লালু মিয়া সংকীর্তন

কৃপণ (নভেম্বর ২০১৮)

Jamal Uddin Ahmed
  • ১১
  • ৬৪৯
লালু মিয়া মৃত্যু শয্যায়। বয়স মোটামুটি ভালই হয়েছে। তিয়াত্তর। তবে এর চেয়ে বেশি বয়সের লোকজনও এখনও শুকনো সুপারি চিবিয়ে খেয়ে কাক ভূষণ্ডি হয়ে দিব্যি এবাড়ি ওবাড়ি করে বেড়াচ্ছে। খোদ লালু মিয়ার বড়ভাই ফালু মিয়া যে গত বছর আশির মাইলফলক ছুঁয়েছে সে-ও সমাজ-সংসার হাট-বাজার সর্বত্র জোরকদমে ধাবমান। অবশ্য ফালু মিয়া আর লালু মিয়ার মাঝখানের দুই বোন কুলসুম আর ময়মুনা ষাট ছোঁয়ার আগেই জগৎ সংসারের মায়া কাটিয়ে উর্ধ্মুখী হয়েছে। সত্য হল, জীবন-মৃত্যুর ভার মানুষের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি। তাই এ ব্যাপারে হিসাব-নিকাশ মানুষের এখতিয়ার বহির্ভূত।

লালু মিয়া বিছানা নিয়েছেন মাসাধিক কাল হল। সাধ্যমত সবকিছু করা হয়েছে ও হচ্ছে। তবুও ঘুরে দাঁড়াবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ‘সাধ্যমত’ বলার দুর্মর কারণতো অবশ্যই আছে। তবে কারণ-টারন অবজ্ঞা করে রতন মিয়া আর কাঞ্চন মিয়া দু’ভাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে বাবাকে সারিয়ে তোলার। তাদের একমাত্র বোন সফিনা খাতুনও খেয়ে না খেয়ে বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। একদিকে বাতরোগী মাকে সামলাচ্ছে এবং অন্যদিকে বাপের মাথার উপরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে চলেছে।

গত দুদিনে শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে লালু মিয়ার। জ্ঞান যদিও পুরোপুরি লোপ পায়নি তথাপি দুর্বলতার কারণে চোখ প্রায় সারাক্ষণই বুজে থাকেন। এখন মোটেই কিছু মুখে তুলতে চান না। সফিনা বার বার জোর করে দুয়েক চামচ ডাবের পানি বাপের মুখে তুলে দিচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হলেও কখনও চোখ লাল করে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করছেন। এই যেমন গতকাল হরিপদ ডাক্তারের পরামর্শে তার সহকারি কাম কর্মচারি নগেন যখন প্রথমবারের মত একটি আই.ভি. স্যালাইনের ব্যাগ নিয়ে এল পুশ করার জন্য তখন খেপে উঠেছিলেন লালু মিয়া। গায়ে শক্তি থাকলে হয়ত দু’চার ঘা লাগিয়ে দিতেন নগেনকে। বাড়ির সবাই অনেক কাকুতিমিনতি করে যখন লাভ হচ্ছিল না তখন বড়ভাই ফালু মিয়া জোরেশোরে আচমকা একটা ধমক লাগিয়ে বলেছিলেন, আজরাইল দাড়াইয়া আছে দুয়ারে; এইসব ছাড়। ফালু মিয়ার রীতিবিরুদ্ধ এ আচরণে সবাই হা হয়ে গেলেও এতে কাজ হয়েছিল । নগেন স্যালাইনের সুঁইটা লালু মিয়ার চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অমনটি হয়েছিল গত পরশুও। দু’বার বিছানা নষ্ট করার পর সবাই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল যে শৌচকর্মের জন্য লালু মিয়াকে পাঁজাকোলা কিংবা ধরাধরি করে ঘরের বাইরে উঠানের উত্তরদিকের একমাত্র খাটা পায়খানায় আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। তখন বাধ্য হয়ে হরিপদ ডাক্তারের পরামর্শে কাঞ্চন মিয়া শহর থেকে বেডপ্যান, ইউরিন্যাল, টয়লেট টিস্যু, রেক্সিন শীট, ইত্যাদি কিনে নিয়ে এল। নিয়ে এলতো দায়ে পড়ে; কিন্তু তা নিয়ে সে কী প্রলয়কাণ্ড! লালু মিয়া পারলে লাফ দিয়ে উঠে ছেলের ঘাড় মটকে দেয়। চিৎকার দিতে গিয়ে গলার রগ ফুলে উঠছে ঠিকই কিন্তু উচ্চারিত শব্দগুলো শানিত হতে পারছে না। সফিনা বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে কেঁদে কেঁদে বুঝাচ্ছে যে বিছানা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য এ ব্যবস্থা। তবুও লালু মিয়া রাগে গজগজ করে মাথা সরিয়ে নিচ্ছেন। এই হুলস্থুলের মধ্যেই দেখা গেল তার লুঙ্গি, বিছানা ভিজে ছপছপ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এ ক’দিনে অল্প হলেও ছেলে-মেয়েদের মুখে কথা ফুটেছে। রতন মিয়া সাহস করে বলল, বাবা, তুমি নামাজ পড়বা না? বারবার কাপড় নষ্ট অইয়া গেলেতো নামাজ পড়তে পারবা না। এ কথায় মনে হল কাজ হয়েছে। লালু মিয়ার লাফালাফি একটু কমে এলে সফিনার ছেলে কামু আর কাঞ্চন মিলে অনেক কষ্ট করে তাকে ঘরের বাইরে তুলে এনে গা-গতর ধুইয়ে দিল। এই ফাঁকে ঘরের ভিতরে রেক্সিন শীট বিছানোসহ বিছানাপত্র ঠিকঠাক করা হল।

চিকিৎসার জন্য জ্ঞানত ডাক্তারের কাছে খুব কমই গিয়েছেন লালু মিয়া। একবার বন্যার সময় দাস্ত বন্ধ না হওয়ায় প্রায় যখন মরমর হয়ে পড়েছিলেন তখন গ্রামের লোকজন কিছু পথ নৌকায় এবং কিছু পথ পোলোতে করে থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। নিজের গাঁটের পয়সা তেমন লাগেনি। আর একবার টাইফয়েডে কাবু হয়ে গেলে হরিপদের কাছে গড়াতে গড়াতে গিয়েছিলেন। পরিবারের সবাই হরিপদ ডাক্তারকে বাড়িতে ডেকে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু লালু মিয়াকে রাজী করানো যায়নি। কিছু পথ রতন আর কাঞ্চনের ঘাড়ে ভর করে পা টেনে টেনে যেতে পারলেও শেষ পর্যন্ত রিক্সায় উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়া ছোটখাট অসুখবিসুখ হলে তিনি লতাপাতা, গোটাবিচি খেয়ে কিংবা আদা-রসুন-কালজিরা আর গাছ-গাছড়ার মূল-শেকড়ের পাঁচন বানিয়ে নিজে নিজেই চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু এ যাত্রা এসবে কাজ হয়নি বলে দুই দফা হোমিওপ্যাথ কসির মোল্লার পুরিয়া সেবন করেছিলেন। কিন্তু তাতে ফল পাননি। এরপর থেকেই খুব দ্রুতই তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে।

লালু মিয়ার এহেন পতনোন্মুখ অবস্থায় সংসারে আরও দুটি বড় সমস্যা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। কমলগঞ্জ বাজারের মুদির দোকান ইদানীং খুলবার কোনো উপায় নেই। শয্যাশায়ী বাপকে রেখে রতন-কাঞ্চন সরবার সাহস পায় না। চার-পাঁচদিন আগে পর্যন্ত দুইভাই পালা করে সকাল বিকাল দোকান খোলা রেখেছে। একজনের পক্ষে দোকান চালানো কষ্টকর। কোন কর্মচারি নেই। বাপের তালিম অনুযায়ী রতন মিয়া কাঞ্চন মিয়া দোকান চালানোর দায়িত্বে ছিল; লালু মিয়া সন্ধ্যাবেলা গিয়ে গদিতে বসে সারাদিনের হিসাবনিকাশ বুঝে নিতেন। বেচা-বিক্রি একেবারে খারাপ না। মৌরসি পাট্টার বাইরে আরও বিঘা পাঁচেক জমি কেনার পিছনে এই দোকানের আয়ের একটা বড় অবদান আছে। কিন্তু গেল সনে রতন মিয়ার বিয়ে দিতে গিয়ে একটা বড় ধাক্কা খেয়েছেন লালু মিয়া। ইচ্ছা ছিল, দুই কেজি খেজুর দিয়ে মসজিদে বসে সুন্নতি তরিকায় বিয়েটা সেরে ফেলবেন; কিন্তু সে কি হয়! আত্মীয়স্বজনের চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে একটা অনুষ্ঠান করে নিজের লোকজন ছাড়াও পাড়াপ্রতিবেশী কুড়িপঁচিশজনকে খাওয়াতে হয়েছে। আর বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচতো রইলোই। এবং বড় ছেলের বিয়ের দিনই সবাইকে শুনিয়ে ছেলের মা গুলজান বিবিকে কড়া আওয়াজে তিনি বলে দিয়েছেন, কাঞ্চন মিয়ার বিয়ের জন্য কেউ যেন আর পীড়াপীড়ি না করেন। বিয়ের খরচ দোকান থেকেই বের করতে হবে; অন্য কোনো খাত থেকে এক পয়সাও খরচ করা যাবে না। এখন এই দোকানটি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। লালু মিয়া হঠাৎ হঠাৎ চোখ খুলে দুই ছেলেকে একসাথে চোখের সামনে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। অথচ পেশাব-পায়খানার জন্য ধরাধরি করতে তাদের সাহায্য দরকার । ওইসময় মহিলারা কেউ আশেপাশে থাকেন না। বাপের গোঙানি-গজরানির জবাবে ছেলেদের মিথ্যা বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। রতন বলে, বাবা আমি হবায় আইলাম, কাঞ্চন দোকানে যাইতাছে। এতে বাপ যে শান্ত হন তা মনে হয় না।

অন্য সমস্যাটি বড়ই নিষ্টুর ও স্পর্শকাতর। মেয়ে সফিনা কাঁদছে ঠিকই, কিন্তু বাপকে ছেড়ে যেতে পারছে না; এদিকে মা-ও ঊনপাঁজুরে। মেয়ে বাপের বাড়ি পড়ে আছে এতদিন। তার উপর জামাই, নাতির আনাগোনাও লেগে আছে। বাপতো বলেই ফেলেছেন, বাড়িতে কি মেলা বসাইছ? লালু মিয়া চিৎকার করে গুলজান বিবিকেও শাসাতে চান, কিন্তু কাশির টানে শব্দ মিলিয়ে যায়। কাহিল হয়ে পড়ে থাকলেও এটা তিনি বুঝতে পারেন যে চুলোয় এখন বড় মাপের ডেকসি চড়ছে। গোলার ধান বিক্রির জন্য উদ্বৃত্ত থাকবেনা এবার। শুধু কি ধান-চাল? ধান-চালের সাথে নুন-তেল, শাক-সব্জি, ডাল-ভর্তা, মাছ-মুরগি... হায় হায়, সর্বনাশ! শুধু সফিনা কেন, সবাই জানে যে তার বাবা এভাবে ভাবেন। কী নিষ্ঠুর ভাবনা! তারপরও বাপকে ছেড়ে যায় কীভাবে! বাপেরতো ফিরে আসার লক্ষণ নেই।

দোকানে সেভাবে বসা না হলেও প্রতিদিন একবার ঝাড়ামোছা করে আসতে হয়। সে কাজটা কাঞ্চন মিয়াই করে। সেই সুযোগে হরিপদ ডাক্তারের সাথে বাপের অবস্থা নিয়েও একটু কথা বলা হয়। পল্লী চিকিৎসক হরিপদ দাস সময়ের সাথে সাথে মোটামুটি হাতপাকা হয়ে উঠেছে। জটিল কোনো বিষয় হলে সে নিজে থেকেই বলে দেবে শহরের কোন ডাক্তার কোন বিষয়ে দক্ষ। নিদেনপক্ষে গুরুতর কিছু হলে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেবেই। লালু মিয়ার ব্যাপারটা জটিল হলেও উপদেশ দিয়ে কোন লাভ নেই। চিকিৎসার জন্য না এলেও আটপৌরে কথাবার্তা থেকেই হরিপদ ডাক্তার আঁচ করে নিয়েছে লালু মিয়ার অন্ত্রে সমস্যাতো আছেই, তার উপর হেপাটাইটিস সি’র সব লক্ষণই বিদ্যমান। ইতিমধ্যে লিভার সিরোসিস হয়েই গেছে হয়ত। রতন-কাঞ্চনকে কয়েকবার সাবধান করেছে হরিপদ ডাক্তার। তারা অসহায়ের মত বলেছে, কী করব কাকা, বাবাতো কারো কথা হুনে না। এখন এই শেষ সময়ে স্যালাইন পুশ করা আর জ্বর-ব্যথা সারানোর ওষুদ দেয়া ছাড়া অন্য কোন কথা ভাবাও যাবেনা।

লালু মিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কথাবার্তা বলার তেমন চেষ্টা করছেন না। হঠাৎ চোখের পাতা খুললে মণিটা ঘুরিয়ে আশেপাশের লোকজনদের দেখার চেষ্টা করেন। ঠোঁট নাড়ালে মুখের কাছে কান বাড়িয়ে দিতে হয়। তারপরও সব কথা বোঝা যায় না। কথার মধ্যে মাঠ-ঘাট-দোকান এসব ছাড়া তেমন কিছু নেই। সন্ধ্যার দিকে বড়ভাই ফালু মিয়া এসে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন। কাশতে গিয়ে বাপের মুখ থেকে একটু রক্ত বের হয়েছিল দেখে সফিনা মাথা ঠিক রাখতে পারেনি তাই হাউমাউ করে চাচাকে ডেকে এনেছে। ফালু মিয়ার মনটাও ভারী। মায়ের পেটের ভাই বলে কথা। ছোট হয়েও সে-ই আগে চলে যাচ্ছে। একবার মনে হয়েছিল বড়ভাইকে দেখে লালু মিয়ার চোখের কোণে একটু পানি জমেছে।

রাত দশটার দিকে ফালু মিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাবার আগে তিনি মলিন মুখে ভাইয়ের বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন। সফিনা একটু ফুঁফিয়ে উঠতেই লালু মিয়া চোখ খুলে বড়ভাইকে মাথার উপরে দেখে ঠোঁট নেড়ে কী যেন বলার চেষ্টা করলেন। ফালু মিয়া ‘কিছু কইলা?’ বলে লালু মিয়ার মুখের উপর মাথাটা ঝুঁকালেন। কয়েকবারের চেষ্টায় সফিনা শব্দটা শুনতে পেল। ‘করিমুন’। সে বলল, চাচাজান, বাবা করিমুন নাকি কী কয়। ফালু মিয়া একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। করিমুন আবার কী? তিনি ইশারায় সফিনাকে চেয়ারটা এগিয়ে আনতে বলেন।

চেয়ার টেনে ভাইয়ের মুখের কাছাকাছি বসে ফালু মিয়া জিজ্ঞেস করলেন, কী কইতাছ?
লালু মিয়া আবার ঠোঁট নাড়লেন, কিন্তু কিছু বোঝা গেল না।
করিমুন কী? ফালু মিয়া জিজ্ঞেস করেন।
আবারও ঠোঁট নাড়লেন লালু মিয়া। সফিনা আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে বাপের কথা শোনার চেষ্টা করছে।
‘মোহরানা?’ সফিনা চমকে ওঠার মত শব্দটা উচ্চারণ করল। বলল, চাচাজান, কী কইতাছে বাবা, মোহরানা!

ফালু মিয়া তড়িতাহত হয়ে একটু ঝিম মারলেন। তারপর চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে সফিনা আর রতনকে হাত দিয়ে ঘরের বাইরে আসার ইঙ্গিত করলেন। বাড়ির উঠানে নেমে কুর্তার জেব থেকে চোরাইপথে আসা ভারতীয় পাতার বিড়ি মুখে নিয়ে লাইটার ঘষতে ঘষতে ফালু মিয়া বললেন, তগো যে মা আরেকটা আছিল হেই কথা তোমরা কি জানো?
রতন আর সফিনা বোকার মত পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
বিড়িতে টান দিয়ে ফালু মিয়া বলেন, যাউকগা, জাইন্যা কাম নাই ...
হুনছিলাম চাচাজান..., ভ্যাবলার মত বলে সফিনা। চাচীজান একবার কইছিল।
তইলেতো হুনছসই। হেই বেটি যাওয়ার পরে তোর মা’রে অনেক কষ্টে খুইজ্যা আনছিলাম। বাপজান মইরা যাওনে বোঝাটা আমার ঘাড়েই পড়ছিল। ঐ সুমোয়ই তোর বাপেরে আলাদা কইরা দিছিলাম।

করিমুনের এমন কোন পদচিহ্ন পরিবারে নেই যে সে আলাপচারিতা বা গালগল্পে থাকবে। তবুও ফালু মিয়ার মত পুরনো দু’চারজনের স্মৃতির মহাফেজখানায় করিমুনের একটু-আধটু দীর্ঘশ্বাস জমা আছে। একান্নবর্তী পরিবারে থাকা অবস্থায় বিয়ে করলেও লালু মিয়া ছোটবেলা থেকেই চুপসানো স্বভাবের। তাছাড়া যৌথ পরিবার হলেও একান্ত নিজের একটা গোপন হিসাব-নিকাশ তার ছিল। আদর-যত্নে বেড়ে ওঠা করিমুন বিবি শ্বশুরবাড়িতেও একটু খলবলে ছিল। ভাইবোনরা বেড়াতে এলে উজাড় করে দিত ভালবাসা। একটু ভাল খাবারের ব্যবস্থা,একটু বেশি যত্ন-আত্তি করার চেষ্টা করত । কিন্তু করিমুন বিবির জন্য এসব কাল হয়ে দাঁড়াল এক সময়। লালু মিয়া যখন পষ্টাপষ্টি বলেই ফেললেন, এত আদিখ্যেতা দেখাতে হলে বাপের বাড়ি থেকে এনে কর। বড় ঘরের মেয়ে করিমুন স্বামীর এ আচরণ হজম করতে পারল না। আত্মসম্মান বলে একটা কথা আছে। বাপের বাড়ি খবর পাঠিয়ে লোক আনিয়ে সে সেই যে স্বামীর ঘর ছাড়ল, আর ফিরে এল না। চেষ্টা-চরিত্র করা হয়েছিল ঢের, কিন্তু মিয়া বিবির বিপরীতমুখী অবস্থান ফাটলটাকে আরও প্রশস্থ করল শুধু।

চাচাজান চলে যাওয়ার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করে সফিনা আর রতন লালু মিয়াকে ধরে বসিয়ে কয়েক চামচ হরলিক্স মুখে দেয়ার চেষ্টা করছে। লাভ তেমন হয়না। তবুও মন মানেনা বলে যখনই বাপকে বসানোর সুযোগ পায় তখন ছেলেমেয়েরা তরল এটা ওটা দেবার চেষ্টা করে। আজকে মুখে রক্ত উঠেছে তাই সবাই বেশি উদ্বিগ্ন। শরীর খারাপ নিয়ে গুলজান বিবিও আজ এসে বসেছেন স্বামীর শিয়রের পাশে। কাঞ্চন এখনও ফিরেনি বাজার থেকে। তার কাছে হয়ত কিছু টাকা আছে। চাচাজান বলেছেন করিমুন বিবির বাপের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করে এক হাজার এক টাকা যেভাবেই হোক যেন পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। না হলে দাবি থেকে যাবে। প্রশ্ন হল, করিমুন বিবি কি এখনও বেঁচে আছে, থাকলে কোথায় আছে, আর বেঁচে থাকলেও সেই নফরতের বিয়ের মোহরানা সে কি নেবে?

লালু মিয়ার মুখে যেটুকু তরল দেয়া হয়েছে তার অর্ধেক গলা দিয়ে নেমেছে কি না সন্দেহ। তবুও রতন পিতার পিঠে বুক ঠেকিয়ে বসে আছে আর সফিনা চামচ নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। হঠাৎ বাড়ির পথের দিকে একটা গুঞ্জন শোনা গেল। কয়েকজন মানুষের গলার স্বর, বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে স্পষ্ট হচ্ছে। মা হারিকেনটা হাতে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বারান্দায় বেরোলেন। তারপরই একটা চিৎকার শোনা গেল মায়ের, বাবা রে...। সবাই সচকিত হল বটে, তবে রতন বাপকে রেখে উঠতে পারল না। কারণ এ অবস্থায় বাপও একটু অস্থির হয়ে উঠেছেন। সফিনা এক লাফে চলে এসেছে মায়ের কাছে। তারপর সেও মায়ের সাথে কান্নায় যোগ দেয়, ওরে আমার ভাইরে, তোর কী অইল রে?

কাঞ্চন মিয়াকে ঘরের ভেতরে এনে চেয়ারে বসানো হয়েছে। তার মাথা, হাত ও গলায় ব্যাণ্ডেজ। অবস্থা গুরুতর হতে পারত, হয়নি। পেছন থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী রতনের চিৎকার শুনে দৌড়ে আসতে আসতেই ডাকাতগুলো কেটে পড়েছে। হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে; উপরন্তু ধারালো অস্ত্র এবং রডের কয়েকটি আঘাত বসিয়ে দিয়ে গেছে। কপাল ভাল, লোকগুলো পাঁজাকোলা করে তাকে হরিপদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। বেশ ক’টা সেলাই পড়েছে। কাঞ্চনকে নিয়ে আসা লোকগুলো আর বেশিক্ষণ বসেনি। বাড়ির সবাই জড় হয়েছে। সফিনা আর তার মা রয়ে রয়ে কান্নাকাটি করছে।কাঞ্চন কাহিল হয়ে পড়লেও সবার কেন, কোথায়, কীভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর ধীরে ধীরে দিয়ে চলেছে।

লালু মিয়াকে শোয়ানো হয়েছে বিছানায় । কিন্তু অস্থিরতার কারণে তিনি চোখ বন্ধ করতে পারছেন না। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ছে তার। কিন্তু কেউ এখন তার দিকে তেমন তাকাচ্ছে না। ফালু মিয়া ধমক দিয়ে সবার ফোঁপানো বন্ধ করেছেন; সফিনাকে বলেছেন, ওরে বিছানায় নিয়ে শোয়া। তখনই তার চোখ ছোটভাই লালু মিয়ার দিকে যাওয়াতে সফিনার দিকে হাত তুলে বললেন, এই খাড়া। লালু মিয়া ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কী বলছেন আর অস্থিরভাবে মাথা নাড়ছেন। সবাই দ্রুত এসে তার খাটের পাশে দাঁড়াল। লালু মিয়া মাথা ঘুরিয়ে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন মনে হল।
কাঞ্চন শরীরের কষ্ট নিয়েও মাথা ঝুঁকিয়ে বাপের মুখের কাছে কান আনল।
লালু মিয়া কিছু একটা বললেন, কিন্তু কাঞ্চন বুঝতে পারল না।
কাঞ্চন বলল, বাবা আবার কও, বুঝি নাই।
এবার চোখ লাল করে মুখ খিঁচিয়ে লালু মিয়া কিছু একটা বললেন যা শুনে কাঞ্চন মিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কাঞ্চন ভয়ে ভয়ে মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে সবার মুখের দিকে ঘুরে তাকাল।
লালু মিয়ার অধৈর্য আচরণের জন্যই হয়ত আবার কাশি উঠল জোরেশোরে। এবার বেশ কিছু রক্ত দেখা গেল তার মুখে।
শোরগোল ওঠার আগেই কী ভেবে রতন মিয়া সাহস করে বলে ফেলল, বাবা, টাকার ব্যাগ দিয়া তুমি কী করবা? আমারেতো আল্লায় বাচাইয়া আনছে.........
রতন মিয়া আরও কিছু কথা হয়ত বলেছে; কিন্তু কান্নাকাটি, কালেমা শাহাদৎ আর চিৎকার চেঁচামেচিতে তার বাকি কথাগুলো শোনা যায়নি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুল হুসাইন কবিতার ন্যয় গল্পেও ভোট রেখে গেলাম।আপনার লেখার মধ্যে সব সময় কিছু ভিন্ন স্বাদ থাকে।প্রতি মাসে যাদের লেখা নিয়মিত পড়ি আপনি তাদের একজন।শুভ কামনা।আমার পাতায় দাওয়াত রইলো।
রঙ পেন্সিল লালু মিয়াদের জন্য শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। খুব ভাল লাগলো গল্প। অনেক শুভকামনা
অনেক ধন্যবাদ।
মুহাম্মাদ লুকমান রাকীব প্রিয় কবি/লেখক. অাপনাদের জন্য নতুন ওয়েব সাইট www.kobitagolpo.com তৈরি করা হয়েছে নতুন অাঙিকে। এখানে বর্তমান প্রতিযোগীতার জন্য নির্ধারিত “বাবা-মা” শিরোনামে লেখা জমা দেয়ার জন্য অামন্ত্রণ করা হচ্ছে। অাগ্রহীগণ ২৫ নভেম্বরের মধ্যে www.kobitagolpo.com এ লিখা জমা দিন। প্রতিযোগীতায় সেরা নির্বাচিত ৬ জনকে সম্মাননা দেয়া হবে।।।
মুহাম্মাদ লুকমান রাকীব প্রিয় কবি/লেখক. অাপনাদের জন্য নতুন ওয়েব সাইট www.kobitagolpo.com তৈরি করা হয়েছে নতুন অাঙিকে। এখানে বর্তমান প্রতিযোগীতার জন্য নির্ধারিত “বাবা-মা” শিরোনামে লেখা জমা দেয়ার জন্য অামন্ত্রণ করা হচ্ছে। অাগ্রহীগণ ২৫ নভেম্বরের মধ্যে www.kobitagolpo.com এ লিখা জমা দিন। প্রতিযোগীতায় সেরা নির্বাচিত ৬ জনকে সম্মাননা দেয়া হবে।।।
Lutful Bari Panna দারুণ লেখেন আপনি
আপনার স্বীকৃতি অনেক মূল্যবান। আপনি গক'র অনেক জ্যেষ্ঠ সদস্য। আমার লেখা পড়েছেন তাতেই আমি খুশি। অনেক ধন্যবাদ।
শামীম আহমেদ শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আমার পাতায়,আমন্ত্রণ রইল।
অনেক ধন্যবাদ, ভাই।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত সুন্দর গল্প । পড়ে ভাল লাগল । ভোট দিলাম সঙ্গে শুভকামনা রইল ।
ধন্যবাদ, দাদা।
জসিম উদ্দিন আহমেদ ভাল লাগল।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ARJUN SARMA লালু মিয়ারা সব দেশেই থাকে, তাই আপনার লালুমিয়া আর আমার যুগলকিশোর একই তারে বাঁধা, ভালো লেগেছে, ভোট দিলাম
তাই তো দেখা গেল; ধন্যবাদ, দাদা।
মোঃ মোখলেছুর রহমান ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এ গল্পে একজন লালু মিয়ার জীবনের খণ্ডচিত্রে তার কৃপণ চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে এমন অনেক মানুষ আছে যারা জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত বিষয়-সম্পদকে শক্ত মুষ্টিতে ধরে রাখতে চায়; পরের জন্যতো নয়ই, নিজের জীবন-মরণ প্রয়োজনেও সে মুষ্টি তারা খুলতে চায় না।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪