সুকন্যা ফ্যাশন হাউস

নারী তুমি জয়িতা (মার্চ ২০২৩)

Jamal Uddin Ahmed
  • ১০
  • 0
  • ২২০
গুড্ডু আজও এসেছিল। দুপুরে। ঘরে ঢোকেনি বা ঢোকার মতো সাহস করেনি; জানালার গ্রিলে ধরে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ফুঁকতে ফুঁকতে বজ্জাতি করে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। আজ একাই এসেছিল। ফাতেমাকে সে একরকম শাসিয়েই গেছে। অন্য মেয়েরা, মানে, রোকেয়া, শাহানা, নির্মলা এবং মরিয়ম বরাবরের মতো টানটান দুয়েক কথা বলেছে। মরিয়ম বিবাহিত এবং সবার চেয়ে বয়সে বড়। গুড্ডুরও বড়। ছোটবেলা থেকেই আশুলিয়ায় আছে সে। গুড্ডু তাকে ছোটবেলায় আপা ডাকত; এখন নাম ধরেই ডাকে। এ নিয়ে মরিয়ম একটু মর্মাহত হলেও প্রতিবাদ করে ঝামেলা পাকাতে চায় না। তবে ফাতেমাকে উত্যক্ত করতে এলে সে গুড্ডুকে চড়া গলায় দুকথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হয় না।ওদের মধ্যে শুধু নির্মলাই অনেক কিছু বিবেচনা করে একটু সাবধানে কথা বলে।

মরিয়ম আজকেও বলেছে, ‘গুড্ডু, এখনও কইতাছি তুই ভালা অইয়া যা। নইলে আমি তোর বাপের কাছে যামু। আচ্ছা, এত কথা কই, তোর কি একটু লজ্জা হয় না?’

গুড্ডু এলাকার বখাটে ছেলে। তেমন বড় মাপের মাস্তান নয়। তবে বড় ভাইদের সাথে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে। অশিক্ষিত বখাটে হলেও মোটামুটি সুদর্শনের কাতারে তাকে ফেলা যায়। ফাতেমার উদ্দেশ্যে প্রতি সপ্তায়ই দুয়েকবার এদিকে এলে তার সাথে আরও দুয়েকটা বখাটে থাকে। আফসানার সুকন্যা ফ্যাশন হাউসে কাজ নেবার পরই কেবল ফাতেমা আশুলিয়ার বাসিন্দা হয়েছে। তা-ও প্রায় দু’বছর। গুড্ডু আসলে অল্প কিছুদিন হয় ফাতেমার পিছে লেগেছে।

মূলত মরিয়মই তার বাসার একটি কক্ষ নির্মলা ছাড়া বাকি মেয়েগুলোকে মেস করে থাকার জন্য ভাড়া দিয়েছে। নির্মলা অবশ্য তার বাবা-মা’র সাথেই থাকে। চারাবাগ কাঁচাবাজার এলাকার দুই কাঠা জমি মরিয়মের শ্বশুর সেই কবে খুবই অল্প দামে কিনেছিলেন। মারা যাবার আগে পর্যন্ত সেখানে একটি কাঁচা ঘর বানিয়ে তিনি সপরিবারে থাকতেন। এখন মরিয়মের গার্মেন্টস-কর্মী স্বামী ঘরটিকে আধাপাকা করে তৈরি করেছে। শাশুড়ি তার দুই বাচ্চাকে সামলান বলে মরিয়ম সুকন্যা ফ্যাশন হাউসে কাজ করে বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন করতে পারে।

সন্ধ্যার আগে আফসানা তার বাসা-কাম-কারখানা অর্থাৎ ফ্যাশন হাউসে ফিরে এলে মেয়েরা কাজের সব হিসেব-নিকেশের সাথে গুড্ডুর জ্বালাতনের কথাও তাকে জানায়। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন আফসানাকে ঢাকার বিভিন্ন পোশাকের শোরুমে পোশাক সরবরাহ করতে কিংবা ম্যাটেরিয়্যালস কিনতে যেতে হয়। অন্য দিনগুলোতে সে তার বাসায় অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে থাকে। যত ক্ষুদ্রই হোক একজন মেয়েমানুষের পক্ষে একটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করা সহজ কথা নয়। তবুও ক্লান্তিকে দুহাতে ঠেলে আফসানাকে সঙ্গত কারণেই সবকিছু সামলাতে হয়। কিন্তু গুড্ডুর উটকো ঝামেলা নিয়ে সে একটু বেকায়দায়ই আছে। কারণ সে নিজেও আশুলিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা নয়। কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়া তার জন্য একটা ঝুঁকির ব্যাপার। বরং মরিয়মের খুঁটি তার চেয়ে বেশি মজবুত। সেজন্য মরিয়ম তার প্রতিষ্ঠানে থাকায় সে অনেক সাহস পায়। বয়সে ছোট হলেও মরিয়মের কাছ থেকে আফসানা অনেক বুদ্ধি-পরামর্শ নেয়। গুড্ডুকে ঠেকানোর প্রাথমিক দায়িত্বও তাই সে মরিয়মের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু গুড্ডুর নষ্টামিকে এখনও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

আফসানার একমাত্র মেয়ে মুসকান পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। বাইরের কাজে না গেলে আফসানা নিজেই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসে। ফেরার বেলা অবশ্য অন্য সহপাঠীদের সাথে সে চলে আসতে পারে। তাদের প্রতিবেশী চম্পা ও টুম্পা নামে দুটি মেয়েও মুসকানের সাথে পড়ে। মুসকানের পিতা হা্বিব নিজের মেয়ের সাথে স্বেচ্ছায় চম্পা-টুম্পাকেও একসাথে পাঠদান করে। উদ্দেশ্য, তার মেয়েটি যাতে বন্ধুদের সাহচর্যে উৎফুল্ল থাকে, তাদের কঠিন জীবনযুদ্ধের অভিঘাতে সে যেন বিমর্ষ হয়ে না পড়ে। অপরদিকে চম্পা-টুম্পার মা-বাবারাও এমন একটি উপকার পেয়ে ভীষণ খুশি। তাই তারাও সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করে এবং আফসানাদের পরিবারের যেকোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসে।

প্রথম দিকে সংকোচ থাকলেও হাবিব এখন হুইলচেয়ারে বসেই স্বচ্ছন্দে আফসানার ফ্যাশন টিমের সাথে কাজ করতে পারে। সে এখন দক্ষতার সাথে ফ্রক, ব্লাউজের বোতাম হুক ইত্যাদি লাগাতে পারে। বিভিন্ন ডিজাইনের জামায় ফুল-ফিতা বসানোর কাজও করতে পারে। সে তাদের কর্মচারী মেয়েদের সাথে সহজ সম্পর্ক রাখলেও তারা হাবিবকে যথেষ্ট সম্মান করে এবং স্যার বলেই সম্বোধন করে। কেননা হাবিব তাদের সাথে বসে কাজ করলেও তারা তার ওজন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তারা বোঝে হাবিব প্রতিবন্ধী না হলে আফসানার এই ফ্যাশন হাউস গড়ার প্রয়োজন হতো না আর গুড্ডুর মতো ছেলে এসেও তার সামনে দাঁড়াতে পারত না।

আফসানার কল্যাণে তাদের পরিবার এখন অতি সচ্ছল না হলেও ভালভাবে খেয়েপরে চলার মতো অবস্থানে আছে। তার পরও হাবিবের মনটা মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। সকালে অথবা সন্ধ্যায় কখনও কখনও সে চুপ করে বসে থাকে। আফসানা তখন কাজে ব্যস্ত না থাকলে স্বামীর কাছে এসে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা বলে। উদ্দেশ্য, স্বামীর মনকে বিষণ্ণতার জগত থেকে বের করে আনা। স্বামীর মন ভাল করার জন্য সে কোন পোশাক থেকে কত লাভ করল, কোন জামার চাহিদা বেশি এসব ব্যবসায়িক কথা বলতে থাকে। এতে অধিকাংশ সময় কাজ হয়। স্বামী উৎসাহ বোধ করে। নিজের অতীত থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে। কখনও এসব কথায় কাজ না হলে আফসানা বাধ্য হয়ে মেন্টরের ভূমিকায় গিয়ে কথা বলে। সে বলে, ‘দেখ, তুমি বেঁচে আছ, আমরা ভাল আছি, আল্লাহ্‌র কাছে হাজার শোকর। তুমি কোনো চিন্তা করো না, ইনশাল্লাহ আমরা আরও ভালভাবে বেঁচে থাকব।’

গুড্ডুর উৎপাতে বিরক্ত হয়ে সেদিন আফসানা ফাতেমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে, ‘আসল কথাটা খুলে বল, ফাতেমা। তুমি কি গুড্ডুকে প্রশ্রয় দিয়েছ, তার সাথে ফুসুরফাসুর কর?’

ফাতেমা হড়বড় করে বলে, ‘না আপা, হের লগে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। ও-ই আমারে বিরক্ত করে।’

‘আর তো কাউকে বিরক্ত করে না গুড্ডু। এই রোকেয়া শাহানাও তো কম সুন্দর না। তাহলে সে তোমার পেছনে লাগল কেন?’ আফসানা জিজ্ঞেস করে।

আফসানার প্রশ্নে ফাতেমা একটু থতমত খেয়ে যায়। কী বলবে ভেবে পায় না।

আফসানা বলে, ‘ঠিক আছে, এ ব্যাপার নিয়ে আমি বেশি ঘাটাতে চাই না। তোমার যদি তাকে পছন্দ হয়, কিংবা ইতিমধ্যে যদি তুমি তার সাথে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে থাক যে কারণে গুড্ডু তোমাকে জ্বালাতন করার অধিকার পেয়ে গেছে তবে আমরা সেইভাবে ভাবতে পারি।’

তখনই ফাতেমা বলে, ‘আপা ও আমারে নিয়া ঢাকায় বেড়াইবার যাইতে চায়, হোটেলে থাকতে চায়। তার এইসব পচা কথা আমার ভালা লাগে না। হের লাইগ্যা আমি আর তার লগে কথা কই না।’

আফসানা একটু ঝিম ধরে বসে গুড্ডু ও ফাতেমার ভেতরকার সম্পর্কের সারবত্তা খোঁজে। তারপর বলে, ‘ওকে, আমি বুঝতে পেরেছি। যাও, এখন কাজে যাও।’

বছর আড়াই আগে হাবিবের পরিবারের ধপাস করে জলে পড়ার মতো অবস্থা হলে তারা চোখে সর্ষেফুল দ্যাখে। যদিও আরবান বি-টেক বিল্ডার্স হাবিবের চিকিৎসার খরচ যুগিয়েছে এবং চিকিৎসাকালীন সময়ে পরিবারের খাই খরচের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যও দিয়েছে কিন্তু শেষপর্যন্ত হাবিরের আর কাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মালিকপক্ষ তবুও মানবিক বিবেচনায় এসএসসি পাশ আফসানাকে তাদের প্রতিষ্ঠানে একটি চাকরি দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু তার কচি শিশু এবং অসুস্থ স্বামীকে ঘরে রেখে আফসানা কাজে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেনি। শেষপর্যন্ত কোম্পানিপ্রদত্ত কিছু আনুতোষিক নিয়ে তারা মোহাম্মদপুরের বাসা ছেড়ে আশুলিয়ার একটি স্বল্প ভাড়ার বাসায় গিয়ে উঠতে বাধ্য হয়। আফসানা অবশ্য খোঁজখবর নিয়েই আশুলিয়ায় আসে। ওখানে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান দুস্থ মহিলাদের বিভিন্ন ধরণের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আফসানা বুঝতে পেরেছিল তাকে বাঁচতে হলে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে। তাই সে ওই প্রতিষ্ঠানে সেলাই এবং পোষাকতৈরি কাজের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নেয়। তারপর সেই এনজিও’র ঋণেই সেলাই মেশিনসহ পোশাক তৈরির কিছু যন্ত্রপাতি কিনে সে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে। মেয়েদের কিছু পোশাক তৈরি করে সেই এনজিও’র সহযোগিতায় ঢাকার বিভিন্ন পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সে তার পোশাকগুলো বিক্রির চেষ্টা করে। কিন্তু সফলতা তো সহজে ধরা পড়ার বস্তু নয়। আফসানা জানত বাঁচতে হলে তাকে লড়তে হবেই। তাই সে হাল ছেড়ে দেয়নি। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মিরপুর, নিউ মার্কেট, বেইলি রোডের বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে সে তার পোশাকগুলো দিয়ে আসতে থাকে । অল্পদিনের মধ্যে সে কিছু কিছু দোকান থেকে ইতিবাচক সাড়া পায়। তার সরবরাহকৃত পোশাকগুলো বিশেষ করে বাচ্চাদের পোশাকগুলো ক্রেতাদের পছন্দ হলে তার উৎসাহ বেড়ে যায়। তার মেয়েকে দেখাশোনার দায়িত্ব স্বামীর ওপর ছেড়ে দিয়ে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সে উৎপাদন বাড়াতে থাকে। কিন্তু একা সে কতটুকুই বা পারে। সে তো আর মেশিন নয়।

এরকম সময়েই মরিয়মের সাথে আফসানার পরিচয় হয়। সে জানতে পারে মরিয়মের গার্মেন্টসে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। একই এলাকার হাশেমের সাথে তার একটু মন দেয়ানেয়ার ব্যাপার ছিল এবং হাশেমই তাকে গার্মেন্টসে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল। কিন্তু এক সময় তাদের বিয়ে হয়ে গেলে হাশেম তাকে আর গার্মেন্টসে কাজ করতে দেয়নি। আফসানা হাশেমকে বুঝিয়ে সুজিয়ে মরিয়মকে তার কাছে নিয়ে আসে। গার্মেন্টসের অভিজ্ঞতা থাকলেও আফসানার ভিন্নধর্মী কাজ মরিয়মের কাছে নতুন ছিল। আফসানা বলল, ‘কুচ পরোয়া নেই, আমি একমাসে তোমাকে ওস্তাদ বানিয়ে ফেলব। তোমার হাত চালু আছে, শুধু মন দিয়ে আমার কাজটা দেখ।’হলোও তাই। একমাসেই মরিয়ম দক্ষ হয়ে উঠল। সেই থেকেই আফসানার এগিয়ে যাওয়া শুরু। দুজনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতায় তৈরি মানসম্মত পোশাকের চাহিদা বাড়তে থাকলে মরিয়মের সাহায্য নিয়ে নির্মলা, ফাতেমা, শাহানা ও রোকেয়াকে আফসানা তার প্রতিষ্ঠিত সুকন্যা ফ্যাশন হাউসে নিয়ে আসে। কিন্তু মেয়েগুলো ছিল একেবারেই আনকোরা। আফসানা মেয়েগুলোকে নিয়ে তার সেই এনজিওতে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণে ভর্তি করে দিল। একই সময়ে সে তার নিজের প্রতিষ্ঠানে তাদের হাতেকলমে কাজও শেখাতে লাগল। এখন তারা সেলাই, এমব্রয়ডারি এবং অন্যান্য সুক্ষ্ণ কাজগুলোতে পাকা হয়ে উঠেছে। আফসানার দায়িত্ব এখন প্রধানতঃ কাটিং ও নির্দেশনা।

হাবিবের বন্ধু সুখেন যে সাভার থানার ওসি হয়ে এসেছে তা সে জানতে পারে আফসানার কাছ থেকেই। জানবে কী করে? সেই আট বছর আগে তাদের বিয়েতে সুখেন বড় একটি উপকার করেছিল। এরপর হয়তো বারদুয়েক সে তাদের বাসায় এসেছিল। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় তার বদলি এবং ব্যস্ততার জন্য সুখেনের সাথে তাদের যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমে আসে।

আফসানা পালিয়ে বিয়ে করলে তার ভাইয়েরা হাবিবের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। তখন সুখেন এসেই তাকে উদ্ধার করে। চট্টগ্রামে এসআই হিসেবে বদলির অর্ডার হয়ে যাওয়ায় সে দৌড়ঝাঁপ করে কোনোরকমে হাবিবের শ্বশুরবাড়ির লোকদের সাথে বিষয়টা মিটমাট করে দেয়। তারপর একদিন হাবিবের বাসায় বসে খেতে খেতে সুখেন বলেছিল, ‘দোস্ত, এমন প্রেম করলি, একেবারে ঘাম ঝরিয়ে দিলি। তুই হলি রড-সিমেন্ট-পাথর পরিবারের লোক, প্রেম করার সাধ হলো কেন তোর?’ নতুন বউ আফসানা তখন শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ডেকে মুচকি হেসেছিল।

থানায় গিয়ে প্রথমে সুখেনকে আফসানা চিনতে পারেনি। কিন্তু সুখেনই তার পুলিশি চোখ দিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘আপনাকে তো চেনাচেনা মনে হচ্ছে; আপনি…হাবিবের???’

‘আফসানা’, আফসানাই সুখেনকে সাহায্য করে।

‘আফসানা ভাবী!’ টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে সুখেন গলা ফাটিয়ে বলে, ‘আরে, আপনি কোথা থেকে? কীভাবে?’

আফসানা বলে, ‘দাদা, আমি তো আপনাকে চিনতেই পারিনি। কেমন মোটা হয়ে গেছেন।’

সেদিন আফসানাকে অনেক সমাদর করে চা-নাশতা খাইয়ে সুখেন আফসানার পূর্বাপর সব সুখ-দুঃখের কাহিনী শোনে। তাছাড়া আফসানার থানায় যাওয়ার কারণটাও সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। সে বলে, ‘আমি আগামী শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে আপনাদের বাসায় আসব। হাবিবের দুর্ঘটনার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। আর ওই বদমাশ ছোকরাকে আমি সাইজ করে দেব; আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

শুক্রবার সন্ধ্যার একটু পরে সুখেনের জীপ গাড়িটি এসে আফসানাদের বাসার সামনে থামে। সুখেন উঁচু গলা হাঁক দেয়, ‘হাবিব বাসায় আছিস?’ হাবিব সুখেনের অপেক্ষায় ছিল। তবে সুখেনের গলার আওয়াজ শুনে সে হুইল চেয়ার ঠেলার ঝামেলায় না গিয়ে আফসানাকে বেরোতে বলল। আফসানা দৌড়ে এসে সুখেনকে বাসার ভেতর ডেকে নিয়ে গেলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো। সুখেন ও হাবিব একে অপরের গলা জড়িয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ। পারস্পরিক অভিযোগ অনুযোগের ভেতর দিয়ে তারা অনেক স্মৃতিচারণ করল। সুখেন বলল, ‘তুই পলিটেকনিক থেকে বেরিয়ে ডেভেলপার কোম্পানিতে ঢুকে সাইট ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলি; তখনও আমি বেকার। মনে আছে, আমি প্রায়ই তোর প্রজেক্টে চলে আসতাম বিরিয়ানি খাওয়ার লোভে?’

সুখেনের কথা শুনে হাবিব হাসে। বলে, ‘এখন তো তুই পাওয়ারফুল ব্যক্তি।’

সুখেনের মুখটা কাতর দেখায়। সে বলে, ‘উপরওয়ালার দয়া, তুই ভাঙ্গা কোমর নিয়েও বেঁচে আছিস। চারতলা থেকে পড়লে তো অনেক কিছুই ঘটে যায়। তুই সৌভাগ্যবান, ভাবীর মতো স্ত্রী পেয়েছিস।’

হাবিবের চোখ আর্দ্র হয়ে পড়লে আফসানাই আলোচনার মোড় ঘুরাতে এগিয়ে আসে। সে সুখেনকে বলে,’দাদা গাড়িতে নিশ্চয়ই আপনার লোকজন আছে, একটু চা-নাশতা করেছিলাম…।’

সুখেন তখনই বলে, ‘আরে দাঁড়ান, চা-নাশতা পরে হবে।’ তারপর ডাক পাড়ে, ‘রকিব, ওই বদমাশটাকে নিয়ে আস।’

আফসানা ও হাবিব কিছু বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

সুখেন বলে, ‘ওই বাঞ্চতটাকে ধরে এনেছি।’

এক মিনিটের মধ্যে গুড্ডুকে ধরে নিয়ে এসে কনস্ট্যাবল রকিব তার পাছায় একটা লাথি মেরে মেঝের ওপর ফেলে দেয়। গুড্ডু তখন আফসানার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না জুড়ে দেয়।

ঘটনার আকস্মিকতায় আফসানা একটু ভয় পেয়ে যায়।

সুখেন বলে, ‘শালাকে হাজতে ঢুকিয়ে আজ যা ঢলা দেব, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।’

গুড্ডু এবার সুখেনের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে, ‘স্যার, আমি আর এইসব করুম না, আমারে ছাইড়া দেন। জীবনে আর কোনোদিন আমারে এই এলাকায় দেখবেন না।’

সুখেন সপাটে গুড্ডুর গালে একটা থাপ্পড় কষিয়ে বলে, ‘বদমাইশরা ধরা পড়লে এরকম বলে। তোরে আমি চোদ্দ বছরের জন্য জেলে ঢোকাব।’

গুড্ডুর কান্না বেড়ে গেলে আফসানার মনটা নরম হয়ে আসে। সে বলে, ‘দাদা, ও যখন বলছে আর এসব করবে না, একটা সুযোগ তাকে দেয়া যায় না?’

‘কী যে বলেন ভাবী?’ সুখেন তেতে ওঠে, ‘এরা তো এভাবেই বড় মাস্তান হয়ে ওঠে।’

গুড্ডু হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘স্যার, আমি লেখাপড়া করতে পারি নাই, আমারে যে কোনো একটা কাজ দেন, দেইখেন আমি ভালা অইয়া যামু।’

আফসানার মাথায় তখন হঠাৎ করে একটা বুদ্ধি খেলে যায়। একজন ডেলিভারি ম্যান পেলে তার খুব ভাল হতো। সে গুড্ডুর কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘দাদা, একটা অনুরোধ রাখবেন? ও যদি কথা দেয় তবে আমি তাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’

গুড্ডু আবার আফসানার পায়ে পড়ে চিৎকার করতে থাকে, ‘মেডাম, আমি আপনাগো সবার কাছে মাফ চাই, ফাতেমার পায়ে ধইরাও মাফ চামু, আমারে একটা সুযোগ দেন।’

ও যে এখনও পাকা মাস্তান হয়ে উঠতে পারেনি তা উপস্থিত সবাই বুঝতে পারে। হাবিব এতক্ষণ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আফসানার কোমল মনের প্রতি তার দরদের কারণেই হয়তো সে সুখেনের চোখের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

সুখেন বলে, ‘ওকে কাজ দিলে তো আরও বেশি গণ্ডগোল করবে। কালকেই কোর্টে চালান করব।’

গুড্ডু আবার কাঁদতে আরম্ভ করলে হাবিব মুখ খোলে, ‘দোস্ত, পারলে তোর ভাবীর অনুরোধটা রাখ না। ও আবার তেড়িবেড়ি করলে একবারে ক্রসফায়ারে দিয়ে দিস।’

সুখেন তখন কনস্ট্যাবল রকিবকে বলে, ‘ওরে থানায় নিয়ে চল, তারপর দেখব কী করা যায়।’

আফসানার মুখটা তখন উজ্জ্বল দেখায়। সে বলে, ‘দাদা, টেবিলে সামান্য নাশতা আছে, চলুন। আপনার লোকজন সবাইকেও ডাকতে পারেন।’

সুখেন হাবিবের হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘চল, ভাবী মজার খাবার কী রেঁধেছে দেখি।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান এই সংখ্যায় পড়া দ্বিতীয় গল্প,আপনি বরাবরই চমৎকার লেখেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
মোঃ মাইদুল সরকার গল্পের ঘটনা পুরাই বাস্তবতার সাথে মিলে গেছে, এখানেই লেককের সার্থকতা।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ফয়জুল মহী অসাধারণ লেখা ভাই।খুব ভালো লাগলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
বিষণ্ন সুমন আপনি বরাবরই ভালো লিখেন। এটাও ব্যাতিক্রম নয়। শুভ কামনা রইলো ভাই। কিন্তু ভোট অপশন বন্ধ কেন?
অনেক ধন্যবাদ। তবে আমি অতি ক্ষুদ্র একজন লেখক। মনের তাগিদে লিখি। ভোট কিংবা পুরষ্কারের কেরামতি খুব একটা বুঝি না। পাঠকের বিবেচনাই আমার কাছে অধিক মূল্যবান।
mdmasum mia ভাল লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

জীবনের গল্প

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪