চাঁদনী

শিশু (সেপ্টেম্বর ২০১৯)

মোঃ আব্দুল মুক্তাদির
  • ১০২৪
একদিন নাহিদ এবং জিনিয়া নিজেদের মাঝে কথা বলছিল। নাহিদ জিনিয়াকে বলল---
-'আচ্ছা বলতো আমাদের বিয়ের কয় বছর হল?'
-'কেন! তুমি জাননা, নাকি মনে নাই?'
-'আমার তো মনে আছেই, ভাবছি তোমার মনে আছে কিনা?'
-'বুঝছি...তুমি কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছ আমাকে...'
-'তোমার কি ইচ্ছে করে না?...সাত বছর তো হয়ে গেল!'
-'উফফফ...তোমার সেই এক কথা... আমি শান্তিতে আছি সেটা তোমার সহ্য হচ্ছে না?'
-'তুমি সন্তানহীন মা হয়ে শান্তিতে আছো?!'
-'আমার এখন ওসব মা হওয়ার ইচ্ছা নাই। আমি আগে নিজের জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই। আমি এই পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে চাই।'
-'যারা সন্তান নিয়ে আছে তারা কি জীবন উপভোগ করছে না?'
-'দেখো নাহিদ, তুমি জাননা সন্তান মানুষ করার ঝামেলা কত? সে একটা বোরিং জীবন...'
-'তুমি মনে হয় খুব জান? তোমার তো কোন সন্তানই নাই...'
-'সন্তান না থাকলেও আমি জানি সন্তান মানুষ করার ঝামেলা কত? আরে আমার বাবার বাড়িতে আমার ভাইয়া আর আপাদের মিলে আমি পাঁচটা শিশুকে মানুষ করা দেখেছি। ওসব দেখে দেখে আমার শিশুর উপর থেকে আগ্রহ উঠে গেছে। বিয়ের আগে আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন একটা না একটা শিশুর কান্না আর তার সাথে তাদের মায়ের চিৎকারে আমার ঘুম ভাঙতো! আমি জানি একটা শিশুর পেছনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবিরাম খাটুনি করতে হয়। সেসব তোমাকে আর বিস্তারিত নাইবা বললাম। তাছাড়াও আছে স্বামীর আব্দার পূরণ করা। আমার আপা আর ভাবীদের জন্য আমার কষ্ট হয়। মেয়েরা কি মানুষ না কাজের শ্রমিক?, আমি বুঝিনা!...'
-'তাই বলে তুমি সন্তান নেবেনা?!'
-'নেব...'
-'কবে?'
-'যখন সময় হবে।'
-'কখন সময় হবে?'
-'জানি না।'

নাহিদ আর জিনিয়ার বিয়ের সাত বছর হয়ে গেছে। পারিবারিক 'অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ' তাদের। তাদের সংসারটা মোটামুটি সুখের। কিন্তু জিনিয়ার সন্তান নেবার জন্য কোন আগ্রহ নাই। এটা নিয়ে নাহিদ আর জিনিয়ার বাবা-মা অনেক বুঝিয়েছে জিনিয়াকে। কিন্তু জিনিয়ার সেই এক কথা। আগে জীবনটাকে উপভোগ করবে তারপর সন্তানের কথা ভাববে। নাহিদ জিনিয়াকে অনেক ভালবাসে। সে জিনিয়ার উপর জোর করতে চায়না। নাহিদের ধারণা জিনিয়া নিজেই একসময় একটা শিশুর মা হতে চাইবে। নাহিদ সেই দিনটা দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

দুই মাস কেটে গেল। আজকে নাহিদ আর জিনিয়া "উৎসব" নামের একটা বিনোদন কেন্দ্রে বেড়াতে এসেছে। জায়গাটা দেখে খুব পছন্দ হল জিনিয়ার। এটা বিনোদন কেন্দ্র এবং পিকনিক স্পট। জিনিয়া বরাবরই বেড়াতে খুব ভালবাসে। এখানে আসার পরে সে নাহিদের হাত ধরে ঘুরতে লাগলো। নাহিদ একটু লাজুক স্বভাবের।
সে জিনিয়াকে বলল, 'এত লোকের সামনে হাত ধরো না তো...লজ্জা লাগে।'
জিনিয়া বলল, 'আমার স্বামীর হাত আমি ধরেছি কে কি বলবে?' ---বলেই হাসতে লাগলো।
তারা ঘুরতে ঘুরতে পিকনিক স্পটের শেষ মাথায় পৌঁছে গেল। এমন সময় একটা ছোট্ট মেয়ের কান্না শুনতে পেল তারা। মেয়েটা দৌড়ে এসে 'মা...মা...মা...' বলে জিনিয়াকে পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
মেয়েটা কাঁদছে আর বলছে, 'মা আমাকে কোলে নাও, আমাকে কুকুর কামড়ে দিবে!...'
নাহিদ অবাক হয়ে জিনিয়া আর মেয়েটার কাণ্ড দেখতে লাগলো। আনুমানিক তিন বছর বয়স হবে মেয়েটার। মেয়েটার কান্নার চোটে জিনিয়া মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। ছোট মেয়েটা এবার কিছুক্ষণের জন্য জিনিয়ার ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগলো।
একটু পরে সে বলতে লাগলো, 'মা, আমি তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। আমি আর দুষ্টুমি করবো না।'
নাহিদ বুঝতে পারলো ছোট্ট এই শিশুটা নিশ্চয় তার বাবা মাকে হারিয়ে ফেলেছে। জিনিয়াকে পেছন থেকে তার নিজের মা মনে করেছে। একটু পরেই মেয়েটা চোখ খুলে জিনিয়াকে দেখল এবং তার ভুল ভেঙে গেল। সে আবার কান্না শুরু করে দিল। বললো, 'আমি মার কাছে যাব, মার কাছে যাব।'
নাহিদ জিনিয়ার কাছে গিয়ে মেয়েটাকে বলল, 'তুমি কান্না করোনা মা, আমি তোমাকে তোমার মার কাছে নিয়ে যাব।'
জিনিয়া নাহিদকে বলল, 'এই মেয়েটাকে নিয়ে এখন কোথায় যাব আমরা?'
নাহিদ বলল, 'আমরা এত বড় একটা পিকনিক স্পটে কোথায় এর বাবা মাকে খুঁজব? তারচেয়ে একে "উৎসব" এর অফিসে নিয়ে যাওয়া হোক। ওরাই এর বাবা মাকে খুঁজে বের করতে পারবে। খুঁজে বের করতে না পারলেও ওরা একটা বুদ্ধি বের করতে পারবে। বাবা মা নিশ্চয় মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করছে।'
জিনিয়া বলল, 'তাই করো, মেয়েটা খুব কাঁদছে...'
নাহিদ একটা রাইড এর টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বলল, 'আপনাদের অফিস কোনদিকে একটু বলবেন কি? দরকার ছিল...'
কাউন্টারের লোকটা বলল, 'কেন আপনার কোন সমস্যা হয়েছে?!'
নাহিদ বলল, 'আমার স্ত্রীর কাছে একটা বাচ্চা মেয়ে এসেছে। মনে হয়ে এখানে বেড়াতে আসা কোন বাবা মার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। আমার স্ত্রীকে ভুল করে নিজের মা মনে করেছে।'
লোকটা বলল, 'ঠিক আছে আমার সাথে চলেন। আমাদের অফিসের মাইক থেকে একটা বাচ্চা প্রাপ্তির ঘোষণা দিতে হবে।'
এরপর কাউন্টারের লোকটা অন্য একটা ছেলেকে টিকেটের দায়িত্ব দিয়ে নাহিদ আর জিনিয়াকে সাথে নিয়ে উৎসবের অফিসের দিকে আসতে লাগলো। অফিসের কাছে আসতেই অফিসের মাইক থেকে অন্য একটা ঘোষণা শোনা গেল---

"একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি শুনুন একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি শুনুন!। আজকে উৎসবে বেড়াতে এসে বাবা মার কাছ থেকে একটা তিন বছর বয়সী মেয়েশিশু হারিয়ে গেছে। মেয়েটার নাম চাঁদনী। মেয়েটার পড়নে আছে গোলাপি রঙের ফ্রক। যদি কোন অতিথি মেয়েটিকে পেয়ে থাকেন দয়া করে আমাদের অফিসে দিয়ে যাবেন। আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি..."

ঘোষণা শেষ হলে নাহিদ মেয়েটাকে বলল, 'মা তোমার নাম চাঁদনী?!'
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'হ্যাঁ...'
নাহিদরা অফিসে পৌঁছে গেল। জিনিয়ার কোলে চাঁদনীকে দেখা মাত্র চাঁদনীর মা দৌড়ে জিনিয়ার কাছে এল। চাঁদনী মাকে দেখা মাত্র মার কোলে উঠে গেল। চাঁদনীর মা মেয়েকে কোলে জড়িয়ে নিলেন।
নাহিদ মেয়েটার বাবাকে বলল, 'আপনাদের মেয়েটা আমার স্ত্রীকে ভুল করে পেছন থেকে মা ভেবে কোলে উঠে পড়েছিল। আমরা বুঝতে পারলাম মেয়েটা হারিয়েছে। সেখান থেকে আমরা অফিসের দিকে আসছিলাম মেয়েটাকে দেব বলে। আসার পথে অফিসের ঘোষণা শুনে নিশ্চিত হলাম আপনারা এখানে আগেই এসেছেন।'
লোকটা বলল, 'আর বলবেন না ভাই। আমরা মেয়েটাকে এক ঘণ্টা ধরে খুঁজে না পেয়ে শেষে এই অফিসে এসে ঘোষণা দিলাম। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ ভাই।'
নাহিদ বলল, 'তাতো বুঝলাম। কিন্তু আপনাদের মেয়ে হারিয়েছিল কিভাবে?'
লোকটা বলল, 'আমি টয়লেটে গিয়েছিলাম। চাঁদনীর মাকে বললাম মেয়েকে দেখতে। টয়লেট থেকে বের হয়ে দেখি চাঁদনী নাই।'
আমাদের কথা শুনতে পেয়ে চাঁদনীর মা কাছে এলো। বলল, 'আরে, আমি অনেকদিন পরে একটা চেনা লোকের দেখা পেয়েছিলাম। তার সাথে কথা বলছিলাম। কথা শেষ হলে দেখি চাঁদনী আমার পাশে নাই!'
চাঁদনীর বাবা এবার চাঁদনীকে বলল, 'চাঁদনী, তুমি মায়ের কাছ থেকে কোথায় গিয়েছিলে?'
চাঁদনী কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যা বলল তাতে বোঝা গেল, তার বাবা যখন টয়লেটে ঢোকে তখন মার সাথে লুকোচুরি খেলার জন্য একটা গাছের ধারে লুকিয়ে পড়েছিল। একটু পরে দেখে তার পিছনে একটা কুকুর। চাঁদনী কুকুরকে ভয় পায়। সে দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়। তার মা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে এসে কাউকে পায়নি।
চাঁদনীর বাবা বলল, 'আমরা মেয়েকে খোঁজার জন্য সেখান থেকে চলে আসি। মনে হয় সে সময় চাঁদনী এসে আমাদের দেখতে না পেয়ে, তার মাকে খুঁজতে খুঁজতে আপনাদের কাছে গিয়েছিল।'
নাহিদ বলল, 'এটাই হবে। যাহোক ভাই... আপনারা আপনাদের মেয়েকে পেয়েছেন, আমরা এখন আসি ভাই।'
চাঁদনীর বাবা বলল, 'এখনই যাবেন? চলেন একটু মিষ্টিমুখ করাই আপনাদের...'
নাহিদ বলল, 'আরে ভাই, আপনার মেয়ে তো আমার মেয়ের মতই। তাকে খুঁজে দিয়েছি এই জন্য মিষ্টিমুখ করাতে হবে কেন! আমরা আজকে আসি ভাই...'
নাহিদ আর জিনিয়া অফিস থেকে বের হয়ে এল। জিনিয়া নাহিদকে বলল---
-'চল আমার বাড়ি ফিরি...'
-'কেন?'
-'আর ভাল লাগছে না...'
-'তোমার শরীর খারাপ?'
-'না'
-'ঠিক আছে... তুমি যখন যেতে চাইছ চল...'

নাহিদ আর জিনিয়া বাড়ি ফিরল। সেদিন রাতে নাহিদ জিনিয়াকে বলল---
-'মেয়েটা খুব সুন্দর তাইনা...'
-'কোন মেয়ে!, চাঁদনীর মায়ের কথা বলছ? আমি তো বুঝছি... ঐ মেয়েটাকে তোমার মনে ধরেছে!। আমি তখন খেয়াল করলাম এত মেয়ের মাঝে তুমি ঐ চুল কালার করা মেয়েটাকে দেখছ ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থেকে।'
-'আরে ধুর... আমি কেন তাকে দেখতে যাব? আমি বলছি চাঁদনীর কথা...'
-'হ্যাঁ নাহিদ, মেয়েটা খুব লক্ষীমতন। আমার কোলে মাথা দিয়েছিল আর কি সুন্দর করে মা মা করছিল!...'
-'তোমার বিরক্ত লাগেনি? তুমি তো এসব পছন্দ করো না?'
-'না নাহিদ। সে সময় মনে হয়েছে, আমি বুঝি সত্যি চাঁদনীর মা! আর মেয়েটা আমার কোলে পরম সুখে আর খুব নিরাপদে আছে।'
-'থাক, অন্যের জিনিস নিয়ে আর ঢং করো না...'
-'মানে?!'
-'এমন সুন্দর একটা শিশু তো আমাদেরও থাকতে পারতো...'
-'নাহিদ, তুমি আমার উপর রাগ করে আছো তাই না?'
-'জানি না...'
-'আর রাগ করে থাকতে হবে না। আমি আমার আসল সম্পদ কোনটা বুঝে গেছি...'
-'তাই!!'
-'হ্যাঁ...চাঁদনীর মা যখন চাঁদনীকে কোলে নিয়ে আদর করছিল, আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল ইসস...আমার যদি একটা চাঁদনী থাকতো!...'
-'বাপরে!... আজ এসব কি শুনছি! আমি কি ঠিক শুনছি?'
-'হ্যাঁ... আমিও চাঁদনীর মত একটা শিশুর মা হতে চাই...'
-'আমি জানতাম জিনিয়া, তোমার মাঝে পরিবর্তন আসবেই...'
-'তাই নাকি?'
-'হ্যাঁ। কারণ প্রত্যেক মেয়ে চায় তার একটা শিশু সন্তান জন্ম নেবে যাকে সে আদর করবে। নতুন জন্ম নেয়া একটা শিশু মায়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদ...'

(সমাপ্ত)
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুল হুসাইন ভালো লাগা রইলো প্রিয় লেখক।অনেকটা প্যাকেজ নাটকের মত মনে হল।শুধু দৃশ্য গুলো দিলেই হয়ে যেত।শুভকামনা।আমার গল্প পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
রঙ পেন্সিল ভাল লিখেছেন। শুভকামনা।
ভালো লাগেনি ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

চাঁদনী নামের তিন বছর বয়সী একটি শিশু এই গল্পের সঞ্জীবনী চরিত্র।

১১ জুন - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী