রোদন দিনের আলোয়

বাবারা এমনই হয় (জুন ২০১৯)

Ahad Adnan
  • ৭১৫
‘কবর’ কবিতাটা কখনোই পুরোটা শেষ করতে পারেন না রেজা সাহেব। বিশেষ করে ‘গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ’ লাইনটা আসলেই আমরা আর চোখের জল আটকে রাখতে পারি না। কান্নায় ভেঙে পড়ে এই বৃদ্ধাশ্রমের অধিবাসীরা। রেজা সাহেব ধীরে ধীরে বের হয়ে যান। পিছন থেকে দেখি, শক্ত লোকটা পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছছে।
আমার একমাত্র ছেলেটা কানাডায় একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। স্ত্রী নেই বছর পাঁচেক। ইচ্ছে করেই আসা এই নিবাসে। সবাই কি ইচ্ছে করে আসে এখানে? একেকজনের গল্প শুনি। কান্নায় চোখ ভিজে আসে প্রতিবার। এত কান্না আমাদের কেন যে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা?
কিন্তু রেজা সাহেবকে সামনে থেকে কাঁদতে দেখিনি কোনদিন। শক্তমত লোক, ষাট একষট্টি হবে হয় তো। ভোরে উঠে দিব্যি একঘণ্টা হেঁটে, বাগানে গাছগুলোর পরিচর্যা করে দৈনিক পত্রিকা আর চা হাতে নিয়ে দিব্যি মাতিয়ে তুলেন। ‘কি আজিজ ভাই, বলছিলাম না অস্ট্রেলিয়া আসবে। না আইসা যাবে কই। দেখছেন কি অবস্থা ঢাকার। বৃষ্টির পানি জমে সাগর হয়ে গেছে। এজন্যই তো ঢাকা ছাড়লাম ভাই’।
এজন্যই কি ঢাকা ছেড়েছেন তিনি? কেন ছেড়েছেন বাসা? এখানে সবার একটা করে গল্প আছে। রেজা সাহেবেরও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কেও জানে না। জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ উঠে যান। কঠিন অথচ মিষ্টি মানুষটির ভিতরে না জানি কোন ঝড় বইছে?
আমাদের এখানে কয়েকজন আছেন যাদের অশীতিপর বলা যায়। একজন আছেন মকবুল চাচা। পক্ষাঘাতের রোগী। কথা বলতে পারেন না। আরেকজন রওফ চাচা। পাঁচবেলা নামাজ পড়তে বের হন লাঠিতে ঠুকঠুক করে। কারও সাথে কথা বলেন না প্রায় নব্বই বছরের এই প্রবীণ। আমি, আমরাও কম বয়স্ক না। কিন্তু তিনি আমাদেরও মুরুব্বি।
একদিন পর ঈদ, ঈদুল আজহা। সেই ঈদের রেশ লেগেছে আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে। খুব মনে পড়ছে পুরনো দিনের কথা। ঘুম আসছে না। রাত তিনটা বাজে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বাগানের কাছে আসি। একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ক্ষীণ কিন্তু খুব স্পষ্ট। আমি রেজা সাহেবের কাঁধে হাত রাখি। চমকে উঠেন তিনি। তারচেয়েও বেশি চমকে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন কঠিন মানুষটা।
‘কি হয়েছে, রেজা ভাই’?
‘আমি পাপী, ভীষণ পাপী আজিজ ভাই। কাল আপনারা সবাই ঈদের নামাজ পড়বেন। আর আমি কি করব বলেন তো’?
‘কেন, আপনিও যাবেন আমার সাথে’।
‘আমি গেলে আপনারাও আমার মত অপবিত্র হয়ে যাবেন। ছোটবেলায় বাবা হাত ধরে নিয়ে যেতেন ঈদের নামাজে। কুরবানি ঈদে একসাথে যেতাম হাটে। একসময় শহরে আসলাম। অনেক বড় হয়ে গেলাম সময়ের সাথে। এত বড় যে, যেই মাটি থেকে জন্ম সেই মাটি আমার চোখে পড়ত না। বিয়ে হল, সংসার হল, বাবা হলাম। একসময় মা চলে গেল ওপারে। বাবা হতে লাগল দূরের মানুষ। এত দূরের যে, একদিন দেখি বাবা অচেনা হয়ে গেছেন। আমার বাবা একদিন আমার সংসার ছেড়ে চলে যান। কোথায় গেলেন, সেটাও জানতে চাই নি আমি। ত্রিশ বছর, পাকা ত্রিশ বছর আজিজ ভাই। একদিন ঠিকই বুঝতে পারলাম পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে। বাবা কোথায়, অনেক চেষ্টার পর খুঁজেও পাই। কিন্তু ক্ষমা আর পাই না আজিজ ভাই। অনেক কষ্ট, অনেক পাপ জমে জমে বুকটা ভারি হয়ে আসছে। এত পাপ আমি কোথায় রাখব, জানেন’?
আজ ঈদ। কিন্তু আমাদের কোন খুশি নেই। আমাদের প্রিয় রেজা সাহেব বিছানায় পড়ে গেছেন। মাথা ঘুরে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। বৃদ্ধাশ্রমের সুপার রক্তচাপ মেপে আঁতকে উঠেছে। এত রক্তচাপও মানুষের হয়। না জানি কতদিনের দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, কষ্ট মুখের হাসি দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল লোকটা। আমরা এ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করছি। ঈদের দিন, তাই দেরি হচ্ছে। হঠাৎ একটা ঠুকঠুক শব্দ। আমরা অবাক তাকিয়ে দেখি রওফ চাচা। যে মানুষটা কোনদিন কারও সাথে কথা বলে নি, তিনি কী করেন এখানে?
‘বাজান, আমার বাজান, চোখ খুল। জীবনে কোনদিন আমার কথা শুনলি না, আজ শোন বাপ আমার। দেখ, সকাল হইছে। ঈদের নামাজে যাবি না? তোর আম্মা খোয়াবে আসে। আমারে বকে। পোলাটা তোমার কাছে পইড়া আছে ওরে ডাকো না কেন, বুকে তুইলা নাও না কেন। আমারে মাফ কইরা দে বাজান। বুকটা জড়াইয়া ধর বাপ’।
বৃদ্ধ পিতার একেক ফোঁটা চোখের জল পড়ে পুত্রের কপালে। সেই জলে পাপ ধুয়ে আবার নিষ্পাপ হয়ে উঠে সন্তান।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সুপ্রিয় ঘোষাল বা বেশ ভালো লাগল। তবে আরেকটু বিস্তৃত করলে আরো ভালো লাগত। দারুন প্লট।
মাহিন ইকবাল অনেক ভালো হয়েছে ভাই। শুভ কামনা। ভোট রইলো।
রঙ পেন্সিল মন খারাপ হয়ে গেলো। চমৎকার উপস্থাপনা। অনেক অনেক শুভকামনা রইলো

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বাবা ছেলের মধ্যে সম্বন্ধ, দূরত্ব, ফিরে আসা, অভিমান, অনুতাপ, টানাপোড়েন নিয়েই এই গল্প। শেষ দিকে এসে মনে প্রশ্ন আসবে এ কেমন বাবা? উত্তরও পেয়ে যাবেন, বাবারা বোধহয় এমনই হয়।

২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৪১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী