ট্রাভেলার

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (নভেম্বর ২০১৭)

মুর্তজা সাদ
  • 0
  • 0
এক
অনেকটা সময় ধরে পরী শুভ্র নামের ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকে। শুধু আজকে নয়, কাজটা সে প্রায় প্রতিদিনই করে। ঠিক বিকেলে, যখন সূর্য ঢলে পড়ে, তখনই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে ছেলেটি। পেশায় শিক্ষক, ঢাকার কোন নামকরা এক ভার্সিটি থেকে নাকি পড়াশোনা করেছে। ইচ্ছে ছিল অপরিচিত কোথাও হারিয়ে যাবে সে। তাই এ গ্রামের অচেনা এক কলেজের সামান্য বেতনে চাকরি করে তার আসা। বলতে জগতে কেউ নেই, তাই চেয়ারম্যানের বাড়িতে ওঠা। সেই সুবাদে পরীর সাথে প্রতিদিনই দেখা সাক্ষাৎ শুভ্র নামের রহস্যময়ী ছেলেটির। কথা কম বলা, একাকি দাঁড়িয়ে থাকা, হেঁটে বনজঙ্গল ঘুরে বেড়ানো এ ছেলেটাকে কেন যেন অসম্ভব ভাল লাগে পরীর। মাঝে মধ্যে কিছু নিষিদ্ধ কাজের কথাও মাথায় আসে তার; ঝেড়ে ফেলে দেয় মাথা থেকে। নাহ উনার সম্পর্কে বাজে ভাবা পাপ, দাঁত দিয়ে জিহ্বা চেপে ধরে সে।
"এই মেয়ে।" ডেকে ওঠে শুভ্র।
ঘোর ভাঙে পরীর।
"এই মেয়ে গাছের আড়ালে কি কর? বেরিয়ে আসো।"
পরী ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। পরীর ঠিক সামনে দাঁড়ায় শুভ্র। "এই বিকেলে বাইরে কি করো?চেয়ারম্যান সাহেব জানেন?"
মাথা নাড়ে পরী।
"যাও, বাড়ি যাও।"
"আফনে কি করেন?"
"আমি?!" আমতা আমতা করে শুভ্র। "এই তো বিকাল দেখি।"
"তয় আমিও দেখমু।"
কেমন যেন বিপাকে পড়ে যায় শুভ্র। "কেন?"
"ইচ্ছা, তাই।"
"বাড়ি যাও বলছি-"
"যামু না, কি করবেন?" কোমড়ে হাত দেয় পরী। জড়তা কিছুটা কেটে যায় তার।
তর্কে যেতে ইচ্ছা হয় না শুভ্রর, মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় সে। লালচে আকাশের দিকে তাকাতেই কেমন যেন প্রশান্তি ছুঁয়ে যায় তাকে; হেসে ওঠে একাই- কেন তা মেয়েটি বুঝে উঠতে পারে না।

দুই
ঘুম থেকে উঠে চমকে ওঠে কার্ল। স্বচ্ছ টেবিলটার উপরে পাখির মাংস, প্রাকৃতিক আটার রুটি আর উত্তেজক পানীয় রাখা; খাদ্য সংকটের এ যুগে শুকনো কৃত্রিম প্রোটিনের বদলে যে কিছু দেয়া যায়, তা তার জানা ছিল না। রুহী নামক রোবটটার দিকে তাকিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় কার্লের। ধীরে ধীরে রুহী এগিয়ে আসে তার দিকে।
"শুভ সকাল।" হেসে ওঠে সে।
"জানতে পারি আজ এ শাহী আয়োজন কেন?"
আবারো হেসে ওঠে রুহী। "অবশ্যই, আপনার সে অধিকার আছে।"
"তবে দয়া করে বলবে কি?"
"আজ ৩০১৮ সালের প্রথম দিন। তাই আপনার জন্য আমাদের এ বিশেষ আয়োজন। আপনি কি সন্তুষ্ট নন? যদি চান আরো আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারি-"
বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে হেঁটে যায় কার্ল। বাইরে বিশাল সমুদ্রে ঢেউ খেলে যাচ্ছে অনবরত। সবই কৃত্রিম, তবুও কেন যেন ভাল লাগে তার। হয়তো মস্তিষ্কে রেডিয়েশনের মাধ্যমে তৈরী করা হচ্ছে এ আনন্দ। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে সে, এ মানসিক হাসপাতাল থেকে সে কি আদৌ মুক্তি পাবে? সত্যিই কি সে পাগল হয়ে গিয়েছে?

তিন
আঁকা ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে শুভ্র, পরীর দিকে তাকায় একবার।
"এটা কে?"
"ক্যান, আফনে।"
কিছুটা সময় পরীর দিকে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে সে, তারপর হো হো করে হেসে ওঠে সে।
"হাসেন ক্যান?"
"কার্টুন হয়ে গেছি, তাই।"
কেমন যেন শক্ত হয়ে যায় মেয়েটি। চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে, হাসি থামিয়ে ফেলে শুভ্র। দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায় পরী। কেন যেন বড্ড অনুশোচনা বোধ হয় শুভ্রর, মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। এভাবে বলাটা আসলে ঠিক হয় নি।

চার
ঘরটাতে কেবল দুটো চেয়ার আর টেবিল ছাড়া কিছুই নেই। বিশাল ঘরটাতে এলেই কেমন যেন গা ছমছম করে কার্লের। সামনে যে লোকটি বসে আছে তার দিকে একবার তাকায় সে। চোখে বড় একটা চশমা লাগিয়ে কি যেন পড়ছেন তিনি, মাঝে মাঝে কলম দিয়ে কি যেন দাগাচ্ছেনও তিনি। অনেকটা সময় পরে কার্লের দিকে তাকান।
"কেমন আছ কার্ল?"
"আমি কি আপনার পরিচিত?"
"না।"
"তবে আপনি 'তুমি' করে ডাকছেন কোন অধিকারে?"
কেমন যেন হতচকিয়ে যান তিনি। "কেমন আছেন?"
থুতনীটা হাতের উপর ভর দেয় কার্ল। "কি মনে হয়? আপনাকে এমন চার দেয়ালে বদ্ধ করে রাখলে কেমন বোধ হত?"
হেসে ওঠেন লোকটি। "দেখুন আমাদের মনে হয়েছে আপনার আচরণ স্বাভাবিক নয়। তাই-"
"কি দেখে মনে হয়েছে আমি পাগল? আমার ভবিষ্যৎ বলে দেয়া দেখে?"
"ভবিষ্যৎ বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আজকের বিজ্ঞানীরাও তা পারে নি।"
"তবে আমি যেসব বলেছিলাম তা কি মিথ্যা ছিল? শহরের ওই অগ্নি সংযোগের ঘটনাটা? কিংবা ইলেকট্রিসিটির সমস্যার ব্যাপারটা?"
"ব্যাপারগুলো কাকতলীয় ছিল-"
টেবিলে জোরে একটা বাড়ি দেয় কার্ল। "আপনি আসতে পারেন। কথা বলে লাভ নেই।"
লোকটি দ্বিরুক্তি করে না। কাগজপত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ধরেন তিনি।
"আপনার স্ত্রী গর্ভবতী। তাই না?" চেয়ারটাকে একটু ঠেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে কার্ল।
থমকে দাঁড়ান লোকটি। কার্লের দিকে ফেরে তাকান তিনি।
"ঠিক তিন দিন পর তিনি একটা বড় গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়বেন।"
কিছু একটা বলতে চান লোকটি, সুযোগ দেয় না শুভ্র। "ভয়ের কিছু নেই, আপনার ঘরে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আসবে।"
কেমন যেন কেঁপে ওঠেন লোকটি, কপাল বেয়ে ঘাম জমে ওঠে তার।

পাঁচ
চেয়ারম্যান সাহেব একনাগাড়ে পান চিবিয়ে যাচ্ছেন। লাল ঠোটটা দেখতে কেন যেন খুব নোংরা লাগছে শুভ্রর। বালিশটা আরেকটু কাত করে সে।
"মাস্টার সাব?" আস্তে করে ডেকে ওঠেন লোকটি।
"বলুন।"
"জ্বর কতদিনের?"
"গুনি নি।"
"সারাটা দিন ব্যস্ত থাকি তো, যত্ন আত্তির কম হইলে মাফ কইরে দিয়েন। মফিজ ডাক্তাররে একবার ডাকমু নি বিকালে? আপনারে দেহান দরকার।"
"দরকার নেই।"
"ক্যান মিয়া? গোসসা করলেন?"
"না। মনে হচ্ছে সেরে যাবে।"
"যা ভাল মনে করেন। থাকেন তাইলে।"

সারাদিন শুভ্র কিছুই মুখে নেয় না।জ্বরটা বেড়েই চলছে। সন্ধ্যাবেলায় ঘরে নূপুরের শব্দ শুনতে পায় সে। পরী এসেছে। পরীর পায়ের শব্দেই সে পরীর উপস্থিতি বুঝতে পারে। শুভ্র নিঃশ্বাস আঁটকে পরীর গলা শোনার জন্য অপেক্ষা করে।
"জ্বর অহন কেমুন?"
"জানি না।" কাথার নিচ থেকে পরীকে জবাব দেয় শুভ্র।
কি যেন ভাবে সে। "একটু কষ্ট করে তাকাইবেন?"
অনিচ্ছা সত্যেও কাথাটা সরায় সে। লাল শাড়ি, আলতা মাখা হাতজোড়া, পায়েল পায়ে আর কপালে টিপ- অবাক হয়ে শুভ্র লক্ষ্য করে মেয়েটাকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। তীব্র জ্বরেও সে অবাক হয়ে পরীকে দেখে। মাথার ভেতরটা ভো ভো করছে। সেই যন্ত্রণাকে সে ভুলে যায় অবলীলায়। মেয়ে তুমি অপরূপ, অপ্সরী কেউ।

ছয়
লাফিয়ে উঠে বসে কার্ল। ঘরটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার, কেমন যেন দম বন্ধ ভাব।
"অভিনন্দন।" দূর থেকে কে যেন বলে ওঠে।
"কেন?"
"কারণ তুমি সফল হয়েছ।"
"ওহ।" কেমন যেন অনিচ্ছা সত্যেও সে বলে ওঠে। "আলোটা কি জ্বালিয়ে দিবে একটু?"
"তা তো সম্ভব নয়।"
"কেন?"
"আমরা এখন বাস্তবতা আর অবাস্তবতার মাঝামাঝি। এখানে সব অন্ধকার।"
কেমন যেন থমকে যায় কার্ল। "তোমরা কারা?"
"তোমার মতই স্রষ্টার তৈরি কোন জীব।"
"আমি তোমাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন?"
"তা তোমার সক্ষমতার বাইরে। আমাদের বিশালতার কাছে তোমার জ্ঞান পিপড়া সমতুল্য। মানুষ আর আমাদের পার্থক্য সুবিশাল। তার আমাদেরকে গ্রহণ করবার ক্ষমতা নেই।"
"আমার সাথে তোমাদের কাজ কি?"
"পরীক্ষা।"
"বুঝিয়ে বলা যাবে কি?"
"অবশ্যই।" কন্ঠটা একটু থামে। "ঈশ্বর সবারই কিছু ত্রুটি রেখে দেয়। আমাদের প্রধান ত্রুটি হচ্ছে আমরা অনুভূতি কি জানি না। আমরা তা শিখতে চাই,বুঝতে চাই। তাই তোমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছি।"
"তাই আমাকে এভাবে এক অবস্থান থেকে আরেক অবস্থানে ঘুরানো হচ্ছে?"
"ঠিক তা না। আমরা শুধু তোমাকে সময় আর অবস্থান নামক বাঁধা অতিক্রমের ক্ষমতা দিয়েছি। বাকিটা তুমিই করছো। তুমি সময়ের সাথে বিভিন্ন ফ্রেমে মানিয়ে নিয়েছো। সময়ের সাথে মানুষের আবেগ কমে। কোন আবেগের গুরুত্ব কমে, কোনটা বাড়ে। তোমাকে একেক সময়ে পরিভ্রমণ করিয়েছি। তুমি তার সাথে মানিয়ে নিয়েছো। আমরা ভালোবাসা দেখেছি, অভিমান দেখেছি, রাগ দেখেছি- শুধু তীব্র কষ্ট দেখিনি। আমরা কষ্ট অনুভূতিটা শিখতে চাই; অসহ্য সে কষ্ট। আমরা যন্ত্রণা শিখতে চাই,ভোঁতা যন্ত্রণা দেখতে চাই।"
ঠোঁট কামড়ায় কার্ল। "কি চাচ্ছো তোমরা?"
কন্ঠটা কিছু বলে না, কেমন যেন হেসে ওঠে। এ হাসি মানুষের হাসি না। তীব্র ভয়ানক এ হাসি। কার্ল মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা টের পায়।

সাত
বিকালের সূর্যটার দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকে পরী। কেমন যেন এক শূন্যতা ভর করে তার মাঝে। শুভ্র হারিয়ে গিয়েছে, কাউকে না জানিয়েই গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছে অজানা কোন গন্তব্যে। চেয়ারম্যান সাহেব চিন্তায় পড়ে গেছেন নতুন শিক্ষক পাবেন কোথা থেকে, শিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে মেতে উঠেছে, গ্রামের মানুষের মাঝে হাজারো কানাঘুষা- সবকিছুর আড়ালে মেয়েটির যন্ত্রণা কেন যেন অবহেলিত। অসহ্য সে যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণা ভালোবাসার যন্ত্রণা।

আট
বিশাল ঘরটায় আবারো আসা লাগলো কার্লের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারপাশটা দেখে সে। সেদিনকার লোকটা তার সামনে ইতস্ততভাবে বসে আছে।
"আমি তোমাকে 'তুমি' করে বলি? কোন সমস্যা আছে?"
"আপনি ইতিমধ্যে বলে ফেলেছেন।' হেসে ওঠে কার্ল। "বলুন।"
কেন যেন আমতা আমতা করে লোকটি। "তুমি কে?"
হেসে ওঠে কার্ল। "আমি? আপনার মত মানুষ।"
"সেটা না।"
"তবে?"
লোকটা কি বলবে ভেবে পায় না।
"খুব সম্ভবত ভ্রমণ করে বেড়ানো আমার পেশা। আমি সময় ভ্রমণ করি, অবস্থান ভ্রমণ করি- কষ্ট দিয়ে বেড়াই মানুষের অনুভূতিগুলোকে। কারো কাছে স্বপ্ন পুরুষ, সুন্দর স্বপ্নগুলো ভেঙে দেয়া অসম্পূর্ণ নায়ক। কারো কাছে কার্ল নামক মানসিক রোগী। আমি অনুভূতি শূণ্য। অবস্থান ভাঙি, সময় ভাঙি, ভালোবাসা ভাঙি, অনুভূতি ভাঙি- চরম এক পিশাচ।"
লোকটা কি বলবেন খুঁজে পান না। "আসি তাহলে।" কাগজ হাতে বেড়িয়ে যেতে নেন তিনি।
"অভিনন্দন।"
থমকে দাঁড়ায় লোকটি। "কেন?" পেছন ফিরে কার্লের দিকে তাকান তিনি।
"আপনার মেয়ে খুব সম্ভবত দ্বিতীয় ট্রাভেলার হতে যাচ্ছে।"
ম্লান হেসে ওঠেন লোকটি। "ট্রাভেলার।" আনমনেই বলে ওঠেন তিনি।


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

১২ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪