটা বিষয় আছে । আপনার বোধ হয় ইদানীং একটু এদিক সেদিক হয়ে যাচ্ছে ।
স্যার, আমি তো ছাত্রদের পড়ালেখা বা অন্য কোন বিষয়ে গাফিলতি করি না । দুইদিন শুধু অ্যাসেম্বলি ধরতে পারিনি ।
এই স্কুলে কে কি করছেন সব খবর আমি রাখি । আপনি অনেক সিনিয়র । আর বছর দুয়েক পরেই অবসরে যাবেন । তাই আপনার সাথে অভদ্রতা করতে চাচ্ছি না । কিন্তু, স্কুল আর বাকি শিক্ষকদের স্বার্থেই মনে করিয়ে দিলাম । বিষয়টা আশা করি খেয়াল রাখবেন ।
তিনি স্টাফ রুমের দিকে যাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন, সেদিনই তো তারা কয়জন শিক্ষক মিলে স্কুলটা দাঁড় করালেন । তিল তিল যত্ন দিয়ে লালন করলেন স্কুলটা । স্কুলের জন্য সংসারের প্রতি ঠিকমত নজর দেননি । আজ মনে হচ্ছে তিনি স্কুলের কেউই নন । অথচ আরেক দিক দিয়ে বিচার করলে, প্রধান শিক্ষক ন্যায্য কথাই বলেছেন । তিনি আজকাল স্কুলের বিষয়ে বোধ হয় সেরকম মনোযোগ দিতে পারছেন না ।
মিজান সাহেব দ্রুত হাঁটছেন, আর বারবার রুমাল বের করে কপাল মুছছেন । কতজনের ছেলেকে অমানুষ থেকে মানুষ করেছেন । নিজের ছেলেকে করতে পারেননি । শেষ বয়সে এসে এই গ্লানিই তার সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে । তিনি হয়ত ছাত্রছাত্রীদের প্রতি যতটা যত্নশীল ছিলেন, নিজের ছেলের প্রতি ছিলেন না । স্কুলের কাজে ঢাকায় দৌড়ানো, প্রাইভেট টিউশনি, ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া, স্কুলের ফলাফল উন্নয়ন, এসব কাজেই জীবনের বেশিরভাগ সময়টা ঢেলে দিয়েছেন । ছেলেটা যে একটু একটু করে কবে নাগালের বাইরে চলে গেছে, তা বুঝতেই পারনেনি । যখন বুঝলেন, ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে । ছেলেরা যখন বাবার হাত ছেড়ে নিজে চলতে শেখে, তখন ছেড়ে দেওয়া সেই হাত যেমন আর ধরা যায় না । ছেলেরা সেটা পছন্দ করেন না বাবারাও বিব্রত হন ।
মিজান সাহেব হাঁটার গতি যতটা সম্ভব বাড়ালেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না । গেটে ঢুকার আগেই ক্লাসের ঢং ঢং ঘণ্টা শুনা গেল । স্টাফ রুম খালি । সবাই নিজ নিজ ক্লাসে চলে গিয়েছেন । হাজিরা খাতায় সই করে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালেন মিজান সাহেব । আজ মাথাটা খুব ভারি ভারি লাগছে । সেকেন্ড কণ্ডিশনাল নিয়ে বক বক করা আজকে আর সম্ভব না । তাই ‘মাই ফাদার’ কম্পোজিশন লিখতে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি ।
কিছু দিন যাবত ছেলে সম্বন্ধে নানা কথা তার কানে আসছে । স্কুলেও কানাঘুষা চলে বুঝতে পারেন । হালিম সাহেব বললেন রঞ্জুকে নাকি খারাপ লোকজনদের সাথে মেলামেশা করতে দেখা যাচ্ছে । অজানা এক ভয়ে তার মন অস্থির হয়ে উঠতে থাকে । ছেলের সাথে মাঝেসাঝে দেখা হলেও কথা হয় না । সকালে যখন তিনি স্কুলে যান তখন ছেলের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ থাকে আবার রাতে যখন ঘুমাতে যান তখনো ছেলের ঘর বন্ধ থাকে তবে বাইরে থেকে । গভীর রাত পর্যন্ত ছেলে কোথায় থাকে, কি করে, তিনি কিছুই জানতে পারেন না । জানতে চেয়েও লাভ নেই । ছেলে জবাব দেয় না । ভেবেছিলেন আজ সরাসরি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করবেন, কিন্তু সেটাও আর হল না । নিজেকে একজন অসহায় বাবা মনে হয় । ব্যর্থও ।
স্কুল শেষে বের হতে যাবেন । গেটের মুখে কনস্টেবল ইয়াসিনের সাথে দেখা ।
স্যার আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম ।
কেন বলত ?
ওসি স্যার আপনাকে একটু থানায় যেতে বলেছেন ।
আমাকে থানায় যেতে বলেছে ?
জী স্যার কি যেন দরকার আছে ।
সারসা থানার বর্তমান ওসি বছর দশেক আগে এখানেই সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন তখন তার ছেলেকে তিনি বহুদিন পড়িয়েছেন । সেই সুবাদেই পরিচয় । তিনি মিজান সাহেবকে যথেষ্ট সম্মান করেন । কিন্তু তাকে বাসায় না ডেকে থানায় কেন ডাকা হল সেটা বুঝতে পারছেন না । তবে কি রঞ্জুকে নিয়ে কিছু হল ? স্কুল থেকে থানা পাঁচ মিনিটের পথ কিন্তু সেই পথটুকু যেন কিছুতেই শেষ হতে চায়না । তিনি যখন থানায় পৌঁছান তখন হাত ঘড়ির কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বেজে দশ । ওসি সাহেব ফোনে কথা বলছেন মিজান সাহেবকে দেখে তিনি ইশারায় বসতে বলেন । ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে তবুও মিজান সাহেব কুলকুল করে ঘামছেন ।
ফোন রেখেই ওসি সাহেব অতর্কিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
মিজান সাহেব, আপনার ছেলের নাম রঞ্জু না ? ও আজকাল কি করছে, জানেন কিছু ?
তিনি এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । আমতা আমতা করতে থাকেন ।
আচ্ছা বাদ দেন, আপনার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন বলেন তো ?
ও কিছু না, স্যার । প্রেসার একটু বেশি ।
শরীরের দিকে নজর দেন বুঝলেন ? পৃথিবীতে সুস্থ শরীরই কেবল আপন, আর সব পর । আপনি প্রচণ্ড ঘামছেন । একটু পানি খাবেন ? এই ইয়াসিন । মিজান সাহেবকে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি দাও । তিনি হাঁক ছাড়েন ।
স্যার লাগবে না । আপনি কেন ডেকেছেন সেটা বলেন ।
বলছি, তার আগে বলেন তো আমার আর আপনার মধ্যে মিল কোথায় ? আচ্ছা আমিই বলে দেই । আপনার নাম মিজানুর রহমান, আমার নামও মিজানুর রহমান । আপনার আর আমার ছেলে একই বয়সের । এখন আমাদের মধ্যে পার্থক্যটা শুনেন, আপনি হলেন একজন সৎ স্কুল শিক্ষক আর আমি একজন ক্ষমতাবান পুলিশ অফিসার । আপনি তো জানেন, আমি কাজের কথার বাইরে বেশি কথা বলিনা, কিন্তু আজ বলছি কেন জানেন ?
না, স্যার ।
কারণ আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । আপনার আদর্শ আমার ছেলে এখনও লালন করে । সে এবার বিসিএস প্রশাসনে যোগ দিয়েছে । আপনি আমার ছেলের আদর্শ হতে পারলেন । কিন্তু নিজের ছেলের আদর্শ হতে পারলেন না কেন ?
স্যার কি হয়েছে, একটু খুলে বলবেন ?
আপনি কি সত্যিই জানেন না ?
না স্যার, এক বাড়িতেই আমরা থাকি। কিন্তু আমার সাথে দুই বছর যাবত ছেলের কথা হয় না ।
কি বলেন আপনি ? এই এলাকার চোরাচালানের বড় গ্যাং সবুর বাহিনীর নাম শুনেছেন ? আপনার ছেলে এখন ওই দলেরই সক্রিয় সদস্য । মানুষ খুন থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই এরা করে না । আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি । কিন্ত ভালভাবে খোঁজ নিয়ে দেখলাম খবর সঠিক ।
মিজান সাহেবের পায়ের নিজ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে । তার মাথে ঝিমঝিম করছে ।
ওসি সাহেব বলে যাচ্ছেন, চাকরিবিধি মানতে গেলে এসব খবর আপনাকে আমার জানানো উচিত নয় । কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে খুব পছন্দ করি । তাই সাবধান করছি । এখনও সময় আছে ছেলেকে ফিরিয়ে আনেন । না হলে কবে দেখবেন হয় নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরবে অথবা পুলিশ বা সীমান্তরক্ষীর গুলিতে প্রাণ দেবে ।
থানা থেকে যখন তিনি বের হন তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত একজন মানুষের প্রতিছবি । ছেলেকে নিয়ে কখনো গর্ব করার সুযোগ তার হয়নি । তার কাছে ভাল কিছু আশাও করেননি । কিন্তু তাই বলে সে যে এই ধরণের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়বে সেটা তার কল্পনায়ও কখনো আসেনি ।
ছোটবেলা থেকেই রঞ্জু একটু একরোখা । যা বায়না ধরত সেটা তাকে দিতেই হত । তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করানো যেত না । শিশুবেলায় তিনি তেমন গুরুত্ব দেননি । কিন্তু একটু বড় হলে যখন শাসন করতে গেলেন তার মা ছেলের ঢাল হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল । ছেলের কোন দোষই তার চোখে দোষ ছিলনা । এই নিয়ে সংসারে নিত্য অশান্তি হতে থাকল । অবশেষে তিনি হাল ছেড়ে দেন । আজ বুঝতে পারছেন, কতবড় ভুল তার সেদিন হয়েছিল । এখন তো ছেলের সামনে দাঁড়াতেও তিনি ভয় পান ।
বাড়িতে স্ত্রীকে কিছু জানালেন না । রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লেন ।
জায়গাটা কোথায় সেটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না । চারদিকে বিশাল এক শুন্যতা । মিজান সাহেবের মনে হল তিনি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছেন আলোহীন সে পথের যেন কোন শেষ নেই । হঠাৎ বিকট শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল । ঘামে শরীর জবজবে হয়ে গিয়েছে । যথারীতি বিদ্যুৎহীন আঁধারে নিমজ্জিত শহর । বাইরে ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে । স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ।
তিনি পাখা হাতে বারান্দায় এসে বসলেন । ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে মাঝে বিজলীর চমকে আলো আঁধারির খেলা খেলছে । সে আলোর ঝলকে একটি ছায়ামূর্তি পূর্ণ অবয়বে তার সামনে স্পষ্ট হল । রঞ্জুর ঘরের দিকে ছায়ামূর্তিটি হেঁটে চলেছে । আজ নিজের ছেলেকে বড্ড অচেনা লাগছে ।
রঞ্জু তালা খুলে ফেলেছে ।
রঞ্জু ।
কে ?
বাবা । চিনতে পারছ না ?
ও । এত রাতে ! আশা করিনি ।
তোমার এত রাতে বাড়ি ফেরাটা কি আমারও আশা করার কথা ?
বাবা, যাও । এই বয়সে না ঘুমিয়ে এত রাতে ছেলের সাথে বাকবিতণ্ডা করার কোন মানে হয় না ।
বাবা কি তুমি আমার, নাকি আমি তোমার ?
বাহ ! সেকথা আমাকে জিজ্ঞেস করছ ? তোমার মনে আছে ?
রঞ্জু তোমার বয়স এখনও পড়ে আছে পৃথিবীতে ভাল কাজের অভাব নেই , সবুরের গ্যাং ছেড়ে দাও । আমার কোন কথাই তো তুমি রাখনি এই অনুরোধটা রাখ ।
চাইলেও তো এখন তা পারব না, বাবা । বেঁচে থাকতে হলে ওদের সাথেই থাকতে হবে । আর এই অন্ধকার ওয়ান ওয়ে রোডে তো আমি স্বেচ্ছায় যাইনি । বাধ্য হয়ে ভেবে চিন্তে গিয়েছি ।
মানে ? কি বলতে চাও তুমি ?
মানে আবার কি ? ছোটবেলা থেকে তুমি আমাকে কতটাই বা দেখেছ ? তুমি আর তোমার স্কুল । আমার চেয়ে অন্যের ছেলের প্রতিই তোমার দরদ বেশি ছিল ।হাজার হাজার ছেলেকে তুমি পড়িয়ে মানুষ করেছ আমাকে কতদিন কাছে বসিয়ে পড়িয়েছ বলতে পার বাবা ?
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন আমিও দেখেছিলাম । কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাল রেজাল্ট করতে পারলাম কই ? এই শহরের প্রতিটা ইংরেজি শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে হাজার হাজার টাকা আয় করছে সেখানে তুমি সনাতনী সততা আঁকড়ে পড়ে আছ । টাকার অভাবে আমাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করতে পারলেনা , কেন বাবা ?
পারতে না আমাকে শাসন করে মানুষ করতে ? করনি । তোমার হাতে সন্তানের জন্য সময় কোথায় ? তুমি একজন মহৎ মানুষ হতে পার কিন্তু কোনভাবেই একজন সফল বাবা না । তুমি হাজার ছেলের বাবা হয়েছ নিজের ছেলের হতে পারনি ।
যাও , ঘুমাও বাবা । এতদিন যখন আমার জন্য চিন্তা করনি আজ করে কি হবে ? আমার নিয়তি যেখানে নিয়েছি সেখানেই ঠিক আছি । এই রাস্তা আমি আপন করে নিয়েছি আমার আর ফেরার উপায় নেই । বহুদিন থেকে রঞ্জুর মনে বাবার প্রতি যে অভিমান পুঞ্জিভুত হয়েছিল আজ সেগুলো যেন বের হবার পথ খুঁজে পেয়েছে ।
অন্ধকারে সে পিতার চেহারা দেখতে পাচ্ছেনা দেখলে বুঝতে পারত তার বাবার চোখ ভিজে উঠেছে , কিছু বলার জন্য তার ঠোঁট বোধকরি একটু কেঁপে উঠলো । কিন্তু, তিনি কিছু না বলেই ধীরেধীরে বারান্দা ছেড়ে ছোট্ট আঙিনায় নেমে গেলেন খোলা আকাশের নিচে তিনি কিছু সময় কাঁটাতে চান । রঞ্জু সেদিকে তাকিয়ে ছিল, বাবা হিসেবে না হোক একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে সে যে তার বাবাকে কতটা ভালবাসে সেটা এই মানুষটা হয়ত কোনদিন জানবে না ।
কয়েক মাস পর ।
দেশের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকার মাঝের পাতায় ছোট একটা খবর ছিল ,”বিপুল পরিমানে মাদক দ্রব্যসহ বেনাপোলে সবুর বাহিনীর প্রধান ও তিন সদস্য গ্রেফতার” ওই তিন সদস্যের মধ্যে রঞ্জুর নাম ও ছিল ।
স্যার আপনার ইনফরমেশন ছাড়া গ্যাংটাকে ধরা সম্ভব ছিল না । আপনাকে আমি স্যালুট করি । রঞ্জুর শাস্তি লাঘব করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব । শ্রদ্ধায় ওসি সাহেবের কণ্ঠ বুজে আসে । মিজান সাহেব খেয়াল করলে বুঝতেন ওসি সাহেব এই প্রথম তাকে স্যার সম্বোধন করছেন ।
ফেরার সময় হাজতের কালো গরাদের মধ্য দিয়ে মিজান সাহেব আরেকবার রঞ্জুর চোখগুলো দেখে নিলেন । ছেলের চোখের ভাষা বুঝার ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়েছেন । কিন্তু, কেন জানি মনে হচ্ছে, চোখগুলো আদ্র হয়ে এসেছে সে দৃষ্টি যেন বলছে ,
বাবা আমি ভুল ছিলাম । তুমি সঠিক ছিলে । আমি তোমার উপযুক্ত ছেলে হয়ে ফিরে আসব ।
১০:৫০ টা । মিজান সাহেব স্কুলের গেটে । অ্যাসেম্বলি প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে । ছেলেমেয়েদের সাথে তিনিও সুর মেলালেন ‘আমার সোনারবাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’
লাল-সবুজে আঁকা পতাকাটি পতপত করে উড়ছে । মিজান সাহেব ঝাপসা চোখে সেদিকে চেয়ে আছেন । তার মনে রঞ্জুর একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে , “বাবা তুমি হাজার ছেলের বাবা হতে পেরেছ নিজের ছেলের বাবা হতে পারনি”
একটু দূরের আকাশে একটি সোনালি চিল । তিনি মনেমনে আবৃত্তি করলেন,
“হায় চিল, সোনালী ডানার চিল”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
অদিতি ভট্টাচার্য্য সাবলীল ভাষায় সুন্দর লিখেছেন। ভালো লাগল।
বিদিশা চট্টপাধ্যায় খুব সুন্দর লিখেছেন।ভাল লাগল পড়ে।
নাজনীন পলি আপু , আপনার লেখাতো সবসময়ই অসাধারন হয় । এ গল্পটার কাহিনী পুরানো হলেও আপনার লেখনীতে অসাধারন লাগলো ।
বহুদিন পর লেখা জমা দিলাম তবে পোস্ট করতে গিয়ে সমস্যা হওয়াতে লেখার মাঝে প্যারা গুলো দেখছি এখন আর ঠিক নাই । পড়ার জন্য এবং ভাল লাগার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।

০৩ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী