পার্থিব

পার্থিব (জুন ২০১৭)

এশরার লতিফ
মোট ভোট ৩১ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.১৮
  • ২৭


হাসপাতালের একটা গন্ধ আছে, স্যাভলন আর ফিনাইল মেশানো। গন্ধটা নাকে এলেই আমার নিশ্বাস আটকে আসে, গা গুলিয়ে যায়। বুকের উপর মৃত্যুর একটা বিরাট ভার অনুভব করি। আমি বিয়েতে যাই, জন্মদিনে যাই, আকিকায় যাই, এমন কি মুসলমানিতেও। কিন্তু হাসপাতালে না। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দিনরাত প্রচুর ভাত আর প্রক্রিয়াজাত গরু মহিষ গলধঃকরণ করে হয় হৃদরোগ নতুবা ডায়বিটিসে আক্রান্ত। কেউ রক্ত-শর্করাজনিত ঘা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, কেউ হৃদযন্ত্রের ভাল্ব আটকে সিসিইউতে মটকা মেরে পড়ে থাকে। আমি খবর পাই কিন্তু দেখতে যাই না। এরা ক্ষুব্ধ হয়। আড়ালে আবডালে বেয়াদব বেয়াড়া জামাইকে নিয়ে অনেক কথা বলে। বিয়েতে,জন্মদিনে,আকিকায় 'দুধের মাছি' কিম্বা 'বসন্তের কোকিল' উপমাগুলো বর্শার ফলার মত কান ঘেঁষে তীব্র বেগে ছুটে যায়। আমি পাত্তা দেই না।

কিন্তু আজ হাসপাতালে না গিয়ে উপায় নেই। সকাল এগারোটা তিরিশে আমাদের ফার্মের মিটিং চলছিল। আগামী সপ্তাহ থেকে নতুন অ্যাপার্টমেন্টের নির্মাণ আরম্ভ হবে। আর্কিটেক্ট, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, প্রজেক্ট ম্যানেজার, কন্ট্রাকটর এদের সবাইকে একত্র করা হয়েছে। শেষবারের মত কাজের ক্রম গুলো এক সুতোয় গাঁথা কিনা তার যাচাই চলছে।টেবিলের উপর গাদা গাদা নক্সার স্তুপ। আমি যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পাইপলাইনের একটা নাজুক মোচড়ে লাল কালির গোল্লা বসাচ্ছি ঠিক সেই সময় নীলার ফোন এলো। ওকে যত দ্রুত সম্ভব অফিস থেকে ওঠাতে হবে। তারপর পান্থপথের কোন একটা হাসপাতালে যাওয়া লাগবে। সব কথা ফোনে বলা যাবে না। আমি যেন হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে আসি।

নীলার ফোন পেয়ে মনে মনে নিভে গেলাম। ঘন্টাখানেক পর মধ্যাহ্ন বিরতি। ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরে একটা নূতন বুফে রেস্টুরেন্ট খুলেছে। কথা ছিল সামিয়ার সঙ্গে সেখানে দেখা করব। কিন্তু সেই সম্ভাবনা এখন সম্পূর্ণ তিরোহিত। আমি মিটিং রুম থেকে বের হয়ে সামিয়াকে ফোন করলাম। ওর ফোন বন্ধ দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি জানি সামিয়া ঘড়ি ধরে ঠিক বারোটা পঁয়তাল্লিশে রেস্টুরেন্টে আসবে। আমার জন্য প্রয়োজন হলে এক দু’ ঘন্টা অপেক্ষা করবে।
সামিয়ার স্কুল আমাদের অফিস থেকে সাত আট মিনিটের হাটা পথ। ওদের উপবৃত্তাকার নূতন ভবনটা আমাদেরই নির্মাণ করা। ভবনের উদ্বোধনী দিনে আমি অগ্নি নিরাপত্তা আর তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপন করেছিলাম। আমার রসকষহীন বক্তব্যের পর গানের টিচার সামিয়া আহমেদ গেয়েছিল অতুলপ্রসাদের গান, 'আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর, ওগো অনেক দিনের পর'। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওর গান শুনেছিলাম। সেই মুগ্ধতা ডালপালা মেলে আজ আকাশস্পর্ধী।

প্রথম যৌবনে শরৎ-রবীন্দ্রনাথ পড়ে বেড়ে ওঠায় কারনেই কিনা জানি না, আমার কাছে ভালোবাসা এখনো অধরা মাধুরী, একটা আবছায়া স্বপ্ন যেন। এই অপার্থিব অনুভূতির সাথে শরীরকে টেনে আনা যেন অতি কুৎসিত এবং ঘিনঘিনে একটি ব্যাপার। আমি জানি দেশ একটা ক্রান্তি কালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অন্তর জালের কল্যানে ভালোবাসা আর জৈবিক চাহিদার সীমারেখা আজ অবলুপ্ত। কিন্তু আমি কখনোই এই ভোগ সর্বস্ব দলের অন্তর্গত হতে পারিনি। এ কারনে সামিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শুধুই হার্দিক।

আমার তমসাঘন জীবনে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত সামিয়ার আবির্ভাব। কিন্তু ওর নিজের জীবনে একটা গাঢ় বিষাদের ছায়া আমি আঁচ করি। মাঝে মধ্যে দেখি সামিয়ার চোখের নীচে কালির ছাপ, মেকাপের আড়ালে আঘাতের আভাস।জানতে ইচ্ছে করে বাসায় অশান্তি হচ্ছে কিনা, স্বামী কী করেন। ও নিজে থেকে না বললে আমি উপযাচক হয়ে কিছু জিগেস করি না।একে অপরের শরীরের দখল নেবার কিম্বা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খবরদারীর কোন ইচ্ছেই আমাদের নেই।

সামিয়ার কথা আমি ভুলেও কাউকি বলিনি। শুধু পারভেজ ভাইকে হাল্কা আভাস দিয়েছিলাম। পারভেজ ভাই ধার্মিক মানুষ। অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, 'রাশেদ, তুমি মিড লাইফ ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। হুট হাট করে কিছু করে বস না। পারলে নামাজ পড়ার চেষ্টা কর। ওটা এক ধরনের মেডিটেশন। আর কিছু না হোক মনটা প্রশান্ত হবে। মনে ঝড় নিয়ে বড় বড় শিল্প হয় কিন্তু এঞ্জিনিয়ারিং হয় না'


পারভেজ ভাইয়ের পরামর্শ আমাকে ভাবিত করে। আমি আমার দাম্পত্য জীবনকে আয়নার সামনে দাঁড় করাই। নীলা ছিল বাবার বাছাই করা মেয়ে। আমি বাবার বাধ্যগত সন্তান। সমকোণের দুই রেখা যেমন শুরুতে একই বিন্দুতে থাকে, বিয়ের প্রথম ছ'মাস আমি আর নীলাও একে অপরে বিলীন ছিলাম। কিন্তু দিন যত গ্যাছে, কৌণিক দূরত্ব ততই সুস্পষ্ট হয়েছে। বিভেদ-বিসম্বাদ তিক্ততার রূপ নিয়েছে।

আমি জানি না জীবন-মধ্যাহ্নের সংকট কী জিনিস, জানার আগ্রহও নেই। শুধু এটুকুই বলতে পারি যে সাত বছরের বিবাহিত জীবনে কখনো প্রশান্তি অনুভব করিনি। সংসারের শান্তি যদি ধ্যান আর আরাধনার মাঝে খুঁজে নিতে হয় তবে আমি তাবলীগে গেলাম না কেন? সন্যাসব্রত নিলাম না কেন?

আমি যখন এত কথা ভাবছি তখন নীলার ফোন এলো, ‘তুমি কি রওনা হয়েছ নাকি এখনো ভ্যাবলার মত অফিসেই বসে আছ?’




এত নামি দামি হাসপাতালেও যে এমন ভিড় হয় জানা ছিল না। আইসিইউর সামনে পিঁপড়ের সারির মত লম্বা লাইন। প্রতিবার তিনজন করে দর্শনার্থী মুখোশটুখোশ পরে ভেতরে যাচ্ছে আর তিনজন করে বেরুচ্ছে। এই গতিতে চললে আমাদের ডাক আসতে কম করে হলেও পৌনে একঘন্টা লাগবে। গাড়িতে বসে নীলা বলেছে ওদের অফিসের কুদ্দুস ভাই মৃত্যু শয্যায়, সুইসাইড অ্যাটেম্পট। কিন্তু এর বেশী খোলাসা করেনি। শুনে আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়েছে। ও কোন কলিগগে নিয়ে এলেই তো পারত, এর ভেতর আমাকে জড়ানোর কী দরকার? আমাকে যখন তখন ড্রাইভারের মত ব্যবহার করা ওর অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরক্ত মুখে নীলাকে বললাম, ‘নীচ থেকে হাওয়া খেয়ে আসছি’। নীলা একটা কোম্পানির আকাউন্ট্যান্ট, হিসেব ভালো বোঝে। আমার এইসব টুকিটাকি হাওয়ার কারবার ওর মাথায় ঢোকে না। তাই জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না।

হাসপাতালের গেটে এসে একটা ফাইভ ফাইভ ধরালাম। তারপর সামিয়াকে ফোন করলাম। এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব না। ও কি ফোনে চার্জ দিতে ভুলে গ্যাছে? আমি জানি ওর প্রায়শই এমনটি হয়। একবার ভাবলাম ওর স্কুলে ফোন করি। আবার মনে হলো সেটা ভালো হবে না। রিসেপশনিস্ট এটা সেটা অযাচিত প্রশ্ন করবে, কিছু একটা বুঝে নিয়ে এদিক সেদিক কানকথা ছড়াবে।

সামিয়া হয়তো এখনো বুফেতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে অথবা মন খারাপ করে স্কুলে ফিরে গ্যাছে। পরেরবার দেখা হলে ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলতে হবে। সিগারেট শেষ করে যেই ভাবলাম একটা ব্যাখ্যামূলক টেক্সট পাঠিয়ে রাখি ঠিক সেই সময় নীলার ফোন এলো,'কোথায় তুমি, তাড়াতাড়ি আসো'।

আমি লিফটে করে তেতালায় এসে দেখি নীলা চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। নীলার পেছন পেছন কুদ্দুস ভাইয়ের কেবিনে ঢুকে তাজ্জব হয়ে গেলাম। সাদা ধবধবে বিছানার উপর কুদ্দুস ভাইকে ভাসমান নভোচারীর মত লাগছে। একটা মানুষের শরীরে যে এত যন্ত্রপাতি আর নল বসানো থাকতে পারে সেটা আমার ধারণায় ছিল না। এরা কি বেশী পয়সা খাওয়ার লোভে ওনাকে খনন করছে নাকি বহুদিন হাসপাতালে আসি না বলে আমিই সেকেলে হয়ে গ্যাছি?

কুদ্দুস ভাইয়ের বাঁ হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। খাটের পাশে একজন নার্স স্যালাইনের ব্যাগ বদলাচ্ছে। নীলা নার্সকে জিগেস করল,

'ওনার কী অবস্থা? বাঁচবেন?'

'হাতে চারটা স্টিচ লেগেছে। দু ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। পেশেন্ট আপনার কে হন?'

নার্সের পাল্টা প্রশ্ন বোধহয় নীলার ভালো লাগেনি। ও কোন উত্তর দিল না। নার্সও কোন সম্ভাষণের ধার না ধেরেইকেবিন থেকে বেরিয়ে গ্যালো।

আমি নীলাকে বললাম,

'চিন্তা কর না। তোমার কুদ্দুস ভাইয়ের মৃত্যুর কোন সম্ভাবনা নাই'

'কেন?'

'উনি বোধ হয় প্রচুর হলিউডি মুভি দ্যাখেন'

'মানে কী?'

'সিনেমায় কব্জিকাটার সুইসাইড দৃশ্যে সবাই ব্লেড টানে হাতঘড়ির বন্ধনী বরাবর। তারপর চোখ বুজে বাথটাবে পড়ে থাকে। এর নান্দনিক আবেদন হয়তো বেশী কিন্তু এটা একটা ক্লাসিক মিস্টেইক। নিরানব্বই ভাগ নবীশরা এই ভুলটাই করে। কুদ্দুস ভাইও করেছেন'

'কোন ভুলটা?'

'এই যে হাতঘড়ির বন্ধনী বরাবর রগ কাটা'

'বুঝলাম না'

'নিয়ম হলো, ডোন্ট কাট অ্যাক্রস, কাট ডাউন'

নীলা এবার ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। ও বুঝতে পারছে না আমার আপ্তবাক্য গুলো গুরুত্ব নাকি লঘুত্বসহকারে নেবে। আমি বললাম,
'প্রথমে হাতটা মেঝের সমান্তরালে এমনভাবে রাখতে হবে যেন হাতের তালুর দিকটা উপরে থাকে। তারপর কব্জি থেকে কনুইয়ের মাঝামাঝি যেতে হবে। সেখান থেকে শিরা আর ধমনী লক্ষ্য করে ব্লেড টেনে টেনে কব্জির দিকে নামতে হবে। এতে টেন্ডন কাটবে না, শুধু শিরাধমনী চিরে ফালা ফালা হবে। ফিনকি দিয়ে রক্তের নহর বয়ে যাবে। টেন্ডন ঠিক থাকায় কাটা হাত দিয়ে এখনঅন্য হাতের বারোটা বাজানোর পালা। তোমার কুদ্দুস ভাই হাতকেটেছে নবীশের মত। এজন্য রক্ত বন্ধ করতে তেমন সময় লাগেনি। হয়তো ওনার আরম্ভটাও ঠিক হয়নি। অন্তত চব্বিশ ঘন্টা আগে থেকে প্রচুর পানি খাওয়ালাগে। এতে শিরা আর ধমনীগুলো টসটসে আর খোলতাই হয়, ব্লেডের নিশানার মধ্যে থাকে’

'তুমি এইসব কারিগরি কোত্থেকে জানলে?' আত্মহত্যা নিয়ে আমার জ্ঞান এবং গরিমায় ও সামান্য উদ্বিগ্ন।

আমি না শোনার ভান করে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। সামিয়ার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত গত সাত বছর আমিও বহুবার আত্মহননের কথা ভেবেছি। স্বেচ্ছামৃত্যুর বহুবিধ পন্থা একে একে রপ্ত করেছি।




আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। এই শহরের অলিগলি দালানকোঠা জলের ঝাপটে অর্ধেক অবলুপ্ত। আমি নীলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। গাড়ি থেকে ট্যাক্ ট্যাক্ ট্যাক্ ট্যাক্ একটা আওয়াজ আসছে। বোধহয় ভাল্ব কিম্বা টাইমিং বেল্ট এর সমস্যা। নীলক্ষেতে ইকবালের ওয়ার্কশপে নিয়ে সারাতে হবে।

একবার হাসপাতালে গেলে আমার মাথা থেকে রোগবালাইয়েরতাণ্ডব আর বেরোতে চায় না। আজ করিডোরে ফিনাইলের গন্ধ পাইনি, কিন্তু অন্য একটা মন অবশ করা ভার বাতাসে স্তরীভূত ছিল। ইথানল মিথানল এসব কিছু হবে। সেই গন্ধ আমাকে অত ভাবাচ্ছে না যতটা ভাবাচ্ছে কুদ্দুস ভাইয়ের কেবিনের বাইরের দৃশ্যটি। পরিবাগের মোড়ে এসে একবার নীলার দিকে তাকালাম। নীলা কোন এক গভীর ভাবনায় মগ্ন, মুখটা পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে। এখন কিছু বললে খ্যাক করে ওঠার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল।ঝামটা খাওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বললাম,

'কুদ্দুস ভাই কি খুব প্রতাপশালী লোক?'

'না,কেন?'

'এত দামী হাসপাতাল। রুমের বাইরে আবারপুলিশের গার্ড,একজন ইউনিফর্ম পড়া, অন্যজন সিভিল ড্রেসে...খেয়াল করেছ...'

'তুমি বুঝো নাই?'

'কী?'

'এত ঝামেলার মধ্যে তোমাকে পুরো ঘটনাই বলা হয়নি'

আমি কিছুটা ঔৎসুক্য এবং কিছুটা নিরুৎসাহ নিয়ে নীলার দিকে তাকালাম। উত্তেজনাময় কাহিনী শুনতে আমারও ভালো লাগে কিন্তু একবার প্রগল্ভতা পেয়ে বসলে নীলাকে থামানো মুশকিল। বহু বহু দিন আগে ওই কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দের ঝংকার মরমে মধুর মত পশত। সময় এবং অভ্যাস মানুষকে নিঃশেষ করে দ্যায়।

নীলা বললো,

'কুদ্দুস ভাই কিছুদিন ধরে খুব বিগড়ে ছিলেন'
আমি বললাম,

'ভীষণ আবেগ প্রবণ মানুষ, না?'

'আবেগপ্রবণ না ছাই! পিশাচ কোথাকার!'আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নীলা কথা চালিয়ে গ্যালো,

'আমাদের অফিসের সুরাইয়াকে চেন তো? চুল কোঁকড়া, মোটা মত মেয়েটা, বাঁ গালে তিল? আমাদের বাসায় এসেছে দু'বার। কুদ্দুস ভাইয়ের আপন ফুফাতো বোন। ওদের উপরের ফ্ল্যাটে থাকে'

সুরাইয়াকে আমার মনে পড়ছে না। আমি কোনাকুনি করে মাথা নাড়লাম যার অর্থ হ্যাঁ না দুটোই হতে পারে।

'যা বলছিলাম, কুদ্দুস ভাইয়ের মেজাজটেজাজ তো ইদানীং খুব খারাপ। অফিসে যার তার সঙ্গে যেনতেন ব্যবহার করছে। আমি সুরাইয়াকে জিগেসকরলাম ব্যাপার কী? সুরাইয়া তখন পুরো ঘটনা খুলে বললো'

'কী ঘটনা?'

নীলা গলা নামিয়ে বললো,

'ওর ওয়াইফের একটা সম্পর্ক ছিল। বিবাহবহির্ভূত'

'বউ বাদে পৃথিবীর বাকি সবার সাথে যে কোন সম্পর্কই তো বিবাহবহির্ভূত'
'তুমি ভালোই জানো আমি কী বোঝাতে চাইছি। মেয়েটারই বা কী দোষ। কুদ্দুস ভাই প্রতি সন্ধ্যায় কোথায় গিয়ে মদ গিলতো, আরো কীসব আজেবাজে যায়গায় যেত। সুরাইয়া আমাকে বলেছে...'

নীলা আমার দিকে তাকিয়ে একটু থামল। আমাকে একটা টানাপোড়েনেফেলতে চাইছে। তেমন মেজাজে থাকলে এইসব নাটকীয়তা নীলার ভীষণ পছন্দ। আমি বললাম,

'সুরাইয়া কী বলেছে?'

'কুদ্দুস ভাই মাতাল হয়ে বউয়ের সাথে যা তা করত। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, গায়ে হাত তোলা, ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওসব করা...গরমের দেশে গোঁয়ারের মত মদ গিললে কি মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে?'

'কিন্তু পুলিশের ব্যাপারটা কী?' আমি বাগড়া দিলাম। অলিগলি খানাখন্দ ঘুরিয়ে নীলা মূল ঘটনায় আসবে। আমার প্রশ্নে বিচলিত না হয়ে নীলা বলে চললো,

'একটা শিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রঘরের মেয়ে কতদিন এসব সহ্য করবে? ও নাকি কুদ্দুস ভাইকে জানিয়ে দিয়েছিল আর সংসার করবে না...'

'আর তাতেই কুদ্দুস ভাই সেন্টিমেন্টাল হয়ে...' আমি দুয়ে দুয়ে চার মেলালাম।

'সেটা হলে তো একরকম ভালোই ছিল'

'উফ, কি হয়েছে একটু সংক্ষেপে বলো না...' শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বৃষ্টি ভেঙ্গে গাড়ি চালাব নাকি বকর বকর শুনব?
'গতরাতে কুদ্দুস ভাই যথারীতি মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছে। লাবনী বোধহয় শাওয়ারে না কোথায় ছিল। হঠাৎ লাবনীর মোবাইলে টিংটং করে একটা টেক্সট আসে। কুদ্দুস ভাই ফোন তুলে দ্যাখে কে একটা কবিতার দুটো লাইন লিখে পাঠিয়েছে। জানো লাইন দুটো কী?'

'আমি কী করে জানব?'

'তুমি শুনলেই বুঝবে'বলে নীলা আবৃত্তি করল,

'ভালোবাসার অকুল সাগর বটের পাতায় ভেসে/পাড়ি দিতে চেয়েছি আমি তোমায় ভালোবেসে'

বিয়ের প্রথম দিকে জীবনানন্দের এই লাইনগুলো নীলাকে আমি অনেকবার শুনিয়েছি। ওর মনে আছে দেখে অবাক হলাম।

'লাবনী বাথরুম থেকে বের হতেই কুদ্দুস ভাই ওকে চেপে ধরে টেক্সটের রহস্য ভেদের জন্য। লাবনী তখন হঠকারীর মত বলে বসে ও আর কাউকে ভালোবাসে। একটা পাড় মাতালকে এসব বলার কোন দরকার ছিল? এই নিয়ে রাতবিরেতে কথা কাটাকাটি। হঠাৎ কী থেকে কী হলো জানি না, কুদ্দুস ভাই চুলোর পাশে রাখা ছুরিটা নিয়ে লাবনীর গলায় খচাত করে বসিয়ে দ্যায়। ঘোর কেটে যাওয়ার পর সুরাইয়াকে ফোন করে। তারপর বউয়ের ডেডবডি দেখে ছুরি দিয়ে নিজেই নিজেকে... উফ কী নির্মম আর বীভৎস ঘটনা! এজন্যই তো ওর রুমের বাইরে...'

'কী নাম বললে মেয়েটির?'

'লাবনী। সামিয়া আহমেদ লাবনী। একবার আমদের অফিস ফাংশনে এসেছিল অতুল প্রসাদ শোনাতে। যা সুন্দর গানের গলা আর চেহারাটাও কেমন মায়া মায়া। ধানমন্ডিতে একটা কিন্ডারগার্টেনের গানের টিচার ছিল। মুনলাইট না সানলাইট কী যেন নাম ওই স্কুলের। তোমার অফিসের ওদিকেই তো...'

নীলা আরো কী সব বললো। সব কথা আমার কানে গ্যালো না। আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। আমি চারিদিকে ফিনাইলের গন্ধ পাচ্ছি। কাল ঠিক রাত এগারোটায় সামিয়াকে বার্তা পাঠিয়েছিলাম,'ভালোবাসার অকুল সাগর বটের পাতায় ভেসে/পাড়ি দিতে চেয়েছি আমি তোমায় ভালোবেসে'। হঠাৎ ক্র্যাচ ক্র্যাচ করে শব্দ হলো। আমার গাড়ি চাকাপিছলে রাস্তার অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। নীলা চিৎকার দিয়ে বলছে'রাশেদ...রাশেদ... কী হলো...তুমি এমন করছ কেন?'
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সাবলীল, সুন্দর উপস্থাপন ।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
Shamima Sultana অসাধারণ, মানুষের ভালবাসা বড় রহস্যময়
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া গল্পটি ভালো লেগেছে বন্ধু। হলিউডি মুভির প্রভাব.. এখন আবার শুরু হয়েছে ব্ল হোয়েল-এর প্রভাব। ভালো লেগেছে সব মিলিয়ে..
শামীম খান অভিনন্দন রইল ।
সেলিনা ইসলাম বিজয়ী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা!
নাস‌রিন নাহার চৌধুরী অতি প্রত্যাশিত। খুব খুশি হলাম। অভিনন্দন রইল অনেক অনেক।
অনেক ধন্যবাদ।
Fahmida Bari Bipu এশরার ভাই, প্রথম অবস্থানটা আপনার জন্য বেঁধে রাখা। এতোটাই অসাধারণ লেখেন যে, অন্যকিছু ভাবার অবকাশই থাকে না। আন্তরিক অভিনন্দন। খুব শীঘ্রই আপনার একক গল্পগ্রন্থ আসুক তা চাই। :)
অনেক ধন্যবাদ আমার যোগ্যতার অতিরিক্ত প্রসুংশার জন্য।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী অনেক অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইলো ভাইয়া.....
অনেক ধন্যবাদ।
Md Kamrul Islam Konok খুব সুন্দর লেখেন।

০১ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.১৮

বিচারক স্কোরঃ ৩.৮৫ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৩৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী