অজানা অনুভুতি

মা (মে ২০১১)

নিশাত শামা
  • ৩৯
  • 0
  • ৭৭
আজকে তিশা স্কুল থেকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে। ড্রাইভার আংকেল ওকে বাসার গেটের সামনে নামিয়ে দেওয়ার পর রহিমা বুয়া এসে দরজা খুলল। তিশা কারো সাথে কথা না বলে ওর রুমে চলে গেল। রহিমা বুয়া ছাড়া এখন ওদের বাসায় আছে ফুলি, তিশার থেকে দুই বছরের ছোট। সে ও ওদের বাসায় কাজ করে। তিশার বাবা মা অফিসে। দুইজনই সন্ধ্যার পরে ফিরবে। তিশা স্কুল ড্রেস ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ওর কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসল। ফুলি ওর ঘরে খাবার দিয়ে গিয়েছে। ইন্টার নেট ঘাটতে ঘাটতে খাওয়া শুরু করল তিশা।
তিশার বয়স বার বছর। ক্লাস সিক্সে উঠেছে এবার। ইংলিশ মিডিয়াম একটা স্কুলে পড়ে। ছোট বেলা থেকেই নাচ শেখে ও। অবশ্য সেটা বাবা মার কথায় ই। কোকারিকুলাম এক্টিভিটিস না শিখলে নাকি কিছু করা যায় না কোথাও। তিশা বাবা মার কথা শুনে। ঠিক মত পড়াশুনা করে। নাচে। স্কুলে যায় প্রতিদিন। কিন্তু তাদের সাথে তিশার সম্পর্কটা অনেক ফর্মাল। প্রতিদিন অফিস থেকে এসে দুই জনই টায়ার্ড থাকে। তখন তারা টিভি দেখে, বিশ্রাম করে, মাঝে মাঝে তিশাকে ডেকে ওর স্কুল আর পড়াশুনার খোঁজ নেয়। সপ্তাহের ছুটির দিন গুলোতে অবশ্য তিশাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বের হয় ওর বাবা মা। কিন্তু তিশার তাদের সাথে বের হতে তেমন একটা ভাল লাগে না। ছোট বেলায় ওর বাবা মা জানত ওর কি পছন্দ। কিন্তু এখন তারা এসব কিছুই বুঝে না। হয় তারা কোন একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খায়। কিন্তু এরকম বড় দুইজন মানুষের সাথে বসে খাওয়ার কি মজা তিশা বুঝতে পারে না। এর থেকে তিশার ফ্রেন্ডদের পার্টি গুলোতে কত মজা হয়। সেদিন আবার তার বাবা স্টার সিনেপ্লেক্সে ওদেরকে নিয়ে একটা মুভি দেখতে গেল। বাংলা সিনেমা। তিশার প্রায় ঘুম এসে গিয়েছিল। তাই ও বাবা মার সাথে না বেড়াতে না যেতে হলে খুশিই হয়। প্রতিদিন স্কুলে, সপ্তাহে দুই দিন নাচের ক্লাশে ড্রাইভার আঙ্কেল ই নিয়ে যায়। স্কুলে ফ্রেন্ডদের সাথে থাকে। বাসায় টিভি দেখে, ইন্টারনেট ব্রাউস করে সময় কাটায়। মাঝে মাঝে গেমস খেলে। এই সময় টুকু তিশার নিজের। আর ওর এই জগতটা ওর বাবা মার থেকে আলাদা। তিশার বাবা মা ওর এ জগতে ঢুকার চেষ্টাও করেন নি কখনো।
তিশার বন্ধুদের কথায় আসি। ওরা সবাই ইংলিশ মিডিয়ামের অবস্থা সম্পন্ন ঘরের ছেলে মেয়ে। কারো কারো বাবা মা তিশার মত, চাকরি করে। কারও শুধু বাবা চাকরি বা ব্যাবসা করে, মা গৃহিনী। গৃহিনী মা দের সমস্যা হল তারা সবসময় ঘারের উপর লেগে থাকে। কিছুই করা যায় না। অবশ্য তারাও পার্লার আর নিজেদের মত পার্টি করে সময় কাটায়, তাও, বাসায় তো থাকে।
তিশা ওর বন্ধুদের সাথে গল্প করে, মাঝে মাঝে বিভিন্ন বড় বড় ফাস্টফুড সপে পার্টি করে ওরা। কিন্তু তিশার কেন যেন মনে হয় ওদের কারো প্রতি কারো কোন টান নেই। তিশা কখনোই ওর একান্ত অনুভূতি গুলো এদের কারো সাথে শেয়ার করে না। ওর সাথে ও কেউ করে না। ওদের মাঝে ব্যাপারটা এমন একজন বন্ধু চলে গেলেও কারো কিছু না। নতুন কেউ তো আসবেই। এটাকেই কি বন্ধুত্ব বলে?

সেদিন ছুটির দিন ছিল। তিশা অনলাইন হয়েছে মাত্র। ওকে নক করে শান্তা হাই দিলো। তারপর একটা কনফারেন্স জয়েন করার জন্য ইনভাইট করল। সেখানে তিশার স্কুলের সব বন্ধুরা আছে ওদের কথা গুলো বাংলা ইংলিশ মেশানো, চ্যাট এর ভাষায়। আমরা বাংলা তরজমাটাই শুনিঃ
- এই কালকে ফ্রি আছ?
- হ্যাঁ, কেন?
- আমরা বাইরে যাওয়ার প্ল্যান করছিলাম। সাদিব ট্রিট দিবে।
- আচ্ছা, যাব আমি। কিসের জন্য ট্রিট?
- এমনি।
- তিশাআআআ..... কালকের কন্সার্টটা দেখেছিলে?
- হুমমম, দেখেছি। রকিং।
- সবাই শুনো শুনো, আমি একটা ল্যাপ্টপ পাচ্ছি। বাই বাই টু মাই ডেস্কটপ পিসি।
- আরিবা, ল্যাপটপ এমন বড় কোন ব্যাপার না। এইটা নিয়ে এত লাফানোর কি হল? সবারই আছে।
- হ্যাঁ আছে, কিন্তু আমাকে পাপা দিতে চাচ্ছিল না। যাই হোক বাদ দাও।
- শান্তা তুই কালকে কোন ড্রেস পরবি?
- মেয়েরা এসব কথা পরে বোল। এখন আমাদের কথা শুন। কালকে একটা জোস গেম পেয়েছি।
- .........
ওদের এসব কথা অনন্ত কাল ধরে চলতেই থাকবে। এর থেকে পরদিন ওদের হ্যাং আউটের কি হল সেটা দেখি।
সবাই যে যার মত খাবার অর্ডার করেছে। গল্প করছে। ছেলেরা স্কুলের একটা বাস্কেট বল ম্যাচ নিয়ে কথা বলছে। শান্তা মেয়েটা একটা পিঙ্ক নেইলপালিশের গল্প করছে, সেই নেইলপালিশ দিলে নাকি অনেক হট লাগে। সব মেয়েরা সেটাই শুনছে। তখন তিশা দেখল, ফাস্ট ফুড সপটা তে একটা মেয়ে তার মায়ের সাথে ঢুকল। মেয়েটা ওদেরই বয়সি। কিন্তু কেমন যেন ওদের থেকে আলাদা। দুইজন এসে ওদের টেবিলের কাছে থামল। মাটার ভেতর কেমন যেন অপ্রস্তুত ভাব। তিশা তাদের কথা গুলো ভাল মতই শুনতে পেল।
- এখানে খাবার তো অনেক দামি। এখানেই খাবি তোরা?
- হ্যাঁ মা, এখানেই।
- মা খাবারের পিছে এত টাকা খরচ করার কোন মানে হয় না। এর থেকে তোরা ওই পাশের রেস্টুরেন্টে যাস না কেন?
- মা, একদিনই তো।
- একদিন বলে তোরা অপচয় করবি। চল বাইরে সবার জন্য অপেক্ষা করি। সবাই আসলে ওই দোকান টাতেই যাব।
- মা, প্লিজ।
- মা তুমি জানো না পয়সা কিভাবে আসে। তাই পয়সার প্রতি মায়া নাই। চল ওখানে, বেয়াদপি কর না।
মেয়েটা মন খারাপ করে মায়ের সাথে রওনা দিল। তিশার মন খারাপ হয়ে গেল। মাটা এমন নিষ্ঠুর কেন? মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর বন্ধুদের সামনে অনেক লজ্জা পাবে। কি রকম “চিপ মেন্টালিটি”-এর মা। তিশাদের মা রা এর থেকে কত্ত ভাল।

তিশাদের খাবার চলে এসেছে। ওরা সবাই গল্প করছে। ওরা ঠিক করল খাওয়া শেষ করে পাশের সপিং মলটাতে যাবে। সেখানে স্নিকার্স ওয়ার্ল্ডের দিকে সবারই অনেক আগ্রহ। খাওয়া দাওয়া করে, সপিং মলে ঘুরে মেয়েটার কথা তিশা ভুলেই গিয়েছিল। সপিং মলের নিচের তলায় এসে সবাই যখন বিদায় জানিয়ে চলে গেল, তখন তিশা মেয়েটাকে একটা দোকানের সামনে দেখল। সে কিছু একটা কিনছে। কি মনে করে যেন তিশা সেদিকে এগিয়ে গেল। দোকানটায় মেয়েদের অনেক জিনিস পাওয়া যায়। তিশা একটা কানের দুল দেখার ভান করে মেয়েটার কথা শুনছিল। ওর সাথে ওর একটা বান্ধবীও আছে। মেয়েটার মা মনে হয় ওদের কে দিয়ে চলে গেছে। মেয়েটা তার বান্ধবীকে একটা জিনিস দেখিয়ে বলল, বলতো এটা কেমন? আম্মুর পছন্দ হবে?
তিশা একটু অবাক হল। ওর মা মাত্র না ওকে বকা দিল। আর ও এখন মার জন্য গিফট কিনছে। অথচ তিশা কখনও কারো জন্য কোন গিফট কিনে নি। বন্ধুদের জন্মদিনে আম্মুকে বললে আম্মু কিছু একটা কিনে দেয়। আম্মুকে গিফট দেওয়ার কথা তো মাথায় ও আসে নি কখনো। এসব ভাবতে ভাবতে তিশা অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটা বড়দের মত জিনিসটা নিয়ে দামাদামি করছে। তিশা মনে হয় বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটার সাথে ওর চোখাচোখি হয়ে গেল। তিশা চোখ নামিয়ে নিতে যাবে, তখন মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল; যেন ওরা কত দিনের পরিচিত। তিশা একটু হাসল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। ওর কেমন অসস্তি লাগছে। মেয়েটা অবশ্য সেটা ধরতে পারল না। বলল আমি তোমাকে ফাস্ট ফুড সপটা তে দেখেছি। তারপর ওর হাতের জিনিসটা দেখিয়ে তিশাকে বলল এটা কেমন বল তো? আম্মুর জন্য কিনছি। পরশু দিন আম্মুর জন্মদিন। বলতো ওঁর পছন্দ হবে নাকি? তিশা মাথা নাড়িয়ে বলল হ্যাঁ সুন্দর। অসস্তি যায় নি ওর তখনও। তখন মেয়েটা ওকে বলল, ও হ্যাঁ আমার নাম অহনা। তিশা ওর নাম বলল। তারপর ওরা স্কুল ক্লাশ এসব বলল নিজেদের। মেয়েটাও ক্লাশ সিক্সে পড়ে। তিশা বুঝতে পারল ওদের সাথে মেয়েটার পার্থক্য কোথায়। মেয়েটা বাংলা মিডিয়ামে পড়ে।
তিশার বন্ধুরা বাংলা মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের পছন্দ করে না। ওরা নাকি অনেক লো ক্লাস আর বাজে মেন্টালিটির হয়। কিন্তু তিশার অহনাকে দেখে ভালই লাগল। সে নিজে থেকেই অনেক কথা বলে। দোকানদার ওর আম্মুর গিফটটা প্যাক করে দিচ্ছিল আর তখন ও অহনা কে বলল, যে অনেকদিন পর ওরা বাসায় আম্মুর জন্মদিনে মজা করছে। ওরা তিন ভাই বোন আলাদা আলাদা গিফট কিনছে। আর সবাই মিলে আম্মুকে সারপ্রাইজ দিবে। কেক কিনে আনবে। ওরা ঘর কিভাবে সাজাবে সেটা নিয়ে প্ল্যান করছে এখন।
তিশা হেসে বলল, অনেক দিন পর কেন? এর মাঝে এরকম কর নি কেন?
তখন মেয়েটা কেমন দুখি হয়ে গেল। বলল যে ওর আব্বুর সাথে আম্মুর সমস্যা হয়েছিল কিছু। সেটার জন্য ওদের নাকি অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এখন আম্মু একটা চাকরি পেয়েছে। তাই সবাই অনেক খুশি ওরা।
- আম্মুর সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে। বাসার বাইরের সব কাজই করতে হত। আমাদের সাথে অনেক রাগারাগি করত তখন। কিন্তু আমরা কিছু মনে করি নি। আমাদের জন্যই তো কষ্ট করত। এখন সব কষ্ট শেষ। তাই আমরা সেলিব্রেট করব।
বলতে বলতে মেয়েটার গলা কেমন ভারি হয়ে এসেছে। তিশা ওর কাধে হাত রাখলো। অহনা বলল, আমি আমার মা কে অনেক ভালবাসি। সবাই বাসে। কিন্তু আমার মা আমার কাছে অনেক স্পেশাল। আম্মুর জন্য আমি যে কোন কিছু করতে পারব। আম্মু যেমন আমাদের খুশি করার জন্য সব করে। তুমি একদিন আমাদের বাসায় এস। তোমার অনেক ভাল লাগবে।
তিশা অহনার ফোন নাম্বার নিয়ে গাড়িতে উঠালো। ও এখনো বুঝতে পারছে না মেয়েটাকে। মায়ের জন্য এত ভালবাসা। এটা কেমন অনুভূতি। তিশা তো কখনও ওর মায়ের জন্য এমন কিছু অনুভব করে নি। ও সব সময় ওর মাকে দেখেছে ব্যাস্ত। ওর সাথে মায়ের সম্পর্কটা তো অনেকটা দেনা পাওনার মত। ও ঠিক মত পড়াশুনা করলে আর তার কথা শুনলে ও যা চায় তাই পাবে। তিশার কাছে ব্যাপারটা এমনঃ মা তো আছে, থাকবেই। এটা নিয়ে কখনওই মাথা ঘামানোর কথা চিন্তা করে নি। অহনার মায়ের প্রতি যে ভালবাসা, সেটা তো ওর ভিতরে কখনো আসে নি। এই অনুভূতিটা হয়তো তিশার জন্য না। ও কখনই জানবে না এটা কেমন। এভাবে মা কে ভালবাসা, এ অদ্ভুত অনুভূতিটুকু অনুভব করা হয়তো অহনার মত একটা অদ্ভুত মেয়ের পক্ষেই সম্ভব।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিশাত শামা রওশন ধন্যবাদ আপনাকে :)
রওশন জাহান ভালো লেগেছে . আমাদের প্রজন্মের বাস্তবতা তো এই !
নিশাত শামা @zero তোমার comment তা পড়ে আমারও অনেক ভালো লাগলো @রানা আপনাকেও ধন্যবাদ :)
মিজানুর রহমান রানা আপনার লেখা যথেষ্ট ভালো লাগলো। আপনার প্রতি সুভাশিষ। --------- রানা।
ZeRo পড়ি কম , বুঝি কম কিন্তু অনুভুতিটা তো আর কম না ! অনুভবে সুন্দর অনুভুতিটা নাড়া দিয়ে গেল তোমার সাবলীল বর্ণনাধারায় ! তোমাকে সালাম সিস্টার !
নিশাত শামা nahid- ধন্যবাদ আপনাকে
খন্দকার নাহিদ হোসেন লেখাটা আমার কাছে অনেক পরিণত লাগলো। বিষয়টা আমার কাছে বেশি ভালো লাগছে। সামনের জন্য দোয়া রইলো ভাইয়া।
নিশাত শামা মামুন ধন্যবাদ আপনাকে. আমাদের সামাজিক অবস্থা আসলেই পারিবারিক সম্পর্ক গুলোর উপর অনেক প্রভাব ফেলছে.
মামুন ম. আজিজ এভাবেই আমাদের সামাজিক অবস্থা ধিরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন।

২০ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪