হাশেমের মা

মা (মে ২০১৯)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ৭৭
উঠানের দক্ষিণ পাশের বড় কাঁঠাল গাছের নিচে মেহগনি কাঠের তৈরি হাতলওয়ালা চেয়ারে বসেছেন যদু মুন্সি। ফাল্গুন মাসের সকাল। রোদ এখনও তেতে উঠেনি। একটি ছেলে হুট করে কোথা থেকে একটি হুকা নিয়ে এসে হাজির। তা দেখে যদু মুন্সি ধমক দিয়ে ওঠেন, ‘এখন কিসের হুক্কা? আইজ জুম্মাবার না, নামাজে যামু। আর হুক্কা টানুম না। ’

ছেলেটি শরীর বাঁকা করে ছিলিমে ফু দিতে দিতে বলে, ‘কিছুই হইব না চেয়ারম্যান সাব, কুল্লি কইরা ফালাইবেন।’ তারপর সে হুকার নলটি চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে ধরিয়ে দেয়।

যদু মুন্সি হুকাতে ঘন ঘন কয়েকটি টান দিয়ে ডাক পাড়ে, ‘কাঞ্চন কই গেলিরে?’ কাঞ্চন যদু মুন্সির সার্বক্ষণিক হুকুমবরদার। বিড়ির পাছা মাটিতে ঘষতে ঘষতে পুকুর পাড় থেকে সে জবাব দেয়, ‘আইতাছি চাচাজান। ’ তারপর এক দৌড়ে যদু মুন্সির সামনে এসে হাত কচলাতে কচলাতে সে বলে, ‘এই তো আইয়া পড়ল, বেশি দূরে নাই।’

যদু মুন্সি আবার ধমক লাগায়, তোগোরে কইলাম আজ শুক্রবার। নামাজের দিন। তোরাতো দেরি কইরা ফালাইতেছস।’

বৈঠক বসেছে হাশেম দফাদারের বাড়িতে । মাত্র দু’খানা ঘর এ বাড়িতে। হাশেম দফাদার এবং তার চাচা আলিম দফাদার পাশাপাশি ঘরে বাস করে। যদু মুন্সি টানা কুড়ি বছর চেয়ারম্যানগিরি করেছেন । বয়স হয়ে গেলেও লোকজন তার ছেলে যে কিনা বর্তমান চেয়ারম্যান তাকে না ডেকে যদু মুন্সিকেই বিচারসালিশে টেনে নিয়ে যায়। চেয়ারম্যান না হয়েও এখনো তিনি প্রবল প্রভাবশালী। বিচারের যে রায় দেবেন সবাই তা এক বাক্যে মেনে নেয়। আজকের এই বৈঠকের আয়োজন করেছেন আলিম দফাদার। এই আয়োজনকে বিচার কিংবা সালিশ না বলে বৈঠক বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত এ কারণে যে এই আসরে কোন বাদী বিবাদী বা সাক্ষীর তেমন প্রয়োজন নেই। গ্রামের লোকজন জড় হয়েছে মূলত যদু মুন্সি হাশেম দফাদারের ঘাড় ধরে কেমন করে একটা আছাড় মারেন তা দেখার জন্য। উত্তম-মধ্যমের বেলায় তাঁর বেশ খ্যাতি আছে।

হুক্কা টানা শেষ হলে যদু মুন্সি আলিম দফাদারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ওই জাউরার পুততো দেখি দেরি কইরা ফালাইতাছে, তার মা’রে ডাক। কাম আগাইয়া রাখি। ’ গ্রামে খবর চাউর হতে বেশি সময় লাগে না। দফাদার বাড়ির লোকজনকে মানুষ মোটামুটি সমীহ করতো বা এখনও করে। তাই বাড়িওয়ালার মৃদু আপত্তি থাকলেও ওসবের তোয়াক্কা না করে জনাবিশেক গ্রাম্য লোক যদু মুন্সীকে ঘিরে আলিম মিয়ার উঠানে বসে পড়েছে।
এমন লোক সমাগম দেখে হাশেমের মা বেশ ভড়কে গেছেন। যদু মুন্সি সবার সামনে তাকে তলব করলে তিনি সেখানে যেতে প্রবল আপত্তি জানান। লজ্জা-শরম বলেতো একটা কথা আছে। আলিম দফাদার তাকে বোঝান, ‘ভাবিজান, লজ্জা শরমের আর কি কিছু বাকি আছে? গ্রামের মানুষের কারুর কি আর জানতে বাকি আছে ? দফাদার বংশে এমন কালনাগ দেখার আগে আমাগো মরণ হওয়া উচিত আছিল। এই কলঙ্কের দফারফা করতে অইলে আপনারে যাইতে অইব, চেয়ারম্যান সাবের কাছে সব খুইলা কইতে অইব।’

যদু মুন্সি আবার হাঁক দেন, ‘কি অইল আলিম মিয়া, হাশেমের মা কি আইব না?’ পাশে দাঁড়ানো কাঞ্চন এর দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে ওই জাউরার পুতের আর কতদূর ?’

কাঞ্চন তার ডান হাতটা পূব দিকে প্রসারিত করে তোতলাতে তোতলাতে বলে ‘আর বেশি দূর না। কান্দির হাটে আইয়া পড়ছে। তার শ্বশুরে মোবাইল করছিল। ’

আলিম দফাদার একটি মোড়া হাতে নিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ান । তারপর উপস্থিত গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে নরম সুরে বলেন, ‘ভাই, আপনারা কিছু মনে কইরেন না। আপনারা একটু পুকুর ঘাটের দিকে ঘুইরা আসেন। হাশেমের মা চেয়ারম্যান সাবের লগে একটু কথা কইব। ’ উপস্থিত লোকজন একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বসা থেকে উঠে পড়ে। কেউ কেউ আবার অনুচ্চস্বরে টিপ্পনী কাটে, ‘লুকানোর কী আছে? ঘটনাতো সবাই জানে।’

লোকজন উঠে গেলে লম্বা ঘোমটা টেনে হাশেমের মা চোখ মুছতে মুছতে যদু মুন্সির বাঁ পাশে রাখা মোড়ায় এসে বসেন। আলিম দফাদারও দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে হাশেমের মায়ের পিছনে এসে দাঁড়ান।

ইতিমধ্যে হুকার ছিলিম বদলানো হয়ে গেছে। যদু মুন্সি দুই টান দিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘দেখ হাশেমের মা, তোমার স্বামী আমার খুবই আপন ছিল, আমি তারে ছোট ভাইয়ের মত দেখতাম। এই শরীফ বংশে এমন খবিশ ছেলে জন্মাইল কেমনে?’

হাশেমের মায়ের মুখ দিয়ে কোন কথা সরলো না। তবে ঠিক সেই মুহূর্তে ঘাটের দিকে শোরগোল শোনা গেল। কাঞ্চনের গলাটাই সবচেয়ে উঁচু, ‘আরে মিয়া তোমার লাইগা চেয়ারম্যান সাব সেই সকাল থাইকা বইসা রইছে, এত দেরি অইল কেন ?’ হ্যাঁ, হাসেম ফিরে এসেছে। সাথে তার বউ এবং শ্বশুরও। গ্রামের লোকজন যেন মিছিল করে তাদের বাড়ির ভিতরে এগিয়ে নিয়ে আসছে।

যদু মুন্সি ঘাড় বাঁকা করে তাকিয়ে এক নজর ওদের দেখে বলেন, ‘নবাবপুত্র তাইলে আইছেন। ’ আলিম দফাদার তাড়াহুড়া করে হাশেমের বউকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান এবং ফিরে আসার পথে একটা বেঞ্চি নিয়ে আসেন। যদু মুন্সি হাশেমের শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনি মেহমা্ন। সম্মানিত মানুষ। বসেন। ’ হাশেম বুকের উপর হাত ভেঙ্গে মাথা নিচু করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে।

সওয়াল জওয়াব শুরু হওয়ার আগেই কাঞ্চন কোথা থেকে বরাক বাঁশের একটা কঞ্চি নিয়ে এসে হাজির। যদু মুন্সি কোনো কথা না বলেই কাঞ্চন এর হাত থেকে বাঁশের কঞ্চিটি নিয়ে নেন। তারপর বলেন, ‘হাশেমের মা, এইবার কও। তোমার রাজপুত্রের কাহিনী কও।’

হাশেমের মা মাথা না তুলেই আড়চোখে ছেলের দিকে একবার তাকান। হাশেম মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের লোকজন সবাই আবার বাড়ির ভিতরে চলে এসেছে। কেউ কেউ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বিড়ির শেষাংশ দ্রুত লয়ে টানছে। আলিম দফাদার বিব্রত হয়ে একবার ঘরের দিকে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছে্ন। তিনি জানতেন বিষয়টা সুখকর নয়। এতে বংশের মান ইজ্জতের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মান ইজ্জত বাঁচানোর জন্যই অপারগ হয়ে যদু মুন্সির শরণাপন্ন হতে হয়েছে তার।

হাশেমের মা কোন কথা বলছেন না দেখে যদু মুন্সি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আলিম মিয়া, এতো দেখি আরেক বিপদ। যার জন্য আসা হেইতো কোন কথা কইতেছে না। ’

আলিম দফাদার হন্তদন্ত হয়ে বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাব, আমার মনে হয় ভাবিজান লজ্জা পাইছেন। একটা কথা কই? আপনি যদি অনুমতি দেন তাইলে আমিই শুরু করতাম। ’ তারপর তিনি চোখ কটমট করে একবার হাশেমের দিকে আর একবার তার শ্বশুরের দিকে তাকান। হাশেম পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার শ্বশুর বেঞ্চিতে বসেও যেন কাঁপছেন। তিনি ধারণাও করতে পারেননি তাদের জন্য এরকম একটি লজ্জাজনক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

যদু মুন্সি কিছু বলার আগেই পিছন থেকে বাচাল ধরনের দফাদার বাড়ির এক দূরাত্মীয় গলা বাড়িয়ে বলে, আলিম মিয়া কইব কেন, যার কথা হে-ই কউক। এ কথায় যদু মুন্সি চেতে যান। বলেন, ‘অসুবিধা কি? হাশেমের মায়ের মুখ দিয়া কথা না বাইরালে আমরা কি সারাদিন বইয়া থাকুম? কও, আলিম মিয়া তুমিই কইয়া যাও।’

আলিম মিয়া কোন ভুমিকা ছাড়াই শুরু করেন। ‘চেয়ারম্যান সাব, কি কমু লজ্জার কথা। আমাগো বংশে এইরকম ইতিহাস নাই। আমার ভাইরে আল্লাহ নিয়া গেছে। আর হে রাইখা গেছে এক কুবংশ সন্তান। ভাইয়ের একমাত্র সন্তানের লাইগা একটা ভালা মাইনসের মাইয়াও নিয়া আইলাম। কিন্তু আমাগো কপালটাই খারাপ। এখন হের বাপের সামনেই কই, এতো ছোট্ট একটা সংসারে মাইয়াটা শাশুড়ির সাথে মিলজিল কইরা চলতে পারে না। খালি শাশুড়ির সাথে খেচাখেচি করে আর সোয়ামি ঘরে আইলে কান্দাকাটি করে। যত দিন গেছে সমস্যা খালি বাড়ছে। কত কইরা বুঝাইলাম; এই বেয়াই সাব আইসাও অনেক বুঝাইলো। কিন্তু কুনু লাভ অইল না। এই তো গত হপ্তায় বউয়ের পক্ষ লইয়া এই খাটাশের বাচ্চা বাড়িটারে দুযখ বানায়া ফালাইছে। হারামজাদার কত্ত বড় সাহস, তার মা’রে ধাক্কা দিয়া দেউড়িতে ফালাইয়া থুইয়া তার বউরে নিয়া শ্বশুর বাড়ি চইলা গেছে। ’ এতটুকু বলে আলিম দফাদার দৌড়ে হাশেমের মায়ের কাছে এসে বলে, ‘ভাবিজান আপনার ঘোমটাটা সরানতো। ’

না, হাশেমের মা ঘোমটাতো সরালেনই না, বরং আরো একটু টেনে দিলেন। তার কপালের বাঁ পাশে এখনও কাল ফোলা দাগ আছ। আলিম দফাদার বাজার থেকে কয়েকটা প্যারাসিটামল এবং ব্যথার মলম এনে দিয়েছেন হাশেমের মাকে । গ্রামের এত লোকজনের সামনে এই কলঙ্কের দাগ হাশেমের মা দেখাবেন কেমন করে?’ তিনি ব্যাপারটা কাউকে জানাতেই চাননি। কিন্তু আলিম দফাদারের সহ্য হবে কেমন করে? দফাদার বংশে এত বড় একটা ঘটনা । তাই তিনিই যদু মুন্সিকে অনুরোধ করে নিয়ে এসেছেন ঘটনার একটি চূড়ান্ত ফয়সালা করতে।

অবস্থা বেগতিক দেখে নাকি লজ্জায় হাশেমের শ্বশুর বেঞ্চি থেকে উঠে আলিম দফাদারের পাশে এসে দাঁড়ান। তারপর মাথা ঘুরিয়ে উপস্থিত লোকজনের মনোভাব অনুধাবন করার চেষ্টা করেন এবং প্রায় সাথে সাথেই মিনমিন করে হাশেমের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বেয়াইন সাহেব, আমি যারপরনাই লজ্জিত। আমার মাইয়া যদি কুনু অপরাধ কইরা থাকে, আমি এই সবার সামনে আপনার কাছে ক্ষমা চাই। চলেন এখানে বইসা না থাইকা আমরা ঘরের ভিতরে যাইয়া বিষয়টা মীমাংসা করি। ’ একথা শুনে ওই বাচাল লোকটি প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে। বলে, ‘আপনি যদি মীমাংসা কইরা ফালাইবেন তয় আলিম মিয়া চেয়ারম্যান সাবেরে কষ্ট দিয়া আনছে কেন? আপনি এত দিন কই আছিলেন?’

যদু মুন্সি হাত তুলে বাচাল লোকটিকে থামবার ইঙ্গিত করেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে্ন, এইটাতো খুবই ভালা অয় যদি তারা নিজেরা নিজেগো সমস্যা মিটাইয়া ফালাইতে পারে। চেয়ারম্যানের কথায় হাশেম কিছুটা সাহস ফিরে পায় বলে তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হল । সে মাথা তুলে উপস্থিত লোকজনদের দিকে একবার তাকাল। কিন্তু সকাল থেকে অপেক্ষমান অতি উৎসাহী লোকজন চেয়ারম্যানের এই কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই পিছন দিক থেকে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। কে একজন সবাইকে শোনাবার জন্যই বলল, ‘নিজেরাতো এক বছরেও মীমাংসা করতে পারে নাই, আইজকে কী মীমাংসা করব?’

অপমানে কিংবা রাগেই হোক এই অনাহুত লোকজনের বাগাড়ম্বর দেখে হাশেম সবাইকে বেকায়দায় ফেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘আপনাগো এত মাথা ব্যাথা কেন? চেয়ারম্যান সাবের কথার উপর মাতব্বরি দেখান কেন?’

ঘটনার আকস্মিকতায় যদু মুন্সি বিব্রত হয়ে পড়েন। তিনি চেয়ারে নড়েচড়ে বসে রাগতস্বরে হাশেমকে বলেন, ‘এই ব্যাটা, বেয়াদবের মত কথা বলতেছিস কেন? এই লোকগুলোতো আমার সাথেই আসছে... । ’ যদু মুন্সির রাগের মাত্রা বাড়বার আগেই আলিম দফাদার ভাতিজার গালে সজোরে একটা চপেটাঘাত বসিয়ে দেন, ‘কুলাঙ্গারের বাচ্চা কুলাঙ্গার, তোর লাইগা আইজ বংশের মুখে চুলকালি। গলার রগ ফুলাইয়া আবার কথা কস।’

হাশেম একমাত্র ভাতিজা হওয়ায় আলিম দফাদার তাকে খুবই স্নেহ করতেন। তাছাড়া বড় হওয়ার পর কখনোই তার গায়ে হাত তুলেন নাই। তাই এই জনসমক্ষে চাচার হাতে চড় খেয়ে হাশেম মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। চড়ের প্রত্যুত্তরে তার ফোঁসে ওঠা দেখে মনে হচ্ছিল যেন চাচার গায়ে হাত তুলেই ফেলে । ঠিক সে মুহুর্তেই যদু মুন্সির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। চেয়ারের পাশ থেকে বরাক বাঁশের কঞ্চিটা হাতে নিয়ে তিনি হাশেমকে এলোপাতাড়ি পিটাতে আরম্ভ করেন। লোকজন কারুরই তাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি যতই পেটাচ্ছেন তার রাগ ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। ‘আর কেউর জবানবন্দি লাগব না । কুনু সাক্ষী সাবুদের দরকার নাই। এই বেয়াদবের বাচ্চা কী করতে পারে তা বুইঝা ফালাইছি। তোর কত বড় সাহস, তুই তোর মায়ের গায়ে হাত তুলিস!’

ঘটনা যে অকস্মাৎ এভাবে খারাপের দিকে মোড় নেবে তা কেউই ধারণা করতে পারেনি। হাশেমের শ্বশুর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে না পারলেও তার বেসামাল পদচারণা এটাই প্রমাণ করছে যে তিনি এ পরিস্থিতিতে খুবই শংকিত । যদু মুন্সির রাগের আতিশয্য থেকে বাঁচার জন্যই হয়তো হঠাৎ তিনি দ্রুত ঘরের দিকে ছুটে যান। কিন্তু হাশেমের মা না তার আসন থেকে উঠতে পারছেন, না কিছু বলতে পারছেন । তবুও তিনি তার চোখ মোছার দৃশ্য আড়াল করতে পারছেন না।

এ সময় হঠাৎ করে হাশেমের শ্বশুর তার মেয়েকে নিয়ে পড়িমড়ি করে দৌড়ে এসে হাশেমের মায়ের পায়ের উপর তাকে চেপে ধরে বলেন, ‘মাফ চা, মাফ চা। যদি কুনুদিন শাশুড়ির কথার উপরে আর কথা কইছস তয় আমি তোরে জবাই কইরা ফালামু।’ হাশেমের মা না বেয়াইয়ের কথার দিকে নজর দিতে পারছেন, না পা জড়িয়ে ধরা বউয়ের দিকে তাকাতে পারছেন। তার কাতর দৃষ্টি যদু মুন্সি আর ছটফটায়মান হাশেমের দিকে। আবার হতাশ হয়ে দেবর আলিম দফাদারের দিকেও তাকাচ্ছেন। অবশেষে তিনি তার পর্দার কথা ভুলে গিয়ে অসহায়ের মত উপস্থিত কৌতুহলী গ্রামবাসীর দিকেও তাকাচ্ছেন। তার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে তিনি সবাইকে মিনতি করছেন কেউ এগিয়ে এসে চেয়ারম্যান সাহেবকে থামাক। কিন্তু না, কেউ এগিয়ে আসছে না। হাশেম দফাদারও এমন যে সে মার খেতে থাকলেও উঠান থেকে পালাচ্ছে না। তবে সে কাকুতি মিনতি করেই চলেছে, ‘চেয়ারম্যান সাব, আমি ভুল কইরা ফালাইছি, আমারে মাফ কইরা দেন, আপনারা সবাই আমারে মাফ কইরা দেন। আমি আর এমন করুম না।

যদু মুন্সি হাঁপিয়ে উঠেছেন। পাশে দাঁড়ানো কাঞ্চনের হাতে কঞ্চিটা দিয়ে তিনি পরনের লুঙ্গির গিঁট ঠিক করেন। এরপর আবার যখন কঞ্চিটি হাতে নিয়েছেন তখনই হাশেমের শ্বশুর করজোড়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাব , মাফ কইরা দেন, দুইজনরে আপনি মাফ কইরা দেন। তারা অবশ্যই অপরাধ করছে। এখন থাইকা এই ভুল আর করব না । কিন্তু যদু মুন্সির রাগ তখনও পড়েনি। হাশেমের শ্বশুরের মিনতি শুনে তিনি দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে আবার কঞ্চি চালাতে থাকেন। হাশেমের শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এতদিন কই আছিলেন? মাইয়ারে আর জামাইরে সামলাইতে পারেন নাই কেন?’ এই কথার মধ্যেই বেখেয়ালে কঞ্চির একটি বাড়ি হাশেমের কপালে সজোরে পড়তেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। তার জামায় রক্ত দেখে হাশেম ‘মাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে।

ঠিক সেই মুহূর্তে জগতের সবচেয়ে বড় নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে। হাশেমের মা প্রায় মাথা ঘুরে পড়তে পড়তে লাফ দিয়ে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ান। তারপর লজ্জার মাথা খেয়ে তিনি পাগলের মত হাশেম এর উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন । হাশেমকে জড়িয়ে ধরে যদু মুন্সির দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আর মাইরেন না চেয়ারম্যান সাব, ওরে আর মাইরেন না। আমি ব্যথা পাই নাই, আমার লাগে নাই। আমার একটা মাত্র পোলা। মইরা গেলে আমারে কবর দিব কে? মাফ কইরা দেন, আপনি ওরে মাফ কইরা দেন।’

মুহুর্তের মধ্যে এই জনসমাবেশ যেন নিশ্চুপ নিথর হয়ে গেল। হাশেম ও তার মায়ের কান্না ছাড়া কারও মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। যদু মুন্সির তুলে ধরা বাঁশের কঞ্চি হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। আলিম দফাদার হাঁ করে যদু মুন্সির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আর তখনই হাশেমের বউ পিছন দিক থেকে এসে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল।

যদু মুন্সি আলতোভাবে হাতের কঞ্চিটি ফেলে দিয়ে উপস্থিত গ্রামবাসীকে লক্ষ্য করে বললেন, এই তোমরা সবাই চলো। মসজিদে আজান হইয়া গেছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান অবশেষে গল্পটিও পড়লাম প্রিয়!
বাসু দেব নাথ মায়ের বেদনায় হুহু করে হৃদয় আতকে উঠলো। সত্যি ভালো লাগলো গল্প।
রণতূর্য ২ মায়ের মমতার এক অকাট্য স্বাক্ষী আপনার এ গল্পটি।অনেক ভালো লেগেছে।ভোট ও শুভকামনা রইল। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইল।আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
মুহম্মদ মাসুদ মা পৃথিবীর অন্যতম আন্তীয়। সন্তানের শরীরের আঘাত পরলে আগে মায়ের শরীরেই পরে। বেশ ভালো লাগলো। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।
অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্পে শাশ্বত মায়ের রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪