বাবা আমার আজও কাঁদে

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

Shahed Hasan Bakul
  • ২০
  • 0
  • ৬৭
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ। চারিদিকে আতঙ্ক। পাক হানাদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন, নির্মম অত্যাচার। হাহাকার, চারিদিকে শুধুই হাহাকার। সন্তানের মা-বাবা হারানোর হাহাকার, মা-বাবার সন্তান হারানোর হাহাকার। ভাইয়ের বোন আর বোনের ভাই হারানোর হাহাকার। স্ত্রীর স্বামী আর স্বামীর স্ত্রী হারানোর হাহাকার। প্রিয়ার প্রিয়তম আর প্রিয়তমের প্রিয়া হারানোর হাহাকার। আত্মীয়স্বজন হারানোর হাহাকার। কারো বা আশ্রয়দাতা বিয়োগের হাহাকার। সেদিন এভাবেই নির্যাতিত হয়েছিল অনেক পরিবার। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সবাই।
অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের 'যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো' মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে শুধু নিপীড়িত জনগণই নয়, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে স্বাধীনতার লাল টুকটুকে সূর্যটা ছিনিয়ে আনার আত্মপ্রত্যয়ে কেউ জীবনের পরোয়া করেনি, কেউ পিছপা হয়নি। সবাই অনুধাবন করতে পেরেছিল, 'শিয়ালের মত একশ' বছর বাচার চেয়ে সিংহের মত একদিন বাচাও শ্রেষ্ঠ।'
লক্ষ লক্ষ নিষ্পাপ প্রাণ অকালে ছিনিয়ে নিয়েছে, হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত লুটেছে সেদিন নির্দয় পাষাণ পাক হানাদার বাহিনী। অতর্কিতভাবে হানা দিয়েছে হাজারো পরিবারের উপর, অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়েছে পরিবারের নিরীহ সদস্যদের উপর। সেই অতর্কিত হামলার অত্যাচার থেকে আমাদের পরিবারও রেহাই পায়নি। বিষাক্ত সাপের মত ছোবল তারা ঠিকই মেরেছিল। কৌতুহলভরে এ সবই শুনেছি বাবার মুখ থেকে। যুদ্ধের সময় আমার জন্মই হয়নি। ব্যথায় বুক ভেঙ্গে আসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারিনি বলে।
বেড়বাড়ী। সখীপুর থানার ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে 'লৌহজং' নদী। নদীর ধারেই বিরাট বাড়ি। ছোট্ট একটি পরিবার। দাদা, দাদী, চাচা, আমার বাবা-এই চারজন নিয়ে দাদার পরিবার। এই পরিবার থেকেও সবাই যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল প্রত্যক্ষভাবে। বিখ্যাত টাঙ্গাইলের সুসন্তান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দীকি'র অসাধারণ ক্ষমতাবলে সতের হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও সত্তর হাজার স্বেচ্ছাসেবকের সমন্বয়ে গড়ে উঠে "কাদেরিয়া বাহিনী" নামে এক বিশাল বাহিনী। সেই বাহিনীর একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আমার চাচা এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন আমার অল্পবয়সী বাবা। সেই বয়সে বাবা ভালভাবে বুঝেনি যুদ্ধ কি জিনিস, কি বা তার উদ্দেশ্য? স্বাধীনতা আর পরাধীনতার পার্থক্য নির্ণয় করার মত বোধ শক্তি তখন বাবার ছিল না। তবু তিনি সানন্দে নেচে গেয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেছে মুক্তি বাহিনীদের। বৃদ্ধ দাদাও সহযোগিতা করেছে বিভিন্নভাবে। চাচা বেশীর ভাগ সময়ই থাকত বাইরে। মাঝে মধ্যে আসলেও রাত দ্বি-প্রহরের সময় আসত।
'৭১ এর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি (সঠিক তারিখটা বাবা বলতে পারেনি) এক ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে পাক হানাদার বাহিনী অতর্কিতভাবে হানা দেয় আমাদের পরিবারটির উপর। ভয়ে আমার বাবা খাটের নীচে লুকিয়ে ছিল। খাটের নীচ থেকে বাবা সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। সাতজন পাক হানাদার ঘরে প্রবেশ করেছিল। আর হ্যাঁ, বলা শ্রেয় , পাক হানাদাররা খটখট করে দরজার কড়া নাড়ছিল আর কি যেন বলছিল। সবাই বুঝতে পেরেছিল পাক বাহিনীই হবে তাই কেউ দরজা খুলতে চাইছিল না। চাচা অসীম সাহস নিয়ে দরজা খুলতে গিয়েছিল। কিন্তু দাদী তাকে বারণ করেছিল। তাই অবশেষে পাক হানাদাররা দরজা ভেঙ্গেই রুমে প্রবেশ করেছিল। বাবা যেখানে লুকিয়েছিল সেখান থেকে সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সবই শোনাও যাচ্ছিল। কিন্তু পাক হানাদাররা কি বলছিল বাবা তার সব বুঝতে সক্ষম হননি। তবে দাদীকে তারা কিছু বলছিল না। হয়তো ষোড়শীর সেই যৌবন ছিল না বলেই নরপিশাচদের ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আমার চাচার গায়ে ধাক্কা দিয়ে তারা যেন কি জিজ্ঞেস করছিল। বাবা উর্দু এবং বাংলার পার্থক্য বুঝতে পারেননি। শুধু অন্য ভাষায় যে কথা বলেছে তা বুঝতে পেরেছে। যা বলছিল তা থেকে তিনি শুধু 'নাম' ও 'কাদের' এই দু' টি শব্দই বুঝেছিল। আমার মনে হয় আমার চাচা যে কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল তা টের পেয়ে গিয়েছিল পাক হানাদাররা। এজন্যই হয়তো আমাদের বাড়ি আক্রমণ করেছিল। আর জিজ্ঞেস করেছিল, 'তেরা নাম কিয়া হ্যায়? তুম কাদেরকো সাথ কাম করতে হো?' কিন্তু চাচা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোন কথাই বলেননি। পেছন থেকে একজন লোক এসে চাচাকে লাথি মেরে ঘরের মেঝেতে ফেলে দেন। চাচা পড়ে গেলেই অন্যরাও সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। দাদা দাদী তাদের ছেলের এই অবস্থায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। 'আমার ছেলেকে মেরো না। আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও।' এসব বলে কাঁকুতি মিনতি করে কেঁদেছে। দাদা দাদীকেও তারা বন্দুক দিয়ে পিটিয়েছে নির্মমভাবে। চাচার হাত দু'টো পিঠ মোড়া করে বেধে, মুখ কাপড় দিয়ে বেধেছিল। চাচাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। ছেলেকে তুলে নিয়ে যাবে এ সহ্য করতে না পেরে দাদা প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদারদের উপর। এতে দাদার উপরও তারা ভীষণ রেগে যায়। তারা তখন দাদাকেও রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। স্বামী বিয়োগের আর্তনাদে বুক ফেটে যায় দাদীর। দাদী দাদাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যে আর ছাড়তে চায় না। পাক হানাদাররা দাদীর উপর লাঠি চার্জ শুরু করে। দাদী কোনমতেই দাদাকে ছাড়তে চায় না। বাবা আমার ভয়ে কাঁপছিল। যেমনটি কাঁপে শীতের সকালে খালি গায়ে বসে থেকে। এত ভয়ের মধ্যেও বাবার মায়ের উপর এত অত্যাচার দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল সেদিন। ভয় ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হানাদারদের উপর। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে, কি আর করবে সে! 'ডাকাত বদমাইশের দল, ছেড়ে দে আমার মা-বাবা-ভাইকে' বলে চিৎকার করেছে। দাদীকে এমনভাবে মেরেছিল যে দাদী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। দাদার উপরও অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল পাক বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্দয় নরপিশাচরা। বন্দুক দিয়ে বাবার পায়ে কয়েকটি বাড়ি মারে। এরপর বাবাকে উঁচু করে শূন্যে উঠিয়ে মাটিতে ছুড়ে মারে। বাবার একটি পা ভেঙ্গে যায়। বাবা আর কিছু বলতে পারে না। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকেন। দাদা আর চাচাকে তারা নিয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা দাদীকে জড়িয়ে ধরে বাবা কাঁদতে থাকেন। বাবার চোখের জল টপটপ করে পড়ছিল দাদীর গায়ে।
সময় বহমান। কারো জন্যই থেমে থাকে না। দাদা চাচাকে নিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই দাদী মারা যান। দাদী মারা যাওয়ার পরদিনই দেশ স্বাধীন হিসেবে ঘোষিত হয়। তারপর থেকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যুগের পর যুগ সময় চলছে তার নিজস্ব গতিতে। কিন্তু বাবা আমার সেই দিনের কথা আজো ভুলতে পারেনি। দাদা চাচার কেউই আজ অবধি ফিরে আসেনি। বাবাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। সেই দিনের সেই বেজন্মা নরপশুদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা কি ভোলার মত! না তা সম্ভব নয়। তাই সেদিনের কথা মনে করে আজো বাবা তীর বিদ্ধ পাখির মত ছটফট করে। আজো কাঁদে নীরবে নিভৃতে, চিবুক বেয়ে চোখের গরম জলের স্রোত পড়ে অঝোর ধারায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রাজিয়া সুলতানা আপনি এত সুন্দর করে লিখেছেন মনেকরে ছিলাম সত্যি আপনার বাবারই অর্থাত আপনাদের পরিবারেরই কাহিনী/অথচ এটা যে কাল্পনিক ভাবে বাবার উক্তিতে লিখেছেন ভাবতে পারিনি/অনেক সাবলীল লেখা/আপনাদের লেখা থেকে যায় অনেক কিছু শেখা/...
ওয়াছিম কেন জানি চোখে পানি চলে আসলো।
সূর্য ভালো লাগলো..... তবে মনে হলো আরো ভালো করার সুযোগ ছিল।
Shahed Hasan Bakul asole babake nie lekha holeo ata kalponik...apnader dooay amar baba susthoi asen...
Shahed Hasan Bakul osongkho donnobaad sobaike....
বিন আরফান. kintoo bondhoo apni khoob valo likhen. nete aktoo somoy din bijoy apnake hatchhani diye daktechhe.

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪