রোদের ক্যানভাসে আঁকা ঝড়

ঝড় (এপ্রিল ২০১৯)

রঙ পেন্সিল
  • ৯৩৩
গরমের দিন। আকাশ মেঘলা বলেই হয়তো বিকেলটা ভারী সুন্দর। ভেজা ভেজা নরম আলোতে মাখামাখি চারদিক। শেষ বিকেলের এই ঘোলাটে মেঘের ছায়া গায়ে মেখে লীনা, লীনার মা সুমনা আর বাবা জাভেদ হোসেন হাসিমুখে পাশাপাশি হাটছেন। লীনা আড়চোখে একবার মা'র দিকে তাকিয়ে দেখে। কি সুন্দর নিষ্পাপ হাসি! লীনার মায়ের এই রঙিন প্রজাপতির মত উচ্ছলতা লীনার খুব ভালো লাগে। ও মনে মনে ভাবে আচ্ছা মা কি জানেন এই গোলাপী রঙা জামদানীতে আজ তাকে কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে! ঠিক যেন একটা প্রষ্ফুটিত ক্যামেলিয়া ।

আকাশের গুরুগম্ভীর ডাকে হঠাৎ লীনা চমকে ওঠে। মিহিদানার মত বৃষ্টি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে মানুষের ছোটাছুটি দেখে লীনার মা খিলখিল করে হেসে ওঠেন। কিন্তু লীনা ওর মা'র সাথে হাসিতে যোগ দিতে পারেনা। কালি গোলা অন্ধকার আকাশের বুকে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে ওর ভয় ভয় করতে থাকে। ঝড় উঠবে নাকি?
হঠাৎ শুরু হওয়া দমকা হাওয়ার ফাঁকে আটকে পড়া রাজপথের ধুলো,ময়লা,ছেড়া কাগজের টুকরা ভেদ করে দৃষ্টি চালানো কঠিন। তাই দুহাতে চোখ রগড়ে লীনা ব্যাকুল হয়ে আশেপাশে তাকায়।
ঝোড়ো বাতাসের সাথে সাথে এবার তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাতাসের তীব্র ঝাপটার কারনে বৃষ্টির পানি ভূমি স্পর্শ না করতে পেরে ছেড়া তুলোর মত এদিকসেদিক উড়ছে।
তবে জাভেদ হোসেন কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে এই হঠাৎ শুরু হওয়া ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিতে সত্যিই দিশেহারা হয়ে পড়েন। রাস্তার পাশের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এদিক ওদিক তাকান। আশপাশের বেশিরভাগ বাড়িরই মেইনগেট বন্ধ। খোলা দোকানগুলোর সামনে পথচারীদের উপচে পড়া ভীড়।
অথচ এই কিছুক্ষন আগেও রাস্তার ওধারে আইসক্রিমওয়ালার পাশেই বেঁচাকেনায় ব্যস্ত ছিলো ভেলপুরিওয়ালা। ফুটপাত ঘেঁষে কয়েকটা খালি রিকশা দাঁড়িয়ে ছিলো। শহুরে জীবনের আরো হাজারো রকম উপকরণে পরিবেশটা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ছিলো। অথচ মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই গাছহীন ন্যাড়া পিচঢালা রাস্তাটা এখন শূন্য।
বাবার তাড়ায় লীনা আর ওর মা ভুতে পাওয়া মানুষের মত বাতাসের সাথে যুঝতে যুঝতে যেমন তেমন একটা আশ্রয় খুঁজতে থাকে। আশেপাশের সব দোকানপাটও ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কোথায় দাঁড়াবে ওরা? ছুটতে ছুটতেই লীনার মনে প্রশ্ন জাগে দোকানের সামনে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো কোথায় গেলো?

বাতাসের তীব্রতায় লীনার মা'র পায়ে বারবার ভেজা জামদানী জড়িয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির সূচালো ডগা সজোরে খোলা চামড়ায় বিঁধছে, তবু জাবেদ হোসেন দুই হাতে স্ত্রী আর কন্যাকে শক্তভাবে ধরে ছুটছেন। এভাবে এই বরফের মত ঠান্ডা বৃষ্টি আর বাতাস ঠেলে কতক্ষনই বা এগুতে পারবেন…তাই লীনা থেমে দাঁড়িয়ে হঠাৎ একটা বাড়ির বন্ধ গেট লক্ষ্য করে দ্রুত ছুটে যায়। হাত দিয়ে জোরেজোরে গেটে শব্দ করে…কেউ কি আছেন? প্লীজ দরজাটা খুলুন..।
গায়ে লেপ্টানো ভেজা কাপড়ে শীতে হি হি করে কাঁপছে সবাই। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে লীনার মায়েরও ও কিন্তু তবু তিনি কৌতুকমাখা চোখে লীনার দিকে তাকিয়ে বলেন, “লীনু, ভেজা চুলে তোর বাবাকে একেবারে ছিচকে চোরের মত লাগছে না!” বলেই লীনার মা তার স্বভাবসুলভ উচ্ছল হাসিতে ভেংগে পড়লেন।

বাড়ির ভেতর থেকে ছাতা হাতে লীনার বাবার বয়সী একজন সুদর্শন মানুষ বেরিয়ে এসে হাত ইশারায় ওদের বাড়ির ভেতরে যেতে বললেন। লীনারা ভদ্রলোকের পেছন পেছন বাড়িতে ঢুকে গ্রীল টানা লম্বা বারান্দায় উঠে দাড়ালো। ঝড় বৃষ্টি কমার কোন লক্ষনই নেই। আগের চেয়ে বরং বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। কোথাও একটা ট্রান্সমিটার ব্রাস্ট এর বিকট শব্দ হলো। শিলা বৃষ্টিও হচ্ছে নাকি?

“আরে তুই জাভেদ না? কি আশ্চর্য! কত বছর পরে তোর সাথে দেখা!” লীনার বাবাকে উদ্দেশ্য করে আশ্রয়দাতা ভদ্রলোকটির বলা কথা শুনে লীনা আর ওর মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।

বছর খানেক পরের কথা।
জাভেদ হোসেন সেদিন বাসায় এসে খুশিমনে কন্যাকে বলেছিলেন, “আজ ঝড় হয়েছিলো বলেই না আমার স্কুল জীবনের পুরনো বন্ধুকে খুঁজে পেলাম। বুঝলিরে লীনু, একেই বলে কারো পৌষমাস আর কারো সর্বনাশ। ”
কিন্তু ওর বাবা সেদিন বুঝতে ভুল করেছিলেন। সর্বনাশ নেমে এসেছিলো তার জীবনেই। সেদিনের সেই ঝড়ের তান্ডবলীলা যে লীনাদের সংসারেও এমনি করে আঘাত হানবে তা সেদিন কেউ ঘূনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।

সেদিন ঝড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া লীনার বাবার বন্ধুটি খুবই আমুদে ধরনের লোক। লীনাদের বাসায় যখন আসেন তখন পুরো বাসাটাই যেন রৌদ্রজ্জ্বল দিনের মত ঝকঝকে হয়ে ওঠে। অন্তত লীনার তাই ধারনা। লীনার মত ওর মায়েরও ভারী পছন্দ তাকে। কিসবের যেন ছোটখাটো ব্যবসা করেন। পোষাক আষাক দেখলে বেশ একটা রমরমা অবস্থা বলে মনে হয় কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত বিয়ে কেন করেননি সেটা লীনা আর ওর মা অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি। লীনার মা অবশ্য ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,কিছু একটা ব্যক্তিগত কারন নিশ্চয়ই আছে।


প্রথম যেদিন লীনা কিছুটা নিশ্চিত ভাবে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো সেদিন জাভেদ হোসেন অফিসের কাজে শহরের বাইরে ছিলেন। লীনার মনে হয়েছিল বাবার অনুপস্থিতির কথা বাবার বন্ধুটি কি না জেনে পারেন! তবু তো ঠিকই সন্ধ্যার মুখে মুখে হাযির হয়েছেন। কিসের টানে?
লীনা ঘুমিয়ে ছিলো। তুমুল ঝড়বৃষ্টি আর ঘন ঘন বাজ পড়ার শব্দেই কি আচমকা ওর ঘুম ভেঙেছে? নাকি অন্য কিছু?
গায়ের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে স্যান্ডেলে পা গলাতেই বৃষ্টির সরসর আওয়াজ ছাপিয়েও বসার ঘর থেকে ওর মা'র জলতরংগের মত টুংটাং হাসির শব্দ আসে। শ্রবণশক্তির উপর ভর করে ও শিকারি বিড়ালের মত নিঃশব্দে গিয়ে ভারী পর্দাটা সরিয়ে উঁকি দেয়। কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর সমস্ত ইচ্ছেটাই যেন ওর গলা টিপে ধরে। ও একছুটে বারান্দায় চলে আসে। লীনার অভিমানি চোখের জল আর বছরের প্রথম বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবু বাবার বন্ধু আর ওর মায়ের হাত দুটোর পরষ্পরের আলিঙ্গন এতটুকু ঝাপসা হয়না।

এরপর থেকে শুরু হয় লীনার মা আর লীনার ইঁদুর বিড়াল খেলা। লীনা মায়ের প্রতিটা ভঙ্গি গভীর মনযোগে লক্ষ্য করে। দিন দিন ওর মায়ের সংসারের প্রতি অন্যমনষ্কতা বাড়ে। আর সাজগোজের উপর বাড়ে অকারণ আগ্রহ। লীনার চোখে কিছুই এড়ায়না। ওর মত পনেরো বছর বয়সী একটা মেয়ের এত কিছু বোঝার কথা নয়,ভাবার কথা নয়। কিন্তু লীনা সব বোঝে। ওর মাঝে মা'র মত ছটফটে উচ্ছলতা না থাকায় সবকিছু ধীরস্থির পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখে বলে হয়তো একটু বেশিই বোঝে।

বাবা কি চোখে রঙিন চশমা পড়ে ঘোরেন? লীনা ভাবে। এই যে আস্তে আস্তে ওদের সুন্দর সংসারটা রংহীন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে বাবা কি তা বুঝতে পারেননা! মাঝে মাঝে ওর বাবার উপরও রাগ হয়। সপ্তাহে সপ্তাহে প্রিয় জায়গা গুলোতে নিয়ে গিয়েই কি মা'র প্রতি দায়িত্ব শেষ?


লীনার মাকে দেখা যায় সবসময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকেন। লীনার ব্যাপারে পুরোপুরি যে উদাসীন তা কিন্তু নয়। লীনাদের হাসি আনন্দের জায়গাগুলো একই রকম আছে কিন্তু তবু কি যেন নেই,কি যেন থাকার কথা ছিলো। গানের সুর তাল লয় আস্তে আস্তে যে কেটে যাচ্ছে তা সবই লীনা টের পায়।


তারপর একদিন ছুটির দিনে লীনার মা কোথায় হারিয়ে যান কেউ জানেনা। জাবেদ হোসেন একটি দুধসাদা কাগজে তাড়াহুড়ো করে লেখা চার লাইনের চিঠি হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। এমনটি হবে তা যেন লীনা আগেই জানতো,তবু বুকের মাঝে এসে কিসের যেন সজোরে ধাক্কা লাগে। ওর প্রচন্ড অভিমান হয়। দাঁতে দাঁত চেপে ও কান্না আটকায়।

জন্মের পর থেকেই যাকে ও বন্ধুর মত পাশে পেয়েছে, তাকে ছাড়া এখন থাকতে হবে ভেবে ওর নিজেকে কেমন যেন মনে হচ্ছে ও অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন থেকে কত কাজ ওর। সকালে একা একা ঘুম থেকে ওঠা,স্কুলের জন্য তৈরী হওয়া আরো কত কি…..তবু ও কাঁদবে না প্রতিজ্ঞা করে। কিছুতেই না।

প্রায় সপ্তাহখানেকের ভিতরই লীনাদের সমস্ত আত্মীয়স্বজন ছাড়াও ওদের ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী সহ পুরো স্কুল কিভাবে যেন জেনে যায় ঘটনাটা। স্কুলের বাউন্ডারির ভেতরে বাইরে সবখানে চলে লীনার মাকে নিয়ে রসালো আলোচনা। লীনার দম বন্ধ হয়ে আসে। চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।

আজকাল লীনার কাছে এই সংসারটাকে শুকনো নারকেলের ছোবড়ার মত শুষ্ক আর খড়খড়ে লাগে। গ্রীষ্মের দুপুর গুলোতেও যেন হিম বাতাস বয়। রুটিনবাঁধা জীবন যন্ত্রের মত চলে শুধু সপ্তাহঘুরে আসা ছুটির দিনগুলোতে লীনা আর ওর বাবা ঘরেই কাটায়। প্রথমদিকে জাভেদ হোসেন কন্যাকে বাইরে নেয়ার ব্যাপারে খুব জোরাজুরি করতেন কিন্তু আজকাল আর কিছুই বলেন না। কি যেন ভাবেন সারাদিন।
লীনার মাঝেমাঝে রাগ হয় বাবার উপর আবার কখনো বা নিজের উপর। কিন্তু মাকে ও ভুলে থাকতে চায়। মায়ের সমস্ত চিহ্ন ও যতটুকু সম্ভব ঘরদোর থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। লীনা মায়ের প্রিয় বই শেষের কবিতা,নেভার লাভ এ স্ট্রেঞ্জার সহ আরো কতসব বইয়ের পাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে। তবু যেন চোখ মুখ দিয়ে গরম ভাপ বের হয় ওর। এক মুঠো শান্তি পায়না কোথাও।

একবার লীনাদের বারান্দার দেয়ালের ফোকড়ে দুটো চড়ুই খড়কুটো এনে বাসা বানানো শুরু করেছিলো। ওর মা একটু পর পর গিয়ে দেখতেন কতটা কাজ হলো। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই চড়ুইদুটো ওদের অর্ধনির্মিত বাসা ফেলে রেখেই কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো। লীনার বাবা অবশ্য বলেছিলেন ওর মা’র অতি উৎসাহী মনোভাবের কারনেই বিরক্ত পাখি দম্পতি অন্য কোথাও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।

কখনো কখনো সেই চড়ুইদুটোর কথা লীনার খুব মনে পড়ে। আচ্ছা ওর মা কি ঐ পাখিদুটোর মত এ সংসারটাকে অনিরাপদ ভেবেছিলেন? নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজেই কি তবে…. লীনার মাথা কাজ করেনা। ঠিকঠাক ভাবে কিছু গুছিয়ে ভাবতেও পারেনা।

হঠাৎ একদিন জাভেদ হোসেন অফিস থেকে এসেই দক্ষিনা জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ার মত এঘর ওঘর করতে থাকেন। লীনা আড়চোখে বাবার প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ্য করে। কি হয়েছে বাবার? বিশেষ কিছু যে সেটা বুঝতে পারে কিন্তু মূল বিষয়টাই ধরতে পারেনা। মনে হচ্ছে ওর বাবা কিছু একটা বলতে চেয়েও পারছেননা।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর লীনার বাবা বারান্দায় গিয়ে অস্থিরভাবে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পায়চারী করেন। লীনা লুকিয়ে দেখে। কিন্তু প্রচন্ড কৌতূহলের কাছে হার মেনে ও একপর্যায়ে আস্তে করে বাবার পাশে গিয়ে দাড়ায়। জাবেদ হোসেন কন্যাকে দেখে যেন কেমন একটা স্বস্তি পান।
বারান্দায় রাখা দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে ছায়া ছায়া আলোতে লীনা আর ওর বাবা অন্ধকার আকাশের দিকে নিষ্প্রভ তারার দিকে চেয়ে থাকে। টবে লাগানো প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলোকে কেমন ভুতুড়ে বলে মনে হয়।

লীনার মা খুব গাছ ভালবাসতেন। বর্ষাকাল এলেই লীনাকে নিয়ে চলে যেতেন নার্সারিতে। খুঁজে খুঁজে বর্ষাকালীন ফুলের চারা কিনতেন। লতানো গাছের মধ্যে অপরাজিতা ওর মা'র খুব প্রিয় ছিলো। সাদা,বেগুনী আর নীল অপরাজিতার পাতাভর্তী লতার আনাগোনা থাকতো বারান্দার পুরোটা গ্রীল জুড়ে। ফুল ফোটা শুরু হলে সমস্ত বারান্দার চেহারাটাই যেন বদলে যেত।
লীনার মা চলে যাবার পরে আর কোন নতুন গাছ লাগানো হয়নি। গাছের যত্নও নেয়া হয়নি। বারান্দার শূন্য গ্রীলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই বাবার জন্য লীনার মন কেমন করে ওঠে। ও নিচুস্বরে ডাকে “বাবা।” বাবা চমকে ওর দিকে তাকান। কন্যার হাতদুটোর উপর নিজের হাত রেখে অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বলেন, “তোর মা ফিরে আসলে আমরা অনেক খুশি হবো তাই নারে মা?” লীনা বাবার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সরাসরি জানিয়ে দেয় ওর মনোভাবের কথা। কাঁচা ক্ষতের উপর কঠোরতার প্রলেপ দেয়ার মত মায়ের প্রতি অভিমানে ওর বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়। জাভেদ হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আহত চোখে কন্যার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

সেদিন রাতের পর লীনার বাবাকে যেন অন্যরকম মানুষ বলে মনে হয়। সারাক্ষণ শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ান। সেদিনের সেই মেঘ কেটে যাওয়া উজ্জ্বল আকাশের মত মুখটাও আর দেখা যায়না। তবু লীনা নির্বিকার ভাবে দৈনন্দিন কাজ গুলো করে যায়।
চোখ মুখ শক্ত করে ক্লাসগুলো ঠিকঠাক মতই করে। লীনার মা যাবার পরপর ওর ঘনঘন টিচার্স রুমে ডাক পড়তো। সহানুভূতির মত কোমলতার আড়ালে শিক্ষকেরা প্রকৃত ঘটনা জেনে নিতে চাইতেন কিন্তু এখন আর সেসবের বালাই নেই। সবাই হয়তো ভুলেই গিয়েছে ওর মায়ের কথা…কথাটা ভেবে তপ্ত দুপুরে এক পশলা বৃষ্টির মত লীনাও খানিকটা স্বস্তি পায়।

একদিন ছুটির দিন সকালে লীনা ঘুম ভেংগে দেখে বাবা ওর বিছানার পাশে বসে আছেন। ওকে জেগে উঠতে দেখে তিনি একটু হাসার চেষ্টা করেন। তার হাসিটা কেমন কান্নার মত দেখায়। লীনা টের পাচ্ছে যত দিন যাচ্ছে ততই বাবার প্রতি জামাটবাধা রাগগুলো গলেগলে ক্রমশ মায়ায় পরিণত হচ্ছে। লীনা বুঝতে পারে ওর বাবা ওকে কিছু বলতে চান। তাই অভয়ের ভঙ্গিতে লীনা বাবার হাত ধরে। ওর বাবাও হয়তো কিছুটা ভরসা পেয়ে অপরাধীর মত নিচু স্বরে বলেন, “মা'রে,মানুষের জীবনটাতো প্রকৃতির মত। প্রকৃতির মত জীবনেও বসন্ত আসে,শীত আসে,ঝড় ঝাপটাও আসে। কালবৈশাখী ঝড়ে নিঃস্ব একটা পরিবারের বাড়িঘর নির্মানে যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হয়, তেমনি ঝড়ের পরে জীবনকে পুনর্নির্মাণ করতেও সাহায্যের হাতের প্রয়োজন হয়। ” বলেই বাবা ব্যাকুল দৃষ্টিতে লীনার ঘুম জড়ানো মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। ও উঠে শক্ত হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ওর বাবা কাঁপা গলায় বলতে থাকেন “তোর মা ভালো নেই। ঘুরে দাড়ানোর জন্য তাকে আমাদের একটা বার সুযোগ দেয়া উচিত, কি বলিস মা?”

এরপর থেকে শুরু হয় লীনার অপেক্ষার পালা। সময়গুলো যেন বড় বেশি স্থির হয়ে ঝুলে থাকে। কলিংবেলের শব্দ শুনে ওর বুক ধড়ফড় করে। পড়ায় মনোযোগ দিতে পারেনা। পড়তে বসেও উঠে বারবার বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। অনেকটা আশা নিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। লীনার মা চলে যাবার পরে যতখানি নিজেকে গুছিয়ে এনেছিল অপেক্ষার হাওয়া তারচেয়েও বেশি এলোমেলো করে দিয়েছে লীনার জীবন।

দেখতে দেখতে লীনার এসএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু মা'র জন্য অপেক্ষার এতটুকু ঘাটতি নেই। এখনো লীনা রিকশার টুংটাং শব্দে চমকে ওঠে। প্রয়োজনেও সচারচার ঘর থেকে বের হয়না। মনের গভীরে একটা ভয় লুকিয়ে থাকে….মা যদি এসে ফিরে যায়।
তারপর অনেক অনেক দিন নিরবিচ্ছিন্ন অপেক্ষায় কেটে যায়। কিন্তু রাতে বাবার কথা শুনে লীনার বুকের রক্ত ছলকে ওঠে।
সারারাত এক ফোটা ঘুম হয়নি ওর। ওদের জীবনে শুরু হওয়া এই ঝড়ের শেষ দেখার প্রতীক্ষায় রাতের শেষ প্রহর থেকেই লীনা জেগে বসে আছে।

সকাল থেকেই খুব ঝড় বৃষ্টি।
বন্ধ জানালার কাঁচে বৃষ্টি আর বাতাসের নিষ্ফল আক্রোশ। ভারী পর্দাটা সরিয়ে জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে বসে লীনা বাইরে ঝড়ের তান্ডবলীলা দেখছে। এমন বৃষ্টি বাদলের দিনে রাস্তাঘাট প্রায় নির্জন। হাতে গোনা দুই একটা রিকশা চোখে পড়ছে। জানালার ঝাপসা কাঁচ মুছে ও তীক্ষ্ণ চোখে পলিথিনে ঢাকা রিকশার যাত্রীদের দেখার চেষ্টা করে। মা কি সত্যি আসবে?
কতক্ষণ জানালার পাশে বসে ছিলো খেয়াল নেই।
হঠাৎ কাছেপিঠেই কোথাও বজ্রপাতের তীব্র কান ফাটানো শব্দ ছাপিয়েও ওর মনে হলো যেন কলিংবেলের আওয়াজ হলো! হৃদপিন্ড লাফিয়ে ওঠে ওর। আরেক বার বেল বাজার শব্দ শুনতেই ও আনন্দে দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে ডাকে “বাবা,বাবা তুমি কোথায়…..” এই প্রথমবারের মত ও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কাঁপা হাতে দরজা খোলে।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সুপ্রিয় ঘোষাল ভাল লেখা। বেশ চমকপ্রদ পরিসমাপ্তির গল্প।
ফেরদৌস আলম পুরোপুরি অসাধারণ এবং সার্থক এক ছোটগল্প। অনেক অনেক ভাল করবেন।
মাইনুল ইসলাম আলিফ সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবার মত গল্প।ভোট রেখে গেলাম।
অনেক ধন্যবাদ!
বহতা নদী একটানে পড়ে ফেললাম গল্পটা। বেশ ভালো লেখেন আপনি। ভোট আর শুভকামনা থাকলো।
অনেক ধন্যবাদ!
সেলিনা ইসলাম চমৎকার উপাস্থাপনা! জীবন্ত ছবির মত গল্পের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল! শুভ কামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ!
প্রজ্ঞা মৌসুমী আপনি চমৎকার এক আবহ তৈরি করেন আপনার লেখায়। সামনে কি হবে কি হবে চিন্তা কাজ করে না, কি হচ্ছে সেটা জানতে জানতে গল্প বয়ে যায়। প্রকৃতির ঝড়, সম্পর্কের ঝড়ের বর্ণনা ভালো লেগেছে। এত সর্তকতার সাথে লিখেছেন নেগেটিভ কিছু বলবো, খুঁজে পাইনি। খানিকটা রহস্যও কি রাখতে নেই? জ্যোতিষীর কাজটা পাঠকের না লেখকের? এমনও যখন ভাবছি শেষে এসে ট্রাম্প কার্ডটা ধরে রাখলেন। অনেক শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ!
রণতূর্য ২ মা-বাবা কে আসলে ঘৃণা করা যায় না।যত চেস্টাই করা হোক না কেন।গল্প টা পড়ে লীনার জন্য বড্ড মায়া লাগল।ভোট ও শুভকামনা রইল।সময় পেলে আমার পাতা ঘুরে আসবেন।মন্তব্য করে অনুপ্রাণিত করবেন।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

কোন এক ঝড়ের দিন থেকে এ গল্পের সূত্রপাত হলেও আমি এ গল্পে বলতে চেয়েছি একটা ভুল সিদ্ধান্ত কখনো কখনো মানুষের জীবনেও প্রলয়ঙ্করী ঝড় হয়ে আসে। ওলট পালট হয়ে যায় লীনাদের মত হাজারো সন্তানের দৈনন্দিন চেনা গণ্ডি। লীনার মত ক'জনই বা সমস্ত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আবারো রোদের দেখা পায়? বেশিরভাগ সন্তানেরা হয়তো ঝড়ের বিধ্বংসী খেলায়ই আজীবন ঘুরপাক খেতে থাকে....

০৩ আগষ্ট - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী