ভিড়ের মধ্যে মিশে আছি

পার্থিব (আগষ্ট ২০১৮)

ইশরাত মাহেরীন
  • ১০২
খুব সাধারণ একটা শৈশব কেটেছে আমার। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগে ভোগা বড় মেয়ে। সেই ছোট বেলাতেই আমার
মন খারাপ হতো কারণ আমার ছোট বোন খুব সুন্দর ছিল, একদম আমার মায়ের মতো। ওর ছিল দুধে আলতা গায়ের রং,
কেমন সুন্দর ঘন কালো চুল। আমি হলাম আমার দাদীর মতো দেখতে, শ্যামলা, পাতলা ঠোঁট আর মাথা ভর্তি কেমন
কোঁকড়ানো চুল। আমার তের বছর বয়সে রিউম্যাটিক ফিভার হল তখন সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটতো। প্রায়ই
জ্বর, গলা ব্যথা, গায়ে ব্যথা লেগে থাকতো। প্রতি মাসে একটা পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে হতো-উফ কি যে অসহ্য ব্যথা!
ডাক্তার বলেছিল,
-মা, একটু সহ্য করতে হবে। এই ইনজেকশনের ব্যথা সাপের কামড়ের মতো।
তার থেকেও অস্বস্তিকর ছিল, কোমরের একটু নীচে দিতে হতো। ব্যথা, লজ্জা, মন খারাপ সব মিলিয়ে বেশ দুঃখী একটা
শৈশব। দুঃখী শৈশব আমাকে বেশ সহনশীল একটা মানুষে পরিণত করলো। সেই সময় গুলো আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ে পার
করে দিতাম। রঞ্জু আমার জন্য বই নিয়ে আসতো।

রঞ্জু মনে হয় আমার থেকেও দুঃখী ছিল। রঞ্জু আর আমি মামাতো ফুপাতো ভাই বোন। রঞ্জুর যখন বারো বছর তখন ওর
বাবা -মা একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আমার মা তার ভাইয়ের ছেলেকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। আমরা
দুইজন সমবয়সী ছিলাম। এই ঘটনার আগে রঞ্জু বেশ ভালো ছাত্র ছিল কিন্তু এরপর সে বিষণ্ণ ছিল একদম লেখাপড়া করতো
না। আমি তাকে মায়া করতাম আর সেও আমাকে মায়া করতো। সে যখন বাসার দেয়াল টপকে সন্ধ্যাবেলা একটা পুরনো
পুকুরের ধারে বসে থাকতো, আমি দিব্যি চেপে যেতাম যে রঞ্জু পড়ছে না, সে বাসায় নেই। রঞ্জুর অনেক পাগলামি আমরা
পুরো পরিবার সহ্য করতাম কিছুটা তার দুঃখী জীবনের কথা ভেবে আর কিছুটা হয়তো অর্থনৈতিক কারণ ছিল। আমার
মামার ব্যবসা পাতি বাকি মামারা দেখতে শুরু করলেন আর সেখান থেকে রঞ্জুকে দেখাশোনার জন্য কিছু টাকা পয়সা
আসতো। রঞ্জুকে আমার মামারাও তাদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে আমাদের বাসায় থাকতে চাইতো। একমাত্র
আমার সামনে বসেই সে চোখের পানি ফেলত। আমি তাকে প্রায়ই বলতাম, তোমার কিছু বন্ধু দরকার। সে বলতো, না
আমার আর কোনও বন্ধুর দরকার নেই। তিন চার বছর শুধু আমি তার বন্ধু ছিলাম। তারপর কোনো এক ঘটনায় সে
আমার থেকে দূরে সরে যায়।

আজকে আমি একটা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। হাসপাতালের সাদা পর্দা গুলো ভুতুড়ে লাগছে। হাসপাতালে
একটা অসুখ অসুখ গন্ধ পেতাম ছোট বেলায়। এখন এইসব দামি হাসপাতালে ওই গন্ধটা নেই। এখন অনেক আদর যত্ন
আমার। কিছু খেতে পারি না কারণ আমি মা হতে যাচ্ছি। শুধু এই কারণেই বড় লোকের আদরের ছেলের বউকে এখানে
ভর্তি করা হয়েছে। বিছানায় শুয়ে কিছু করার খুঁজে পাচ্ছি না। টিভি দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আমি আমার ব্যাগ হাতড়ে

একটা খাতা পেলাম যেখানে সংসারের টুকিটাকি হিসাব লিখি, আমার পার্থিব জীবনের হিসেবের খাতা। আজ ইচ্ছা হল
শেষ পাতা গুলোয় অন্য কিছু লিখি, নিজের জীবন নিয়ে লিখি। স্মৃতি হাতড়ে শুধু দুইটি ঘটনা মনে পড়লো, যাদের কথা লিখে
রাখতে ইচ্ছা হয়। প্রথম ঘটনা ঘটেছিল আমার যখন ষোলো বছর বয়স। আরেকটা আমার বিয়ের দিন। আর.... এরপর
যেদিন আমার সন্তান আসবে হয়তো সেদিন হবে আরেকটা স্মরণীয় দিন।

বয়স যখন ষোলো - আজকে আমার ভীষণ জ্বর, বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার বৃষ্টি খুব প্রিয় তাই আমি জানালা খুলে
রেখেছি। অনেকক্ষণ হলো বিদ্যুৎ চলে গেছে। দূরে একটা ট্রেন যাবার শব্দ। ঠিক সাতটায় এই ট্রেনটা যায়। মা হয়তো
মাগরিবের নামাজ পড়ছে। আমি মোমের আলোতে হুমায়ুন আহমেদ পড়ছি " আমার আছে জল "। শেষ অংশে একটা
কিশোরী মেয়ে তার ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার কষ্টে আত্মহত্যা করলো। আমি অঝোরে কাঁদছি। হঠাৎ ঘরে একটা
ছায়ার নড়াচড়া থেকে বুঝতে পারলাম, রঞ্জু এসেছে। রঞ্জু এখন আর ঠিক কিশোর নেই, কিছুটা যুবক, মুখে হালকা গোঁফ।
রঞ্জুর চোখ দুটো অন্য রকম, খুব মায়া মায়া। ইদানীং সে আবার লেখাপড়ায় মন দিয়েছে। সে একটু দুঃখী কণ্ঠে জিজ্ঞেস
করলো,
-কি হয়েছে?
-মন খারাপ লাগছে।
-কেন?
-আমাকে কেউ বিয়ে করবে না।
-কেন করবে না?
-আমি তো অসুস্থ।
রঞ্জু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। খানিকটা মেনে নিল আমার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা কম। তার পর আমার কপালে হাত দিল।
তোমার তো অনেক জ্বর। ফুপুকে ডাকবো?
-নাহ।
-কিছু খাবে?
-না।
-আচ্ছা কেউ বিয়ে না করলে আমি করবো।
এরপর রঞ্জু আমার গালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে চলে গেল।
আমি অন্য দিক মুখ ঘুড়িয়ে নিলাম। মনে মনে বললাম, "রঞ্জুর সব কষ্ট যেন স্রষ্টা আমাকে দিয়ে দেয়।"

এরপর সে ওই বাড়িতে আরও দু’বছর ছিল। এইচ এস সি তে সে বেশ ভালো ফল করলো। তারপর সে একটা হোস্টেলে চলে
গেল। কিন্তু শেষের দুই বছর আমি একটু পালিয়ে বেড়াতাম আর সেও একটু লজ্জা পেত।

আমার বিয়ের দিন -আমার বয়স আটাশ। আমি ছিলাম সব কিছু মেনে নেয়া মানুষ। আমি দেখতে ভালো নই, আমাদের
টাকা নেই। তাই আমার যখন বেশ ধনী পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলো, আমার বাবা-মা বেশ খুশি হলেন। আমি
মাস্টার্স শেষ করে চাকরি খুঁজছি। কয়েকটা টিউশনি করি। আমার বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। ঘটকের মাধ্যমে প্রস্তাব
আসলো। ছেলে দেখতে সুন্দর, ঢাকার সম্ভ্রান্ত এলাকায় নিজেদের বাড়ি। ছেলে এস এস সি তে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিল। শুধু
এইচ এস সি আর দেয়া হয় নি। সেই সময় মাথার দোষ দেখা দিল। সেই একবারই তাকে বেঁধে রাখতে হয়েছিল। এরপর
থেকে সে আর তেমন বড়সড় পাগলামি করে না। শুধু সারাদিন পেপার পড়ে, ক্রিকেট খেলা দেখে আর নামাজ পড়ে।
আমাকেও বোরখা পরতে হবে। নাহলে ছেলে রাগ করবে। আমার বিয়ে হলে আমার অন্য বোনটার বিয়ে হতে পারে। তাদের
একটা ভালো মেয়ে দরকার। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অংশটাও ছেলের মা দেখাশুনা করার আশ্বাস দিলেন। আমি
রাজি হয়েছি, না বলাটা আমার আসে না।

খুব তাড়াহুড়োয় বিয়ে হলো আমার অল্প কিছু মানুষ নিয়ে। আমার গা ভর্তি গহনা। এতো গহনা সারা জীবনেও দেখিনি।
আয়নায় নিজেকে রাজরানী মনে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সৌন্দর্যের একটা সম্পর্ক আছে মনে হয়। সাধারণ
আমাকে সেদিন অসাধারণ লাগছিল। গাড়িতে চড়ে শ্বশুর বাড়ি আসলাম। বেশ বড় একটা গাড়ি তাজা ফুল দিয়ে সাজানো।
বাসর ঘরে প্রথম স্বামীর দিকে তাকালাম। বেশ ভালো দেখতে শুধু চোখ দুটো যেন জ্বল জ্বল করে। এই প্রথম আমার সারাটা
শরীর অসাড় হয়ে গেল। একা একটা ঘরে একজন অস্বাভাবিক লোকের সাথে রাত কাটানো যে বিভীষিকা সেটা প্রথম
বুঝলাম। এরপরের অংশ আর মনে করতে চাই না।

আজ -ছত্রিশ বছর। অনেক সাধ্য সাধনার পর আমি মা হতে যাচ্ছি। আমি একটা চাকরিও পেয়েছি। দুই তিন বছর আগে
সংক্রামক রোগের মতো আমাকেও পাগলামিতে পেয়ে বসলো। চুপ করে থাকা, একা একা বসে থাকা, অঝোরে কান্না।
একসময় আমার শাশুড়ি আমাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। সেই সময় রঞ্জু এসেছিল। ওই সময়টা আমার ঠিক মনে
পড়ে না কিন্তু সে তার ফার্মে আমাকে চাকরি জুটিয়ে দিল। হয়তো আমি যে শিশুকালে তার অনেক খেয়াল রাখতাম সেই ঋণ
সে শোধ করলো। প্রথম দিকে কাজে তেমন মনোযোগ দিতে পারতাম না। ধীরে ধীরে আমি আসলেই কাজে ফিরে গিয়ে
অনেকটা স্বাভাৱিক হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি অফিসে রঞ্জুর ধার পাশেও যাই না। সে অনেক সম্মানিত মানুষ তার ফুপাতো
বোন হিসেবে আমিও আমার কাজের জায়গায় কিছুটা সম্মান পাই। আমি আমার অনাগত সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছি।
মাঝে মাঝে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেই। আমার মাথার ওপর ছাদ আছে, খাবার আছে। আমার একটা সুন্দর সাজানো গুছানো
সংসার আছে। নাটক সিনেমা দেখে হাসি এখন, কত সহজে মানুষ আত্মহত্যা করে। এখন ছোট বেলার মতো নায়িকার
আত্মহত্যা দেখে মন খারাপ হয় না। এতো সহজে মরে না মানুষ। তাহলে কবে মরে যেতাম। আমার মতো অসংখ্য মানুষ
আছে পৃথিবীতে। তারা তাদের অতি সাধারণ পার্থিব জীবন নিয়েই খুশি। তাদের কাছে ভালোবাসা শুধুই একটি মুহূর্ত
যখন তাকে কেউ বলেছিল, আর কেউ বিয়ে না করলে আমি করব।

আমাকে নিয়ে কেউ ভাবে না। আমি নিজেও ভাবি না। আজ কিছু করার খুঁজে না পেয়ে এই ডায়েরিটা লিখলাম। এখানে
কোথাও আমার নাম নেই। একেবারেই সাধারণ আমি, ভিড়ের মধ্যে মিশে ছিলাম, আবারো মিশে যাব। এই লেখাটা একটা
বোতলে ঢুকিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিব। সাথে নীচের কবিতাটাও। হাসি আনন্দের সংসার সমুদ্রে দুই বিন্দু বোতলে আটকে পড়া
কষ্ট দুলতে থাকবে -এক বিন্দু আমার নিজের আর অন্য বিন্দুটা মনে হয় স্রষ্টার থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ আপনিতো দারুণ লিখেন!!! শুভ কামনা পছন্দ আর ভোট রইল।আসবেন আমার গল্প আর কবিতায়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!!!
রুহুল আমীন রাজু বাস্তবতার এক অসাধারন লেখনি । লেখায় ধার আছে। বেশ লাগলো গল্পটি । এই সাইটে আপনাকে স্বাগতম...।
অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত একটি নারীর জীবনের তিনটি সময়ের গল্প । গল্পটি পড়ে খুব ভাল লাগল । ভোট সহ অনেক শুভকামনা ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ইশরাত মাহেরীন অনেক অনেক ধন্যবাদ ফাহমিদ বারী।
Fahmida Bari Bipu চমৎকার গল্প। একটি মেয়ের মনের গভীর সূক্ষ্ণতম অনুভূতিকে নিটোল পারদর্শীতায় তুলে ধরেছেন। গল্পকবিতায় আপনাকে স্বাগতম আপা। আপনার চমৎকার লেখনী এখানে নিশ্চয়ই প্রশংসিত হবে, আমি আশাবাদী।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্প এক সাধারণ নারীর শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের গল্প। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সংসারের হিসেবের খাতায় সে তার জীবনের স্মরণীয় তিনটি মুহূর্ত লিখেছে। একটি আনন্দের মুহূর্ত, একটি কষ্টের আর আরেকটি মুহূর্তের অপেক্ষায় সে আছে। তার মতো অসংখ্য মানুষ আছে পৃথিবীতে যারা ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে। তারা তাদের অতি সাধারণ পার্থিব জীবন নিয়ে তৃপ্ত

১৭ জুলাই - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪