উজ্জয়িনী

কোমল (এপ্রিল ২০১৮)

এলিজা রহমান
  • ১২
নীরা যখন বাবা মাকে জানাল যে সে পুলিশ অফিসার হতে চায় , তারা নিজেদের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না , এত চাকরি থাকতে পুলিশ হবে তাদের রোগা পাতলা ছোটখাটো মেয়েটা ? পুলিশের কঠিন কাজ পুরুষদের মানায় ।

মিনারা বেগম দুপরের খাবার খেতে ডাকলেন মেয়েদের সঙ্গে তাদের বাবাকেও । তিনি দেখলেন মেয়ের চোখমুখ ভার ।তার দুই মেয়ে আর সমবায় ব্যাংকের অফিসার স্বামীকে নিয়ে ভালোই সংসার করেছেন , নীরা চাঁদপুর মহিলা কলেজ থেকে এবার ডিগ্রি পাশ করেছে আর ছোট মেয়েটা এবারে ক্লাস এইটে উঠেছে , মিনারা বেগম ভাবছেন নীরা যদি পুলিশ অফিসার হয় তাহলে মেয়েটাকে কে বিয়ে করবে তার কোন ঠিক আছে ? তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনীর সঙ্গে সময় কাটবেন সেটা কবে হবে কে জানে !

নীরার বাবা নিজাম সাহেব নীরাকে ভালবাসেন , মেয়েটা বুদ্ধিমতী আর সাহসী ছোটবেলা থেকেই । মেয়ের পুলিশ অফিসার হওয়াটা তিনি মনে মনে মানতে পারছেন না । মেয়েরা হল মায়ের জাত , তাদের নরম কোমল হাত তো অস্ত্র ধরার জন্য ? মেয়েদের তো অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার কাজ করবে না তারা শুধু স্বামীর দেখাশুনো আর সংসার ঠিকঠাকভাবে করবে এই তো ।

মিনারা বেগম দেখলেন মেয়ের ভাতের থালায় সবজি তরকারি পড়ে আছে ,নীরা মুখে খাবারটা তুলছে না । তিনি বলে ফেললেন ,` কিরে নীরা , ভাত খাচ্ছিস না যে ? তরকারি ভাল হয়নি বুঝি ?’

নীরা বলল , ` না মা , ঠিক আছে তো । তোমার রান্ধা তো সবসময়ই ভাল হয় । ’’

নিজাম সাহেব নীরাকে বললেন , ``বিসিএস দিয়ে একটা সরকারি কলেজে বা যে কোন অফিসের চাকরিতে ঢুকে পড় । আমি তো রিটায়ার করেছি ,তোমার বিয়ে দিতে হবে , মায়মুনার পড়াশুনার খরচ , সংসারের খরচ, তাই চিন্তা করছি সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে । ’’

`মা শাকভাজিটা অনেক মজা হইছে ’ , নীরা আনন্দের স্বরে বলল মিনারা বেগমকে , `ইলিশ মাছের দোপেয়াজাটা তো অসাম লাগতেছে খেতে । এটা কি শাক ভাজি মা ? ’’
` এটা ঘৃতকোমল শাক , ’ মিনারা বেগম হাসিমুখে বললেন । তাঁর রান্নার কেউ প্রশংসা করলে তিনি বাচ্চাদের মত খুশি হয়ে যান ।মনে অনেক আনন্দ হয় , মানুষকে রান্না করে খাইয়ে তিনি মানসিক তৃপ্তি পান এক ধরনের । নিজাম সাহেব কখনই মিনারা বেগমকে রান্না নিয়ে ভালমন্দ কিছুই বলেন না ,কোনরকম অভিযোগ ছাড়াই তিনি খেয়ে নেন ,তাতে রান্নায় লবন বেশি হোক বা না হোক কিংবা অতিরিক্ত ঝাল হলেও খেতে পারেন !

মিনারা বেগম বললেন , ` মেয়েদের সংসারই হোল আসল জায়গা , মেয়েদের আসল পরীক্ষা হচ্ছে সংসার , ঐ পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে সব পাশ , এটা আমার কথা না , তোদের প্রিয় হুমায়ুন আহমেদের কথা । ’’

নীরা হাসতে হাসতে বলল , ` মা তুমি ঠিকই বলেছ , কিন্তু কি জান , যেসব পুরুষেরা মেয়েদের উপর অত্যাচার করে , মেয়েদের বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে , ছোটছোট বাচ্চা মেয়েদের বিক্রি করে দিচ্ছে ,এসব অপরাধীদের তোমার কি মনে হয় না শাস্তি হওয়া উচিত ? আমি মানুষের সেবা করতে চাই মা , পুলিশের কাজ হচ্ছে জনগন বা মানুষের সেবা করা , আমি মেয়েদের আইনের মাধ্যমে সাহায্য করতে চাই , এটা কি আমি ভুল করছি তুমি বল ? ’’

নিজাম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিলেন , হঠাৎ করে বলে উঠলেন , ` হুম ,মা নীরা কি জান , কালকেই পত্রিকায় দেখলাম ; পুরুষ পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি নারী পুলিশরাও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছে । পুরুষ পুলিশ অফিসারদের তুলনায় নারী পুলিশদের কর্ম দক্ষতা আর সাফল্যের কথাও লিখেছে । হাইতি , কঙ্গো ,সুমালিয়া , আইভরি কোস্ট এসব বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশরাও দায়িত্বপালন করছে , এই সাফল্যের কারনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশী নারী পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বাড়ানোর কথা চিন্তা ভাবনা করছে জাতিসংঘ । আসলে কি জান নীরার মা ,পুলিশ কিন্তু জনগণের সেবক , তারা অনেক ভাল কাজও করে কিন্তু ভাল কাজের চেয়ে তাদের মন্দ কাজের প্রচারটা বেশি হয় বুঝলা ।’’

মিনারা বেগম ভেবে দেখলেন ,ঠিকই অন্যের নামে মন্দ কথা বলতে বা শুনতে মানুষের যত আনন্দ হয় অন্য কারো নামে সুনাম বা প্রশংসা করতে ততটা আনন্দের অনুভূতি হয়না অনেকের সঙ্গেই। মানুষ যেহেতু অন্যের নামে কেচ্ছা কাহিনী শুনতে আগ্রহী সেই কারনে ভাল কাজের কথা ততটা প্রচার পায়না সবখানে ।

নীরা বলল , ` মা ভেবে দেখ , একজন নারী পুলিশের কাছে একজন নির্যাতিতা নারী যেভাবে তার সমস্যার কথা খুলে বলতে পারে , একজন নারী তদন্তকারী অফিসারের কাছে একজন বাদী (নারী ) যেভাবে তার তদন্তের ব্যাপারে বা শারিরীক অসুবিধার কথা যেভাবে জানাতে পারে সেভাবে একজন পুরুষ পুলিশকে বলা সম্ভব হয় না । অনেক সময় তুমি শুনতে পাও যে ভিক্টিম একজন অল্পবয়সী বাচ্চা মেয়ে , তখন তো সে যে কোন পুরুষকে দেখলেই ভয় পাবে , তাকে সাহায্য করতে তো একজন নারী পুলিশকে এগিয়ে আসতে হবে , তাই না মা ?’’

মিনারা বেগম মনে মনে স্বীকার করে নিলেন যে তার মেয়ের কথায় যুক্তি আছে । আল্লাহর কাছে মেয়ের জন্য দোয়া চাইলেন তিনি তার মেয়ে যেন যোগ্যতা আর দক্ষতা দিয়ে একজন ভাল পুলিশ অফিসার হতে পারে ।
পুলিশে ৩ পদে নিয়োগ হয় , এসএসসি এর পর কনস্টেবল পদে , গ্রাজুয়েশনের পর পিএসসি এর মাধ্যমে সাবইন্সপেক্টর পদে ,আর বিসিএস দিয়ে এএসপি পদে নিয়োগ । এএসপি হচ্ছে ১ম শ্রেণীর পদ , এসআই হচ্ছে ২য় শ্রেণীর , পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৮০% লোকজন হচ্ছে কনস্টেবলরা । এরাই পুলিশবাহিনীর সবধরনের কাজকর্ম করে থাকে । এসআইরা করেন ইনভেস্টিগেশন বা তদন্ত । এএসপি থেকে আইজি এনারা হলেন সুপার ভাইজিং অফিসার ।

নীরা ইসলাম এখন একজন এএসপি ।তার কাজের মধ্যে এসআইদের সাহায্য করা ,থানার দৈনন্দিন যাবতীয় লেখালেখির কাজ করা , এফআরআই মামলার ডায়েরী , জেনারেল ডায়েরী ঠিকঠাক দেখে রাখা , অনেক সময় ফোর্সের স্বল্পতা থাকলে তাকে আসামি স্কট করতে হয় ,টহল , ওয়ারেন্ট ও সমন জারির কাজও করতে হয় , কোন এসআই অসুস্থ হলে তিনি তার কাজটাও করেন অনেক সময় । নীরার দিন শুরু হয় সকাল ৯টায় আর রাত্রি ১২টার আগে বাসায় ফিরতে পারে না । খুন , ধর্ষন , ডাকাতি এসব নিয়েই তার দিন শুরু হয় । পুলিশিং একটা ২৪/৭ চাকরি , Cops are always in the line of fire , ছুটি খুব কম পায় সে , আত্নীয়স্বজনদের বিয়ে শাদি, জন্মদিন সে খুব কম এটেন্ড করতে পারে ডিউটির জন্য । যাতায়াতের জন্য তাকে ড্রাইভারসহ গাড়ি দেয়া হয়েছে সরকারিভাবে , পুলিশ বলে তার আত্নীয়দের অনেকেই তাকে খাতির করে সেইসঙ্গে মিনারা বেগম , মায়মুনা আর নাজিম সাহেবকেও ; এটা তার খুব ভাল লাগে ।

আজকে একটা ঘটনায় তার মনে হচ্ছে নারী পুলিশ হলেও পুরুষেরা মেয়েদের এখনও শুধুমাত্র রক্তমাংসের নারীদেহই মনেকরে । তাদের যেন আর কোন মর্যাদা নেই । ঘটনাটা এরকম , একজন কলেজ ছাত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে এলাকার একটি ছেলে উত্ত্যক্ত করছিল , এতে মেয়েটার মা ছেলেটির বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দায়ের করেন থানায় । ওই অভিযোগের তদন্ত করার জন্য সেদিন সকালে এসআই নাজমুন নাহার আর কনস্টেবল খাদেম সরকার ছেলেটির বাড়িতে যান । এসময় ছেলেটির ছোট ভাই নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দেয় এবং পুলিশের সঙ্গে অসদাচরণ করতে থাকে । পুলিশের কাজে বাঁধা দেওয়ার কারনে পুলিশ অফিসার তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল । এখবর পেয়ে ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা পুলিশের গাড়ির থেকে আসামিকে নিয়ে যেতে চায় । পুলিশ তাকে ছাড়তে রাজি না হওয়ার এক পর্যায়ে তারা এসআই নাজমুন নাহারকে কিলঘুষি মারতে থাকে । এসআই নাজমুন নাহারকে রক্ষা করতে গেলে তারা কনস্টেবল খাদেম সরকারকেও মারধোর করতে থাকে । এমনসময় এস আই ওয়ারলেসের মাধ্যমে থানায় খবর দিলে নীরা তার ফোর্সের সঙ্গীসহ আর একজন এসআই অফিসারকে নিয়ে ঘটনাস্হলে গিয়ে হামলাকারীদের ৭জনকে থানায় নিয়ে আসে । এমনসময় ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে শুরু করে । ইভটিজিংয়ের অভিযোগকারীও এসময় থানায় উপস্থিত ছিলেন ।
আটককৃত কর্মীদের ছাড়াতে থানায় আসেন সরকারি দলের সভাপতি হাবিবুর রহমান মল্লিক ।
নীরা ইসলাম তাকে বলেন , ` আপনার ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা ইভটিজিং এর মত অপরাধ করেছে , নারী পুলিশ অফিসারকে মারধোর করেছে , পুলিশের কাজে বাঁধা দেওয়ার কারনে তা্কে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইভটিজিংয়ের অভিযোগের ভিত্তিতেই তাকে আটক করা হয়েছে , আপনারা কিভাবে বলছেন তাকে ছেড়ে দিতে ?’’

`ম্যাডাম আমরা ক্ষমতায় আছি , সেটা ভুলে যাবেন না ।’’ সভাপতি হাবিবুর রহমান মল্লিক ঠান্ডা গলায় বললেন ।
` আপনিও আপনার ছাত্র সংগঠনের ছেলেদের বলবেন তারা যেন ভুলে না যায় যে মায়ের গর্ভে তাদের জন্ম হয়েছে সেই মাকে যেন তারা সন্মান করে আর বর্তমান সরকারও একজন নারী , একজন মা , তাঁর সন্মান বাড়ে এমন কাজ করতে বলেন আপনার দলের ছেলেদের , ইভটিজিং , নারী পুলিশকে মারধোর এসব করে আপনারা কি তাঁর সন্মান বাড়াচ্ছেন ?’’
একটু থেমে নীরা আবার বলল ,` মনে রাখবেন নারী যেমন ভালবাসার কোমল হাতে সমাজ সংসারকে সিক্ত করতে পারে তেমনি শক্ত হাতে প্রশাসন এমনকি রাষ্ট্র্ কে পরিচালনা করতে পারে , আপনাদের কর্মীর বিরুদ্ধে নারী এসআই অফিসার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন , তাই মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আটককৃত ব্যাক্তিকে আপনারা ছাড়াতে পারবেন না । ’’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সালসাবিলা নকি সুন্দর প্লট। আপনি লিখেছেনও ভালো।
সাদিক ইসলাম ভালো হয়েছে তবে নাজমুন নামে এস আইকে মারার ঘটনাটি বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ আনলে হতো। শুভ কামনা ও ভোট রইলো। গল্পে আমন্ত্রণ।
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া এবার মনে হয় একটু বিরতি দিয়েই লিখলেন। লেখার বিষয়বস্তু, লেখকের উপস্থাপনা শৈলী পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে। এটাই লেখকের বড় অর্জন। আর পাঠক হিসেবেতো আমার বেশ ভালো লেগেছে। ভোট, পছন্দ, শুভকামনা। সময় পেলে আসবেন আমার কবিতার পাতায়। নিয়মিত লিখবেন।
মৌরি হক দোলা সুন্দর একটি বিষয়ের উপরে গল্পটি লিখেছেন... নীরার মতো মনমানসিকতার মেয়ে সত্যিই প্রয়োজন। ভালো লেগেছে... শুভকামনা....

১১ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪