ক্ষত

প্রিয়ার চাহনি (মে ২০১২)

ম্যারিনা নাসরিন সীমা
মোট ভোট ১২১ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.০২
  • ৭২
মাটির ঘরের দাওয়ায় বশে এক মনে জাল বুনে চলেছে মাধব । জালের এক প্রান্ত খুঁটিতে বাঁধা । অন্য প্রান্তে দ্রুত হাতে কাঠি ঘুরছে আর একটা একটা করে নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে । কিন্তু সৃষ্টির আনন্দে সে যে খুব বেশি আনন্দিত তা তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না । জাল বুনে আর কি হবে ? বাজারে এ জিনিসের আর কদর নেই । আগে জাল তৈরির জন্য অনেক বায়না আসত বুনে সে শেষ করতে পারত না ।আর এখন কালে ভদ্রে দুই একটা পাওয়া যায় । জেলেরা আর আজকাল জাল খোঁজে না । সময়ের ব্যবধানে তারা নানা ধান্ধায় ব্যস্ত । কেও কাঁধে লাঙ্গল তুলে নিয়েছে কেওবা পরের ক্ষেতে কামলা খাটছে ।

ব্রহ্মপুত্রের বুকে বিশাল বিশাল চর । নদীতে কোথাও হাঁটু সমান জল, কোথাও বা বুক সমান । জাল ফেলে টেনে আনলে শামুক-ঝিনুক, শ্যাওলা ছাড়া কিছুই উঠে আসে না । মাছের কোন বালাই নেই । তবুও পূর্ব পুরুষের ব্যবসাটা কোন রকমে জিইয়ে রেখেছে মাধব । জাল বোনে আর উঠোনের দিকে আড় চোখে চায় সে । সেখানে মালতী একটা কাঠের মুড়িতে ধানের আঁটি বাড়ি দিয়ে বিচালি থেকে ধান ঝাড়ছে । মালতীর ফর্সা শরীরে নীল শাড়িটা যেন গিলে ধরেছে । হাত উঁচু করলে বগলের কাছে লাল ব্লাউজের অনেকটা অংশ ঘামে ভিজে গিয়েছে দেখা যায় । গলায় , কপালে আর নাকের পাশ টাতে মুক্তোর মত ঘাম জমেছে । হাতের তালে তালে ভারি কোমর উঠা নামা করছে । যেন কাঁঠাল কাঠের চকচকে পুষ্ট ঢেঁকি । আটাইশ বছরের নিঃসন্তান মালতীর শরীরের ভরভরন্ত যৌবন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় । কোমরের শাড়ির প্যাঁচ শরীর টাকে আরও সু স্পষ্ট করেছে । গলার ঘাম গুলো জড় হয়ে একটা জলধারা তৈরি করেছে সেটা দুই বুকের মাঝ দিয়ে শীর্ণ ঝর্না ধারার মত প্রবাহিত হচ্ছে । মালতীর কোমর যখন নিচু হয় সেই ঝর্ণা এলাকার অনেকটাই ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি গোচর হয় । মাধব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে দিকে । একটু খেয়াল করলে বুঝা যাবে মাধবের চোখের দৃষ্টিতে এক ধরণের ভাল লাগার স্নিগ্ধতা আছে । কিন্তু একজন পুরুষের নারী দেহের প্রতি যে আকর্ষণ, তা সেখানে পুরোপুরি অনুপস্থিত । মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে কাজে মন দেয় । মনে মনে ভাবে বউটা বড় সুন্দর !
মালতীর এ ঢলঢলে সৌন্দর্য আরেকজন উপভোগ করছে । সে হল মালতীর পাড়াতো দেবর ছাব্বিশ বছরের টগবগে যুবক অমল । উঠোনের এক কোনের পেয়ারা গাছটিতে হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে সে দাঁত খিলাল করছে । তার পুরুষ দৃষ্টি মালতীর বুকের সাথে সাথে উঠা নামা করছে । তার দৃষ্টিতে এক ধরণের আদিমতা । মুখে তেলতেলে ভাব নিয়ে অমল চেঁচিয়ে বলল,
“বৌদি আরও জোরে! বিচালিতে তো ধান থাইকাই যাইতাছে ।”
“এর চাইতে জোরে পারতাম না । তা তুমি যে ভঙ্গি ধইরা খাড়ায়া আছ, একবার আইয়া পড় । দেহি শইল্যে কত জোর ।“ আহ্লাদী ভঙ্গিতে জবাব দেয় মালতী ।

“আরে বৌদি, আগে কইবা না ? দেও দেহি । এইগুলান কি মাইয়া মাইনসের কাম ? মরদ হউন লাগে । ক্যান যে তোমারে দিয়া মাধব দা এইত্তা কাম করায় ?”
বলে অমল হাত থেকে ধানের আঁটি নিয়ে আলতো করে নিজের শরীরটা লাগিয়ে একটু ধাক্কা দেয় মালতীর গায়ে। মালতী এবার চোখ বাকিয়ে অমলের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে ।
মাধব বারান্দায় বসে সব কিছু খেয়াল করে । তার বুকে ঈর্ষার দাবাগ্নি জ্বলে ওঠে । সে জাল গুটিয়ে রেখে নেমে আসে উঠোনে । অমলের হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নেয় ধানের আঁটিটা ।
“যা গা ! তোর কামে তুই যা । আমি ধান বাড়াইতে পারবাম । বিহান মেলায় এই হানে তোর কিয়ের কাম ?”
রাগে মাধবের মুখ থেকে যেন আগুনের রক্তিম আভা ঠিকরে বের হচ্ছে ।
অমল কোন কথা না বলে চুপচাপ চলে যায় ঘাটের দিকে । মালতী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, হঠাৎ মাধবের কি হল ! অমলের এই কাজ তো নতুন কিছু নয় । সে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে ।
মাধব তার দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে “খাড়ায়া রইছ ক্যা ? কোন কাম কাজ নাই ? পাক ঘরে যাওগা । কাম কর গিয়া । হুদাই খাড়ায়া থাইকা কি লাভ ?”
মালতী দৌড়ে গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে । কিন্তু কোন কাজ করে না । পিঁড়িটা টেনে বসে । পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মেঝের মাটি খুড়তে থাকে । সে জানে মাধবের বুকের জ্বালাটা কোথায় । সেই আগুনে সেও অহর্নিশি জ্বলে । এই জ্বলুনির কোন শেষ নেই ।

মাধবের সঙ্গে যখন মালতীর বিয়ে হয়, তখন তার বয়স চৌদ্দ কি পনের বছর হবে । গরিব বাবা লেখাপড়া তেমন শেখাতে পারেনি । স্কুলে কিছুদিন গিয়েছিল । বানান করে টুকটাক পড়তে পারে । একে তো সুন্দরী তার উপর বাড়ন্ত শরীর । চারদিকের কুনজর পড়তে থাকে মেয়ের উপর । গরিব বাপের সোমত্ত সুন্দরী মেয়ে নিয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় । হিন্দু ঘর , জাত কুল মিলিয়ে পাত্র পাওয়া অনেক কঠিন । তারপর আছে এক কাড়ি যৌতুকের জ্বালা ! মালতীর বাবা দিশেহারা হয়ে পড়ে । এর মধ্যে মাধবের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসে । নগদ দশ হাজার টাকা আর এক ভরী স্বর্ণ ছাড়া তাদের আর কোন দাবী নেই । এটুকু জোগাড় করাও মালতীর বাবার জন্য সহজ ছিলনা তবুও রাজী হয়ে যায় । মেয়েটা যেন তার ঘাড়ের বোঝা ।কোন রকমে নামাতে পারলেই বাঁচে । ধারদেনা করে বিয়ে দিয়ে দেয় মালতীর ।
শোলার টুপি পড়া লম্বা চওড়া বাইশ চব্বিশ বছরের মাধবকে দেখে সবাই মুগ্ধ । পিসতুতো মাসতুতো বোনেরা কত ঠাট্টা ! ঠাকুমার কথা শুনে তো মালতী র কান লাল হয়ে গিয়েছিল । শুভ দৃষ্টির সময় গামছার নিচে যখন সে স্বামীর দিকে লাজুক চোখে তাকিয়েছিল তখন মনে হয়েছিল ভগবান তার মনের আশা পূরণ করেছেন ।
কালরাত পার হল । তারপর আসলো প্রত্যেক মেয়ের জীবনের বহু আকাঙ্ক্ষার সেই ফুল শয্যার রাত । কিন্তু বৌদি কানে কানে যে কথা বলেছিল, ঠাকুমা যে অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়েছিল, তার কিছুই সে রাতে ঘটল না ।
মালতী অবাক হলেও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি । কিন্তু কিছুদিন যেতেই মালতীর বুঝতে কিছু আর বাকি রইল না । শিক্ষিত অশিক্ষিত বেশির ভাগ বাঙালি মেয়েই স্বামীর শারীরিক এই অক্ষমতাকে কেন জানি সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায় । হয়ত পাঁচ কথা শোনার ভয়ে । মালতীও চুপ করে থাকে আর নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।

হিন্দুর ঘরের মেয়ে হয়ে জন্মেছে মালতী । শিশু বেলা থেকেই সে জেনে এসেছে হিন্দু মেয়েদের জন্য স্বামীই ধর্ম । স্বামীই কর্ম । বারটি বছর ধরে সে নিঃসন্তান । বুকের মধ্যে নিদারুণ কষ্ট চেপে মুখে হাসি এনে সে সংসার করে যাচ্ছে । কিন্তু মাঝে মাঝে তার শরীর বিদ্রোহ করে, তার মন বিদ্রোহ করে । কোন কোন রাতে মাধবকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে পিশে ফেলতে চায় । কিন্তু মাধবের শীতল আচরণে সে হতাশ হয়ে পড়ে ।
অনেক সময় মালতী চিন্তা করে মালতীর জন্যে আজ মাধব যদি সন্তানহীন হত, তাহলে সে কি করত ? অশিক্ষিত মালতীর কাছে সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই । তবে সমাজ জানে তখন কি ঘটত । এ ধরণের উদাহরণ আমাদের সমাজে ভারিভুরি আছে ।

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাধব ধানের মুঠো ধরে কাঠের টুকরোয় বাড়ি দিতে থাকে । মনের সমস্ত জ্বালা যেন সে ধানের উপর মিটাতে চায় । ধানগুলো বিদ্রোহী হয়ে দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে ।
জাল বিক্রি করে , মাছ ধরে এখন আর সংসার চলে না । তাই মাধব এবার কিছু জমি বর্গা করে ধানের চাষ করেছিল । সেখান থেকেই দুইজন মানুষের বছর চলে যাওয়ার মত কিছু ধান পেয়েছে ।ধান ছাড়ানোর কাজ শেষ হলে মালতীর খোঁজে চারদিকে তাকায় মাধব । উত্তেজনার বশে এত সময় খেয়াল করেনি সে , এখন মনে হল মালতী সেই যে পাকঘরে ঢুকেছে । তারপর আর কোন সাড়াশব্দ নেই ।

দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ঢোকে মাধব । রান্না ঘর বলতে উঠোনের এক কোণে চাঁটাই দিয়ে ঘেরা , ছনের ছাউনির ছোট্ট একটা খুপরি ঘর । মালতী তখনও পিড়িতে চুপচাপ বসে আছে । পা দিয়ে মেঝে খুড়ে অনেকটা গর্ত করে ফেলেছে । দেখে মাধবের মাথায় যেন আগুন ধরে যায় । সে চিৎকার করে উঠে ,
“ওই বড়লোকের বেটি, কি হইছে তোর ?”
মালতী কিছু বলে না । ঘাড় গুঁজে বসে থাকে ।
“কিরে, কথা কস না ক্যা ? ও, নাগররে বালা মন্দ কইছি, হ্যার লাইগা বুঝি কইলজা জ্বলতাছে ?” মুখে শ্লেষ এনে বলে মাধব ।
ঝট করে মাথা তুলে তাকায় মালতী । চোখ টকটকে লাল ,বুঝা যায় এত সময় সে কান্না কাটি করছিল।
“কি কইলা তুমি ? নাগর ক্যাডা ? খারাপ কথা কইবা না কইয়া দিলাম ।”
“ও ,লাগছে না ? আমি মনে হয় কিছুই দেহি না, বুঝি না ? আন্ধা পাইছো আমারে ? অমলের সাথে তোর এত খাতির কিয়ের, আমি জানিনে ? শুধু আমি ক্যান পাড়ার হগলেই জানে ।”
“জানো, তাইলে এত কথা কও ক্যা ?”
“কি কইলি নষ্ট মাইয়া মানুষ ? তোরেএতবড় সাহস ?তোরে কিসের অভাবে রাখছি আমি?”
“নষ্ট মাইয়া মানুষ কইবা না কইলাম । কিসের অভাবে রাখছ, জানো না ?”
কার্বলিক এসিডের গন্ধ পেলে সাপ যেমন মাথা নিচু করে পালানোর পথ খোঁজে । মালতীর এ কথার পর মাধব ও তেমনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেন পালিয়ে বাঁচে।

আরও কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে বসে থাকে মালতী । তারপর গামছা কাঁধে ফেলে টিনের কলসিটা কাঁখে নিয়ে ধীরে ধীরে ব্রহ্মপুত্রের ঘাটের দিকে রওনা দেয় ।
বাড়ির কাছেই ঘাট । ঘাট বলতে নদীর পাড় থেকে একটা চিকন রাস্তা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে । পানির সীমানায় কিছু পাথর বসানো । এখন গ্রীষ্মকাল ।নদীতে তেমন স্রোত নেই । নদীর জল শুকিয়ে হাঁটু সমান হয়েছে । ব্রহ্মপুত্রের ধারের এই বাওশিয়া গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই নদীতে গোসল করে । কিন্তু এখন নদীতে ডুব দিয়ে গোসল করা যায় না । ঘাটে বসে ঘটি ডুবিয়ে মাথা ভেজাতে হয় । মালতী যখন বউ হয়ে এ গায়ে এসেছে তখন এ নদীর কি রূপ ! চঞ্চলা ষোড়শীর মত প্রমত্তা ঢেও ছিল নদীতে । আর এখন যেন জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা ।
মালতী অভ্যাস বশত দ্রুত পায়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে যায় । গ্রামের আরও কিছু নারীপুরুষ গোসল করছে । ময়লা আঠালো পানি । দূরে কিছু ছেলেমেয়ে পানিতে খেলছে । আনন্দে লাফালাফি করছে । ও পারে খাঁখাঁ বিরান চর । মালতী কলসটা রেখে পানিতে পা ডুবিয়ে একটা পাথরের উপর বসে । তার চোখে আটকে আছে চরটিতে । দুপুরের রৌদ্র যেন তিরতির করে কাঁপছে । মালতী র চোখে ধাঁধাঁ লাগে ।
তার বিষণ্ণ চেহারা দেখে রাখালের বউ এগিয়ে আসে । মালতীর কাঁধে হাত রেখে বলে, “কি হইছে বৌদি ? তুমারে আইজকা এমুন লাগতাছে কেন ?”
মালতীর চোখ ভিজে ওঠে, কিন্তু সে চট করে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ।“কিছু না বইন ,আজ শইলডা বালা না তো, এর লাইগগাই.........।” বলে সে চোখে মুখে পানির ছিটা দেয় ।

নদীর ঘাট এখন প্রায় খালি । দূরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো এখনো কোলাহলে ব্যস্ত । সেদিকে তাকিয়ে মালতীর বুক ঠেলে কান্না আসে । তার শুন্য মাতৃহৃদয় চঞ্চল হয়ে উঠে । শিশুর কোলাহলে তার ঘর কখনো মুখরিত হবেনা ।

নদীর একপাশে বাঁধ তৈরি হচ্ছে । বর্ষার প্রকোপে যাতে করে উত্তাল নদীর পাড় না ভাঙে সে জন্যই এ ব্যবস্থা। সেদিকে তাকিয়ে মালতীর মনে হয় সেও যেন নদীটার মতই । তার ভরা শরীরের উদ্দামতা সে একরকম বাঁধ দিয়েই মানিয়ে রেখেছে । শরীরকে না হয় পোষ মানানো গেল । কিন্তু তার মাতৃহৃদয় তো কোন বাঁধ মানতে চায়না । সেখানে তো নিরন্তর শুন্যতার জোয়ার বইছে । এই জোয়ার সে কি দিয়ে আটকাবে ? মাঝে মাঝে ভয় হয় এই জোয়ারে আবার কখনো সে ভেসে না যায় । না পাওয়ার জন্যে এই যে আক্ষেপ তার জন্য কে দায়ী ? স্বামী, সমাজ, ঈশ্বর, না সে নিজে ?
পায়ের কাছে কয়েকটা শ্যাওলা এসে জড়ো হয়েছে । মালতী সেগুলো পা দিয়ে ঠেলে আবার স্রোতের দিকে ভাসিয়ে দেয় । নীরব মধ্যাহ্ন । সবাই যার যার ঘরে হয়ত খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত । মালতী র খেয়াল হয় আজ এখনো তার রান্না হয়নি । মাধব হয়ত অপেক্ষা করছে । দ্রুত দু ঘটি জল শরীরে ঢেলে ভেজা গামছায় গায়ে জড়িয়ে কলসি ভরে সে ফিরে আসে । নদীতে নামাটা যত না সহজ তার চেয়ে অনেক কঠিন পিচ্ছিল মাটি বেয়ে ওঠা । ঠিক জীবন চলার পথের মতই । যখন উপরে উঠতে যাবে ধীরে ধীরে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে । আর যখন নামবে তরতর করে নেমে যাও । মালতী ভেজা পা টিপে টিপে উপরে উঠে আসে । ঘরে ফিরে দেখে মাধব তখনো ফিরেনি । সে মাধবকে চেনে । আজ সে ফিরতে কিছুটা দেরিই করবে ।
ঘরে কিছু বেগুন আর চ্যাপা শুঁটকি ছিল । মালতী বেগুনের নিরামিষ আর চ্যাপা ভর্তা করে সারা বিকেল অপেক্ষা করে থাকে । কিন্তু মাধবের কোন খোঁজখবরই নেই । পশ্চিম দিকে রক্তিম সূর্য গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে । মালতীর প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হতে থাকে । লোকটা গেল কোথায় ? এত দেরি তো কখনো করে না ! ক্ষুধায় সে কাতর হয়ে ওঠে । কিন্তু, স্বামীকে না খাইয়ে তার খাওয়ার অভ্যেস নেই । এখনো গ্রাম দেশে বাঙালি নারীদের মধ্যে এই কুসংস্কারটা রয়ে গেছে । কারো কারো মধ্যে শুধু ধর্মের দোহাই, কারো মধ্যে স্বামীর জন্যে ভালবাসা আর শ্রদ্ধা । না খেয়ে থাকার সুফল কুফল যে কি অনেক মেয়েই এখনো তার বিচার করার ফুরসত পায় না ।

মাধব ফেরে রাত নয়টার দিকে । রাত নয়টা গ্রাম এলাকায় বলতে গেলে মধ্যরাত । গ্রামের সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । মালতী ও বারান্দায় বসে ঝিমুচ্ছিল ।
মাধব কে দেখে মালতী কোন কথা না বলে তরকারি গরম করতে চলে যায় । ভাত তরকারি নিয়ে এসে দেখল মাধব হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়েছে । পাতে তরকারি সাজিয়ে ঘরে এসে মাধবকে খেতে ডাকে ,
“ভাত গরম করছি । খাইয়া লও ।”
“আমি খামু না । খিদা নাই । তুই খা গিয়া ।” গম্ভীর স্বরে বলে মাধব ।
“খিদা নাই মানি ? বাইর থন খাইয়া আইছ ?”মালতীর গলায়ও উস্মা ।
“কইথন খাইয়া আইছি না আইছি হেইডা তোর জাননের কাম নাই । তুই খাইলে খা । না খাইলে যা ইচ্ছা কর । আমি খামু না ।”
“না খাইলা । আমিও খাইতাম না ।”
বলে মালতী দম দম করে পা ফেলে সব খাবার রান্নাঘরে রেখে আসে । ঘরে এসে কুপির আলোটা কমিয়ে শুয়ে পড়ে । একে তো সারাদিন না খাওয়া তার উপর মাধবের আচরন তাকে আরও দুঃখী করে তোলে । বিছানায় উপুড় হয়ে সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে । কিন্তু মাধবের সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । তার দৃষ্টি আজ অস্বাভাবিক উদ্ভ্রান্তের মত ।

কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল মালতীর মনে নেই । হটাৎ ঘুমের ঘোরে শরীরের উপর তীব্র চাপ অনুভব করে সে । নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করে জেগে উঠে । মাধবের মুখ তার মুখের উপর । ওষ্ঠাধর চেপে বসেছে তার ওষ্ঠের উপর কিন্তু সে ঠোঁটে কোন উষ্ণতা নেই । মালতীর শরীর মাধবের শরীরের মধ্যে যেন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে । নারীর শরীর পুরুষ শরীরের ভাষা বোঝে । কোনটা ভালবাসা আর কোনটা জোর সেটা সে মুহূর্তেই জেনে যায় । তারপর ও মালতী মা হবার বাসনায় মাধবের জোরে সাড়া দিতে চায় । কিন্তু মাধবের যে শুধুই মনের আক্রোশ সেটা বুঝতে তার সময় লাগে না ।
মাধব চাপা স্বরে অশ্লীল একটা গালি দিয়ে বলে ওঠে ,“আইজকা দেখবাম তোর কয়জন মরদ লাগে ।” ঘৃণায় মালতীর শরীর সংকুচিত হয়ে আসে । ওষ্ঠে কে যেন তার বিছুটি লাগিয়ে দেয় । শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে মাধবকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসে ।
অসংলগ্ন বেশ , উস্কখুস্ক চুলে গ্রীবা বাঁকা মালতীকে ফণা তোলা নাগিনীর মত ভয়ঙ্কর মনে হয় । কুপির স্বল্প আলোয় মাধব দেখে মালতীর সুন্দর দুটি চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে ।
“না মরদ ! শইল্যে শক্তি নেই আবার বউয়ের লগে জোর খাটাতি আহো ?” হিসহিস করে ওঠে মালতী ।
মাধব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মালতীর দিকে । এই মালতীকে সে চেনে না । সবচেয়ে অবাক হয় তার চোখের দিকে তাকিয়ে । সে চোখের দৃষ্টিতে ভালবাসা দূরে থাক স্নিগ্ধতার লেশ মাত্র নেই । আছে প্রবল ঘৃণা আর অবজ্ঞা ! এই দৃষ্টি তার চিত্রপটে মোহরাঙ্কিত হয়ে গেল । জীবনে সে ভুলবে না । সে বিহ্বল হয়ে মালতীর দিকে তাকিয়েই থাকে কোন কথার প্রতিবাদ করে না ।

মালতী কিছুসময় ব্যর্থ আক্রোশে ফুলতে থাকে তারপর একসময় ধীরে ধীরে উঠে দরজা খুলে বারান্দায় এসে বসে । আজ পূর্ণিমা রাত । সমস্ত দুনিয়া যেন রুপোলী আলোয় ঝলমল করছে । মালতী আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার উদ্দ্যেশে তার মনের সমস্ত অভিযোগ নীরবে জানাতে থাকে । দুইচোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু নামে । এ কান্না তার অনাগত সন্তানের জন্য। বুকে জমে থাকা তার অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কষ্টের জন্য ।

সব রাতের শেষ আছে । একসময় আকাশে দিনের আলো ফুটতে শুরু করে । মালতী চোখ মুছে দৈনন্দিন কাজে লেগে যায় । তার মধ্যে তেমন কোন ভাবাবেগ দেখা দেয় না । আর দশটা দিনের মত স্বাভাবিক । রাতে যেন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব । কিন্তু মাধবের মনে শান্তি নেই । তার হৃদয়ে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় । সন্তানহীন হওয়ার যন্ত্রণা তারও রয়েছে কিন্তু একজন স্ত্রীর কাছে স্বামীর অক্ষমতা যে কি যন্ত্রণার সেটা শুধু ভুক্তভোগীই জানে । মালতীর এই রূপ বিবাহিত জীবনে কোনদিন সে দেখে নাই । কাজের ফাঁকে প্রতি মুহূর্তে মালতীর দুটি চোখ তাকে তাড়া করে ফেরে । কানে রিরি করে বাজতে থাকে “না মরদ” । এই দৃষ্টি থেকে সে পালাতে চায় কিন্তু পালাবার পথ পায় না ।

সারাদিনে দুইজনের মধ্যে তেমন কোন কথাবার্তা হয়না । সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি খেয়ে মাধব শুয়ে পড়ে কিন্তু ঘুম আসে না ছনের চালের দিকে তাকিয়ে বিছানায় চুপচাপ পড়ে থাকে । কিছুক্ষন পরে মালতীও এসে একপাশে শুয়ে পড়ে । অন্যদিন হলে তারা এইসময় একটু গল্পগুজব করে যার বেশির ভাগই সাংসারিক । কিন্তু আজ আর কোন কথা হয় না ।

গভীর রাত ! একবুক তৃষ্ণা নিয়ে ধড়মড় করে জেগে উঠে মাধব । জেগেই আগে দৃষ্টি পড়ে মালতীর দিকে । কিন্তু সে হতবাক হয় , বিছানায় মালতী নেই । কোথায় গেল ? মালতী তো তাকে ছাড়া কখনো রাতে ঘরের বাইরে যায় না ।
ঘরের দরজা ভেজানো । আস্তে করে দরজা খুলে সে বাইরে এসে দাঁড়ায় । বারান্দার এককোণে চাঁটাই দিয়ে ঘিরে আরেকটা ঘরের মত তৈরি করেছিল মাধব । আত্মিয় স্বজন আসলে লাগে । তারা নিজেরাও মাঝে মাঝে গরমের রাতে এই ঘরটিতে ঘুমায় । আজ বড় গরম পড়েছে মালতী হয়ত ওখানে শুয়েছে ।
একটু দ্রুত পায়েই এগিয়ে যেতে থাকে মাধব। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে হটাৎ সে থমকে দাঁড়ায় । ঘর থেকে কিছু অস্পষ্ট আদিম তোলপাড়ের শব্দ ভেসে আসছে । মাধব বুঝতে পারে মালতী একা নয় । উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপতে থাকে । সে চিৎকার করতে চায় কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না । মালতীর সে রাতের প্রেমহীন দৃষ্টি তাকে বাঁধা দেয় ,সে রাতের একটি শব্দ তাকে স্থবির করে দেয় , “না মরদ” ।
সন্তানের বীজ লাভের তীব্র আকাঙ্খা মালতীকে যে পথে নিয়েছে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা মাধবের নেই ।জীবনের অনেক ঘটনা আছে যেটা দেখতে হয় না । অনেক কথা আছে যেটা শুনতে হয়না । স্খলিত পায়ে নিঃশব্দে ঘরে ফিরে আসে মাধব । তার বুকের গভীরের ক্ষত টা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আদনান আদি অসাধারন
সানাউল্লাহ নাদের ভাল লেখা । বিজয়ের শুভেচ্ছা ও আভিনন্দন।
দীপক সাহা অভিনন্দন হে বিজয়ী !!!!
ইসমাইল বিন আবেদীন একজন নারী হয়ে নারীত্বকে কীভাবে প্রকাশ করলেন আমার বোধগম্য নয় | আর গল্পটা বিষয় ভিত্তিক মনে হয়নি | মা শিরোনাম হলে ঠিক হত | তবুও শভকামনা রইলো লেখকের জন্য |
ভালোলাগলো...........শুভেচ্ছা রইলো...........
বিষণ্ন সুমন অভিনন্দন সীমা দি । আগেই বলেছিলাম, তোমার এই গল্প এ সংখ্যার সেরা না হয়েই যায় না । এখন প্রমান পেলে তো ?
হাবিব রহমান বিজয়ী অভিনন্দন.....
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ প্রাণঢালা অভিনন্দন ও ফুলেল শুভেচ্ছা ।
আপনাকেও শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন ভাইয়া !
স্বাধীন বিজয়ী অভিবাদন।

০৩ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২০ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.০২

বিচারক স্কোরঃ ২.৫২ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৫ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪