শামসুল হকের প্রত্যাবর্তন

বাংলাদেশ (ডিসেম্বর ২০১৯)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৪৬৩
অক্টোবরের মিঠে মিঠে শীতের সন্ধ্যায় দেশি রেস্তোরাঁয় কফি খেয়ে শুক্কুর মিয়ার সাথে গল্প করতে করতে জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ ষ্ট্রিট ধরে শামসুল হক হেঁটে হেঁটে যখন ঘরে ফিরছিলেন তখন শুক্কুর মিয়া মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেছিলেন, ‘হবে না।’

শামসুল হক হাঁটা থামিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বলেছিলেন, ‘হবে না মানে? কেন হবে না? পেটের দায়ে অর্ধেক জীবনইতো কাটিয়ে দিলাম বেজাত-কুজাতের দেশে, এখন মরবোও নাকি এখানে?’

বৈবাহিক সূত্রে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আমেরিকায় আসা সিলেটের শুক্কুর মিয়া পান খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তেই পারেননি। বিশেষ করে অবসরে-আড্ডায় সুগন্ধী জর্দা দিয়ে পান চিবানো তার প্রিয় অভ্যাস। তিনি শামসুল হকের কথার প্রতিক্রিয়ায় নিজের বাম গালের পান-সুপোরি জিহবা দিয়ে ঠেলে ডান গালে এনে বলেছিলেন, ‘আমার কথার গূঢ় অর্থ এখন বুঝবেন না; সময় এলে বুঝবেন।’

না, শুধু শুক্কুর মিয়াই নন, নিজের স্ত্রী সালেহা খাতুন, ছেলে মিলন ও শুভ, মেয়ে রাফিয়া এবং স্মার্ট জামাই বেলাল, কেউই শামসুল হককে বুঝাতে সক্ষম হননি। তার একই কথা, ‘ঢের হয়েছে; আমার মিশন কমপ্লিট। আমি আর এদেশে থাকব না। তোমাদেরতো আর যেতে বলছি না; তোমরা তোমাদের মত করে সুখে-শান্তিতে থাক। ’

শেষপর্যন্ত নাছোড় বান্দার মত আমেরিকার বন্ধন ছিঁড়ে বছর খানেক আগে স্বদেশে ফিরে এলেন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রাইমারি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শামসুল হক। শহরাঞ্চলে কোনো বিষয়-সম্পত্তি না করলেও গ্রামে জমিজমা করেছেন অনেক – বেঁচে থাকা অবধি বাপই নিজে খেটেখুটে জায়গাজমি কিনেছেন যতটুকু পেরেছেন। কিন্তু জোতদারি সুখ পুরোপুরি উপভোগ করার আগেই তিনি পরপারে চলে যাওয়াতে সংসারের দায়িত্ব এসে বর্তায় ছোটভাই কামরুল হকের উপর। তখন থেকেই জমি ছাড়াও বাজারের দোকানপাট, ট্রাক-ট্রাক্টর ইত্যাদি কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ কামরুল হকই করে আসছেন। এমন কি বাড়িতে বিশালাকার দালান, কারুকাজ করা বেষ্টনী দেয়াল সবই তিনি একহাতে করেছেন। শামসুল হক চার-পাঁচবার দেশে এসে সাংসারিক উন্নতি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। এই ভেবে আরোও খুশি হয়েছেন যে ভাইটি ছিল বলে পরিবারের এই রঙ-রূপ পাল্টেছে, নইলে শুধু শুধু টাকার বস্তা দিয়ে তিনি কি কিছু করতে পারতেন।

কিন্তু এক বছর হেসে খেলে কাটানোর পর হঠাৎ শুক্কুর মিয়ার কথা মনে পড়ল শামসুল হকের।

আমেরিকা-ফেরৎ শামসুল হকের বিগত বছরটাই ছিল ঘটনাবহুল। কিছুদিনতো কেটে গেল পুরনো বন্ধু-সাথিদের সাথে গালগল্পে। মেহমানদারীও করতে হল বেশ কিছুদিন। নিকটাত্মীয়, দূরাত্মীয় সবাই পরমাত্মীয় হয়ে ভিড় জমিয়েছিল দেশে ফেরার পরপরই। শামসুল হক সবাইকে কমবেশি খুশি করেছেন। বিদেশি উপহার তেমন দিতে না পারলেও নগদ অর্থ ধরিয়ে দিয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আমেরিকার বিভিন্ন বেনিফিট স্কীমের সাথে বোঝাপড়া করে বেশ বড় অংকের ফান্ড নিয়ে এসেছিলেন তিনি। আসার সময় স্ত্রী-পূত্রদের জোর দিয়ে বলে এসেছিলেন, ‘আমার জন্য তোমাদের চিন্তা করতে হবে না; দেশে যা আছে তাতেই আমার ভালভাবে চলবে ইনশাল্লাহ। ’

প্রারম্ভিক সামাজিকতা পর্ব শেষে হয়ে গেলে মোটামুটি নিরবচ্ছিন্ন ঝর্ণাধারার মতই শেষ জীবনটা কেটে যাবার কথা। কিন্তু কিছু অবাঞ্ছিত ও অনির্ধারিত বিষয় ক্রমান্বয়ে জীবনযাত্রায় যোগ হওয়ার ফলে শামসুল হকের সার্বিক পরিকল্পনার ছক একটু গোলমেলে হয়ে যায়। স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদে তিনি আগেও নিয়মমাফিক দান করে এসেছেন, দেশে আসার পরও যথাসম্ভব সেই দায়িত্ব পালন করবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ঝামেলা বেঁধেছে অন্যখানে। এখন তাকে ওয়াজ মহফিলসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রায়শই প্রধান অতিথি হতে হয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি মর্যাদার ব্যাপার বটে। প্রথম প্রথম তিনি এটা বেশ উপভোগও করেছেন। কিন্তু এটার পুনরাবৃত্তি ক্রমশ ঘটতে থাকলে তিনি বুঝতে পারেন এসব একটি অলঙ্ঘনীয় বিপত্তিও বটে। মর্যাদার মূল্য চুকাতে গিয়ে তাকে প্রতিবারই বড় অংকের চাঁদা দিয়ে হয়, কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্মাণব্যায়ের সিংহভাগ বহন করতে হয়। উটকো ঝামেলা হল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপদ্রব। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন তাকে সরকারপক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করে; কিন্তু মনে করলেও তাদের সংগঠনের কার্যক্রমে তাকে যুক্ত করার আগ্রহ দেখায় না। বিপরীতে বিরোধী শিবিরে তার বেশ কদর। এর একটা বড় কারণ হল, শামসুল হকের ভাতিজা, বদরুল হক, এখন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন সভাপতি এবং একই সাথে উপজেলা সহ-সভাপতি। ভাতিজা ও তার সহকর্মিদের পীড়াপীড়িতে শামসুল হককে বিশেষ অতিথি হয়ে দু’বার তাদের সভায় যেতে হয়েছে। স্বভাবতই এতে তার জটিলতা বেড়েছে।

জামাই বেলাল মাঝে মাঝে ফোন করে বলে, ‘আব্বা, অনেকদিনতো থাকলেন। এবার চলে আসেন; আপনার নাতি-নাতনিরা আপনার কথা বলে, কান্নাকাটি করে …।’ কিন্তু শামসুল হকতো চলে যাবার জন্য আসেননি। শেষ জীবনটা আরাম আয়েশে দেশের মাটিতে কাটিয়ে দেবার জন্য এসেছেন। প্রচণ্ড উন্মাদনা নিয়ে যুদ্ধ করে দেশের মাটি শত্রুমুক্ত করে বড় বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষত শুকোবার আগেই যখন দফায় দফায় শকুনের পাল এটাকে ছেঁড়াখোঁড়া করতে আরম্ভ করল তখন অনেকের মত শামসুল হকেরও ঘুম ভেঙ্গে গেল। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য অবশেষে তিনি একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকুরি নেন। আই.এ. পাশের যোগ্যতা থাকায় এক পর্যায়ে যখন প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পেলেন তখনই OP-1 লটারিতে তার ভাগ্যের মোড় ঘুরে গেল। লটারি জেতায় শামসুল হক যতটা না আলোড়িত হলেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি উত্তেজিত হলেন পরিবারের লোকজন। বন্ধুরা এসে বলল, ‘খরচপাতি যা লাগে আমরা দেব, তুই যা; দেশপ্রেমে গুল্লি মার।’ অগত্যা নতুন জীবনের আশায় দেশপ্রেমের খোলস দেশে ফেলেই বউ-বাচ্চাসহ তিনি আমেরিকায় অভিবাসী হন। তারপর অতি স্বাভাবিকভাবে অন্য সবার মত তার জীবনধারাও পাল্টে যায়। বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, দোকানে কাজ করতে করতে একসময় বেশি উপার্জনের আশায় ট্যাক্সিচালক হয়ে যান। প্রচুর টাকা-পয়সার মালিকও হন; দেশের সয়-সম্পত্তি বলতে গেলে পুরোটাই তার উপার্জনের টাকা দিয়ে করা। নিউইয়র্কেও বাড়িঘর করে বেশ সচ্ছলভাবে চলছিলেন তিনি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার সেই পুরনো ব্যথাটা চিনচিন করে বাড়তে থাকে: জীবন বাজি রেখে যে দেশটা স্বাধীন করলাম, সেই মাটিতে কি মরতেও পারব না? তাই গোঁ ধরে তার দেশে ফিরে আসা।

সেদিন নাস্তার টেবিলে বসে শামসুল হক একথা সেকথা বলতে বলতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ভাতিজা বদরুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে সভাপতি বানাল কে?’

চাচার প্রশ্নের ধরন দেখে বদরুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে একজন লিডার। কত ছেলেবুড়ো তার পেছন পেছন ঘোরে। জেলা উপজেলার বাঘা বাঘা নেতাদের সাথে তার ওঠাবসা। চাচার বেমক্কা প্রশ্ন শুনে আশ্চর্য হয়ে তার মুখের দিকে তাকায় বদরুল।

‘আচ্ছা, নেতাগিরি করতে গেলেতো লেখাপড়া লাগে।’ চাচা ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘তুইতো কত চেষ্টা করে মেট্রিক পাশ করতেই পারলে না…।’

বদরুল বলতে পারত বা এটা তার মনেও ছিল যে নেতা হওয়ার জন্য লেখাপড়া মুখ্য ব্যাপার নয়, অন্যসব যোগ্যতাও থাকতে হয়। কিন্তু সোনার ডিমপাড়া চাচার মুখের ওপরতো এসব কথা বলা যায় না। তাই আমতা আমতা করে বলল, ‘লোকজন জোর করে বানায়ে দিছে।’

শামসুল হক সেদিনই মনস্থ করলেন সার্বিক বিষয় নিয়ে একবার ছোটভাই কামরুলের সাথে বসতে হবে। কিন্তু অতি ব্যস্ত কামরুলকে রাতের বেলা ছাড়া দেখাই যায় না।

কামরুলকে দু’চার দফা তাগাদা দেয়ার পরও যখন তিনি বড়ভাইয়ের সাথে বসার সময় বের করতে পারছিলেন না তখন শামসুল হক বাধ্য হয়েই তাকে জানালেন যে একটা জরুরি বিষয় নিয়ে তিনি তার সাথে কথা বলতে চান। কামরুল সেদিন দুপুরেই বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘ভাইজান, বেশি জরুরি হইলে এখনই বইলা ফালান; কোনো অসুবিধা নাই।’

শামসুল আলম অন্য কোনো বিষয়ে না গিয়ে বললেন, ‘আমিতো একটা ওয়াদা করে ফেলেছি। মাদ্রাসা-লাগোয়া দশ ডেসিম্যাল জায়গা আমি সদকায়ে জারিয়া হিসেবে তাদের দিয়ে দেব বলে কথা দিয়ে এসেছি। ’

বড়ভাইয়ের কথা শুনে কামরুল আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘এ কী কন ভাইজান, বাজারের পাশের এই মূল্যবান জমি আপনি মাদ্রাসায় দিয়ে দিবেন? না-না, এইটা দিয়েন না। যখন বইলা ফালাইছেন, দেখি অন্য কোথাও থাইকা দেয়া যায় কিনা।’

ছোটভাইয়ের এমন প্রতিক্রিয়া শামসুল হক আশা করেননি। বেশুমার জায়গাজমি তার পাঠানো অর্থেই কেনা হয়েছে। নিজের পয়সায় করা সম্পদের ব্যাপারে এটাই তার প্রথম কোনো সিদ্ধান্ত। কামরুল এভাবে তার সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিল। তিনি একটু জেদের সাথেই বললেন, ‘যেটা বলে ফেলেছি, বলে ফেলেছি; ওয়াদার বরখেলাফ করা যাবে না। এই জায়গাটুকু পেলে মাদ্রাসাটা বড় করা যাবে। তুমি জায়গার দলিলটা আমাকে দিয়ো।’

কামরুল কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যান। এবং সেদিন রাতে আবার তাদের দেখা হলেও জমির ব্যাপারে কেউ কোনো কথা বলেননি।

পরদিন সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে ভাতিজা বদরুলসহ বসে নাস্তা খাচ্ছিলেন শামসুল হক। তখন আমতা আমতা করে বদরুলই কথা উঠায়, ‘চাচা আপনি নাকি বাজারের জমিটুকু মাদ্রাসায় দিয়া দিবেন?’

শামসুল হক ভাতিজার ধৃষ্টতা দেখে একটু চমকে উঠেন। বড়দের বিষয়ে এই পুঁচকের নাক গলানো তার পছন্দ হয়নি। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, দিয়ে দিলাম; পরকালের জন্যও কিছু করতে হবেতো।’

‘না মানে এইখানেতো একটা মার্কেট উঠামু; প্ল্যান কইরা রাখছি।’ বলে, বদরুল আঁড়চোখে চাচার দিকে তাকায়।

ভাতিজার কথায় রাগ হলেও শামসুল হক সংযত থাকলেন। বললেন, ‘এখানে মার্কেট না করলেও চলবে। আর আমি যখন চলে এসেছি তখন কিছু করতে হলে ভেবেচিন্তে আস্তেধীরেই করব। তোদের চিন্তা করতে হবে না।’

বদরুল বলল, ‘আপনিতো এতদিন বিদেশে কষ্ট করলেন, এখন আরাম করেন; যা করার তা আমরাই করব।’

‘মানে কী?’ শামসুল হক একটু বিরক্ত হলেন, ‘সবার জন্য কষ্ট করেছি তা ঠিক; কিন্তু এখন আল্লাহ্র নামে কিছু দান-খয়রাত করব, এতে তোমরা বাধা দিচ্ছ কেন?’

বদরুল এবার বেয়াড়ার মতই বলল, ‘দান-খয়রাত করবেন, করেন; টাকাপয়সা আছে, কিছু টাকা দিয়া দেন…’

শামসুল হক এবার রেগে যান। বলেন, ‘অ্যাই, তোকে এসব নিয়ে কথা বলতে কে বলেছে; আমি আমার টাকা দেব না জমি দেব সেটা আমি বুঝব। তুই এসব ব্যাপারে কথা বলবি না। তোর বাপ বাড়িতে এলে ওই জমির দলিলটা আমাকে এনে দিসতো।’

বদরুল টেবিল থেকে উঠতে উঠতে বলল, ‘দলিল সবগুলাতো আমার কাছেই রাখা। আর আপনি দলিল নিয়া কী করবেন? আব্বাওতো এই জমি ছাড়বোনা।’

শামসুল হকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তিনি ধমক দিয়ে বলেন, ‘অ্যাই দাঁড়া, তোর বাপ জমি ছাড়বোনা; কথাটার মানে কী? আমার জমি, আমি আল্লাহ্র ওয়াস্তে দান করব; এতে তোর আর তোর আব্বার সমস্যা কী?’

বদরুল তখন আসল বোমাটা ফাটায়, ‘জমিতো আপনার না, আব্বার নামে কেনা।’

শামসুল হকের মনে হল এই প্রথম তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেলেন। তিনি ভাতিজার কথার প্রত্যুত্তর না করে ঝিম ধরে বসে রইলেন। তার মনে হল এতদিন তার চোখের ওপর যে ঠুলি ছিল তা খসে পড়ল। নাস্তা সেরে তিনি প্রাত্যহিক নিয়ম ভঙ্গ করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অনেকবার কামরুল ও বদরুলের কাছ থেকে ফোন এলেও শামসুল হক কল রিসিভ করলেন না। তার স্কুলবন্ধু ও সহযোদ্ধা করিম বখশের বাড়িতে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে দুই বন্ধু এক বিছানায় গড়াগড়ি করলেন। করিম বখশও বন্ধুর অবস্থা জেনে মর্মাহত হলেন। শামসুল হকের পিতা বেঁচে থাকা অবস্থায় যখন জমিজমা কিনছিলেন তখন করিম বখশও বিভিন্নভাবে তাকে সহায়তা করেছেন। কয়েকবার সাক্ষী হিসেবে জমির দলিলে সইও করেছেন। ওই জমিগুলা শামসুল হক ও কামরুল হকের যৌথ নামেই তাদের পিতা কিনেছিলেন বলে জানালেন করিম বখশ। কিন্তু ভাতিজা বদরুলের বক্তব্যে যখন জানতে পারলেন বাজারের অর্থাৎ মাদ্রাসা-লাগোয়া জমিটি কামরুল তার নিজের নামেই কিনেছেন শামসুল হকের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে গেল যে শুধু ওই জমিই না, পিতার মৃত্যুর পর কামরুল যা সয়-সম্পত্তি করেছেন সবটুকু না হলেও বেশির ভাগই হয়ত একা তার নামেই করেছেন। শামসুল হকের সব কথা শুনে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে রহিম বখশ বললেন, ‘তুমি চিন্তা কইরোনা, বিষয়টা লজ্জার; আমি চুপি চুপি ব্যাপারটা তলাইয়া দেখমু।’

শামসুল হক রাতে বাড়িতে ফিরলেন ঠিকই, তবে তার আকস্মিক অন্তর্ধান নিয়ে কেউই কোনো কথা বললেন না। হয়তো করিম বখশই কামরুলকে এ ব্যাপারে কোনো ইশারা দিয়ে গেছেন, তাই। প্রায় চুপচাপ অবস্থায় খাওয়াদাওয়া শেষ হলে কামরুল নিচু গলায় বললেন, ‘ভাইজান, ওই জমিটা মাদ্রাসায় দিয়া দিমু, আপনি টেনশন নিয়েন না।’

কামরুলের অনুমোদন পেয়ে মনে মনে হাসলেন শামসুল হক – কার সম্পদ আর কে অনুমোদন দেয়! তিনি কিছু না বলে নিজের কক্ষে গিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেন। পরক্ষণে হঠাৎ শুক্কুর মিয়ার কথা মনে পড়ায় ইমো’তে শুক্কুর মিয়াকে কল করলেন।
………
- আরে হক সাহেব; স্লামালেকুম; কেমন আছেন? এতদিন পর মনে পড়ল?
- আরে ভাই, মনে সবসময়ই পড়ে; কেমন আছেন? নাতি-পুতি?
- মাশাল্লাহ্, খুব ভাল। নিউইয়র্কে স্নো পড়েছেতো; লনে নাতি-নাতনির সাথে ঢিলাঢিলি খেলছি…হা হা হা।
- আমিও আছি, ভাল আছি।
- একেবারেই চলে গেলেন; আসেন, একবার ঘুরে যান।
- হ্যাঁ হ্যাঁ আসব; এখন মনে হচ্ছে আসা দরকার।
- আচ্ছা! তো কবে আসছেন?
- জানাব। এদিকে কিছু কাজ আছে। শেষ করে আসব। জানাব, সব ঠিক হলে পরে আপনাকে কল দেব।
- তাহলে ঠিক আছে, কথা হবে ইনশাল্লাহ। ও হ্যাঁ, আসার সময় কৌশল করে সিলেটের কিছু খাসিয়া পান আনার চেষ্টা করবেন…হা হা হা।

দু’চারদিন পর করিম বখশ যখন স্পর্শকাতর বিষয়টা নিয়ে গোপনে কামরুল ও তার ছেলে বদরুলের সাথে বসলেন তখনই থলের বিড়াল বেরিয়ে এল। কামরুল অকপটে জানালেন তিনি নিজে যে জমিজিরেত কিনেছেন তার অধিকাংশই নিজের নামে করেছেন। তার যুক্তি হল, বড়ভাইয়েরতো কোনোকিছুরই অভাব নেই; তাছাড়া তিনি আর দেশে ফিরে আসবেন এটা কেউই ভাবেনি; এক্ষেত্রে দুই ভাইয়ের নাম থাকলে সম্পত্তির মালিকানা এবং প্রয়োজনে বেচাবিক্রির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অসুবিধা হবে, তাই তিনি বুদ্ধি করে এই কাজটা করেছেন।

করিম বখশ দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘অন্যায়তো করছোই, তার উপর এইটুকু জাগা নিয়া কেঁচো খুঁড়াখুঁড়ি করতে গেছ কেন? যখন সে জমিটা মাদ্রাসায় দিব কইছে তখন চুপ কইরা দিয়া দিতা। সে জানতোই না এইটা কার নামে রেকর্ড হইছিল। তা না; কিছু না ভাইবা মুখের উপর না কইয়া দিলা। আর তোমার পোলা – মাথায় গোবর নিয়া নেতাগিরি করে, বক্তৃতা কইরা কইল যে এটা তার বাপের জাগা। এইবার ঠেলা সামলাও।’

মাসের শেষদিকে জুমার দিন মসজিদে মিলাদ দিলেন শামসুল হক। এটা তিনি প্রায়ই করেন। আজকের মহফিলে করিম বখশও এসেছেন। শামসুল হক সবার সাথে কথা বললেন; নতুন করে মুর্দেগানের জন্য দোয়াও চাইলেন। দুপুরে একসাথে বন্ধু করিম বখশকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করলেন। গত সপ্তাহে করিম বখশ কায়দা করে অপ্রীতিকর ব্যাপারটার একটা আপাত সুরাহা করেছেন। কামরুল ছেলেকে নিয়ে বড়ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং এও বলেছেন যে বড়ভাই চাইলেই জমিজমার পাওয়ার অব এটর্নী তাকে দিয়ে দিবেন। তবে শামসুল হক পাওয়ার অব এটর্নী চাননি, শুধু বলেছেন যে আপাতত যেভাবে আছে সেভাবে থাক।

সন্ধ্যার দিকে করিম বখশ একটা সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে হাজির হন। বদরুলের মা আর কাজের মহিলা ময়নার মা আড়াল থেকে মাথা বের করে আঁচ করতে চেষ্টা করলেন যে কোনো মেহমান এসেছে কিনা। কামরুল ও বদরুলের এখনও ফিরে আসার সময় হয়নি। শামসুল হক মোটামুটি তৈরি হয়েই ছিলেন; সাথে নেবার স্যুটকেসে কিছু কাপড়চোপড় ও জরুরি জিনিস নিয়েছেন। একটি স্যুয়েটার ও জ্যাকেট হাতে করে নিবেন বলে পাশে রেখেছেন। বদরুলের মায়ের সাড়া পেয়ে শামসুল হক বললেন, ‘বদরুলের মা শোনো; জরুরি কাজের জন্য আমকে এখুনি চলে যেতে হবে। ওদের সাথে দেখা হল না; তোমরা ভাল থেক।’

বদরুলের মা হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘এসব কী বলতাছেন ভাইজান? বদরুলের বাপ যে কুন রাইতে আইব; খাড়ান, আমি তারে ফোন করি। ’ এই ফাঁকে করিম বখশ স্যুটকেসটি অটোরিক্সায় তুলে ফেলেছেন।

শামসুল হক ‘না না’ বলে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন। ‘আমার দেরি হয়ে যাবে; ফ্লাইট মিস করব।’ তারপর স্যুয়েটার আর জ্যাকেট দুটি হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যান।

অটোরিক্সা বড় রাস্তায় ওঠার পর শামসুল হক বন্ধু করিম বখশকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘অনেক বিরক্ত করলাম তোমাকে; জীবনে আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা জানিনা। আমাকে মাফ করে দিয়ো। ’

করিম বখশ কোনো কথা না বলে শুধু চোখ মুছতে থাকেন। আসলেই তার বলার কিছু নেই। গত এক বছরে অনেক বলাবলি, স্মৃতিতর্পণ হয়েছে। যুদ্ধের কথা, দেশের কথা, সমাজের মূল্যবোধের কথা এবং শ্বাসরুদ্ধ সময়ের কথা কিছুই বাদ যায়নি।

আরোও কিছু অশ্রুভেজা কথা বলতে বলতে গাড়ি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলে এলে শামসুল হক ভাঙ্গা গলায় বললেন, ‘দোস্ত, বড় আশা করে রক্ত দিয়ে কেনা নিজের দেশের মাটিতে শেষ শয্যা নেব বলে এসেছিলাম, তা আর হল না।’ তারপর বামহাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ডানহাত পকেটে ঢুকিয়ে একটি দশহাজার টাকার বাণ্ডিল বের করে তিনি করিম বখশের শার্টের বুকপকেটে জোর করে ঢুকিয়ে দিলেন।

করিম বখশ না না বলে লাফিয়ে উঠলেও কোনো লাভ হল না। ইতিমধ্যে অটোরিক্সা এয়ারপোর্টের প্রবেশদ্বারের সামনে এসে থেমে গেলে শামসুল হক গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘দশ হাজার টাকার মূল্য কিছুই না, কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার ভালবাসা আরেকজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার কাছে অমূল্য। যতদিন বেঁচে থাকবে এই ভালবাসা নিয়েই বেঁচে থেক। ’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহা রুবন ভেবেছিলাম পরে পড়ব। আপনার লেখনি শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য করলো বাস্তব সমাজের চিত্র এঁকেছেন শেষটায় উঠেছিল।
ভালো লাগেনি ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯
আপনি পড়েছেন এতেই আমার আনন্দ। অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯
MD. MOHIDUR RAHMAN অনেক ভালো লেগেছে....
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯
মোঃ মোখলেছুর রহমান অনেক শুভ কামনা ভাই।
দোয়ার দরখাস্ত।
ভালো লাগেনি ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯
Abdul Hannan জামাল ভাই সুন্দর লেখা।
অনেক ধন্যবাদ।
নাস‌রিন নাহার চৌধুরী বাস্তবেও তাই হয়। এমন ঘটনা অনেক আছে। পড়তে ভালো লেগেছে। ভোট রইলো।
অনেক ধন্যবাদ।
Tahmina Alom Mollah জীবনের গল্প। শেষে একটা ব্যথা ভাব থেকে গেল - এটাই আপনার সার্থকতা। আশা করছি এটাই আপনাকে লেখা আমার শেষ মন্তব্য। ... বেশী বলে বিরক্ত বাড়াবো না। ভাল থাকবেন।
আপনি আমার গল্পের প্রথম পাঠক ও প্রথম মন্তব্যকারী। অতএব আপনার মূল্য আমার কাছে অনেক। কোন মন্তব্য না করলেও আশা করি মূল্যবান পাঠক হিসেবে পাশে থাকবেন। কৃতজ্ঞতা।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

যারা বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল তারা যেখানেই থাক না কেন, তাদের হৃদয়ের একটি কোণে বাংলাদেশ ঝিম মরে পড়ে থাকে। শামসুল হকের বুকের ভেতরের বাংলাদেশ যখন আড়মোড়া ভাঙল, তখন তিনি বিদেশ-বিভুঁইয়ে আপনজনদের ফেলে স্মৃতি আর স্বপ্নঘেরা প্রিয় নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন। পরিবর্তিত বাংলাদেশের আপ্যায়নে তার মোহমুক্তি ঘটলে তিনি আবার তার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে যান। গল্পে এই আখ্যান রূপায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪