ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

সজল কুমার মাইতি
  • 0
  • ৫৭০
পূজো আসছে। দার্শনিক খুবই ব্যস্ত। নিয়মিত ইসু ছাড়াও পূজো সংখ্যার প্রচন্ড চাপ। সব ধরনের লেখা প্রাথমিকভাবে দেখে সিলেক্ট করা। প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো। সবই দার্শনিকের দায়িত্ব। দার্শনিক ' কালের দর্পণ ' পত্রিকার সম্পাদক। ' কালের দর্পণ ' পত্রিকা একটি জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা। এটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রবন্ধ, গল্প উপন্যাস, কবিতা ভ্রমণ, আর্ট নাটক কৃষ্টিমূলক সব রচনা ও খবরের এক অমূল্য ভান্ডার। সম্পাদক হিসেবে প্রাথমিকভাবে এই সবকিছু দেখার দায়িত্ব দার্শনিকের। বাংলা ভাষার এই পত্রিকা বাঙালি সমাজে খুবই জনপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গন্য হয়। পত্রিকা তার পলিশি অনুযায়ী নতুন ও পুরোন লেখক, কবি সাহিত্যিক সবাইকেই সুযোগ ও উৎসাহ দেয়। ফল ও হাতে নাতে পেয়েছে পত্রিকার স্বত্বাধিকারিরা। এই পত্রিকার দৌলতে বহু নবীন কবি সাহিত্যিক আজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাদের সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে। পাঠক ও নিত্য নতুন সাহিত্যের স্বাদ পাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাও ' কালের দর্পণ' এর কল্যাণে।
" হ্যালো, আমি 'কালের দর্পণ' থেকে দার্শনিক বলছি। নীলকান্তবাবু আছেন? " অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে " হ্যাঁ। ধরুন। দিচ্ছি।" দার্শনিক ফোন ধরে থাকে। খানেক পরে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নীলকান্ত গাঙ্গুলির কন্ঠস্বর ভেসে আসে " তলব কেন?"
" আপনার পূজোর লেখাটা এখনো পেলাম না। একটু তাড়াতাড়ি করলে ভাল হয়। এর পরে আরও কত কাজ। বোঝেনতো!"
" হ্যাঁ, হয়ে এসেছে। শিগগিরই দিয়ে দোব। এখন রাখছি। নমস্কার।"
" নমস্কার।" দার্শনিক ফোন রেখে দেয়। সহকর্মী কুশলকে নির্দেশ দেয় ইমেলে যে লেখাগুলো এসেছে সেগুলো আগে ডাউনলোড কর। বিভিন্ন ক্যাটিগরিতে আলাদা আলাদা ফোল্ডারে রাখ। পরে আমি দেখব।"
দার্শনিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ছাত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করা ছেলে। কলকাতার সবচেয়ে নামী কলেজের বরাবর প্রথম হওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্র। মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নিজের স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা। ইচ্ছে অনেক কিছু থাকা সত্বেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি। প্রচন্ড আর্থিক অনটন, তার ওপর অসুস্থ বাবা মা। মনের উচ্চাশাগুলো অঙ্কুর থেকে চারা গাছ হওয়ার প্রয়োজনীয় জল আলো জোগাড় করার সাহসই পায় নি। তাদের স্টীলবর্ন থেকে গেছে। ঠিক এই সময়ে 'কালের দর্পণ' এর বিজ্ঞাপন। তখনও গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা হয় নি। দার্শনিক একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে দেয়। এই সি ভি দেখে ইন্টারভিউতে না ডেকে পারা যায়? যা হওয়ার ছিল তাই হল। নির্দিষ্ট দিনে দার্শনিক 'কালের দর্পণ' এর ইন্টারভিউতে উপস্থিত হয়। ইন্টারভিউ বোর্ড নক্ষত্রে ভরা। সাহিত্য সংস্কৃতির দিকপালরা বোর্ড আলো করে বসে আছেন। সঙ্গে ' কালের দর্পণ ' এর স্বত্বাধিকারী। এই গ্যালাক্সীর মাঝে দুরু দুরু বুকে হাজির দার্শনিক। প্রাথমিক রুটিন প্রশ্নের পর সাহিত্য জগতের প্রখ্যাত বর্ষীয়ান ব্যক্তি দার্শনিককে একটি প্রশ্ন করেন।
" ধর, তোমাকে এই সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হোল। তুমি কোন্ বিষয়কে গুরুত্ব দেবে? পত্রিকার সামাজিক দায়িত্ব না বাণিজ্যিক স্বার্থকে?"
" এই প্রশ্নের সবচেয়ে নিরাপদ উত্তর হবে দুটিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া। অর্থাৎ সামাজিক দায়িত্ব ও বাণিজ্যিক স্বার্থ দুটিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু আমি তা বলব না। আমার স্পষ্ট উত্তর সম্পাদক হিসেবে আমি সামাজিক দায়িত্বকে অধিক গুরুত্ব দোব।"
পত্রিকার স্বত্বাধিকারী তখন প্রশ্ন করেন।
" পত্রিকার কর্মকর্তা কর্মচারিগণ প্রত্যেকের মাইনে ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা। পত্রিকার সরবরাহ ও বন্টনের কাজে বহু ব্যক্তি জড়িত থাকে। তাদের রুটি রুজি এই পত্রিকার বিক্রির ওপর নির্ভর করে। বাণিজ্যিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কি এই সবকিছু নিশ্চিত করা সম্ভব?"
" আমি মনে করি সামাজিক দায়িত্ব ও বাণিজ্যিক স্বার্থের মধ্যে কোন সংঘাত নেই। সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। এমনকি একে বর্ধিত করাও সম্ভব।"
" তা কিভাবে সম্ভব?"
" উন্নত মানের লেখা, নিরপেক্ষ মতামত প্রকাশ। যোগ্যতা ও মেধার উপযুক্ত সম্মান ও সুযোগদান। সমাজের বৃহত্তর অংশের মতামতের প্রতিফলন। দূর্বল ও বঞ্চিতদের কথা তুলে ধরার মাধ্যমে পত্রিকা তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। দলমতনির্বিশেষে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সৃজনশীল মানুষের আস্থা অর্জন এইভাবে করতে সক্ষম হবে এই পত্রিকা। সেই আস্থা এই পত্রিকার সুনাম অর্জনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এই সুনামই পাঠক সমাজে এর পরিচয় ও জনপ্রিয় করে তুলবে। যে পত্রিকা যোগ্যের সম্মান দেয়, দূর্বল অসহায়ের মনের কথা নিরপেক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরে; পাঠক সমাজই তার বিজ্ঞাপনের মাধ্যম। এক থেকে দুই, দুই থেকে বহুতে পৌঁছনোর কাজ পাঠককূলই করবে। যে পত্রিকার পাঠক সংখ্যা বেশি, যার জনপ্রিয়তা বেশি; তার বিক্রি বেশি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অধিক বিক্রয়ের ফল তো অধিক মুনাফা। শুধু তাই নয়। পাঠককূল যার বিজ্ঞাপনের মাধ্যম, তার তো বিজ্ঞাপনজনিত ব্যয় ও কম। ফলস্বরূপ মুনাফার আধিক্য। আর অধিক মুনাফা প্রশ্নের মধ্যে যে সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে তা সফলভাবে সমাধান করতে সক্ষম হবে। আশাকরি আমি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।"
দার্শনিকের এই দীর্ঘ উত্তর শুনে গুনীমন্ডলী কিছু সময়ের জন্য নির্বাক ও নিরুত্তর থাকেন। অবশেষে পিন ফেলা নীরবতা ভঙ্গ করে পত্রিকার স্বত্বাধিকারী বলে ওঠেন " আপনারা আর কেউ কোন প্রশ্ন করবেন?" সবাই সমস্বরে বলেন " না।" স্বত্বাধিকারী দার্শনিকের উদ্দেশ্যে বলেন " পরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয় দেওয়া হবে।"
নমস্কার জানিয়ে দার্শনিক বিদায় নেয়। হস্টেলে ফিরে আসে। বন্ধুদের প্রশ্নের মধ্যে পড়তে। " কেমন হল ইন্টারভিউ?"
" ওই একরকম।"
" কি বলল?"
" পরে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেবে।"
এর মধ্যে দার্শনিকের ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ ঘোষনা হয়ে গেছে। পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে দার্শনিক। দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন এসে যায়। হস্টেল লাইফে রাত জেগে পড়ার ওভ্যেস হয়ে গেছে। একে একে সব পরীক্ষা হয়ে যায়। আজ শেষ পরীক্ষা দিয়ে হস্টেলে পৌঁছে জামা কাপড় চেন্জ করছে, এমন সময় হস্টেলের ওয়ার্ড বয় এসে দার্শনিকের হাতে একটা সাদা খাম ধরায়। খামের ওপরে লেখা ' কালের দর্পণ'। খামটা খুলে দার্শনিক দেখে ' কালের দর্পণ ' এর সম্পাদক দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। পরদিন দার্শনিক ' কালের দর্পণ ' এর অফিসে যায়। সঙ্গে করে চিঠিটা নিতে ভোলে না। হাতের চিঠি দেখিয়ে সম্পাদকের চেম্বারে ঢোকে। দার্শনিককে দেখে 'কালের দর্পণ ' এর সম্পাদক বলে ওঠেন " বসুন"। সামনের চেয়ারে বসে দার্শনিক। সম্পাদক ভদ্রলোক টেবিলের ওপর রাখা স্লাইডিং বোর্ডে কিছু একটা রেখে পড়ছিলেন। সম্পাদক শশাঙ্ক ঘোষ বয়স্ক ব্যক্তি। বহুদিন এই প্রকাশন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষিত ভদ্র কর্মযোগী। শশাঙ্কবাবুর সিনসিয়ারিটি নিয়ে ওনার শত্রু ও কোন প্রশ্ন তুলবে না। সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে উনি একজন ভার্সেটাইল জিনিয়াস। সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের দিকপালরা শশাঙ্কদা বা শশাঙ্কবাবুর ওপর অগাধ আস্থা। সেই শশাঙ্কবাবুর সামনে বসে থাকতে দার্শনিকের অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। জড়তা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে। " আমায় দেখা করার কেন ডেকেছেন জানতে পারি?"
" ইন্টারভিউ বোর্ড আপনার উত্তরে যারপরনাই খুশি। আপনি ট্রেনি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। "
" আমাকে এখন কি করতে হবে?"
" আপনার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ?"
" হ্যাঁ।"
" কেমন হল পরীক্ষা? নিশ্চয়ই ভাল। এ তো বলার অপেক্ষা রাখে না।"
" হয়েছে মোটামুটি।"
" আপনার ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে এসে ' কালের দর্পণ ' এ ট্রেনি হিসেবে জয়েন করতে পারবেন।"
নমস্কার জানিয়ে দার্শনিক ' কালের দর্পণ ' এর অফিস থেকে বেরিয়ে হস্টেলে ফেরে। হস্টেলে বন্ধুদের মধ্যে এই সুখবর ছড়িয়ে পড়ে। একে একে সবাই কনগ্রাটস জানিয়ে যায়। ট্রিট দেওয়ার জোরাল দাবী ওঠে। আবার বন্ধুদের থেকেই কথা ওঠে " আগে তো জয়েন করুক। তারপর তো ট্রিটের প্রশ্ন উঠবে।" এরমধ্যেই হস্টেল কমিটি এসে প্রথাগত কথগুলি জানিয়ে যায়। ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে হস্টেল ছেড়ে দেওয়া এখানকার প্রথা। সেই প্রথামতো দার্শনিককে ও হস্টেল ছাড়তে হবে। অগত্যা চার বন্ধু মিলে বাসার খোঁজ লাগায়। কিছু দিন খোঁজার পর সোনারপুরে একটা রুম পাওয়া গেল। চার বন্ধু মিলে অ্যাডভান্স দিয়ে বুক করে এল। মেস করে থাকবে। একটা রুম। কমন বাথরুম। এক চিলতে রান্নার জায়গা। তাই সই। সামনের পয়লা তারিখ থেকে ওই রুমের ভাড়া শুরু হওয়ার চুক্তি। বন্ধুরা মিলে একদিন বাজার থেকে হাঁড়ি কড়াই নতুন সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বাকি সব সামগ্রী কিনে আনে। দার্শনিক এবার একবার দেশের বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হয়। কারণ এরপর বাড়ি যাওয়ার সময় পাওয়া মুস্কিল হবে। পরের দিন দার্শনিক দেশের বাড়ি রওনা দেয়।
অনেক দিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে মা বাবার আনন্দ আর ধরে না। অসুস্থ শরীর নিয়ে দুজনেই ছেলের যত্নের কোন ত্রুটি রাখেন না। আজ সকাল সকাল দার্শনিক পাড়ায় বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছে। পাড়ায় যেতে যেতে অনেক জনের সঙ্গে দেখা হল। প্রত্যেকে দার্শনিকের পড়াশোনার খবর নেয়। ভালো মন্দ খবর নেয়। কয়েকজন তো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গল্প করা ও খাবার খাইয়ে তবে ছাড়ে। দার্শনিক বরাবরই পড়াশোনায় ভাল। স্বভাবে শান্ত ও অমায়িক। সেই কারণে সে সবার খুবই প্রিয়। দার্শনিকের বাড়ি আসলে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের কাছ দিয়ে কুলু শব্দে বয়ে চলেছে এক নদী। এই নদীর পাড়ে জেলেদের বাস। তাদের সবারই সংসার চলা নির্ভর করে এই নদীর ওপর। ধারদেনা ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি নৌকো বানায়। যার সে ক্ষমতা ও নেই, সে নৌকো ভাড়ায় নেয়। সেই নৌকো নিয়ে পুরুষেরা সবাই সকাল সকাল নদীতে বেরিয়ে পড়ে। যদিও এই বেরিয়ে পড়াটা জোয়ার ভাঁটার ওপর নির্ভর করে। এদের অধিকাংশের চাষযোগ্য জমিজমা খুবই যৎসামান্য। আবার অনেকের সেই সৌভাগ্য ও নেই। সারাদিনের পরিশ্রমের ফল যা কিছু মাছ ধরা পড়ে তা বিক্রি করে আয় যা হয় তা দিনের উপার্জন। সেই উপার্জনের চলে পুরো সংসার। কোন কোন সময় কোটালে উপার্জন অনেক সময় বেশি হয়। তবে বেশিরভাগ সময় নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এই নিয়েই এরা দিনের পর দিন কাটিয়ে যায়। নিজেদের এই কষ্টের জন্য কারুর বিরুদ্ধে এদের কোন ক্ষোভ অভিযোগ নেই। এই ভবিতব্য মেনে নিয়েই চলে এরা। দার্শনিকের আড্ডায় একটা বড় সময় কেটেছে এদের মধ্যে। এবার ও সে এই পাড়ায় চলে এসে সবার সঙ্গে দেখা করে। গল্প করে সময় কাটায় এদের মধ্যে। এদেরই মধ্যে আধ পাগলা টাইপের একজন আছে। সবাই তাকে গান খুড়ো বলে ডাকে। গান খুড়োর সঙ্গে দার্শনিকের সম্পর্ক ভীষন মধুর। গান খুড়ো দার্শনিককে অত্যন্ত স্নেহ করেন। দার্শনিক ও মন খারাপ হলেই গান খুড়োর চলে আসে। গান খুড়োর কাছে গান শুনলে মনটা ভরে ওঠে। সব দুঃখ কষ্ট মুহূর্তে যেন উবে যায়। অনেক দিন পর আজ গান খুড়োর সঙ্গে দেখা। দার্শনিককে দেখে খুড়ো ও খুশি। ভাল মন্দ খবর নেওয়ার পালা শেষ হতে দার্শনিক আব্দার ধরে। " খুড়ো, অনেক দিন তোমার গলায় গান শোনা হয় নি। একটা গান শোনাও।" দার্শনিকের অনুরোধ খুড়ো ফেলতে পারে না। হলদি নদীর তীরে বসে উদাত্ত কন্ঠে ভাটিয়ালি সুরে খুড়ো গান ধরে। ওদিকে কুলুকুলু রবে নিজের মনে গাইতে গাইতে হলদি বয়ে চলে।
" ও নদী..ই..ই..ই রে ..এ...এ.....এ..
নাও ভাসাইয়া যাই।
তুমি মোদের..এ..এ...ঘর..বাড়ি
তুমি মোদের টাকাকড়ি
দুঃখ কোন নাই। নাই রে..এ.. এ
ধনীর আছে অনেক ধন
গাড়ি..ই..ই.. বাড়ি..ই..ই
মনে সুখ নাই। নাই...রে..এ..এ
ও নদী...ই..ই..ই রে..এ...এ...এ
নাও ভাসাইয়া যাই।"
খুড়োর গানে গায়ক শ্রোতা দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য বাস্তব থেকে হারিয়ে গেছিল। এক গাঙচিলের ডাকে সম্বিত ফেরে। গান খুড়ো এক রকম জোর করে তার কুঁড়েঘরে নিয়ে যায়। দার্শনিককে বলে " দাশুবাবা, আজ আমার এখানে একটু ভাতে ভাত খেয়ে যাও। তোমায় খাওয়াতে পারলে আমার এই কুঁড়েঘর ধন্য হবে। "
" খুড়ো, মা বাবা আমার জন্য বসে থাকবে। আমি তো দু এক দিনের মধ্যে কলকাতা চলে যাব। তোমার সঙ্গে একসাথে খেতে পারলে আমার ও তো খুব আনন্দ হবে। খুড়ো, মনে কিছু কোরো না। একদিন এই খুড়ো ভাইপো একসঙ্গে বসে তোমার এই কুঁড়েঘরে খাব।"
" তা ঠিক আছে। তা হবে খন। এখন তো বাড়ি থেকে কিছু না মুখে দিয়ে কি করে ছাড়ি? " এই গান খুড়ো একটা বাটিতে মুড়ি ছোলা নিয়ে এসে দার্শনিককে দেয়। দার্শনিক সেই ছোলা মুড়ি খুব যত্ন করে খায়। খেয়ে উঠেই দার্শনিক খুড়োর অনুমতি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
বাড়িতে যথারীতি মা বাবা অধীর আগ্রহে দার্শনিকের জন্য অপেক্ষা করছিল। স্নান খাওয়া করে বিশ্রাম করে। 'কালের দর্পণ ' এর কথা বাবা মার সঙ্গে শেয়ার করে। মা বাবা খুবই খুশী। মা তো কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে ওঠে " যাক, ঠাকুর মুখ তুলে তাকিয়েছেন। বাবু, কবে কাজে যোগ দিবি? "
" পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলেই।"
পরের দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর দার্শনিক বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হস্টেলে কিছু দিন কাটিয়ে বন্ধুরা মিলে সংসারের সব সরঞ্জাম নিয়ে সোনারপুরের মেসে যাত্রা করে। নতুন আর একটা অধ্যায় এই মেস লাইফের শুরু। প্রথম প্রথম বন্ধুরা পালা করে রান্না বান্না করে চালিয়ে নিচ্ছিল। পরে প্রত্যেকে কাছে বেরানোর জন্য সে কাজ সম্ভব হয়ে উঠছিলো না। এজন্য একজন কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করে। রান্না থালা বাসন ধোয়ার কাজ করে দেবে। সবাই মিলে কাজের মাসির মাইনে দিয়ে দেবে। এর মধ্যে দার্শনিক কয়েকটা প্রাইভেট টিউশন জোগাড় করতে পেরেছে। এতে মেস খরচ ও হাত খরচের একটা হিল্লে হয়েছে। সকাল সন্ধে দার্শনিক বেরোয় ছাত্র পড়ানোর জন্য। এইভাবে কয়েকটা মাস কেটে গেল। খুশির সেই দিন হাজির। আজ দার্শনিকের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। রেজাল্ট যা আশা করা গিয়েছিল তাই হয়েছে। প্রথম শ্রেনীতে প্রথম। কলেজ থেকে মার্কশীট কালেক্ট করে পরের দিনই দার্শনিক হাজির হয় 'কালের দর্পণ ' এর অফিসে। শশাঙ্কবাবুর সঙ্গে দেখা করে। শশাঙ্কবাবু দার্শনিককে আসতে দেখে হাসি মুখে বলেন " আসুন আসুন। আপনার রেজাল্ট পেয়ে গেছেন?"
" হ্যাঁ। গতকালই মার্কশীট হাতে পেলাম।"
" দিন। হাতে নিয়ে দেখি। চক্ষু সার্থক হোক। প্রথম শ্রেণি নিশ্চয়ই।"
" প্রথম শ্রেণিতে প্রথম।"
দার্শনিক তার মার্কশীট শশাঙ্কবাবুর হাতে দেয়। শশাঙ্কবাবু সেই মার্কশীট খুব যত্ন করে দেখেন।
" এ তো ঝকঝকে রেজাল্ট। দেখেও আনন্দ। এই নবীন, এটার একটা জেরক্স করে আন তো।"
নবীন নামের পিওন এসে শশাঙ্কবাবুর কাছ থেকে মার্কশীট নিয়ে যায়। একটু পরে জেরক্স করে এনে শশাঙ্কবাবুর হাতে দেয়। শশাঙ্কবাবু ইন্টারকমে নির্দেশ দেন " অরিন্দম, দার্শনিকবাবু এসেছেন। ওনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা রেডি কর। " দার্শনিকের উদ্দেশ্যে বলেন " একটু বসুন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা রেডি করছে। ততক্ষন এই ইস্যুটা একটু দেখুন।" শশাঙ্কবাবু ' কালের দর্পণ ' এর লেটেস্ট ইস্যুর একটি কপি দার্শনিকের হাতে তুলে দেন। দার্শনিক একমনে ' কালের দর্পণ ' পড়তে থাকে। এমন সময় নবীন পিওন এসে এক কাপ চা দার্শনিককে দিয়ে যায়। চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়া চলতে থাকে। এই সময়ে এক ভদ্রলোক একটি খাম এনে শশাঙ্কবাবুর হাতে দিয়ে যায়। শশাঙ্কবাবু খামটি নিয়ে দার্শনিককে বলেন " দার্শনিকবাবু, এই নিন আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার।" দার্শনিক খাম হাতে নিয়ে খুলে দেখে। এডিটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট। মাইনে ও কিছু শর্তের উল্লেখ।
" দার্শনিকবাবু, আপনার অন্য কোন অসুবিধে না থাকলে আপনি আজই জয়েন করতে পারেন। আসলে এতে আমার কিছু স্বার্থ আছে। বুঝতেই তো পারছেন কাজের প্রচন্ড চাপ। আপনাকে পেলে আমার খুব উপকার হয়।"
" এখন তো আমি বেকার। আমার তেমন কোন অসুবিধেও নেই। এখন এই কাজে জয়েন করতে আমার কোন সমস্যা নেই। আপনারা অ্যালাউ করলে আমি জয়েন করতে রাজি।"
" নবীন, অরিন্দমের কাছ থেকে জয়েনের কাগজপত্র নিয়ে আয় তো।" নবীন পিওনের উদ্দেশ্যে শশাঙ্কবাবুর নির্দেশ। একটু পরে নবীন কয়েকটি কাগজ এনে শশাঙ্কবাবুর হাতে দেয়। শশাঙ্কবাবু ওই কাগজগুলি দার্শনিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন " এই নিন। যেখানে যেখানে টিক দেওয়া আছে সেই জায়গায় সই করে দিন।" দার্শনিক সেইমত সই করে দেয়। সইসাবুদ শেষ হলে দার্শনিক কাগজগুলি শশাঙ্কবাবুর হাতে দেয়। সেই কাগজ থেকে একটি নিয়ে একটি খামে ভরে দার্শনিকের দিকে এগিয়ে ধরেন। " এটা আপনার জয়েনিং রিপোর্ট। রেখে দিন।" দার্শনিক খামটি নিয়ে নিজের সাইড ব্যাগে রাখে।
" আসুন। আপনার কাজের জায়গাটা দেখিয়ে দিই।" শশাঙ্কবাবু দার্শনিককে নিয়ে ভেতরের একটি ঘরে যান। সেখানে একটি কিউবিকলের মধ্যে ছিমছাম গোছানো একটি সুন্দর ছোট্টখাট্ট অফিস ঘর। সেটা দেখিয়ে শশাঙ্কবাবু দার্শনিককে বলেন " এই আপনার কাজের জায়গা। এই নিন আপনাকে একটু বুঝিয়ে দি কি করতে হবে। " এই বলে কয়েকটি প্যাকেট দার্শনিকের টেবিলের ওপর রাখেন। কাজ বুঝিয়ে দেন। " কিছু অসুবিধে হলে আমায় জিজ্ঞেস করে নেবেন।" এই বলে শশাঙ্কবাবু ফিরে এসে নিজের কাজে ডুব দেন।
দার্শনিকের জীবনে এ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। শশাঙ্কবাবু পুত্র স্নেহে দার্শনিকের সঙ্গে কথাবার্তা চালান। দার্শনিক ও পিতৃস্নেহে শশাঙ্কবাবুকে দেখে। প্রতিটি জিনিসের খুঁটিনাটি নিজে থেকে বুঝিয়ে দেন। কিভাবে এডিটিং করতে হবে তার প্রতিটি জিনিস বুঝিয়ে দেন। একজন এডিটরের দায়িত্ব কর্তব্য সবই বুঝিয়ে বলেন। বলেন " দার্শনিকবাবু, একটা সাহিত্য পত্রিকা সফলভাবে চলতে পারে কেবলমাত্র তার নীতি ও গুনমানের জন্য। "
" আমি আপনার পুত্র তূল্য। আমাকে দয়া করে আর বাবু বলবেন না। কেবল দার্শনিকই যথেষ্ট।"
" সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে যাবে। ও কিছু নয়।" দুজনেই কাজের মধ্যে ডুবে যায়। শশাঙ্কবাবু প্রথমদিন থেকে দার্শনিককে সত্যিই পুত্রস্নেহে ভালবেসে ফেলেছেন। যেন একটা অধিকারবোধ অনুভব করেন। যদিও আপনি আপনি করেন। কিন্তু কাজের দায়িত্বের কথা উঠলে প্রথমেই ওনার মনে দার্শনিকের মুখটা ভেসে ওঠে। দার্শনিকের সারল্য নাকি সততা নাকি স্পষ্টবাদিতা। নাকি তীক্ষ্ন বিশ্লেষণ ক্ষমতা নিজের মতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃঢ়তা। দার্শনিকের কোন গুন শশাঙ্কবাবুকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করে তা তিনি বুঝতে পারেন না। তবে এটা বোঝেন যে তার কাজের দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে তিনি নিশ্চিন্তে তা দার্শনিককে অর্পন করতে পারেন। এবং এও বিশ্বাস করেন দার্শনিক এই দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করবে। এই বিশ্বাস থেকে শশাঙ্কবাবু সব কাজ নিজেই দার্শনিককে শিখিয়ে বুঝিয়ে দেন।
শশাঙ্কবাবু নিজেই একজন দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। দারিদ্র্য তাকে ন্যায় নীতি আদর্শ থেকে কখনও সরাতে পারে নি। এই জন্য মাঝে মধ্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে মতান্তর হয়নি তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষকে শশাঙ্কবাবুর পথে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই সৎ নিষ্ঠবান কর্মবীর মানুষটির বিকল্প পাওয়া প্রায় দুর্লভ। এই অকৃতদার কাজ পাগল মানুষটির ওপর কর্তৃপক্ষ চোখ বন্ধ করে ভরসা করে। কাজ করতে করতে শশাঙ্কবাবু দার্শনিককে বলেন " বুঝলে দার্শনিক, কোয়ালিটির ব্যাপারে কখনও কম্প্রোমাইজ করবে না। আর নতুন মেধাকে উৎসাহ দেবে। তবেই তো নতুন নতুন প্রতিভার উন্মেষ ঘটবে।"
" স্যার, সে তো বোঝা গেল। কিন্তু প্রভাবশালীর চাপ বা রাজনৈতিক চাপ সেগুলোকে এড়িয়ে নিরপেক্ষ কাজ করা কিভাবে সম্ভব?"
" নিজের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হও না। নীতিতে স্থির থাকলে অনেক কিছু আপনা থেকে সরে যায়। বাস্তবিক জীবনে ট্যাক্ট এর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এর কোন ফর্মূলা নেই। পরিস্থিতি বুঝে অ্যাকশান নিতে হয়। তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলেকে তা বোঝানোর দরকার পড়ে না।"
দেখতে দেখতে কয়েকটি বছর কেটে যায়। শশাঙ্কবাবু দার্শনিক এর মধ্যে বোঝাপড়া আরও দৃঢ় হয়। সম্পর্কের মেলবন্ধন গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। একদিন সেই বিষাদের দিন এসে হাজির। শশাঙ্কবাবু আজ তার সুদীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর নেবেন। সারা অফিসে আজ বিষাদের ছায়া। নিকট আত্মীয় বিয়োগের পরিবেশ। সবার মধ্যে মনঃকষ্টের লক্ষণের পরিস্ফুরণ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। দার্শনিকের মনটা আজ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। অফিসের সবচেয়ে কাছের লোকের বিদায়ের দিন। মনের আর কি দোষ ! এইরকম পরিস্থিতিতে মন তো ভারাক্রান্ত হবেই। একটি ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে শশাঙ্কবাবুর ফেয়ারওয়েলের জন্য। এই অনুষ্ঠানে স্বত্বাধিকারী অদ্রিজিৎ সিদ্ধান্ত মশাই উপস্থিত আছেন। অনুষ্ঠানে প্রতি বক্তাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বক্তৃতা দিলেন। প্রতিজনের বক্তব্যে শশাঙ্কবাবুর প্রশংসা ও গুনকীর্তনেই ভরা। দার্শনিক বলতে উঠে গলা ধরে যায়। স্বর যেন আটকে যায়। অবিরল অশ্রুধারা চোখ থেকে ঝরতে থাকে। আর কিছু বলা হয় না। সবশেষে বলতে উঠে শশাঙ্কবাবুর মধ্যে কোন জড়তা বা ভারাক্রান্ত হওয়ার কোন ছাপই নেই। সাবলীল বক্তৃতায় শশাঙ্কবাবু প্রতিটি ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন। তাদের ভালবাসা ও সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সবার ঋণ শোধ করতে অপারগ হওয়ার জন্য ক্ষমা ও চেয়ে নেন। প্রত্যেকেই উপহারে ভরিয়ে দেন শশাঙ্কবাবুকে। দার্শনিক সব উপহার গুলি নিয়ে শশাঙ্কবাবুকে একটা গাড়ি করে তার বাসায় পৌঁছে দেয়। বলে " স্যার, এরপর কি করবেন? "
" দেশের বাড়ি চলে যাব।"
" দেশের বাড়িতে কে আছেন?"
" ভাইপোরা আছে। আর এক দিদি আছে।"
" এতদিন পর ওখানে থাকতে অসুবিধে হবে না?"
" না। তা হবে কেন? আমি তো মাঝে মধ্যে দেশের বাড়ি যেতাম। ভাইপোদের কাছেই থাকি। ওরা যথেষ্ট আদর যত্ন করে। আমার ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর ওরা আমাকেই ওরা পিতৃজ্ঞানে আদর যত্ন করে। কখনও নিজের বাড়ি নয় বলে মনে হয় না।"
" ঠিক আছে স্যার। যোগাযোগ রাখবেন। ভাল থাকবেন। আজ আসি।"
শশাঙ্কবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে দার্শনিক নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
শশাঙ্কবাবুর রিটায়ারমেন্টের পর দার্শনিকের ওপর দায়িত্ব পড়ে পত্রিকা সম্পাদনার। দার্শনিক শশাঙ্কবাবুর যোগ্য উত্তরাধিকারী। কাজ পাগল মানুষ। কোয়ালিটিতে কোনরকম কম্প্রোমাইজ নেই। নতুনত্বের পরম পূজারী। তা একদিন একটা গল্প পড়তে পড়তে দার্শনিক এক জায়গায় আটকে যায়। বারবার করে পড়ে। মনে মনে চমৎকৃৎ হয়। আরে বহুদিন পর এ রসের আস্বাদন। এ তো এক্কেবারে কালিদাস ঘরানা। ' মেঘদূতম' এর আধুনিক রূপান্তর। স্বামী স্ত্রীর মিলনের ইরোটিকা। মিলনের এই ভিভিড বর্ণনায় মনে শুধুই প্রেমের আবেদন হয় সেক্সের নয়। যক্ষের পত্নী মিলন স্মৃতির বর্ননা কালিদাসের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অন্যতম। এই লেখা সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গল্পের লেখক অজানা নতুন কোন ব্যক্তি। নাম দেখে দার্শনিকের চেনা বলে মনে হয় না। অগত্যা ফোন লাগায়। মোবাইলে অপর প্রান্তে " হ্যালো।"
" আপনি কি রমনীমোহন বাবু বলছেন?"
" হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন? "
" আমি ' কালের দর্পণ ' এর সম্পাদক দার্শনিক বলছি।"
" হ্যাঁ বলুন।"
" আপনার গল্পটা পড়ছিলাম। আপনার পরিচয় জানতে ইচ্ছে করছে। কি করেন?"
" আমি কলেজে পড়াই। " একটি দ্বিশতাধিক প্রাচীন নামী কলেজের নাম বলেন রমনীমোহন।
" আপনি কত দিন থেকে লিখছেন?"
" আমি সিনিয়র সিটিজেন হওয়ার পরই লেখা শুরু করি।"
" আগে কখন কোথাও লিখেছেন?"
" না। এর আগে রিসার্চ পেপার ছাড়া সাহিত্য বিষয়ক কোনকিছুই লিখি নি।"
" আপনি কি শুধুই গল্প লেখেন?"
" না না। আমি গল্প ছাড়া ও কবিতা ও প্রবন্ধ লিখি।"
" দেখুন আপনার লেখা গল্পটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। সামনের সংখ্যায় এটা প্রকাশিত হবে। পাঠক কূলের কেমন লাগে কে জানে? সেই পরীক্ষায় পাস করে গেলে আপনাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।"
" সে আপনার করুণা ও ভালবাসা। সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদ ও অপার কৃপা।"
" সে সব জানি না। তবে হ্যাঁ। আপনি একটা কাজ করুন। আপনার লেখা গল্প কবিতা যা কিছু আছে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। দেখি কি করা যায়।"
দার্শনিকের কর্মব্যস্ততা শুরু হয় অফিস আওয়ার শুরুর একঘন্টা আগে আর শেষ হয় অফিস শেষের দুঘন্টা পর। কোন কবি ফোন করে জানতে চান তার কবিতা এতদিন হল কেন প্রকাশিত হল না। বা কবে হবে? কোন লেখক তার লেখা গল্প উপন্যাসের ভবিষ্যত জানতে চেয়ে ফোন করেন। আবার কোন প্রবন্ধকার জানতে চান তার লেখাটা কবে বেরুবে? একের পর এক ফোনালাপ চলতে থাকে। তাছাড়া লেখাগুলো ও দেখতে হয়। কোন ইস্যুতে কোন কোন লেখা থাকবে তা ও ঠিক করতে হয়। রুটিন অফিস ম্যানেজমেন্ট তো আছেই। এই ব্যস্ততা সামলে নিজের জন্য সময় বের করা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। কাজের ব্যস্ততায় বেলাগাম অবস্থা হাজির হয় যখন কোন উত্তেজক ও আলোড়নকারী ইস্যু উপস্থিত হয়। সেই ইস্যু হাজির। পত্রিকা তো সমাজ দর্পণ। রাজনৈতিক কারণ হোক কিংবা সামাজিক কারণ অথবা ধর্মীয় কিংবা জাতিগত কারণ। সমাজ আলোড়িত যে বিষয়ে তার চর্চার দায়িত্ব বর্তায় সমাজ দর্পণ পত্রিকার ওপর। সেই দায়িত্ব পালনের কর্তব্যবোধ থেকে সম্পাদক দার্শনিক 'কালের দর্পণ ' এর কয়েকটি ইস্যুতে অত্যন্ত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। তা নিয়ে সাধারণ মানুষজনের জোরদার চর্চা চলছে। যদিও পত্রিকার পক্ষ থেকে একথা লেখা থাকে যে মতামত লেখকের নিজস্ব। পত্রিকা এর জন্য দায়ী নয়। তাই বলে কি দায়িত্ব এড়ানো যায় ! সাধারণ মানুষের ভাগ্য বিধাতারা তো রুষ্ট হবেনই। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন স্বত্বাধিকারী অদ্রিজিৎবাবুর ফোন আসে। " দার্শনিকবাবু, আমার সঙ্গে একটু দেখা করবেন? "
" এক্ষুণি?"
" সেরকম অসুবিধে না থাকলে আসতে পারেন।"
দার্শনিক নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে পাশের বিল্ডিং এ অদ্রিজিৎবাবুর অফিসে যায়। অদ্রিজিৎবাবু যেন দার্শনিকের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। দার্শনিক বসতেই শুরু করলেন " আচ্ছা দার্শনিকবাবু, আপনি মুখ বুজে কাজই করে যান। কখনও বিশ্রাম নেওয়া বা একটু বেড়িয়ে আসার কথা মনে আসে না? না মনে আসার কথা চিন্তা করার সময়ই নেই?"
" না না। তা কেন?"
" আমাদের তো কয়েকটি ভালো জায়গায় হলিডে হোম আছে। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি কয়েকটা দিন বেড়িয়ে আসুন।"
" তার আবার কি দরকার?"
" আপনি নিজের দেখার কথা নিজের খেয়াল না থাকতে পারে। কিন্তু আমি আমার দায়িত্ব এড়িয়ে যাই কি করে?"
বুদ্ধিমান দার্শনিকের অদ্রিজিৎবাবুর উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধে হয় না। জিজ্ঞেস করে " আচ্ছা, খোসলি করে বলুন তো ব্যাপারটা কি?" কিছুক্ষণ নীরব থেকে অদ্রিজিৎবাবু নীরবতা ভঙ্গ করেন। " আপনার মতো বুদ্ধিমান লোকের কাছে চেপে যাওয়ার কোন মানে হয় না। গত পরশু থানা থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।"
" আপনি গেছিলেন?"
" হ্যাঁ।"
" কি বলল?"
" তেমন কিছু বলে নি। তবে আমার মতো সেভেনটি প্লাস ব্যক্তিকে আট ঘন্টা বসিয়ে রাখল।"
" শুধু বসিয়ে রাখল? কিছু বলল না?"
" বলল - এমনি তো সরকার ব্যাতিব্যস্ত। তার উপর আপনারা সরকার বিরোধী লেখা ছাপিয়ে তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। রাজরোষ তো হবেই।"
" হুঁ বুঝেছি। "
" দেখুন দার্শনিকবাবু, আপনাকে আমি কখনও জোর করতে পারব না। আপনাকে কেবলমাত্র অনুরোধ করতে পারি। আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই আমার কাছে শিরোধার্য।"
" আপনার অনুরোধই আমার কাছে আদেশ। আপনার মতো একজন বয়ঃবৃদ্ধ ও শাসকের রোষানল থেকে রেয়াত পায়নি। অথচ দেখুন এই শাসক যখন বিরোধী তখন এই পত্রিকাই বিরোধীদের বক্তব্যকে সাধারণ মানুষের কাছে বারবার পৌঁছে দিয়েছে। তখনও রাজরোষ থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু কন্ঠ রুদ্ধ করেনি। আর আজ? এ যেন ' হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ'। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন।"
পরদিন থেকে ' কালের দর্পণ ' পত্রিকার সম্পাদক দার্শনিক অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে গেছেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dipok Kumar Bhadra সুন্দর লিখেছেন। ভোট দিলাম।
ভালো লাগেনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১
আপনাদের ভালোবাসা আমার পাথেয়। এবারে আপনার লেখা দেখলাম না। ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।
ভালো লাগেনি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্প এক মেধাবী দরিদ্র গ্রাম্য যুবকের কাহিনী। মূল্যবোধ ও সততার খাতিরে সে ভয়ডরহীন। সে কোনো কিছুর সঙ্গে এই বিষয়ে কম্প্রোমাইজ করতে অস্বীকার করে। নিজের দক্ষতা ও সততায় এক নামী দৈনিকের সম্পাদকের দায়িত্ব প্রাপ্ত ও হয়। প্রতিষ্ঠান বিরোধী সৎ খবর প্রকাশের মূল্য তাকে দিতে হয়। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ শাসক সরকারের রক্ত চক্ষুর ভয়ে ভীত হয়ে এই স্পষ্ট খজু সম্পাদককে ও বিতাড়িত করে। শাসকের ভয়ে সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। শাসকের হয়তো পরিবর্তন হয় কিন্তু এই পরিবেশের পরিবর্তন হয় না।

১৯ জুন - ২০২১ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪