উল্কা

কাঠখোট্টা (মে ২০১৮)

রবিউল ইসলাম
  • ৪২৩
এক
উল্কার বয়স কুড়ি বছর। দুই দশক অতিক্রমের ক্ষণটি সে স্মরণীয় করে রাখতে চায়। যেমন ইচ্ছে তেমন কাজ। বন্ধুদের দাওয়াত করল। আর সব বন্ধুকে বলল, দেখি তোদের মাঝে কে আমাকে সব থেকে বেশি খুশি করতে পারে। বন্ধুদের চিন্তার শেষ নেই। উল্কা বলে কথা। কোন বন্ধুর টাকা লাগবে সে ধার দিবে। ধার টাকা কেউ কোন দিন ফেরত দিয়েছে এমন নজির নেই। কোন বন্ধু বা বন্ধুর আত্মীয় অসুস্থ সবার আগে হাজির সে। হাসপাতালের বেডে সারা রাত সেবায় মশগুল থাকে। পড়াশুনার কোন বিষয়ে সমস্যা। সমাধান উল্কার কাছে। খেলাধুলা। সেখানেও সরব উপস্থিতি তার। এমন একজন ভাল বন্ধুকে কে না খুশি রাখতে চায়। যাহোক, নির্দিষ্ট দিনে উল্কার চমক একটু ভিন্ন। সে সমবেত, বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘বন্ধুগণ, আজ আমরা আমাদের পরিবারও সমাজে প্রচলিত কিছু কর্মকাণ্ড তুলে ধরব। যা আমাদেরকে হাসি ও কান্নায় ভরে দিয়েছে। যা আমি, আমার পরিবার ও বন্ধুদের দ্বারা সংঘটিত হয়। আমরা যেসব আচারণে কষ্ট পাই। যা আমাদের স্বস্ব ধর্মের পরিপন্থী। আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করব। যাতে ঐ খারাপ কাজগুলি ভবিষ্যতে আমরা কেউ না করি।‘
সব বন্ধু হাতে হাত রেখে সম্মতি জানাল। লটারির মাধ্যমে নাম কল করা হল। জমিরের পালা।

প্রিয় বন্ধুরা আমার পরিবারে একটি কাজের বুয়া থাকত। আমি ওনাকে সব সময় ফুপি বলে ডাকতাম। খুব আদর করত আমাকে। স্কুলে আনা নেয়া করত। খাওয়াত। খুব সুন্দর গল্পও শোনাত। বাড়িটা সব সময় পরিপাটি রাখত। তার রান্নার স্বাদ এখনো আমার জিহ্বায় লেগে আছে। বাসার যত কাপড় সব তিনিই পরিষ্কার করতেন। একদিন কাঁক ডাকা ভোরে মা প্রচণ্ড রাগ করেছে ওনার সাথে। আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, ফুপি প্রেগন্যান্ট! ঐ দিনটি থেকে আজ অবধি আমি প্রচণ্ড মানসিক দৈন্যতায় ভুগি। কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ওনাকে বাসা থেকে যেতে বলেন মা। বাসা থেকে যাওয়ার সময় শুধু বলেছিল,
‘সাহেব, আপনি জোর করে আমার সর্বনাশ করলেন। ঘরে অসুস্থ স্বামী। তিনটা ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা। এখন আমি কি করব? এই নেন আপনার পাপের টাকা। উপরে একজন আছেন উনি বিচার করবেন।‘
তার যাওয়ার ক্ষণটা কান্নার রোলে ভারি হয়ে গেল। আমিও কাঁদছি বিছানায়। কিন্তু বাবা ও মায়ের কাঠখোট্টা স্বভাবের কাছে এ নিছক মায়াকান্না ছাড়া কিছু নয়। সেদিনের পর ভোরে আর পড়তে উঠা হয়নি আমার। আদর করে কেউ যে বলেই নি ‘বাবা উঠ,পড়তে বস’। কোন দিন প্রাতে আর কর্ণে সূরের ঝংকার বাজেনি কুরআন তেলাওয়াতের। বাবার ভুল ও মায়ের কঠোরতায় একটি গরিব পরিবারে অন্ধকার নেমে এল।হয়ত সে অন্ধকার দূরীভূতের আলো তার ঘরে পৌঁছেছে। অথবা, মিটিমিটি জ্বলতে জ্বলতে একবার ধপ করে নিভে গেছে। ফুপির সে উপরওয়ালা খবর রেখেছেন নিশ্চয়। আমার কাছে তার আগত সন্তানের কোন খবর নেই। নেই কোন খবর ফুপির। তবে এ খবর আছে, ঐ আগত সন্তানের বাবার ছায়াতলে আমি বড় হচ্ছি দিনের পর দিন। সাথে সাথে বেড়ে উঠছে একরাশ ঘৃণাও!

দুই
জমিরের কথায় আকাশ ভারি হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ। নীরবতা ভেঙ্গে গেল ঊর্মির কণ্ঠে।
বর্ষাকাল। বাহিরে প্রচুর বর্ষণ। আমি সোফায় ঘুমিয়ে পরেছিলাম। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গর্জনে আমার ঘুম ভাঙ্গে। পাশের কক্ষে ঝনঝন আওয়াজ শুনতে পেলাম। পর্দা সরায়ে দেখি ঘরের মেঝেতে অনেক গুলো কাঁচের টুকরো। চুড়ির লাল লাল ভাঙ্গা টুকরো। মেঝেতে মা পড়ে আছে। বাবা মদ গিলছে। আর বলছে,
‘ঐ বুড়ো বিয়ের সময় হুণ্ডা দিতে চেয়েছিল। শালা পলটি খেল। আমি ওকে ছাড়বনা। যা মাগী। টাকা নিয়ে আয়। না হলে তোকে মেরে ফেলব।‘
এ বলে মার গলা টিপে ধরল। মা কাঁদতে থাকল। আমিও ভয়ে কাঁদছি। থরথর করে কাঁপছিও। অকস্মাৎ বাবা আমার দিকে তেরে আসল। গালে কসে থাপ্পড় মারল। বলল,
‘তুই না থাকলে আমি আর একটা বিয়ে করতে পারতাম। গোলাপিকে। তোরা জানিস না জুঁইয়ের চেয়ে গোলাপ কত দামি জগতের কাছে।‘
সেই মূল্যবান গোলাপের কাছে মা ও আমি এতটাই হালকা যে খড়কুটোর মত ভেসে গেছে আমাদের জীবন। এ ভাসমান জীবনে যখন মা দু’হস্তে তার জন্য প্রার্থনা করে। আমি বলি,
‘ঐ পশুটার জন্য তো ছুরি ধার দিতে হবে। জীবন্ত কুরবানির জন্য।‘
মা আমার মুখে হাত চেপে বলে,
‘উনি তোমার বাবা। বাবাকে এরকম বলতে নেই।‘
আর এখন আমার বাসায় গেলে তোমরা যাকে চাচী বল, উনি আমার মা। সেই গোলাপি মা!আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসেন মা। কখনো কখনো নকল কে আসল রূপে দেখা যায় বৈকি! কিন্তু আসলকে কেমনে নকল হিসাবে চালাবে, বল? গোলাপি মা আমার আসল মা নয়। কিন্তু তার গুনগুলিতে মেকির বালাই নেই। জুঁই মা আমার আসল মা।যাকৃত্রিমতা ও অভিনয়ে ভর্তি। যে অভিনয় আমার বাবাকে অভিনেতা বানিয়েছে আমার সামনে। মাকে অভিনেত্রী করেছে স্বীয় সন্তানের কাছে। আমারা ভাল আছি জুঁই মা! অনেক কিছু শিখেছি তোমার কাছে। শিখতে পারিনি শুধু তোমার সে অভিনয়। যেখানে থাক, যার সাথে থাক। ভাল থাক সব সময়। ভাল থাকুক দুনিয়ার সব মায়েরা। শুধু একটা অনুরোধ। আর কোন ঊর্মি যেন পরকীয়া ও অর্থের কাছে মা হারা না হন! কাঁদতে কাঁদতে গলাটা ধরে এল ওর।

তিন
ঊর্মি, আমি দুঃখিত। আমার বাবা গ্রাম মাতব্বর। আমাদের গ্রামে কিছু হিন্দু পরিবারের বাস। বড় জোর ত্রিশ থেকে চল্লিশটা পরিবার। তাদের সাথে আমাদের সম্প্রীতির অন্ত নেই। ওদের পূজা পার্বণে আমারা শরীক হই। ওরাও আমাদের শবে বরাত ও ঈদে। এক সঙ্গে খেলি। এক সঙ্গে ইস্কুলে যাই। গ্রামের ক্ষতি হোক এরকম কাজ তারা কখনো করে না। একদিন এ সম্প্রীতির মাঝে সহসা অগ্নি দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ভারতী দিদি আর আমার চাচাতো ভাই নাকি গোপনে সম্পর্ক করছে। প্রেমের সম্পর্ক। গোপনে বলা ঠিক নয়। যেহেতু বিচার বসেছে। দু’পক্ষের মুরব্বিরা বৈঠকে। ভারতী দিদিকে ডাকা হল প্রথমে। বলতে শুরু করল,
‘মিনহাজ খুব ভাল ছেলে। ও কোন অন্যায় করতে পারে না। একজনকে তো ভালোবাসা অন্যায় নয়। হোক সে জাতে ভিন্ন। আমরা গরীব। নিচু শ্রেণীর। আমার বাবা সামান্য মাছ বিক্রেতা। আমাদের সাথে আপনাদের তো কোন বিরোধ নেই। তবে কেন এ আয়োজন? মিনহাজের দু’চোখ আছে। আমারও আছে। ওর মস্তক আছে, আমারও আছে। ওর প্রাণ আছে, আমারও আছে। ওর হৃদপিণ্ডে যে ভালোবাসা আছে, আমারও আছে। আমাদের দু’জনের মুখের ভাষা এক। মন ও শরীরের আবেদন এক। শিরার রক্ত প্রবাহ এক। তবে কিসে আপনারা বিভেদ খুঁজেন? আর কেনই বা আমাকে আর মিনহাজকে আলাদা করতে চাইছেন?’ দিদির বাচনগুলি যখন সবাইকে ভাল কিছু ভাবাচ্ছে ঠিক তখন কে যেন বলে উঠল, ‘মিথ্যাবাদী। বেশ্যা। গ্রামের সব পুরুষকে চুষে চুষে খাচ্ছে।‘
কতগুলো দাড়ি টুপি পরা হুজুর ও বলতে লাগল,
‘ঠিক বলেছেন। এ পাপ গ্রামে রাখা যাবে না। মাতব্বর সাহেব, আপনি বিচার শুনায় দেন।‘
বাবা মিনহাজ ভাইকে এবার সবার সামনে বলতে বললেন। কি আশ্চর্য! ভাইয়া বলল,
‘আমার সাথে ভারতীর কোন প্রেমের সম্পর্ক নেই। ও আমাকে বিরক্ত করছিল। মাঝে মাঝে টাকা ধার করত। ফেরত চাইলে বলত, টাকা বাদে যা চাবি তাই পাবি। আমিতো ওর কাছে টাকার জন্য ঘুরঘুর করতাম।‘
উপস্থিত সকলে গর্জে উঠল। সমস্বরে বলতে লাগল,
‘এ বেশ্যাকে গ্রামে রাখা যাবে না। পাপ যে বাপ কেও ছাড়ে না।‘
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দিদির পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলা হল। সকলে সভাস্থল ত্যাগ করল। কাঁদো কাঁদো স্বরে যাওয়ার বেলা দিদি আমাকে বলল,
‘কোন ভগবান নেই যে এ অন্যায়ের বিচার করে! যার প্রতি বিশ্বাস, সে যদি এত বড় ক্ষতি করে। তবে ভগবান কে কি আর বিশ্বাস করব? উনিও নিশ্চয় আমাকে বেশ্যা বলবেন!
দিদির প্রতি মিনহাজ ভাইয়ের যে প্রতারণা তা বিষে পরিণত হয়েছে ঠিক সাত দিনের মাথায়। দিদি ও অমল কাকা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকই। কিন্তু গ্রামের পরতে পরতে অনেক বেশ্যার দেখা মেলে এখন। যারা ঐসব কথিত মোল্লাদের স্ত্রী, কন্যা ও বোন। আর মিনহাজের মত নারী খাদকরা আজ জাতীয় ধর্ষক। আফসোস, মিথ্যার কাছে সত্য কত ঠুনকো। আর এ ঠুনকো সত্য নিয়ে তোমাদের সৈকত আজ অবধি কথা বলেনি। না মিনহাজের সাথে। না ঐ মাতব্বর বাবার সাথে।

চার
আমার মা ও বাবা খুব ধর্ম মানে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন দু’জনে। বলতে শুরু করল মামুন। সমাজে বাবার কদর ও অনেক। গ্রামের একমাত্র চাকুরিজীবী। তাও আবার সরকারি। বাবার দানের হাত ও বড়। মসজিদ কমিটির সভাপতি। এলাকার যে কোন সমাজ সংস্কার মূলক কাজে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। এমন পিতামাতার সন্তান হতে পেরে সত্যিই আমি গর্বিত। কোন এক গ্রীষ্মের বৈকাল। বাড়ির উঠনে ষাটোর্ধ এক বুড়োর আগমন। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল, ‘সাহেব বাসায় আছেন?’
‘কার কথা বলছেন দাদু।‘
‘এটা মোছাহাক সাহেবের বাড়ি না।‘
বাবার কথা শুনতে আমি বললাম,
‘হ্যাঁ। আসুন, বসুন প্লিস।‘
আমরা দু’জনে উঠানের টঙয়ে বসলাম। এরপর জিজ্ঞেস করলাম,
‘বাবার কাছে কি কাজে?’
‘আমি অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। পেনশনের কিছু টাকা পাব। বছর তিন হয়ে গেল। আজ পাই, কাল পাই। এভাবে কেটে যাচ্ছে দিন, মাস ও বছর।‘
‘বাবা কি করে আপনাকে হেল্প করতে পারে?’
‘তোমার বাবাই তো আমার ফাইলটা দেখছে।‘
ঠিক এমন সময় বাবার আগমন। ওনাকে দেখে বাবা বলল,
‘আরে মশায় আপনি অফিসের কাজে বাসায় এসেছেন কেন? বাবা তুমি তোমার কাজে যাও।‘
আমি বাড়িতে আমার ঘরের মধ্যে বসে আছি। ওনারা কথা বলছেন। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ভদ্রলোক কান্না জড়িত গলায় বলছে,
‘আপনাকে তো পঞ্চাশ হাজার দিয়েছি। প্লিস আমার ফাইলটা ছেড়ে দেন।‘
বাবা আস্ত আস্ত কণ্ঠে বলল,
‘দেখুন আপনাকে আগেই বলেছি। যা পাবেন তার তিন ভাগের এক ভাগ না দিলে ফাইল ছাড়া নিষেধ আছে। সবি তো বুঝেন।‘
‘বাবারে এক লক্ষ টাকা এ বয়সে কিভাবে জোগাড় করি বলেন। যে পেনশন আমাকে বুড়ো বয়সে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। সেই পেনশন কিনা বোঝা হয়ে আমার ঘাড় দেবে ধরেছে। যাতে আমার কান্না থামার কথা তাতে কত কান্না লুকিয়ে আছে। কে জানে? তার সবটুকু ঝরায়ে কবরে যেতে পারলে বাঁচি!‘
বাবা নীরব। বাবাকে আমি জীবনে কত মানুষকে সাহায্য করতে দেখেছি। আমি ভাবলাম, বেচারার সমস্যা এবার নিশ্চয় মিটে যাবে। তা যে শুধু আমার কল্পনা। বাস্তবতা বড় নির্মম হয়। আমি নিজের চক্ষু জোড়াকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখি মাথায় টুপি লোহার মত শক্ত হাতে বাবা টাকার ব্যান্ডল নিচ্ছে। আর বৃদ্ধ দাদুর দু’হস্ত থরথর করে কাঁপছে। কান্না জড়িত গলায় বলছে,
‘বাবা আমার সব আয় তোমাকে দিয়ে গেলাম। মরার আগে যেন পেনশনটা তুলতে পারি। জগতের কোন বাবা কি চায় কন্যাকে পাত্রস্ত না করে মরতে।‘
জানি না দাদু পেনশন ভোগ করেছে কিনা। তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিনা। কিন্তু এসব না এর মাঝে আমি এটুকু বুঝেছি যে, একজন ঘুষখোর আমার বাবা। মন কা মন দুধের মধ্যে যেমন এক ফোটা গোবর মেশালে সব নষ্ট হয়ে যায়। সেদিনের আচরণে বুঝেছিলাম, এক জনের রক্ত চোষে বাবা আর একজনকে রক্ত দান করে। আমার মাকেও এর বিরোধিতা করতে শুনিনি কস্মিনকালেও। সেদিন থেকে আমি আর গর্ব করিনা। মনে মনে বলি বাবা একজন সরকারি ভিখারি। ভিখারির পরিচয়টা দিতেও লজ্জা পাই আজকাল!

পাঁচ
আমার বড় ভাই অনিক। ওনাকে আমি বন্ধু ও ভাবি। ভার্সিটির সবচেয়ে কাছের মানুষ আমার। আমি সব ব্যাপারে পরামর্শ করি ওনার সাথে। তোমরা সবাই নিশ্চয় ভাইকে চিনো। অনেকে হয়তো তার সান্নিধ্য ও পেয়ে থাকবা। একদিন আমার ভীষণ মন খারাপ। মা আমাকে বকেছে। আমি ওনাকে যখন মন খারাপের বিষয়টা বললাম। উনি হেসে উড়ে দিলেন। আর বললেন,
“শোনো। দুনিয়াটা বড় আপেক্ষিক। যা তোমার কাছে ভাল, তা অন্যের কাছে খারাপ হতে পারে। যা তোমার কাছে গালি, অন্যের তা ভাষা হতে পারে। যা তোমার ধন, অনেকের কাছে তা বোঝা। যা তোমার স্বাধীনতা, অন্যের তা পরাধীনতার গ্লানি। যে তোমার শত্রু সে অনেকের বন্ধুও। জগতের সবকিছু ঘুরছে আপন কক্ষপথে। তুমি, আমি, আমরা সবাই। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে উত্তম জিনিসটা বাছাই করাই হল জ্ঞানীর কাজ। এক রাতেআমি ঘুমাচ্ছিলেন। ভোর ৪.০০ টা। কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। নিভু নিভু নেত্রে দরজা খুলেদিলাম।
‘আরে তুই বন্ধু এত রাতে! কি, কোন সমস্যা?’
সমস্যার কথা কিছু না বলে হু হু করে কাঁদছে সূর্য।
‘আরে বাবা কান্না থামা। কিছু না বললে আমি কি করে তোকে সান্ত্বনা দিব বল।‘
‘মা বকেছে। ভীষণ খারাপ ভাবে বকেছে।‘
‘মায়েরা তো বকতে পারে। আবার দেখনা মায়েরা আমাদের কত ভালোবাসে।‘
‘ভালোবাসে, না ছাই। আমি ঘৃণা করি মাকে।‘
‘কেন কি হয়েছে বল?’
‘আজ আমার বাবার বার্থডে। বারটার সময় আমিতাকে গ্রিটিং করতে ভুলে গেছি। গ্রিটিং না করে ঘুমায় গিয়েছি। এটা আমার অপরাধ। আমাদের সকাল আটটায় ব্যবহারিক পরীক্ষা। আমি পড়াশুনা করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরেছি।
‘তা ঠিক আছে। কিন্তু বাবার বার্থডের জন্য মা কি করে এরকম করতে পারে। ওনার তো তোমার কথা, পরীক্ষার কথা ভাবা উচিৎ ছিল আগে। উনি করলেন উল্টো। এর মাঝে কি কোন কারন আছে?’
‘আছে দোস্ত। উনি আমার সৎ বাবা। আমার বয়স যখন তিন বা চার বছর। মা প্রকৃত বাবাকে ডিভোর্স করে। আমার নানা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল মাকে। বিয়ের পর ও মা তার পুরনো প্রেমিকের সাথে যোগাযোগ রাখছিল। বাবা এটা টের পেয়ে শোধরানোর চেষ্টা করে। আর মা উল্টো বাবাকে নারী নির্যাতনের মামলায় ফাসায় দেয়। বাবার পাঁচ বছরের জেল হয়। সরকারি চাকুরিও হারায়। আইনের মাধ্যমে মা আমার জিম্মাদারি পায়। সেই থেকে আমি মায়ের সাথে। বছর খানেক হল নানা আমাকে আমার প্রকৃত বাবার কথা বলে দেন। ঠিকানাও দেন। আমি ভার্সিটিতে ভর্তির পর বাবার সাথে দেখা করি। মায়ের সব কৃতকর্ম শুনি। এরপর আমি মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করি। বলি আমি বাবার কাছে ফিরে যেতে চাই। সেদিন থেকে মা আমার সাথে খারাপ আচরণ করছে। আজ সামান্য বিষয়ে কত বাড়াবাড়ি। আমি জানি আমার সৎ বাবা ভাল মানুষ। উনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। একজনের বার্থডে তো ভুলে যেতেই পারি। মায়ের কথা আমি কেন ঠিক বারোটায় গ্রিটিং করলাম না। এজন্য আমাকে যাচ্ছে তাই বলল। আসলে আমি তো শেঁকড় খুঁজে পেয়েছি। এটা মা মানতে পারছে না।‘
‘দেখ বন্ধু, মা তোমাকে আগেও ভালবেসেছে। এখনো বাসে। তোমার প্রতি তার ভালোবাসা শাশ্বত’।“
এ গল্পটি বলার পর অনিক ভাইয়া আমাকে বলল,
‘তোমার মা কি এরকম কিছু করেছে তোমার সাথে। করেনি তো। ভুলে যা ওসব। আয় বাঁশেরহাটে চা বিস্কিট খেয়ে আসি।‘
উল্কার কথাগুলি সব বন্ধু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তোমাদের আরও কিছু কথা বলি।
‘আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। আজকাল দেখনা কত শিক্ষক ছাত্রদের ব্যবহার করছে। নিজের চরিতার্থে ছাত্র নেতাদের টাকা দিয়ে কিনছে। নিয়োগের জন্য প্রার্থী বরাদ্দ দিচ্ছে নেতাদের। আর নেতারা সাধারণ ছাত্রদের দাবাড় গুটি হিসাবে চালছে। হলুদ সাংবাদিকতায় ভরে গেছে এ হাবিপ্রবিক্যাম্পাস। ক্যাম্পাস বলছি কেন পুরো দেশ। কবি, সাহিত্যিক ও লেখকেরা কলম বিক্রি করে ফেলেছে। গবেষকের গবেষণা আজ আস্তকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত।নেতারা কামড়া কামড়ি করছে। নিজেদের আখের গোছাতে। সংসদে জনগণের অধিকার জলাঞ্জলি যাচ্ছে। এ ঘুণে ধরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনা ও গঞ্চনা। না নিরাপত্তা আছে জানের। না মালের। যাক, এসব বলে লাভ কি? আজ তোমাদের আর একটি বাস্তব কথা বলি। যা আমি অনিক ভাইয়াকে বলিনি ঐদিন। শুধু বলেছিলাম মা আমাকে বকেছে। সে বকা যে শুধু বকা ছিল না। ওটা ছিল আমার ভরা জীবনের পরিপূর্ণ ফাঁকা দশা। ঐদিন মা আমাকে কল করল। আর বলল, একটা ঠিকানা লিখতে। আমি লিখলাম। এরপর বলল,
‘যত দ্রুত সম্ভব ওনার সাথে দেখা করতে।‘
আমি বললাম,
‘ভার্সিটি ছুটি হলে যাব।‘
মা বলল,
‘দ্রুত যা।‘
আমি বললাম,
‘উনি কে?’
এ কথা বলার সাথে সাথে মা লাইন কেটে দিল। মিনিট পাঁচেক পর মা আবার ফোন করল। বলল,
‘শীঘ্রই দেখা করতে।‘
আমি আশ্চর্য হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
‘জরুরী কিছু!’
এবার মা প্রচণ্ড ক্ষেপে বলল,
‘বেয়াদব একটা।‘
আর এতেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। যা হোক, আমি যেদিন ওনাকে দেখতে গেলাম। বাড়িতে থমথমে অবস্থা। দু’একজন কুরআন পড়ছে। আগরবাতির গন্ধ চারপাশে। উঠানে একজন একটা খাল কোদাল দ্বারা ভরাট করছে। উঠানের কাঁঠাল গাছের গোঁড়ায় মধ্য বয়স্ক একজন লোক বসেছিল। আমি ওনাকে সালাম দিলাম। মা-বাবা ও গ্রামের পরিচয় দিয়ে বললাম,
‘আমি হাফিজা ফুফুর সাথে দেখা করতে চাই।‘
লোকটি সহসাই আমাকে বুকে টেনে বলল,
‘বাবা তুই এসেছিস। তোর মা তোকে দেখার জন্য অনেক খবর পাঠিয়েছে। আজ তুই এসেছিস। কি দুর্ভাগ্য আমার বোনের! ঐ যে কবর দেখছ। আজ জোহরের নামাজের পর মাটি দেয়া হয়েছে।‘
আমি অবাক হয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এসব আপনি কি বলছেন?’
‘আমি সত্যি বলছি বাবা। তোমাকে ওনারা দত্তক নিয়েছে।‘
এ কথা শোনার পর আমার সব কিছু উলট পালট লাগছিল। ভাবতে লাগলাম। আমার তো পরিচয় আছে। কিসের প্রয়োজন ছিল আরও পরিচয়ের? আর যখন চরম সত্যটা এত কাছে তখন এ সত্যের জননী কেন পরপারে? মায়ের বুকে তিন মুষ্টি মাটি দিয়ে দু’হস্ত তুলে বললাম, ক্ষমা কর মা! এ জগতে দেখা হয়নি, পর জগতে নিশ্চয় দেখা হবে। এ কেমন জগত! জগতের লীলা বুঝা দায়। দশ মাস দশ দিনের পর মাত্র এক বছর মা আমাকে আদর করেছে। শুনেছি, আমার প্রকৃত বাবা মাকে মেনে নেয় নি। আর গর্ভধারণের দোষে স্বামী তাড়ালে বাপের বাড়িতে ছোট ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেয়। এরপর সারাটা জীবন সহ্য করেছে কোন এক পুরুষের বীর্য যন্ত্রণা। স্বামী ছাড়া। তিন সন্তান ছাড়া। তিন বলছি কেন, আমি সহ চার সন্তান ছাড়া। সব কিছু হারার বেদনা তাকে চুষে চুষে খেয়েছে। শরীরের প্রতিটি রক্ত ফোঁটা শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে। এ জমাট বাঁধা রক্তও গোগ্রাসে গিলেছে কুকুর নামধারী সমাজপতিরা।সারাটা জীবন আমার ভ্রূণটিকে আগলিয়ে রাখল।কে জানে কত অপমান, কত তিরস্কার হজম করতে হয়েছে! সুশীল সমাজের দ্বারা। তার অন্ত নেই। আল্লাহ ওনাকে জান্নাতে শান্তিতে রাখুন। আমিও বেশ শান্ত। খালিশাপাড়ার নতুন ঠিকানায়।“

খালিশাপাড়ার কথা শোনার পর অকস্মাৎ জমির হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। উল্কার গলা জড়ায়ে বলতে লাগল,
‘আজ থেকে তুমি আমার ভাই। আমার পক্ষ থেকে এ পুরষ্কার গ্রহণ কর। বাবাকে ক্ষমা করে দাও।‘
সব বন্ধু হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল। কান্নার কষ্টে আকাশও মেঘলা হয়ে উঠল। সমাজের সব অপকর্ম থেকে দূরে থাকার প্রতিজ্ঞা করল ওরা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নৈতিকতা শেখার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত ও করল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ অন্ধকারে আকাশের এক কোন হতে উল্কার আলো ছুটল। সে আলোতে পথ খুঁজে পেল উল্কারা। পথ পেল জাতির বিবেকও!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী অনেক আগে গল্পটি পড়ার আমন্ত্রণ ছিলো, যদিও পুরো পড়ার সময় হয়নি তবে এখন পুরোটা শেষ করলা। গল্পে দারুণ একটি বিষয় টেনে নিয়ে এসেছেন। গল্পের বর্ণনাগুলো ভালো লাগলো। তবে ১ম দিকে যতিচিহ্নের সমস্যা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও গল্পকে আরও একটু গোছানো দরকার। তবে বেশি বেশি লিখলে ও পড়লে এমনেতেই চমৎকার লেখা চলে আসবে মনে করি। সামনে আরও ভালো পাবো বলে আশা করছি। শুভকামনা রইল কবি....
ধন্যবাদ প্রিয় আপনার সু পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা মূলক মন্তব্য এর জন্য। আশা করি আমি নিজেকে শোধরাতে পারব। ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিবেন।
প্রজ্ঞা মৌসুমী লেখার টেকনিকটা বেশ- কয়েকটা ঘটনাকে একসাথে করা। অনেক সময় দিতে হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু লেখনী দূর্বল মনে হয়েছে। শব্দ বাছাইও এর কারণ হতে পারে। এই যেমন- ‘প্রাতে আর কর্ণে সূরে’, ’বাহিরে প্রচুর বর্ষণ’ আলাপ বা বলার রেশটা কেটে যাচ্ছিল। শেষের দিকে তাড়াহুড়ো করে কাহিনী বলা হচ্ছে মনে হলো তবে প্রত্যেকটা কাহিনী অভিনব ছিল। শেষের ইতিবাচকতাও বেশ।
Thanks a lot for your valuable suggestions, I will try to follow up you. Let visit my poem please. Best wishes.
মৌমিতা পুষ্প বড়দের কঠোর বা খারাপ আচরণ ছোটদেরকে নিরবে কঠোর করে তুলে। গল্পের থিমটি ভাল লাগল। ভোট দিলাম। আমার কবিতাটি পড়ার অনুরোধ করছি।
Thanks a lot dear for your valuable and nice compliments. Best wishes for you. Cheers!
মিঠুন মণ্ডল ভাল লাগল...
Thanks a lot dear for your valuable and nice compliments. Best wishes for you. Cheers!
Shamima Sultana আমার কাছে এই পর্যন্ত পড়া সব চেয়ে সুন্দর লেখা
Thanks a lot dear for your valuable and nice compliments. Best wishes for you. Cheers!
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত গল্পটি সময় নিয়ে পড়লাম । আর একটু সাজিয়ে লিখলে বেশি ভাল লাগত । সব মিলিয়ে আমার ভাল লেগেছে । ভোট সহ অনেক অনেক শুভকামনা রইল ।
Thanks a lot dear for your valuable suggestions and nice compliments. Best wishes for you.
মৌরি হক দোলা গল্পে বেশ কয়েকটি সামাজিক, পারিবারিক সমস্যার কথা উঠে এসেছে। ভালো লাগল..... শুভকামনা রইল।
রবিউল ইসলাম সুপ্রিয় সুধী, আপনাদের সবাইকে আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইল।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

'উল্কা' গল্পটিতে আমাদের তরুন সমাজের মন ও মননের প্রতি তাদের অভিভাবকদের কাঠখোট্টা স্বভাব ও নেতি আচরণের কি প্রভাব তা তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের বর্তমান সমাজে বাবা, মা ও আত্মীয়স্বজন দৈনিক কোন না কোন খারাপ কাজে লিপ্ত। তাদের বিদঘুটে আচরণ কিভাবে সন্তানদের, বিশেষ করে যুব সমাজের ক্ষতি করছে সে দিকটি এ গল্পের মূল আলোচ্য বিষয়। মা বাবার কাঠখোট্টা স্বভাব সন্তানের জন্য নেতিবাচক; তবে এ গল্পে কিছু তরুন সে নেতিবাচক বিষয়গুলি আর যাতে সমাজে সংঘটিত না হয় সে জন্য তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। তাদের এ কর্মের দ্বারা জাতি ও দিক খুঁজে পায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার।

১২ মার্চ - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী