ছারা বিবির শেষ রাত্রি

আঁধার (অক্টোবর ২০১৭)

ধুতরাফুল .
ছারাবিবি দেশলাই খুজে পাচ্ছেন না । মাগরিবের আজান হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন আগে। দোতলা বাড়ীর চারিদিকে বেশ কয়েকটা নারিকেলের গাছ। নারিকেল পাতার প্রান্তে সূর্যাস্তের শেষ আলো লেগে আছে সামান্য। ছারাবিবি চোখে ঠিকমত দেখেন না। বয়স তার প্রায় সত্তর ছুয়েছে। বিশাল প্রচীর ঘেরা বাড়িটাতে একাই থাকেন। বাড়ির সামনে বেশ বড় একটা বৈঠকখানা তবে সেখানে এখন কেউ তেমন একটা আসেন না। হাজী সাহেব বেঁচে থাকতে লোকজন গমগম করতো। হাজী সাহেব হচ্ছেন ছারা বিবির স্বামী হাজী করিম বকস্ । সোনাদহ গ্রামের সবাই তাকে হাজী সাহেব নামেই ডাকতেন। বাড়ীর প্রবেশ পথের দরজায় মাধবী লতার ঝাড় অযত্নে বেড়ে উঠেছে। ছারাবিবি মনে করতে পাচ্ছেনা তিনি দেশলাই কোথায় রেখেছেন। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার। আজকাল কিছুই মনে থাকে না । রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে ইতোমধ্যে। ঝিঁঝিপোকারা ডেকে চলেছে অনবরত। বাড়ির উত্তর দিকে লেবু বাগানে জোনাকীপোকারা তাদের আলো জ্বেলে দিয়েছে। মাধবীলতার গোড়ায় একটা বসার পিড়িঁ আছে। হাজী সাহের সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য অযূ করতেন। ছারাবিবি সেখানে বসেই মাগরিবের নামাজের জন্য অযু সেরে নিয়েছেন দিনের আলো থাকতেই। এই বাড়ির সব কিছু তার আপন শরীরের মত অতি চেনা। অন্ধকারে তেমন অসুবিধা হয়না। তিনি জায়নামাজে বসে আছেন অন্ধকারে। নামাজে মনঃসংযোগ করতে পারছেন না। আজকে কোন রান্না করতে পারেননি। দুপুরে মতি মিয়ার বাড়ী থেকে দু খানা রুটি খেয়েছিলেন। এক সময় তার বাড়িতে কত লোকজন গমগম করতো. দোতলা বাড়ির সামনের উঠোনে ঠেঁকির ঘরের কাছে বিশাল একটা রান্নাঘর। বড় বড় কাঠের চুলাই বড় সাইজের ডেকজিতে হরেক রকম রান্না হতো। হাজি সাহেব গোস্ত খুব পছন্দ করতেন। ছারাবিবির পছন্দ ছিল খাটি গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে লাল করে সেই দুধের সরে চিকন চালের ভাত মেখে খাওয়া। বাড়িতে এক সময় হাস, মুরগী দুধের গরু ছাগল পালিত হতো। ছারাবিবির তিন কন্যা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একমাত্র পুত্র জলিল সাহেব। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাস করেন মাইল তিনেক দুরে বোয়ালিয়া বাজারে । পুত্র জলিল সাহেব তার মা ছারাবিবিকে মাঝে মধ্যে দেখতে আসেন বাজারের ব্যাগ হাতে। তার ছেলের ঘরের বড় নাতি শান্ত আসে প্রতি রবিবার স্কুল ছুটি হলে। নতুন সাইকেল চড়া শিখেছে সে। ইংল্যান্ডের তৈরী র‌্যালী সাইকেলটি হাজী সাহেবের খুব শখের ছিল। সে দাদা বাড়ি এসেই চিৎকার শুরু করে দেয় দাদী আমার মাছ ধরার ছিপ কোথায়? ছারাবিবি যত্ন করে ছিপ গুছিয়ে রাখেন। পাশের সবজি ক্ষেতে কোদাল আর কচু পাতা হাতে চিকন চিকন লাল লাল কেঁচো সংগ্রহ করে শান্ত মাছের টোপ হিসেবে কাজে লাগায়।
এশার আজান হয়ে গিয়েছে। ছারাবিবি তখনও জায়নামাজে বসে আছেন তার শরীর ভীষন ক্লান্ত। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া দরকার কিন্তু তিনি যেতে পারছেন না। চারিদিকে অন্ধকার তা ছাড়া শৌচালয়টি বাড়ির উত্তরের দেওয়াল ঘেসে লেবু বাগানের কাছে। অন্ধকার রাতে তার পক্ষে একা সেখানে যাওয়া অসম্ভব। তিনি সাবধানে তার চৌকির বিছানায় উঠে বসলেন। প্রকৃতির ডাক সাথে ক্ষুধার যন্ত্রনায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েছেন। এই বাড়িতে যখন বউ হয়ে আসেন ছারাবিবি তখন তিনি এগারো বছরের অসম্ভব রুপবতী বালিকা। সাত গ্রামের মধ্যে তার মত রুপবতী আর কেউ ছিল না। প্রায় ছয় ফুট লম্বা দীর্ঘদেহী মানুষটাকে দেখে তো ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল ছারাবিবি। মানুষটা বড় ভালো ছিল। বিয়ের পরে তার জন্য কোলকাতা থেকে ভারী সুন্দর কারুকাজ করা একখানা পালঙ্ক কিনে এনে ছিল। তবে সেই খাট আছে দোতলায় হাজী সাহের ঘরে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে যাবার পর তিনি নিচের ঘরে নাতি নাতনিদের নিয়ে আলাদা ঘুমান। একমাত্র পুত্র জলিল সাহেবের স্ত্রী শহরের মেয়ে উচ্চ শিক্ষিতা। গ্রাম তার ভালো লাগে না । অজপাড়া গায়ে বিদুৎ নেই ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য ভালো স্কুল নেই। হাজী সাহেব তার একমাত্র ছেলেকে বোয়ালিয়া বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছেন অনেকদিন আগেই। সেই বাড়িতে ছারাবিবি দু একবার গেছেন। পুত্র জলিল সাহেবের বাড়িতে খোলা উঠোন নেই মাটির সোদাগন্ধ নেই তিনি বড়ই অস্থির বোধ করেন। সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে নিঃসঙ্গ একাকী স্বামীর ভিটেই আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি।

গভীর একাকিত্বের কষ্ট ছারা বিবির ভিতরে এক ধরনের ঘোরের সৃষ্টি করেছে। মলমূত্রে তার বিছানা একাকার হয়ে গিয়েছে। তিনি গোলাপের তীব্র গন্ধ অনুভব করছেন। এই গন্ধ তার অতি পরিচিত। পবিত্র মদিনা শরিফ থেকে এই আতর কিনে এনেছিলেন হাজি সাহেব। ছারাবিবির মনে হচ্ছে হাজি সাহেব তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন। তিনি কিশোরী কন্যার মত হাজী সাহেবের হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালেন। ধীরে ধীরে দরোজার কপাট খুলে বাড়ির সামনে পুকুরের রাস্তায় চলে এসেছেন। রাত্রির শেষ প্রহরে তখন কৃষ্ণপক্ষের আধখাওয়া চাঁদের আলো। তিনি হেটে চলেছেন আশ্বিনের জলে ভরা পুকুরের গহীনে।

আশ্বিনের জলে ভরা পুকুরে ছারাবিবির নিথর দেহ সাদা শাপলার মত দেখাচ্ছে। কোঁকড়ানো চুল আর তার কপালে লেগে থাকা জলের ফোটায় তখন সকালের সোনা রোদের ঝিঁকিমিকি ...........
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী মর্মান্তিক গল্প, খুব কষ্ট লেগেছে। যাদের ৩/৪ সন্তান থাকা সত্যেও মা কে বুড়ো বয়সে কষ্ট করতে হয়, আর এটা তো স্বাভাবিক বলা যায়। তবুও মনে খুব বেদনা জেগেছে....
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত গল্পটা পড়ে মন ভরে গেল । শুভকামনা । আমার পাতায় আমন্ত্রণ ।
মনজুরুল ইসলাম Very pathetic and real. We would not want to see the situation like sarabibi. Though the story is short but very meaningful.Good luck and stay fine.
thank u very very much to eyeing the short story.....ধুতরাফুল।
ফেরদৌস আলম অনেকদিন পর কিছু হারিয়ে যাওয়া কথার সন্ধান পেলাম অাপনার গল্পে। সামনে নিশ্চয় অনেক ভাল করবেন।
কাজী জাহাঙ্গীর আসলেই মন খারাপ করা গল্প। পরিবেশটা কেমন জানি চোখে জল এনে দেয়। তার ত একটা ছেলে ছিল যাদেরে ছেলেই নাই তাদের কী হবে তাহলে, ভাবতেই...। অনেক শুভকামনা আর ভোট রইল।
ধুতরাফুল . একটা মন খারাপ করা গল্প লিখেছি..সেই গল্প যতবার পড়ছি তত কষ্ট হচ্ছে পাঠকের সাথে সেই কষ্ট ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছে.....ধুতরাফুল

১৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪