স্মৃতি তর্পন

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০২১)

সজল কুমার মাইতি
মোট ভোট ২০ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.২৭
  • 0
  • ১৫১৪
দিলবাগ সিং। ছ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। মাথায় পাঞ্জাবি পাগড়ি। শ্মশ্রুগুম্ফ শোভিত সুদর্শন ব্যক্তি। আজানুলম্বিত বাহু, ফর্সা, স্মার্ট। এক নামী ইলেকট্রনিকস কোম্পানির পূর্ব ভারতের এরিয়া সেলস ম্যানেজার। কলকাতার ক্যামাক স্ট্রীটে ঝাঁ চক চকে বিশাল অফিস। গুরগাঁওর MDI থেকে MBA পাশ করে এই কোম্পানিতে জয়েন করেছিল। ব্রাইট রেজাল্ট। সেই জন্য ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতেই কোম্পানি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর ফিরে তাকানোর প্রশ্নই নেই। মই দিয়ে তরতরিয়ে উঠে আজ এরিয়া সেলস ম্যানেজার। কোম্পানির নিউ প্রকাক্ট লঞ্চের পুরো দায়িত্ব দিলবাগের ওপর। মার্কেট এক্সপানসনের কাজে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। আজ গুয়াহাটি, তো কাল মনিপুর, পরশু মিজোরাম। রিজিওনাল অফিস কলকাতায় হলে কি হবে, দিলবাগকে সারা পূর্ব ভারত চক্কর কেটে বেড়াতে হয়।

দিলবাগের জন্ম, পড়াশোনা সবই কলকাতায়। এরা বংশ পরম্পরায় সেনাকর্মী। দাদু গুরচরন সিং ছিলেন সেনা হাবিলদার। বাবা সুরজিৎ সিং ব্রিগেডিয়ার। পরিবারের ইচ্ছা অর্থাৎ বাবার ইচ্ছা দিলবাগ ও আর্মিতে জয়েন করুক। বাপ মায়ের খুব আদরের ছিল দিলবাগ। বাবা ছোটবেলা থেকে ছেলেকে আর্মি ট্রেনিং দিতেন। স্যালুট শেখানো, ' আররাম ভিশশ্রাম ' আর্মি ট্রেনিং এর প্রাথমিক পাঠ দিয়ে রেখেছিলেন। দাদুর দেশপ্রেমের কথা, আত্মত্যাগের কথা কতবার যে বাবার কাছে শুনেছে দিলবাগ! শুনে শুনে দিলবাগের মনের আয়নায় দাদুর দেশপ্রেমের একের পর এক ছবি আঁকা হয়ে গেছে। দাদুকে দিলবাগ চোখে দেখে নি, কিন্তু দাদুর কথা এত শুনেছে যে তার মনে দাদুর এক স্থায়ী চিত্র আঁকা হয়ে আছে। দিলবাগের জন্মের অনেক আগেই দাদু শহীদ হয়েছেন। মরনোত্তর পরমবীরচক্র পেয়েছেন ভারত সরকারের তরফ থেকে। দাদুর কথা যখন মনে আসে, দিলবাগের বুক গর্বে ভরে ওঠে। বাবা, দাদু এক সময় ফোর্ট উইলিয়ামের কোয়ার্টারে থাকতেন। পরে বাবা কলকাতার ভবানীপুরে একটি দোতলা বাড়ি কিনে সেখানে চলে আসেন। দিলবাগের জন্ম এই বাড়িতে। দিলবাগদের দেশের বাড়ি পাঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলার এক ' পিন্ড ' এ অর্থাৎ গাঁয়ে। দিলবাগ মা বাবার সঙ্গে একবার সেই দেশের বাড়িতে গেছিল। সেখানে আত্মীয় স্বজন সবাই আছেন। তখন দিলবাগ খুবই ছোট ছিল। গুরদাসপুরের অর্জনপুর গ্রামে দিলবাগদের পৈতৃক বাড়ি। সেখানে আত্মীয় স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টি সবাই আছে। এমনকি পৈতৃক ভিটেটুকু ও এখনো আছে। আত্মীয় স্বজনরা তার দেখভাল করে। এই অর্জনপুর এক বর্ধিষ্ণু গাঁ। প্রায় প্রতিটি পরিবার স্বচ্ছল। একদিন দিলবাগের বাবার কাকা দিলবাগের সম্পর্কে দাদু রনজিৎ সিং দিলবাগকে ডেকে বলেন, " আ যা পুত্তর, তুঝে পিন্ড ঘুমাকে দেখাউ।" ছোট্ট দিলবাগ আনন্দে আত্মহারা। দাদুর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে।

অর্জনপুর গাঁয়ে প্রত্যেক পরিবারে স্বচ্ছলতার চিহ্ন পরিষ্ফুট। প্রতি বাড়িতে ট্রাক্টর ও অন্যান্য কৃষিসামগ্রী। বিশাল মাঠ জুড়ে সবুজের শ্যামলিমা। সেই সব ক্ষেতে গম, বাজরা, ডাল বিভিন্ন সব্জির চাষ হচ্ছে। দাদুর সঙ্গে যেতে যেতে অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে দিলবাগ। দাদু বোঝাতে বোঝাতে এগিয়ে চলেন, দিলবাগ পেছনে পেছনে দেখতে দেখতে যায়। দাদু ক্ষেতের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাতে দেখাতে বলে চলেন, " এ পরমজিৎ কি, এ গুরবক্স কি। এ হরমিৎ কাউর কি, উসকি পতি গুজর যানেকে বাদ ওহি সবকুছ সামালতি হ্যা।" দিলবাগ মাথা নেড়ে সায় দেয়। কিন্তু এদের কাউকেই সে চেনে না। তবে মাঠের এই সবুজ দেখতে ভালই লাগে। মাঝে মধ্যে মান্ডি রয়েছে। সেখানে চাষীরা ক্ষেতের ফসল বিক্রি করে। এখানকার ক্ষেতের আকার তুলনামূলকভাবে অনেক বড়। সেজন্য এখানে মেকানাইজড ফার্মিং সহজে করা যায়। এর ফলে ফসল উৎপাদনের হার ও অনেক বেশি। দাদু নাতিকে বোঝান, "সোনে য্যায়সে গেঁহু হোতা ইস ক্ষেতিমে। সারা মূলুক ইজ্জতসে খাতে ইস চীজ। ইসি লিয়ে তো পাঞ্জাব দেশকি সব্জি ভান্ডার। ক্ষেতি পরব যব হোতা, সব মিলকে লঙ্গর মানাতা অউর ভাঙড়া নাচতা। পুত্তর, বহুৎ মজা হোতা।" এইসব শুনে দিলবাগ ও মনে মনে ভাঙড়া নেচে নেয়। কল্পনায় সে উৎসবে নিজেকে সামিল করে। সবার সঙ্গে মিলে আনন্দের অংশীদার হয়। পরে একদিন বাবা মায়ের সঙ্গে স্বর্নমন্দিরে যায় দিলবাগ। এত বড় এক সরোবরের মাঝে এক অতীব সুন্দর মন্দির ছোট্ট দিলবাগকে মন্ত্র মুগ্ধ করেছে। চেয়ে চেয়ে অবাক হয়ে কেবল দেখতে থাকে। দেখার শেষ নাই। ' রব ' কে প্রনাম নিবেদন করে সারা জায়গাটা একা একা ঘুরে বেড়ায় দিলবাগ। এই জায়গা কেন জানি না দিলবাগের ভীষন ভাল লাগে। কেমন চেনা চেনা লাগে। যেন বহুদিনের সম্পর্ক। বাবা মা মন্দিরের ভেতরে অনেকটা সময় কাটান। সেসময় দিলবাগ চারদিকের সৌন্দর্য গিলে খাচ্ছিল। দূরে কোথাও ভক্তিগীতি ' রবনে বনায়া...' বেজেই যাচ্ছিল। দিলবাগের মন উদাস হয়ে কল্পনার সাগরে পাড়ি দিতে শুরু করেছে। এমন সময় মায়ের ডাকে দিলবাগের সম্বিৎ ফেরে। সবাই মিলে লঙ্গরে যায়। চাপাটি সব্জি সবার সঙ্গে বসে খুব আনন্দের সঙ্গে খায়। স্বাদে এই সামান্য খাবারই অমৃত সমান। গোটা পরিবেশের মধ্যে কেমন একটা পবিত্রতার ছোঁয়া, এক স্বর্গীয় ভক্তির অনুভূতি। মাথা বারবার নত হয়ে আসে। মন হিংসা বিবাদ, গর্ব অহংকার ভুলে উদার সহযোগী হয়ে ওঠে। পরপোকার ছাড়া আর কিছুর স্থান সেখানে নেই। সে কেবল ' রব ' ময়।


ম্যান প্রোপজেস গড ডিসপোজেস। ঠিক তাই হল এক্ষেত্রে। দিলবাগের আর্মিতে যোগ দেওয়ার কোন তাগিদ নিজের মধ্যে অনুভব করে না। একদম ভাল লাগে না। মনে হয় কেমন যেন মনোটনাস এক ধরনের কাজ। প্রতি পদে শৃঙ্খলার বেড়ি। নিজের পছন্দ মতো ডাইনামিকভাবে কাজ করার স্কোপ কোথায় এখানে? লেখা পড়ায় তার আগ্রহ। খুব একটা খারাপ ছাত্র নয় দিলবাগ। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছে সে। রেজাল্ট ও যথেষ্ট উজ্জ্বল। সেখানে থেমে থাকেনি। গুরগাঁওর MDI থেকে MBA করেছে মার্কেটিং এ। পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সে আজ করপোরেট এগজিকিউটিভ। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে সিলেক্টেড হয়ে গেছে। বতর্মান কোম্পানিতে মার্কেটিং এগজিকিউটিভ হিসেবে জয়েন করে নিজের পারফরম্যান্স ও যোগ্যতায় আজ কোম্পানির এরিয়া সেলস ম্যানেজার। সারা পূর্ব ভারতের দায়িত্ব দিলবাগের কাঁধে। ডিলার এক্সপানসন অর্থাৎ নতুন ডিলার নিয়োগ, পুরোন ডিলারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি। অ্যাড ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ অ্যাড কনটেন্ট ও মিডিয়া ঠিক করা; ডিস্ট্রিবিউটার অ্যাপয়ন্টমেন্ট; রিজিওনাল সেলস এগজিকিউটিভ নিয়োগ ও এই এরিয়ার সব ফিনান্সায়াল ম্যানেজমেন্ট। এছাড়াও প্রতিদিন সেলস রিপোর্ট হেড অফিসে পাঠানো ও দিলবাগে কাজের মধ্যে পড়ে। এই সব কাজের জন্য দিলবাগকে বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মিজোরাম ও পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ও প্রায়শই যেতে হয়। দিলবাগের পরিশ্রমের ফলে পূর্ব ভারতে কোম্পানির বিক্রি এই সময়ের মধ্যে অনেকটাই বেড়েছে। এর পুরো কৃতিত্বই দিলবাগের কিন্তু স্বভাব লাজুক দিলবাগ এই কৃতিত্ব তার টিমের সঙ্গে শেয়ার করে নেয়। আসলে দিলবাগের এই সাফল্যের পেছনে একটি ছোট্ট গল্প আছে। দিলবাগের আগে এই রিজিয়নের এরিয়া সেলস ম্যানেজার ছিলেন মনোজ মালব্য। তখন দিলবাগ ডেপুটি এরিয়া সেলস ম্যানেজার। মি: মালব্যের অধীনে দিলবাগকে কাজ করতে হতো। প্রতিদিনের সেলস রিপোর্ট মালব্যর কাছেই জমা দিতে হতো। দিলবাগ কিন্তু সেই রিপোর্টের একটি কপি হেড অফিসে ও একইসঙ্গে পাঠিয়ে দিত। এর কিছুদিন পর দেখা গেল কোম্পানি দিলবাগকে এরিয়া সেলস ম্যানেজার করেছে। আর মালব্য জয়েন্ট এরিয়া সেলস ম্যানেজার হিসেবে এখন দিলবাগের কাছে রিপোর্ট করেন। মার্কেটিং এ এসব হামেশাই ঘটে থাকে। এই ইঁদুর দৌড়ে কে কখন মই দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার পরমুহূর্তে সাপের মুখে পড়ে নিচে নেমে আসছে। এ যেন সাপ লুডো খেলা। এই পথে চড়াই উৎরাই লেগেই আছে। কোম্পানির আস্থার রিটার্ন সুদে আসলে ফেরত দিতে পেরেছে দিলবাগ। কোম্পানির এই রিজিয়নের মোস্ট ট্রাস্টেড ম্যান আজ দিলবাগ সিং। দিলবাগ পূর্ব ভারতে কোম্পানির প্রডাক্ট প্রোমোশনের জন্য এক নতুন পলিশি নিয়েছে। লোকাল সেলস এগজিকিউটিভ রিক্রুট করার পলিশি নিয়েছে। তাদের ট্রেনিং দিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে। এই পলিশি খুবই কাজে লেগেছে। এরা লোকাল ডিলার সিলেকশন ও প্রডাক্ট প্রোমোশনে লোকাল লোকদের বোঝানোর ব্যাপারে এদের অ্যাকটিভ রোল প্রশংসনীয়। এই পলিশিতে কোম্পানি অল্পদিনের মধ্যে এইসব এলাকায় নিজের বিজনেস বাড়াতে সমর্থ হয়েছে। পূর্ব ভারতের এক এক রাজ্যে বিজনেস বাড়িয়ে দিলবাগ এবার তার পাখির চোখ করেছে অরুনাচলকে। এবারের অক্টোবর মাসে তার অরুনাচল যাত্রার ছক রেডি করে ফেলেছে। এবার মিশন অরুনাচল।

অক্টোবর মাস, শরৎকাল। বর্ষার পর পরিষ্কার আকাশ। পেঁজা তূলোর সঙ্গে নীলের আভা। স্বচ্ছ আকাশে দূর্গা মায়ের পদধ্বনি। মাঠে মাঠে কাশের লম্বা ফুলর ঝালর দেবীর আগমনের রাস্তা পরিষ্কারে সদা ব্যস্ত। শিউলির মিষ্টি সুবাস বাতাসে পবিত্রতার আভাস এনে দিয়েছে। এর কোমল ফুল দেবীর নরম পদরাজি স্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ। আকাশে বাতাসে ঢাকের বাদ্যধ্বনি রনিত হচ্ছে। প্যান্ডেল প্যান্ডেলে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি নানা বর্নে শোভিত হচ্ছে। সারা কলকাতা শহরে পূজো পূজো আবহমণ্ডল। এই অবস্থায় দিলবাগের কলকাতা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। পুরো পূজো খুব ধূমধামে কাটিয়ে দশমীতে কলকাতা এয়ারপোর্ট হয়ে গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে পৌঁছয় দিলবাগ। এয়ারপোর্টের বাইরে একটি এসইউভি দিলবাগের জন্য অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভার দিলবাগের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিল তাকে স্বাগত জানানোর জন্য। দিলবাগ গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। সামনে ড্রাইভারের কাছের সিটে বসে সামনের দৃশ্য দেখতে দেখতে যায়। অরুনাচলে ভ্রমন দিলবাগের এই প্রথম। যদিও এটা প্রমোদভ্রমণ নয়, ব্যবসায়িক। দুচোখ ভরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে দিলবাগ আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলছিল। গলা ভেজানোর ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে। দিলবাগ ড্রাইভারকে বলে, " চায়ে কা দুকান হো তো থোড়া রুক যা না। চায়ে কি বহুৎ জরুরৎ হ্যা।" কিছু দূর এগিয়ে ড্রাইভার এক অদ্ভূত রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করায়। দিলবাগ ভেতরে ঢোকে। রেস্টুরেন্টটি একটু অভিনবত্ব দাবি করতে পারে। এটি একটি টি গার্ডেন কোম্পানির নিজস্ব রেষ্টুরেন্ট। মূলত বিভিন্ন ফ্লেভারের চা সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করে ক্রেতাদের পরিবেশন করা হচ্ছে। চায়ের প্রতি কাপের দাম চল্লিশ টাকা থেকে একশ কুড়ি। রেস্টুরেন্ট বৈচিত্র্যে ভরপুর। সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ, বাগান ও টবের সারি দিয়ে আর্টিস্টিকভাবে ছবির মতো সাজানো। অর্কিড, বিভিন্ন দুর্মূল্য ফুলের সমাহার। বসার জায়গা ও টেবিল চা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। গোটা অ্যাম্বিয়েন্সটা যেন এক শিল্পীর স্টুডিও। দিলবাগ চা ও হাল্কা স্ন্যাক্স খেয়ে গাড়িতে বসে। গাড়ি এগিয়ে চলে।

গাড়ি আসামের ভালুকপঙের জঙ্গলের মধ্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। দিলবাগ ড্রাইভারকে একটু ধীরে চালাতে বলে। বন চিরে রাস্তা চলে গেছে। দুই দিকে শাল সেগুনের বিশাল জঙ্গল। তত গভীর যদিও নয় এই জঙ্গল। খালি চোখে অনেক দূর অব্দি দেখা যায়। দিলবাগ দুই দিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল যদি কোন হাতি বা বুনো শূয়োর বা অন্য কোন জন্তু দেখা যায়। দিলবাগের কপালে নেই, তাই কোন বন্য বন্যপ্রানী আজ দেখা গেল না। কিছুটা হতাশ দিলবাগ আশা ছেড়ে মোবাইলে মন দেয়। হঠাৎ ড্রাইভার চেঁচিয়ে ওঠে, " স্যার, ও দেখিয়ে। মোর। জোড় মে হ্যা।" দিলবাগ মোবাইল থেকে চোখ তুলে দেখে দুটো ময়ূর খাওয়ার খুঁটে খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে। গাড়ি কাছে আসতে দিলবাগ ড্রাইভারকে একটু দাঁড়াতে বলে। মোবাইলে ছবি তোলে। ময়ূরের জোড়া একবার মুখ তুলে দেখে, পরক্ষনে যেন ইগনোর করে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মন ভরে যায় দিলবাগের। সারা পথে আর কারুর দেখা নেই। গাড়ি এগিয়ে চলে। ভালুকপঙ বর্ডার শেষ অতএব আসাম শেষ। এবার অরুনাচলের শুরু। গাড়ি ধীর গতিতে পাহাড়ে উঠতে থাকে। এখানকার রাস্তা যথেষ্ট প্রশস্ত, কিন্তু পাহাড়ের কাদা মাটি একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় এসে পলির মতো জমা হয়ে যায়। তখন গাড়ি চলাচলে খুবই অসুবিধা হয়। গাড়ি স্কিড করে যাওয়ার চান্স থাকে। খুব সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাতে হয়, নাহলে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। তখন আর্মি নেমে রাস্তা পরিষ্কার করে। এখন গাড়ি বমডিলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাজার, লোকালয় আছে এখানে। আর্মি ক্যান্টনমেন্ট আছে। শোনা যায় চীনা সেনা ১৯৬৫ র যুদ্ধের সময় এই এলাকায় চলে এসেছিল। বমডিলা সত্যিই ছবির মতো সুন্দর। পাহাড় প্রকৃতি এখানে সৌন্দর্যের অকৃপণ ডালি নিয়ে হাজির। বিস্তীর্ন দিগন্ত জুড়ে ভুবন ভোলানো রূপ আকাশে, পরিবেশে, দিগন্তে। গাছপালায় ফুলে। প্রকৃতির এই রূপাস্বাদান করতে করতে দিলবাগের গাড়ি এগিয়ে চলে।
এতটা রাস্তা এলেও এলাকার কোথাও চাষবাসের কোন চিহ্ন তেমন চোখে পড়ে নি। গাড়ি ধিরাঙ শহরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় কিন্তু অন্য দৃশ্য দেখা গেল। রাস্তা থেকে একটু দূরে কুমেঙ নদী বয়ে চলেছে। পাহাড়ি নদীর স্বচ্ছ জল এখানকার লোকজনের চাষবাসের একমাত্র সহায়। নদীর দুই তীরে ধান ও বিভিন্ন সব্জির শ্যামল শোভা নয়নাভিরাম দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। ছোট্ট ছোট্ট নুড়িপাথর নদীর জলের সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে চলে। অরুনাচলের এই অঞ্চল এখনকার শস্যভান্ডার। কুমেঙ নদী এই অঞ্চলকে শস্যশ্যামল করে রেখেছে। এই ধিরাঙ অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে শস্যের যোগান ও দেয়। এই অঞ্চল অরুনাচলের এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিনত হয়েছে। কুমেঙ নদীর রূপ দেখতে দেখতে দিলবাগ অরুনাচলের সবচেয়ে উঁচু শহর তাওয়াং পৌঁছে যায়।

তাওয়াং শহর চীন সীমান্তে অরুনাচলের উল্লেখযোগ্য শহর। এর মহানগরের সব বৈশিষ্ট্য থাকা সত্বেও বেশির ভাল বাসিন্দাই বুদ্ধিষ্ঠ। শান্ত, সুন্দর শহরের রাস্তার মাঝে মাঝেই রিলিজিয়াস হুইলস ও দীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা। প্রকৃতি এখানে খোলামেলা। সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির। সৌন্দর্য ভোগের সীমারেখা নেই। পর্যটক, স্থানীয় বাসিন্দা আকন্ঠ প্রকৃতির রূপসম্ভার ভোগ করতে পারেন। সুন্দরী নারী যেমন নিজেকে নিত্য নতুন পোষাকে সুসজ্জিত করে। প্রকৃতি এখানে প্রতি মরসুমে নতুন রূপে সজ্জিত হয়। এই শহরে অনেকগুলি বুদ্ধিষ্ঠ মনাস্টেরি আছে। তাদের মধ্যে বিখ্যাত আরগেলিং গুম্ফা। শোনা যায় এখানে ষষ্ঠ দলাই লামার জন্ম হয়েছিল। বৌদ্ধদের কাছে এই জায়গা খুবই পবিত্র। স্বল্প জনসংখ্যার এই শহরে পরিছন্নতাই মূল মন্ত্র।

তাওয়াং এর যে হোটেলে দিলবাগ উঠেছে সেটি এখানকার সবচেয়ে দামী লাক্সারি হোটেল। লোকেশনটা খুবই সুন্দর। তিনতলার এক প্রশস্ত রুমে বসে দিলবাগ কয়েক দিনের কর্মসূচি নিয়ে বসেছে। কি কি করতে হবে ঠিক করে নেয়। ডিলার ভিজিটের কাগজপত্র গুছিয়ে নেয়। আজ সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ব্রাশ করে রুমে থাকা ইলেকট্রিক কেটল দিয়ে জল গরম করে কফি বানিয়ে খেতে খেতে হোটেলের বিশাল কাচের জানালা দিয়ে সকালের ধীরে ধীরে ঘোমটা সরানো বধূর মতো প্রকৃতির মুখাবয়ব অবাক বিস্ময়ে দেখার স্মৃতি হ্যাংহোভারের মতো দিলবাগের মনিকোঠায় ঘোরাঘুরি করছে। ব্রেকফাস্ট করে দিলবাগ বেরিয়ে পড়ে। পর পর কয়েকটি ডিলার ভিজিট সেরে ফেলে। কয়েকজনের নতুন অ্যাপয়ন্টমেন্ট হয়, কিছুজনের ক্যাপাসিটি বাড়ানো হয়। কিছুক্ষেত্রে কোম্পানি প্রাইসের কম দামে বিক্রির জন্য ওয়ার্নিং ইস্যু করা হয়। ডিলারদের অন্যান্য সমস্যা সমাধান করে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। স্নান সেরে লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নেয়। তন্দ্রা এসে গেছিল। ঘুম ভাঙতে চোখ মেলে দেখে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। আর বেরুতে ইচ্ছে করছিল না। তা সত্বেও বেরিয়ে পড়ে। সরাসরি তাওয়াং এর ওয়ার মেমোরিয়ালে যায়। একের পর এক সিকিউরিটি বেষ্টনী পেরিয়ে মেমোরিয়ালের মেন হলে পৌঁছয়। ১৯৬২ র চীন ভারত যুদ্ধের বিভিন্ন সামগ্রী দেখতে দেখতে এগোয়। এবার আসে বিভিন্ন রেজিমেন্টের যুদ্ধে শহীদের নাভের তালিকা। গোর্খা রেজিমেন্ট, বিহার রেজিমেন্ট। এক একটা রেজিমেন্টের শহীদের তালিকা দীর্ঘ। পঁচিশ থেকে তিরিশ বা ততোধিক। কোন কোন রেজিমেন্টের অনেক সেনাই শহীদ। সেই নামের তালিকা দেখতে দেখতে দিলবাগের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বীরেদের কথা মনে করে, তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরন করে প্রচ্ছন্ন গর্ব ও অনুভব করে। অবশেষে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের তালিকার সামনে পৌঁছয় দিলবাগ। এই রেজিমেন্টের নিহতদের তালিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দিলবাগ। এক দুই........তিরিশ একত্রিশ......শেষতম ক্রমিক সংখ্যা একচল্লিশ। দিলবাগের চোখ থমকে যায়। নাম লেখা গুরচরন সিং। দাদুর নামের সামনে দাঁড়িয়ে নাতির চোখ ভারী হয়ে এল। নিজেকে সামলে ওয়ার মেমোরিয়াল থেকে বেরিয়ে হোটেলের রাস্তা ধরে।

পরদিন পুরোটা রেখে দিয়েছিল বেড়ানোর জন্য। সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ল দিলবাগ। পৌঁছে গেল কাহো গ্রামে। এই কাহো গ্রাম ভারত চীন সীমান্তের LAC অর্থাৎ লাইন অফ একচ্যুয়াল কন্ট্রোল বরাবর শেষ গ্রাম। এই সীমান্ত বরাবর ভারতের শেষ সেনা ছাউনি কিবিথু। এই কিবিথু ব্লকের সাতটি গ্রামের শেষতম গ্রাম হল কাহো। এই কাহো থেকে আট কিলোমিটার দূরে লাইন অফ একচ্যুয়াল কন্ট্রোল। ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধে ভারতীয় সেনা চীনা সেনাবাহিনীকে ওয়ালংয়ের যুদ্ধে তিন সপ্তাহ এই কিবিথুতে আটকে রেখেছিল। এর প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে ভারত চীন মায়ানমার তিন দেশের সীমান্ত দিফু পাস। এর নিকটবর্তী এয়ারস্ট্রিপ হল ওয়ালং। এই এলাকার লোহিত নদী কিবিথুকে আড়াআড়ি উত্তর দক্ষিণে ভাগ করেছে। দুই দিকে যাতায়াতের ভরসা একটি মাত্র ঝুলন্ত সেতু। এই শেষ গ্রাম কাহোর বাসিন্দারা বুদ্ধিষ্ঠ মেয়র জনজাতিভুক্ত। ২০১১ সালের জনগননা অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র পঁয়ষট্টি জন। এই জনসংখ্যা এখন বাড়তে বাড়তে দেড়শোতে পৌঁচেছে। দিলবাগ দেখে তার মোবাইলে কোন সিগন্যাল এখানে নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এখানে কোন হসপিটাল নেই। এমনকি কোন স্কুল ও নেই। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে এর উন্নয়নমূলক অনেককিছু প্রজেক্ট গ্রহন করা হয়েছে। আশা করা যায় আগামী দিনে এরা আমাদের মূলস্রোতে এসে মিশবে। এদের মধ্যে থাকতে, আকারে ইঙ্গিতে এদের কথা বুঝতে ভাল লাগে দিলবাগের। এদের সঙ্গে মিশে এখানকার খাবার দিয়ে এদের সঙ্গে বসে লাঞ্চ সারে। এই সরল সাধাসিধে গতিহীন জীবন দিলবাগের খুব পছন্দ হয়। মনে হয় এখানে আরও কিছুদিন কাটিয়ে যেতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু তা তো হবার নয়। কর্তব্যের তাড়না উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। অবশেষে এই সহজ সরল আদিম গ্রামের মায়া ত্যাগ করে দিলবাগ রওনা দেয় তাওয়াং এর উদ্দেশ্যে। তার আগে এই হতভাগা গরীব, নিঃস্ব লোকগুলোর জন্য আনা কিছু জামাকাপড়, খাবারদাবার, টুকিটাকি উপহার তাদের হাতে দেয় দিলবাগ। খুশি মনে তারা হাত পেতে এইসব জিনিস নেয় খুব আগ্রহ সহকারে। এই দেখে দিলবাগ তার আনন্দ আর ধরে রাখতে পারে না। চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে ওঠে।

গাড়িতে দীর্ঘ পথে দিলবাগ ফিরে যায় অতীত স্মৃতির গলি ধরে। ঘটনাটা বাবার কাছে শোনা। সময়টা ১৯৬২ সাল। ভারত চীন যুদ্ধ। চীনা সেনা প্রবল বিক্রমে এগিয়ে আসছে। কিবিথুর এই ভারতীয় সেনা ছাউনিতে তখন পোস্টিং দাদু গুরচরন সিং এর। তখন তিনি সেনা হাবিলদার। চারদিকে প্রচণ্ড ঠান্ডা। তার ওপর ঝিরঝিরে বৃষ্টি, সঙ্গে প্রবল তুষারপাত। এই অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রবলবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই লড়াইয়ে চিনাবাহিনী তিন সপ্তাহ এই অঞ্চলে আটকে থাকতে বাধ্য হয়। সৈন্য সংখ্যা ও সমরাস্ত্রের দিক থেকে এই যুদ্ধ ছিল এক অসম লড়াই। এই প্রতিকূল পরিবেশে অসম লড়াইয়ে ভারতীয় বাহিনীর অনেক বীর সেনানী শহীদ গতি প্রাপ্ত হন। একদিন দিলবাগের দাদু গুরচরন সিং পায়ে গুলির আঘাতে আহত হয়ে পড়েন। কাহো গ্রামের কয়েকজন গ্রামবাসী দেখতে পায় আহত গুরচরনকে। তারা গুরচরনকে নিজেদের কুটিরে নিয়ে যায়। সেখানে জড়িবটি দিয়ে গুরচরনের চিকিৎসা করে। তাকে খাওয়া ও পথ্য দেয়। নিজেরা পালা করে শুশ্রূষা করে। গুরচরন অনেকটা সুস্থ বোধ করে। পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরে গুরচরন নেই। ভোররাতে সে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছে ঐ অসুস্থ শরীর নিয়ে। তার আর ফেরা হয় নি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন I
আপনার উৎসাহ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। আপনি সত্যি সাহিত্য প্রেমী। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।

১৯ জুন - ২০২১ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.২৭

বিচারক স্কোরঃ ১.৮৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪