বিব্রত ভালবাসা

ভালোবাসার গল্প (ফেব্রুয়ারী ২০২০)

Jamal Uddin Ahmed
  • ১১৫
এক

‘তুই একটা হারামজাদা – লুচ্চা, ইতর, ছোটলোক …’

আমার ইচ্ছে হচ্ছে বাবুলের গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগাই। গত একমাস ধরে যখনই সুযোগ পাচ্ছে সে আমাকে তুলোধুনো করছে। আমার মনে হয় সে আমার দূর্গতির সুযোগ নিয়ে আচ্ছা করে তার মনের ঝাল মেটাচ্ছে। ভেবেছিলাম এই ছুটির দিনের বিকেলটা ওকে নিয়ে হাতির ঝিলে কিংবা, সে রাজি থাকলে, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতের পাখি দেখে কিছুটা সময় কাটিয়ে মাথাটা হালকা করব। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সে আমার বাসায় এল ঠিকই, কিন্তু প্রস্তাবটি উপস্থাপনের আগেই সে আমাকে খিস্তিখেউড়ের বন্যায় ভাসিয়ে দিল।

মিহি তার মামার বাসায় চলে যাবার দিন থেকেই বাবুল আমায় পেয়ে বসেছে। (ঢাকায় মামাই মিহির একমাত্র নিকটাত্মীয় – আমার সাথে বিয়ের সময় পর্যন্ত সে মামার বাসাতেই ছিল।) সহকর্মি থেকে বাবুল অল্প সময়েই আমার অতি কাছের বন্ধুতে পরিণত হয়। গুলশানের বিদেশি বায়িং হাউসে দুজন প্রায় একসাথে চাকুরিতে ঢোকার পর বাড্ডার একটি মেসের একই রুমে তিন বছর একসাথে কাটিয়েছি আমরা। আমি প্রায় এক বছর আগে মেস জীবনের ইতি টানলেও বাবুল সেখানেই রয়ে গেছে – এখনও ব্যাচেলর। মিহির সাথে আমার প্রণয়ের সূচনা ও পরিণয় ওই মেসে থাকাকালীন সময়েই।

না, আমি যখন মিহির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি তখন, এমন কি এই সেদিনও, মনে হয়নি বাবুল আমার সুহৃদ হলেও তার মনের গহীনে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ইর্ষা থাকলেও থাকতে পারে। তবে এখন কেন জানি খটকা লাগে; সেতো আর মহামানব নয়। তবে আমার যখন শেষ রক্ষা হল না অর্থাৎ মিহিকে কোনোভাবেই আটকাতে পারলাম না তখন মানসিক চাপ নিঃসরণ করার জন্যই বাবুলকে সবকিছু খুলে বলি। শুনেই বাবুল লাফিয়ে উঠেছে, ‘কী বলছিস এসব? ব্যাটা, তুই-ই একটা লুচ্চা – তোর চরিত্র আর ঠিক হল না – একটা ফুলের মত মেয়ে…।’ আরোও কত কী যে বলেছে, আমি সেটা গায়ে মাখিনি; কিন্তু তার ধারাবাহিকতা এই এক মাসেও যে শেষ হয়নি। তার পৌনঃপুনিক খিস্তি উদ্গীরণের গতি দেখে আমার মনে হচ্ছে সে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার পরিবর্তে মিহির দেবীমহিমাকে সমুন্নত করার কাজে অধিক যত্নশীল। তাই ইদানীং এরকম একটা সন্দেহ আমার মনে জায়গা করে নেয়ার জন্য মাথার চারপাশে চক্কর দিচ্ছে যে বাবুল হয়ত আমার এই দুর্দশা খুব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।

মিহির সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয় বাসে যাতায়াত করতে গিয়ে। আমাদের বললাম এজন্য যে আমার ও বাবুলের রবরব বাসে চড়ে গুলশানে আসা-যাওয়ার পথেই মিহির সাথে ঘনঘন দেখা হতো। সেও গুলশানের এক গ্রুপ অব কোম্পানির হেড অফিসে চাকুরি করত; অবশ্য আমাদের বিয়ের পর আমিই মিহিকে চাকুরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম। তখন সে একই বাসে বনশ্রী থেকে আসা-যাওয়া করত। বাসের নিয়মিত যাত্রীরা সাধারণত অল্পদিনেই একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে যায়। পরে ‘কেমন আছেন?’ ‘আপনি কোন অফিসে আছেন?’ ‘বাসা কোথায়?’ ইত্যাদি ছোট ছোট কথার মাধ্যমে প্রতিবেশির মত সম্পর্ক হয়ে যায়। চেনা-জানার এই অতি সাধারণ বৃত্তের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক সময় আবিষ্কার করি যে আমি আর মিহি বৃত্তের বাইরে চলে এসেছি। বাবুলের দৃষ্টি এড়িয়ে আর কতদিন লুকোচুরি খেলা যায়; তাই বাধ্য হয়ে বাবুলের কাছে সত্যটা খুলে বলতেই হয়। এসব ক্ষেত্রে ঘনিষ্ট বন্ধুর প্রতিক্রিয়া যেমনটি হয় বাবুল ঠিক তেমনটিই করেছিল – একটু উত্তেজিত হওয়া, ডুবে ডুবে জল খাওয়ার অভিযোগ করা, ভালমন্দ খাওয়ানোর জন্য আব্দার করা, এসবই। আমার সাথে মিহির হল, তার কেন হল না – এমন কোনো আক্ষেপ বাবুলের মনে আছে বলে আমার মনে হয়নি।

উদ্বোধনী চোটপাট শেষ করে বাবুল বলল, ‘কেন আসতে বলেছিলি, কোনো পজিটভ নিউজ আছে?’
আমি বললাম, ‘না কোনো নিউজ নেই; আর যে কারণে আসতে বলেছিলাম তা বলার মুডও নেই এখন।’
‘তবেতো তোর বসে বসে আঙুল চোষার কথা; আমার ছুটির দিনটা মাটি করতে গেলি কেন?’, বাবুলের খেদ।

আমার মুড এমনিতেই ভাল থাকার কথা না এটা বাবুল বোঝে, তারপরও সে চ্যাটাং চ্যাটাং করে বিষোদ্গার করে – যেন আমি তার প্রতিপক্ষ। তবে স্বীকার করতেই হবে, আমার গোষ্ঠী উদ্ধার করলেও মিহির সাথে দফারফা করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তত চারদিন সে মিহির মামার বাসায় গিয়েছে। মিহির ইস্পাতকঠিন জেদের কাছে সে মার খেয়েই চলেছে। উপরন্তু মিহির মামার কাছে আমার পচে যাওয়া ইমেজ উদ্ধার করার জন্য তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। হলে কী হবে, মামাও ভাগ্নির উদ্ধত ফণার সামনে দাঁড়াতে পারছেন না। মিহির এক কথা, এই লম্পট দুশ্চরিত্র লোকটার কাছে আর সে ফিরে যাবে না।

বাবুল প্রথম দিনই বলেছে, ‘ভাবি, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ছেলে-বুড়ো সবাই মজা করার জন্য, এই ধরু্ন, ইউ-টিউব দেখে, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদিতে চ্যাটিং করে; আর মিশুর ব্যাপারটা মোটেও সিরিয়াস কিছু না, জাস্ট ফান।’ মিহি তখন রুক্ষস্বরে জবাব দিয়েছে, ‘বাবুল ভাই, প্লিজ, আপনার অসৎ বন্ধুর জন্য ওকালতি করবেন না, এতে আপনার প্রতিও আমার ধারনা নষ্ট হয়ে যাবে।’ তারপরও বাবুল হাল ছাড়েনি।

গত পরশু মিহির সাথে বাবুলের যে ফোনালাপ হয়েছে তা সে আমার কাছে এ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। আজ যখন বাইরে যাবার ইচ্ছেটা মরেই গেল তখন বিরক্ত হলেও বাবুলকে যেতে না দিয়ে নিজেই দুজনের জন্য কফি বানালাম। বাসায় কোনো স্থায়ী কাজের লোক নেই। মিহির যোগাড় করা ছুটা বুয়া এখনও আছে, তবে তার সময়সূচি পরিবর্তিত হয়েছে। এখন সে ভোর ছ’টায় এসে দ্রুততার সাথে চা-নাস্তা তৈরি করে, বাসনকোসন ধোয় এবং ঘর ঝাড়ামোছা করে। ঠিক সাতটায় সে আমার সাথে বেরিয়ে পড়ে। তবে শুক্রবার বা অন্য ছুটির দিনের রুটিন আলাদা; সকাল ন’টার দিকে এসে নাস্তা তৈরি করার পর আমার পুরো সপ্তাহের ভাজি-তরকারি রান্না করবে, জমানো কাপড় ধুয়ে দেবে, আরোও কোনো ছোটখাট কাজ থাকলে করে দেবে, তারপর যাবে। তবে প্রায়ই জিজ্ঞেস করবে, ‘ভাইজান, আপারে নিয়া আসেন না ক্যান? পেরতেক দিন দেখি ভাতের হাড়ি পুড়াইয়া ফেলাইছেন।’ আমি বলি, ‘আর কটা দিন গেলেই তোমার আপা চলে আসবে; আর ততদিনে আমি ভাত রান্নাটাও শিখে ফেলব।’ বুয়া আর বেশি কিছু বলার সাহস পায় না যদিও সে জানে যে বিরাট কোনো অঘটনের পরই আমার স্ত্রী রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। আর সেজন্য দুপুরের খাবার বাইরে সেরে ফেললেও রাতের ভাতটা হাঁড়ি পুড়িয়ে আমিই রান্না করি।

কফিটাও যে বিস্বাদ হয়েছে তা বাবুলের বিকৃত মুখাবয়ব দেখেই বুঝা যায়। তারপরও সে এ নিয়ে কোনো আপত্তি করে না। বরং সে আবার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যায়। বলে, ‘আচ্ছা, তোর যদি এতই চুলকানি ছিল তবে চ্যাটিং-ফ্যাটিংটা সাথে সাথে মুছে ফেলতে পারলি না?’
আমি আর তাকে নতুন করে কী বলব? বাবুলও যেন মিহির মত আমাকে বিশ্বাস করতে চায় না। বললাম, ‘তোকে আর কতবার বলব যে আমি ক্লীন। আমি ক্লীন না হলে কি ইনবক্স ওপেন ফেলে রাখতাম?’
‘তুই এতই যখন ক্লীন, ওই মেয়েটা তোর কাছে এত রগরগে ছবি পাঠায় কেমন করে?’, বাবুল প্রশ্ন করে।
আমি তার কথার উত্তর দিতে পারি না। একজন নিরপেক্ষ বিচারকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যুক্তিটি অকাট্য। মিহি আমার নির্দোষ ব্যাখ্যা মেনে নেবেইবা কেন? আমি কেন ওই মেয়েটির সাথে এমন রসালাপ করতে গেলাম, কেন সে তার টানটান ছবি আমার কাছে পাঠাবে? তাই আমার আকুতি, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা সবকিছু পিছনে ফেলে মিহি ঠিকই বেরিয়ে গেল। সেই থেকে একটা বার ফোনে কথা বলে যে অনুনয় করব সে সুযোগটিও দিল না।

কফি শেষ করে বাবুল একটু চুপ মেরে গেল বলে মনে হল। এতে আমার একটু ভয় লাগল। আমার বর্তমান তাতানো পরিস্থিতিতে বাবুলের মুখ বন্ধ করে থাকা বেমানান। অসহ্য লাগলেও তার বিষমাখা বুলি আমার মনের জমাট বাঁধা গরলকে অল্প হলেও তরল করে। আমি ঘরের আবহাওয়াকে নাড়িয়ে দেয়ার জন্যই বললাম, ‘চল একটু বাইরে বেরোই।’
বাবুল কিছু না বলে নির্বিকারভাবে একবার আমার দিকে তাকাল।
আবার বললাম, ‘চল।’
তখন বাবুল একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘বস।’ তারপর গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘খুব খারাপ লাগছে; তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না।’
আগে থেকেই আমার মনে ভয় কাজ করছিল। তাই বাবুলের কথার পিঠে কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না।
‘দুয়েক দিনের মধ্যে ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবি; মিহি অর্থাৎ ভাবী কোর্টে গিয়েছিল’, শীতল কন্ঠে বাবুলের উত্তর।

দুই

বাবুল বিরক্তির সাথে আমার শেষ অনুরোধটা রেখেছিল। কিন্তু আমার চাওয়াটাকে কার্যকর করা তার জন্য সহজসাধ্য ছিল না। গণ্ডারের চামড়া পরে সে মিহির হাতেপায়ে ধরে আমার প্রস্তাবে তাকে রাজি করিয়েছে।
সে মিহিকে জানিয়েছে যে আমি কোর্ট থেকে নোটিশ পেয়েছি এবং তার সিদ্ধান্তকে আমি মেনে নিয়েছি। আমার একটাই অনুরোধ, আমি তাকে শেষবারের মত একটিবার দেখতে চাই এবং আমার কৃতকর্মের জন্য সরাসরি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাই।

মিহি প্রথমে রাজি না হলেও বাবুলের পীড়াপীড়িতে শেষপর্যন্ত বাড্ডার সেই মেসে কঠোর শর্তের আবরণে সে যেতে রাজি হয়েছে। ওখানে সে আনন্দের পসার নিয়ে আগেও অনেকবার গিয়েছে। বাবুল ও আমার সাথে খাওয়া-দাওয়াও করেছে বেশ ক’বার। উচ্ছ্বাসের চরম প্রকাশ ঘটার কোনো সুযোগ সেখানে না থাকলেও মিহির উপস্থিতি আমাদের মেসের দৈন্য চেহারাকে বসন্তের গোলাপবাগানে পরিণত করত। আমাদের বিয়ের পর আমার কয়েকবার যাওয়া হলেও মিহি আর কখনও সেই মেসে যায়নি। আজ সে ওখানে যাবে; বাবুলের রুমেই।

আমি সৈকতকে নিয়ে যথাসময়ে বাড্ডার মেসে হাজির হই। অবশ্য বাস থেকে নেমেই আমি বাবুলের সাথে যোগাযোগ করেছি। মেসবাড়ির সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে বাবুলের রুমের সামনে দাঁড়াই আমরা। দরজা খোলাই ছিল। মিহির মুখ দেখা যাচ্ছে না; সে উল্টাদিকের দেয়ালঘেষা চেয়ার টেবিলে বসে কীসব কাগজ নাড়াচাড়া করছে।

বাবুল আমাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে রুমের ভেতর থেকেই বলে, ‘আয়’। কিন্তু পরক্ষণে আমার সাথের আগন্তুককে দেখে কপাল কুঁচকে বলে, ‘ইনি কে?’
আমার সাথে যে এসেছে সে এক সুদর্শন তরুন; এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ করছে; থাকে ভূতের গলিতে – চাচার বাসায়। আমি বললাম, ‘সৈকত।’
বাবুল অস্বস্থি নিয়ে বলল, ‘মানে?’
আমি বললাম, ‘আমিই তাকে নিয়ে এসেছি।’
‘আরে, আমাদের জরুরি কাজ – উনাকে কেন…….?’, বাবুল অধৈর্য হয়ে ওঠে।
ঠিক তখনই মিহি হুট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে, ‘আমি চলি বাবুল ভাই।’
একমাস পর আমি মিহির মুখ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এই কদিন আগেও যে আমার অর্ধাঙ্গ ছিল তাকে কেমন জানি পরাঙ্গ মনে হচ্ছে। যার কোমল চেহারায় আলো বিচ্ছুরিত হত, তা যেন ম্লান হয়ে গেছে। দুচোখের নিচে ছায়া স্পষ্ট। নিশিকাল চুলের গোছা অনাদরে ঘাড়ের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। আমি ত্রস্ত হয়ে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওকে এখানে খুবই প্রয়োজন।’
বাবুল হাত বাড়িয়ে মিহিকে আটকিয়ে বিরক্ত মুখে আমাকে প্রশ্ন করে, ‘কী প্রয়োজন?’
আমি অনুনয় করে বললাম, ‘প্লীজ, আমাকে দশটা মিনিট সময় দেয় তোরা; তারপরই আমি চলে যাব।’
আমার কথা শুনে একমুহুর্ত স্থির হয়ে বাবুল বলল, ‘ভাবী, একটু সময় দেন, প্লীজ; শুনি কী বলতে চায় ও।’

ভিতরে গিয়ে বসার পর বাবুল তাচ্ছিল্যসুরে বলল, ফ্লাস্কে চা আছে, খেলে খা; প্যাকেটে বিস্কিট আছে।’
আমিতো আর চা খেতে যাইনি। বললাম, ‘সে পরে হবে।’ তারপর সৈকতকে বললাম, ‘সৈকত, বল তোমাকে নিয়ে এলাম কেন।’
সৈকত একটু দূরে বাবুলের খাটের এক পাশে বসেছিল। আমার বলা শেষ না হতেই সে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে মিহির সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত জোড় করে বলল, ‘প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দিন; সব দোষ আমার।’
ঘটনার মাথামুণ্ডু মিহি কিংবা বাবুল কারো বোধগম্য নয়। বাবুল রেগে গিয়ে আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এসব কী রে?’
এর পরের এপিসোডটি অনেকটা নাটকের সিকোয়েন্সের মতই। কৈফিয়ত-বিশ্বাস-অবিশ্বাস-চিৎকার-চেচামেচি-কান্না-প্রত্যাখ্যান। প্রতিবেদন আকারে বলতে গেলে ব্যাপারটি মোটামুটি এরকম:
মিহির লঘুপাপে গুরুদণ্ড প্রদানের কারণে আমি যে মুষড়ে পড়েছি তা বলা বাহুল্য। হয়তো তাকে আর ফেরানো যাবে না তা জেনেও এ দণ্ড যে আমার প্রতি অবিচার তা প্রমাণ করার জন্য গত কয়েকদিন আদাজল খেয়ে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করেছিলাম। সৈকত তারই একটা অনুষঙ্গ। আরোও লক্ষ লক্ষ দুষ্ট লোকের মত সে-ও একজন; তবুও আমার দুর্যোগের কথা শুনে লজ্জার মাথা খেয়ে সে আমাকে উদ্ধার করতে চলে এসেছে। সে বারংবার ক্ষমা চেয়েছে মিহির কাছে, স্মার্টফোনে তার ফেক আইডি দেখিয়েছে, বলেছে ফান করার জন্য সে রেহনুমা নামে ফেক আইডি খুলে অনেকের সাথেই দুষ্টুমি করেছে – সেভাবে আমার সাথেও করেছে; সে নিজে মেয়ে সেজে ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করে প্রেমের অভিনয় করতো এবং বিভিন্ন ধরনের মেয়েদের ছবি আদান-প্রদান করতো। কিন্তু কে শুনে কার কথা! মিহি রাগের মাথায় এটা ওটা ছুঁড়ে ফেলেছে কথার ফাঁকে ফাঁকে। একবার তেড়ে এসেছে সৈকতের দিকে; বলেছে, ‘অভিনয়তো ভালই জানেন দেখছি’। বাবুলের ঘোর কেটে যাবার পর সে-ও কাকুতি-মিনতি করে বলেছে, ‘ভাবী, আমি এখন বুঝতে পারছি মিশু তেমন কোনো অপরাধ করেনি; সৈকতের মিথ্যে ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল। আপনি ব্যাপারটা ভুলে যান, প্লীজ!’ তাদের কোলাহলের মধ্যে আমি শুধু একটা কথাই বারদুয়েক বলেছি, ‘আই অ্যাম স্যরি! আমার এমন দুষ্টামিতে জড়িয়ে পড়া ঠিক হয়নি।’ এতকিছুর পরেও মিহির এক কথা, ‘আমার সিদ্ধান্তই ফাইন্যাল। ’

ঝড়ো পরিবেশে পড়ে সৈকত ভড়কে যায়; সবিস্তারে তার কৈফিয়ত উপস্থাপনের পর আমাদের অনুমতি নিয়ে সে পালিয়ে বাঁচে। মিহিও বার বার উঠি উঠি করছে, আর বাবুল তাকে ঠেকিয়ে রাখছে। আমিও যখন বুঝলাম যে আমার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে তখন অজান্তেই আমার চোখ দুটি ভারী হয়ে এল। মিহির সাথে কাটানো প্রেম-পরিণয়ের দিনগুলো মাথার মধ্যে অনবরত ফ্লাশব্যাক করে যাচ্ছে। খুব সাবধানে শার্টের আস্তিন দিয়ে চোখ মুছে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বাবুলকে বললাম, ‘চলি।’
সেই মুহুর্তে মিহি বজ্রকন্ঠে বলে উঠল, ‘বাবুল ভাই, আমার দেয়া শার্ট আর হাতঘড়িটা ওকে খুলে রেখে যেতে বলুন।’
কী অপমান! কী সাংঘাতিক অপমান! আমাদের প্রেম যখন প্রায় পরিণত হয়ে এসেছে তখন মিহি একদিন আমাকে আড়ং থেকে একটা সিল্কের শার্ট এবং বায়তুল মোকাররম থেকে একটি ওমেগা ঘড়ি উপহার দিয়েছিল। মিহির দেয়া উপহার আমার কাছে হীরার চেয়েও মূল্যবান। তার জোরাজুরিতে মাত্র দুদিন পরেছি; বলেছি এ অমূল্য সম্পদ আমি সারাজীবনের জন্য সঞ্চয়ে রেখে দেব – ব্যবহার করে নষ্ট করব না। এই সংকটকালীন সময়ে আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি বলে তার দেয়া উপহারগুলো আজ পরে এসেছিলাম । কিন্তু এরকম অপমানজনক পরিস্থিতিতে যে পড়তে হবে তা জানতাম না। আমি বাবুলের মন্তব্যের অপেক্ষা না করেই দ্রুততার সাথে গা থেকে শার্টটা খুলে ফেলি। হাতঘড়িটাও খুলে রাখি বাবুলের খাটের ওপর। বাবুল তখন হৈ চৈ করে বলল, ‘কী করছিস, কী করছিস! এই আদুল গায়ে কই যাবি? নে নে, আমার একটা শার্ট পরে নে।’

আমার মাথা এখন ফাঁকা। বাবুলের কথা কানে ঢোকে না। আমি হনহন করে বাবুলের রুম থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি। সিঁড়ি বেয়ে কে উঠছে কে নামছে কিংবা আমার খালি গা দেখে কেউ হাসছে কিনা সেদিকে আমার খেয়াল নেই। তখনই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন আমার ঘাড়ে খামছি মারল। রাগে আগুন হয়ে আমি পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়াই।
‘যাবি কোথায়, বদমাশ?’ বলে এবার আমার লোমশ বুকে সে দুহাত দিয়ে খামছে ধরে। মনে হল কয়েকটা নখ আমার চামড়া ফুঁড়ে ঢুকে গেছে। আমি স্থিত হবার আগেই সে আমাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে, এবং প্রায় একই সাথে তার ঠোঁট দিয়ে ক্লিপ করে দেয় আমার মুখ। শ্বাস নেবার জন্য কোনোক্রমে ক্লিপমুক্ত হয়ে তাকিয়ে দেখি অদূরে বাবুল শয়তানের মত মুখ চেপে হেসে হেসে তার রুমের দিকে ফিরে যাচ্ছে।
‘আমার বারটা বাজিয়ে দিয়ে তুই মিস্টার ক্লীন হতে চাস?’ বলে স্থান-কাল-পাত্রের তোয়াক্কা না করে মিহি এবার তার ধারাল দাঁতের পাটি বসিয়ে দেয় আমার নাজুক ঠোঁটের ওপর।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত বরাবরের মত ভাললাগা তৎসহ শুভকামনা রইল ।
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
রঙ পেন্সিল পরিপাটি গল্প। কোথাও ছন্দপতন নেই। এক কথায় চমৎকার!
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
অনেক ধন্যবাদ। সাথে থাকুন।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
ফয়জুল মহী নিপুন ভাবনা।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
Neerob ভালো লেখা। ভোট আর আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
গোলাপ মিয়া অসাধারণ লাগল প্রিয়। ভোট রইল। আমার গল্প কবিতায় আপনাকে আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ভালবাসার গল্পের অনেক আকার প্রকার আছে। আমার গল্পে এরকম একটি উপাখ্যান আছে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪