লটারি নিয়ে গতকাল ঘটে যাওয়া এমন একটা ঘটনার পরও আমি যখন আড্ডার প্রয়োজনীয় রসদ 'চা এবং টা'-এর বিলটি পরিশোধ করলাম, তখন আমার বন্ধুরা পারস্পরিক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে শুরু করল। আমি তখন কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।
গতকালের ঘটনা বর্ণনার আগে আরেকটু পিছনে না গেলেই নয়। কারণ এটি ছিল এক অর্থে আমার উপর ছোটনের নেয়া মধুর প্রতিশোধ।
ছোটন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। আমাদের বন্ধুত্ব তখন স্কুলের গণ্ডী পার হয়ে কলেজ পর্যায়ে উপনীত, সময়টা তখন বিংশ শতাব্দীকে বিদায় জানানোর অপেক্ষায়। ময়মনসিংহ শহরের পন্ডিতপাড়া এলাকায় আগত নতুন ভাড়াটিয়ার কলেজ পড়ুয়া ছোট মেয়েটিকে প্রেমিক হৃদয়ের অধিকারী ছোটনের প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল। আর তার 'ভাল লাগা থেকে ভালবাসা' বাস্তবায়নের প্রজেক্টে আমি, কায়সার ও সজল ছিলাম নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। প্রজেক্টের কাজ সাফল্য জনক ভাবে শুরু করতে না করতেই ছোটন একদিন তার মাকে নিয়ে রীতিমতো বাধ্য হয়ে দিনাজপুর গেল। আমাদের বলে গেল, লাবণ্য'র দিকে খেয়াল রাখার জন্য।
এরই মধ্যে একদিন লাবণ্যদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন দেখলাম, বিয়েটি ছিল তারই বড় বোনের। আর ওই দিনই ছোটন এসে হাজির। তখন আমার মাথায় খেলল এক দুষ্ট বুদ্ধি, যার বাস্তবায়ন হল সকলের সম্মতিতেই। ছোটনকে বললাম, 'সরি বন্ধু, লাবণ্য'র বিয়েটা ঠেকাতে পারলাম না।'
- আমার মনটা ভেঙ্গে গেল রে দোস্ত ! লাবণ্যকে আমি আসলেই তাকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম। তবে এতে তোদেরও দায় কম নয়।
তাকে সবাই বোঝালাম, এখন হাহুতাশ করাটা বোকামি , বরং ভালোবাসার কথাটা তাকে জানানো উচিত - না হয় প্রেমটাই যে বৃথা যায়।
ছোটনকে এত সহজে প্ল্যানের আওতায় আনা যাবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি। বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটা ছিল রাতে, এলাকারই একটি কমিউনিটি সেন্টারে। আমাদের পরামর্শ মতো ভগ্নহৃদয় ছোটন সাহস করে কোন দিকে না তাকিয়েে সোজা চলে গেল কনের কাছে এবং শুরু করল আবত্তি,
"তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয় লেখা,
এইটুকু হোক সান্ত্বনা মোর, হোক বা না হোক দেখা,
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু . . . . . . ."
"ছোটন হচ্ছেটা কি?" - যখন সে পেছন থেকে লাবণ্য'র এ ডাক শুনলো এবং ঘোমটা-পরা বধূটিকে ঘোমটা নামানোর পর দেখল, তখন সে লজ্জায় এক দৌড়ে পালালো। পরে জেনেছিলাম, সে এমন সময়টাতেই কনের কাছে গিয়েছিল, যখন কনেপক্ষ বধুকে ঘোমটাবৃত করে সাজিয়ে বরপক্ষকে দেখানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। যাহোক, এতে ছোটন খুব ক্ষেপে গিয়েছিল, আমার সাথে চিরতরে সম্পর্ক ছেদ করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে হাতে-পায়ে ধরে কোনরকমে শান্ত করতে হয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, ছোটন ও লাবণ্য'র ভালোবাসার শুরুটা এখান থেকেই হয়েছিল।
শপিংয়ে যাওয়ার সময় ছোটনকে একদিন সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে রেড-ক্রিসেন্টের লটারির টিকেট বিক্রয় করতে দেখে সে আমার কাছ থেকে একরকম জোর করেই দশ টাকা নিয়ে একটি টিকেট কিনেছিল, যদিও তার কাছে টিকেট কেনার মত যথেষ্ট টাকা ছিল। টিকেট কিনে পকেটে রাখতে রাখতে সে বলল, "টিকেটটা তোরই জন্য কেনা, ভাগ্যটা তোর টেস্ট করে দেখি। 'যদি লাইগা যায়', তো পুরস্কার তোরই হবে, তবে আমাদেরকে কক্সবাজার থেকে ঘুরিয়ে আনতে হবে, - রাজি?"
- "তাই হবে", নির্লিপ্তভাবে এটি বলা ছাড়া আরও কিছু বলাটা আমি সমীচীন মনে করিনি।
পরশুদিন টেলিভিশনের খবরে শুনেছিলাম রেড-ক্রিসেন্টের লটারির ড্র অনুষ্ঠানের কথা, গতকাল দেখলাম আমার বন্ধুদের প্রায় সবাই বাসায় এসে হাজির। ছোটনের হাতে ছিল লটারির টিকেটটা আর সজলের হাতে ছিল লটারির ফলাফলের একটি ফটোকপি।টিকেটটা আমার হাতে দিয়ে ছোটন বলল, "বন্ধু, দশ লাখেরটা লাইগা গেছে, তবে কক্সবাজারের কথা কিন্তু ভুলিস না।" পরে সে ফলাফলের কপিটি নিয়ে দশ লাখ টাকা পুরস্কারপ্রাপ্ত টিকিটের যে নম্বরটি বলল, আমি দেখলাম, আমার হাতের টিকিটের নম্বরটাও একই। সে এমনভাবে বলল ও পুনরাবৃত্তি করল এবং অন্যরা এমনভাবে উল্লাস করলো যে, আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম দশ লাখ টাকা পুরস্কারপ্রাপ্ত টিকেট আমারটিই। তখন উপস্থিত সকলের উল্লাসের সাথে আমিও যোগ দিলাম।
বহুবিধ পরিকল্পনার পর তারা চলে গেল এবং যাবার সময় সজল তার বোনের টিকিটের নম্বর মিলানোর কথা বলে ফলাফলের কপিটিও নিয়ে গেল। আনন্দ এবং দুঃখের প্রচন্ডতার মাঝে মানুষ অগ্র-পশ্চাৎ ঠিকমতো ভাবতে পারে না, মূলত: পারা হয়ে ওঠে না। আমিও এ সংবাদে এতটাই উল্লসিত ছিলাম যে, পুরস্কার সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার মনে একটু সন্দেহেরও উদয়় হয়নি। এমনকি ছোটনরা চলে যাবার পর আমি টিকিটের নম্বরটি পুনরায় মিলানোরও প্রয়োজন বোধ করিনি। আর ছোটনের সাথে আমার যে সম্পর্ক, তার মাঝে 'অবিশ্বাস' নামক শব্দটির অবস্থান ছিল অনেক দূরে।
বন্ধুরা চলে যাবার পর আমি উল্লাস করতে করতে মা'কে লটারির সংবাদটি বলে জড়িয়ে ধরলাম। তখনকার উচ্ছ্বসিত কথাবার্তার মধ্যে মা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, "টিকেটের নম্বর ঠিকমত মিলানো হয়েছে তো, খোকা?" কিন্তু এ প্রশ্ন তখন আমার উচ্ছ্বাসের জোয়ারের সাথে ভেসে গেল। একটু পরে মায়ের কথামত আমি চাচার বাসায় ছুটলাম।
- "লটারি এক প্রকার জুয়া"- আমার পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ শুনেই এ কথাটি বললেন চাচার বাসার সর্বকালীন অতিথি, চাচীর ছোট বোন।
- জুয়া হোক আর যাই হোক, পেয়েছি এটাই বড় কথা।
- আমরা হলে এ পুরস্কার গ্রহণই করতাম না। কারণ জুয়ার অর্থ হারাম। হারাম অর্থ যেভাবে আসে, সেভাবেই যায়।
চাচা, চাচী এবং আমার সমবয়সী চাচাতো ভাই বোনেরাও জুয়ার বিভিন্ন নেগেটিভ দিক উল্লেখ করে তাকে সমর্থন করলো। শীতকালে ঠোঁট ফেটে গেলে মানুষ যেভাবে শীর্ণ হাসি দেয়, তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ জনিত হাসিটি অনেকটা সেরকমই মনে হলো। চাচা-চাচী আমাকে 'তুই' বলেই ডাকতেন। তবে সেদিন আমি নিজেকে 'তুই এবং তুমি'-এর মধ্যবর্তী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। আমার উচ্ছাসটা ছিল সেদিন বড্ড বেশি। তাই কথা বলছিলাম বেশ জোরে জোরেই। অবশ্য চাচা-চাচী এবং চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে আমার যে সম্পর্ক, তাতে সেখানে গিয়ে আমার উচ্ছাস এরকম হওয়ারই কথা। কিন্তু এতে বিরক্ত হয়ে এক সময় চাচী বলেই ফেললেন, "আস্তে কথা বল খোকা, বাড়িটাকে দেখছি বাজার বানিয়ে ফেলেছো। তোমার কথার ভলিউম শুনে রাস্তার লোকে ভাববে, এ বাড়িতে হয়তো ঝগড়া বেঁধেছে।" এহেন কথাবার্তার পরেও আমি কিন্তু আমার কথার ভলিউম ইচ্ছা করেও কমাতে পারলাম না।
এরপর গেলাম মামার বাসায়। অনিচ্ছুক নাচুনে নাচতে গেলে যেমন তাল-লয় ঠিক রাখতে পারে না, আমার দশ লাখ টাকা পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ সেখানেও এমন অবস্থারই সৃষ্টি হলো।
যাহোক, আমার মামার এখান থেকে সোজা চলে এলাম বাসায়। এসে দেখি ছোটন সজলসহ সকলেই মা'র সাথে মুখ কালো করে কি যেন আলাপ করছে। আমি পৌঁছার সাথে সাথেই সকলে একেবারে চুপ। "কী হয়েছে"- জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন, "ছোটনরা তো একটা অপরাধ করে ফেলেছে, এখন তোকে বলতেও ভয় পাচ্ছে।"
- "বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বলে ফেল, বলে ফেল,কে কখন কী করেছ?"
মা যখন আমাকে নানা সান্তনা বাণী শোনানোর পর ছোটনদের সাজানো ঘটনার বিস্তারিত বললেন, তখন আমি হাসবো না কাঁদবো, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একটু আগে যে বেলুন আকাশে উড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল, এখন তা যেন গ্যাসশূন্য হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল। ভাঙ্গা মনের অদৃশ্য ব্যথা আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। তাদের উদ্দেশ্যে কেবল বললাম, "আমাকে নিয়ে এ ধরনের জঘন্য মজা করাটা মোটেই ঠিক হয়নি।" তারা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে রইল।
এরপর সকলে চলে গেলে মা আমাকে অনেক বুঝালেন, "যা সহজে আসে, তা তেমনি ভাবেই যায়। কাজেই চেষ্টা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় হও।" আমি মায়ের হাঁটুতে মাথা রেখে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম, আর মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমার দশ লাখ টাকা পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদে চাচা ও মামার বাসার বদলে যাওয়া অবস্থার কথা একপর্যায়ে মাকে বললাম। বেশ দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা তখন বললেন, "তোমার আনন্দে আনন্দিত হবে, তোমার দুঃখে কে ব্যথিত হবে, তোমার বিপদে কে এগিয়ে আসবে, তোমার প্রতিষ্ঠায় কে সহায়ক হবে, সে সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান রাখা উচিত। কারণ, এখন তুমি আর সেই ছোট্ট খোকাটি নও। নিজের উপর ভরসা রেখো, নইলে পায়ের নিচে মাটি পাবে না।" এ কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে আমি মা'র দিকে তাকালাম। কারণ মা কখনো আমার সাথে এমন গম্ভীরভাবে কথা বলে না। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা-মা বলতে ছিল একজনই, আমার মা।
যাহোক, সেদিন দ্রুত ঘুমানোর সকল পদ্ধতি প্রয়োগ করেও আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। আমার মাথায় বিবিধ চিন্তা ভর করছিল। চাচা ও মামাদের বাসার ঘটনা সমূহের কথা মনে হতেই চিন্তার গতিটা শ্লথ হয়ে গেল, মা'র কথাগুলো বারবার কানে বাজতে লাগলো। আমার অনেক ভরসা বৃক্ষের তখন অপমৃত্যু ঘটল, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর পাপে আমাকে পাপী হতে হল। আগামী দিনের অনিশ্চিত যাত্রায় একাকিত্বের ভয় তখন আমাকে গ্রাস করল বটে, কিন্তু আমার ভাঙ্গা মন আত্মবিশ্বাসের ঔজ্জ্বল্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
ভাঙ্গা মনের কাহিনীকে উপজীব্য করেই আমার "মন সাগরের জোয়ার-ভাটা" গল্পটি রচিত। এখানে দু'টি মন ভাঙ্গার কাহিনী আছে।
মজা করার অভিপ্রায়ে এক বন্ধুর ভাল লাগার মানুষের বিয়ে হওয়ার গল্প বানিয়ে তার মন ভাঙ্গা হয়। মন ভাঙ্গার এ কাহিনী থেকেই পরবর্তীতে ঐ বন্ধুর প্রেমের সূচনা হয়।
লটারিতে দশ লাখ টাকা পুরস্কার প্রাপ্তির গল্প সাজিয়ে মজা করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা গল্পের প্রধান চরিত্র খোকারও মন ভাঙ্গে। তবে লটারিতে পুরস্কার প্রাপ্তির এ সাজানো ঘটনা তার আত্মবিশ্বাসের চোখ খোলে দেয়, কঠিন বাস্তবতাকে নতুন করে চিনতে শেখায়।
মন ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা মনের উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে এভাবেই "মন সাগরের জোয়ার-ভাটা" গল্পটি এগিয়েছে।
কাজেই গল্প-কবিতা'র "ভাঙ্গা মন" বিষয়টির সাথে এ গল্পটি সম্পূর্ণভাবেই প্রাসঙ্গিক।
১৬ জুলাই - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী