সমুদ্র বিষাদ

প্রিয়ার চাহনি (মে ২০১২)

আহমেদ সাবের
  • ৩৪
আমরা হেটে যাচ্ছি। এ পথ দিয়ে প্রায় বছর পাঁচেক আগেও হেটে গিয়েছিলাম। অবশ্য তখন ছিল গরম কাল। আর সময়টা ছিল বিকেল বেলা। সেবার আমার মেডিকেলের ফাইনালের পর, ইন্টার্নশিপের আগে বেড়াতে এসেছিলাম সুখ নগরে ছোট খালার বাড়ীতে। কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে, মাছ মেরে আর খালাতো ভাই রাজুর হুজুগে তাল দিয়ে। ওদের বাড়ী থেকে তারাগঞ্জ মাইল তিনেকের রাস্তা। ধীরে সুস্থে হেটে গেলে ঘণ্টা খানেক লাগে। তারাগঞ্জ এসেছিলাম ঘুরতে। ফিরে যাচ্ছিলাম বিকেল বেলা।


তারপর সুখ নগরের সুখী নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আমি ইন্টার্নশিপ শেষ করে পটুয়াখালীতে পোস্টিং পেলাম। ছিলাম শহরের ছেলে। ছুটি ছাটায় খালার বাড়ী ছাড়া গ্রাম কখনো দেখিনি। আত্মীয়-বন্ধু বিবর্জিত ছোট শহরটায় মন বসল না। ধান্ধায় থাকলাম, কখন সটকে পড়তে পারি। হয় বিদেশ নইলে একটা ভাল যায়গায় পোস্টিং। এক বন্ধু জানাল, অষ্ট্রেলিয়া যাবার একটা রাস্তা আছে - তবে ডাক্তার হিসেবে নয়, নার্সিং 'এর ছাত্র হিসেবে। ওখানে নার্সদের বেশ ডিমান্ড। নার্সিং 'এর কোর্স শেষ করার পর চাকরী আর অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব মেলার সম্ভাবনা আছে। তখন ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশনের পরীক্ষা পাশ করে ডাক্তারি পেশায় ফিরে যাওয়া যাবে। কথাটা মনে ধরল।


মার গহনা বেচে ভর্তির যোগাড়যন্ত্র করে পাড়ি দিলাম অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের পথে। কেমন করে তার পর তিনটা বছর কেটে গেল। নার্সিং কোর্স 'এর সাথে সাথে ডাক্তারির রেজিস্ট্রেশনের পড়াও চালিয়ে গেলাম। নার্সিং ডিপ্লোমা শেষ করার সাথে সাথে চাকরী পেলাম। পরের বছর পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি হল। এদিকে ডাক্তারির রেজিস্ট্রেশনের পরীক্ষাটাও পাশ করলাম এবং সিডনী থেকে প্রায় চার 'শ কিলোমিটার দূরে অলবারী নামে একটা শহরের হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়ে ছয় মাস পর ছুটিতে আসলাম দেশে।


দেশে এসেই শুনলাম, রাজুর বিয়ে। ও বয়সে আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট। গতবার আমি যখন ওদের বাড়ী এসেছিলাম, সে স্থানীয় কলেজে বি,এ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত। পরে সে বি,এ পাশ করেছে কি না, মা ঠিক বলতে পারলেন না। তবে এখনো নাকি সে ছাত্র। পরীক্ষা এলে নানা অজুহাতে এড়িয়ে যায়। ওর বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগেই ওকে সঙ্গ দেবার জন্য হাজির হলাম আমি। বাসে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকা থেকে তারাগঞ্জ এসে নামতেই দেখলাম, রাজু তার দলবল নিয়ে হাজির। দলবল মানে, রাজুদের কাজের ছেলে আক্কাস আলী আর ওর ছায়া-সঙ্গী মজিদ।


চলেন ইমন ভাই, নৌকা লইয়া আইছি। আমাকে দেখেই বলে উঠলো রাজু।


হেটে যাওয়া যাবে না? মাঠ শুকায় নি? আমি স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাজুর দিকে তাকাই।


তা যাওন যাইবো না ক্যান। চলেন, আপনে যখন চাইছেন, হাইটাই যাই। আক্কাস আলী, ইমন ভাইয়ার মালপত্র লইয়া তুমি নৌকা নিয়া চইলা যাও।


আক্কাস আলী চলে যেতেই আমরা তিনজন পথে নামলাম – আমি, রাজু আর মজিদ। তারাগঞ্জ বাজারের সীমানার শেষে সুখী নদীর পাশের বেড়ী বাঁধ ধরে মাইল দুয়েক গেলে মণ্ডল বাজার। সেখান থেকে গ্রামের রাস্তা ধরে আরও এক মাইল পর সুখ নগর, রাজুদের বাড়ী। মণ্ডল বাজার থেকেও খাল দিয়ে নৌকায় করে রাজুদের বাড়ী পর্যন্ত যাওয়া যায়। বর্ষা কালে বেড়ী বাধ ছাড়া রাস্তাটার বেশীর ভাগই থাকে পানির নীচে।


পুব আকাশ জুড়ে বিরাট একটা চাঁদ উঠেছে। শীতের শুরু। একটু ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। শীতকাল বলেই নদীতে তেমন পানি নেই। বেড়ী বাঁধ থেকে একটু দূরে চিক চিক করে বয়ে যাচ্ছে নদীটা। এখানে সেখানে জ্বলছে আর নিভছে জোনাকিরা।


কি ইমন ভাই, চুপ মাইরা গেলেন যে? রাজুর কথায় সম্বিত ফিরে পাই আমি।

না না, চুপ মারলাম কই? তুই তো বিয়ের ব্যাপারে আমাকেও টপকে গেলি। বলা নাই, কওয়া নাই। পড়াশুনাটা শেষ করলি না। হঠাৎ করে বিয়ের ঝোঁক মাথায় চাপল কেন তোর মাথায়? আমি প্রশ্ন করি রাজু কে।


আমার মাথায় ঝোঁক চাপল কই? বাপে করাইতাছে। যারে বিয়া করুম, তারে ভাল মত চোখেও দেখি নাই। বাপে দেখছে, বইনে দেখছে। আমারে হুকুম দিল, বিয়া কর। আমি কইলাম, কবুল।


ভাইজান, সুমনা আপার জিনিষটা গতকাল পৌঁছাইয়া দিছি। আপনেরে যাইতে কইছে। রাজুকে উদ্দেশ্য করে বলে মজিদ।


আবার দেখা হইলে কইস, সময় পাইলে যামু নে। বলল রাজু।


সুমনা কে রে? আমি বোকার মত প্রশ্ন করি রাজুকে।


উত্তর দেয় মজিদ। ভাইজানের বান্ধবী। ভাইজানের আর ও দুইডা বান্ধবী আছে। মজিদের খি খি হাসি রাতের বাতাসকে ভারী করে তোলে।


এসব এখন ছাড় রাজু। কদিন বাদে বিয়ে করতে যাচ্ছিস। রাজুকে উদ্দেশ্য করে বলি আমি।


বিয়াডা ত আমার ইচ্ছায় হইতাছে না। ওনাদের ইচ্ছা মত ওনারা বিয়া ঠিক করলো। আমিও আমার ইচ্ছা মত আমারডা করুম। প্রতিবাদী হয়ে উঠে রাজু।


দু জন মানুষ পাশ কাটিয়ে প্রায় ছুটে গেল আমাদের গা ঘেঁষে। ওদের পদশব্দে আমার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল?


কেডা গেল রে মজিদ। ফ্যাশফ্যাশে গলায় বলল রাজু। সাবধানে থাকবি। অইডা আছে লগে? প্রশ্নটা মজিদকে।


হ, আছে। পকেট থেকে বস্তুটা বের করে দেখাল মজিদ। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠল পিস্তলটা।


যায়গাডা খারাপ ইমন ভাই। গত চেয়ারম্যান ভোটের সময় আমাগো এক সাপোর্টাররে এই এলাকার দবির উদ্দিনের লোকেরা জবাই কইরা মাইরা ফালাইছিলো। আব্বায় হারলো, এইখানে ভোট পাইলোনা বইলা। ফিস ফিস করে বলল রাজু।


চাচায় এইবার খাড়াইলে আর হারবো না। দবির উদ্দিনের ভাইস্তিরে বিয়া করতাছেন আপনে। এই এলাকার জামাই হইবেন। সব ভোট পড়বো চাচার বাক্সে। চাচার বুদ্ধি চুলের গোঁড়ায় গোঁড়ায়। এক ঢিলে দশ পাখী মারা পড়বো। মজিদ বলতে থাকে। সাথে ওর বিখ্যাত খি খি করে হাসি।


আবার আমরা হাটতে থাকি। জোনাকির আলো জ্বলে আর নিভে, নিভে আর জ্বলে। আমার মনেও আলোর জ্বলা নিভা শুরু হয়ে যায়। আমি কোন মন্ত্রবলে অতীতে চলে যাই। সেবার মণ্ডল বাজারের কাছে আসতে আসতে সূর্যটা হেলে পড়েছিল পশ্চিমে। আমরা বাজার পেরিয়ে একটু সামনে যেতেই দেখলাম, একটা বাড়ীর সামনে ছোট খাট জটলা।


কি হইছে। জটলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো রাজু।


তিথি আপা বারান্দা থেইকা পইড়া পা ভাইঙ্গা ফালাইছে। উত্তর দিল একটা মেয়ে।


কি কইলি? কি হইছে? কেমনে ভাঙ্গল? বলতে বলতে ছুটে বাড়ীর ভেতরে ঢুকে গেল রাজু। আমি আর মজিদ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।


দু পাশে শূন্য ক্ষেত। গায়ে গরম কাপড় আছে। তবুও একটু যেন শীত করছে। নদীর এক যায়গায় জোনাকিদের মেলা বসেছে। আমার মনে সেদিনের ঘটনাটা হাজার জোনাকি হয়ে ফুটে উঠলো। আমি আবার ফিরে গেলাম অতীতে।


একটু পরেই ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো রাজু। আসেন, ভিতরে আসেন ইমন ভাই। বলে আমাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল সে।


খালাম্মা, এই যে আমার খালাত ভাই – ইমন ভাই, ঢাকা শহরের বড় ডাক্তার। তিথির কপাল ভাল, সময় মত তাইন রে পাওন গেল।


কি বলিস তুই? আমি রাজুকে ফিস ফিস করে বলি। আমি তো এখনো ডাক্তার হইনি। সবে পরীক্ষা দিলাম।


ওই এক কথা। শুধু কাগজটা পাওন বাকী। দেখেন, তিথির পা ভাইঙ্গা শেষ। আপনি ছুঁইলেই ভালা হইয়া যাইবো।


আমি রোগীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বারান্দায় একটা পিড়িতে বসে। ব্যথায় মুখটা নীল হয়ে আছে।


এই, ডাক্তার সাব রে একটা চেয়ার দেও। বলে হইচই শুরু করে দিল রাজু। আমি লজ্জায় মরে যেতে লাগলাম।


একটা ছেলে বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে আসার সাথে সাথে রাজু, বসেন ডাক্তার সাব, বসেন – বলে আমাকে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিল। আমি অস্বস্তিতে ঘামতে লাগলাম।


ডাক্তার সাব, দুপুর কলেজ থেইকা আইসা দৌড়াইয়া ঘরে ঢুকনের সময় পিছলা খাইয়া পইড়া ...। কাঁদতে কাঁদতে বাকীটা শেষ করতে পারলেন না তিনি। আমারই দোষ। ঘর লেপনের সময় বেশী পানি দিয়া ফালাইছি। লেপাডা শুকাইলোনা বইলা পিছলা খাইয়া আমার মাইয়াডা পা ভাঙ্গল।


আমাদের চার পাশ ঘিরে একটা ছোট খাট জটলা জমে উঠলো।


আমার গলা শুকিয়ে আসছে লজ্জায়। মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। স্যারদের পেছনে পেছনে রুগী দেখা আর জলজ্যান্ত রুগীর সামনে বসে থাকা কি এক কথা হল? কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমার মেডিক্যাল কলেজের ছ বছরের সমস্ত জ্ঞানের সাগর মন্থন করে এক কণা অমৃতের জন্য লালায়িত হয়ে উঠলাম আমি।


দূরে গ্রামের সীমায় আকাশের নানা রঙের মেঘের মাঝখান দিয়ে সূর্যটা তরল সোনার মত গলতে গলতে হারিয়ে যাচ্ছিল দিগন্ত রেখায়। এক বয়স্কা মহিলা এক বাটি গরম তেল এনে তিথির পায়ে হাত দিতেই হুশ হল আমার। আরে, করছেন কি মহিলা। এ সময় ব্যথার যায়গাটাকে নাড়াচাড়া করতে হয় না। গরম কোন কিছু দিতে হয় না। মহিলা ঠিক উল্টোটা করতে যাচ্ছেন।


থামেন। নিজের অজান্তেই বোধ হয় চিৎকার করে উঠেছিলাম আমি। এখন পায়ের নাড়াচাড়া একদম বন্ধ রাখতে হবে। গরম কোন কিছু দেয়া যাবে না। বললাম ধীরে ধীরে। বাড়ীতে বরফ আছে? তিথির মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।


না, নাই। তিথির মা উত্তর দেবার আগেই বলে উঠলো রাজু। মজিদ, এক দৌড়ে এক্ষুনি মণ্ডল বাজারে যাবি। ফরিদের রেষ্টুরেন্টে বরফ আছে। আমার কথা বইলা কিছু বরফ লইয়া আয়।


আর ফার্মেসী থেকে জ্বর বা ব্যথার ওষুধের একপাতা টেবলেট নিয়ে আসবে। মজিদকে বললাম ডাক্তারোচিত গম্ভীর কণ্ঠে।


ব্যথার টেবলেট লাগবো না; বাড়ীতে আছে। বললেন তিথির মা।


মজিদ চলে গেল। ও যেতে যেতেই উপস্থিত জটলাকে নিয়ে পড়লো রাজু। কি আপনাগো কাজ কাম নাই। খাড়াইয়া খাড়াইয়া তামশা দেখন লাগবো না। যান, নিজ নিজ কামে যান। রাজুর তাড়া খেয়ে ভিড় আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে আসলো।


টিবিয়া, টেলুশ, ফিবুলা, লিগামেন্ট, সিন্ডেসমোসিস, এঙ্কেল স্প্রেইন - শব্দগুলো আমার মাথার মধ্যে ঘূর্ণিবায়ুর মত ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি নিশার পায়ে হাত রাখলাম। যায়গাটা গরম হয়ে আছে। বেশ ফুলে উঠেছে। এক্স-রে ছাড়া লিগামেন্ট ছিঁড়েছে কি না, বুঝার উপায় নেই।


ওনাকে ঘরে নিয়ে যান। তিথিকে দেখিয়ে ওর মাকে বললাম আমি। সাবধান, ভাঙ্গা পা টা যেন মাটিতে না লাগে।


তিথির মা আর অন্য মহিলা ওকে ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন।


আমি বারান্দায় চেয়ারে বসা। আমাদের জন্য বোধ হয় চা বানানো হয়েছিল। রাজু আমার হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে বলেছিল, ইমন ভাই, নেন, চা খান।


চা খেতে খেতেই রাজুর কাছ থেকে জানলাম, তিথি স্থানীয় কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। খুব ভাল ছাত্রী। এস এস সিতে স্ট্যান্ড করেছে। মজিদ ফিরেছিল একটা পলিথিন ভর্তি বরফের ভাঙ্গা টুকরা নিয়ে। আমরা ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। মজিদের হাতের ব্যাগ থেকে বরফ নিয়ে একটা গামছায় পেঁচিয়ে তিথির এঙ্কেলে চেপে ধরলাম। আমার হাত কাঁপছিল, বুকের মধ্যে হাজার হাতুড়ি পেটানোর ধুপ ধাপ শব্দ। প্রথম ডাক্তারির উত্তেজনায় না অন্য কিছু?


বরফ গলছে আমার হৃদয়ের মত। বিছানার তিথির পায়ের নীচে একটা কাঁথা ভাজ করে দেয়া হল। তার উপর এক টুকরা পলিথিন। বরফ গলা শেষ হতে আমি গামছায় নতুন করে বরফ নিলাম।


আমারে দেন ডাক্তার সাব। আপনে একটু জিরান। বলে তিথির মা এগিয়ে এলেন।


আমি একটা চেয়ারে বসলাম। চোখ বুলিয়ে নিলাম ঘরটায়। রাজু বসে আছে আরেকটা চেয়ারে। দশ বার বছরের দুটো ছেলে তিথির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। একজন বয়স্কা মহিলা তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।


কি মন্ত্র বলে যে গলায় জোর ফিরে পেলাম, জানি না। বললাম, চিন্তা করার কিছু নাই। বরফের পট্টিটা চালিয়ে যান ঘণ্টা খানেক। পা টা নাড়াচাড়া একদম বন্ধ আজ রাতের জন্য। দুটো ব্যথার টেবলেট এখনি খাইয়ে দেন। আশা করি কাল সকালের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে। যদি না কমে তারাগঞ্জ নিয়ে এক্স-রে করতে হবে। ভয়ের কিছু নাই। আমি আছি আরও সপ্তাহ খানেক। এখন আমরা আসি। কাল সকালে আবার আসবো। বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।


বাবা, আপনেরে আল্লায় না পাঠাইলে কি যে সর্বনাশ হইত আমার মাইয়াডার। তিথির পায়ে ঠাণ্ডা বরফের পট্টি দিতে দিতে বললেন তিথির মা। যা ত পলাশ, ডাকতার সাবেরে একটু আগাইয়া দিয়া আয়। ছেলেদের এক জনকে বললেন উনি। বোধ হয় বড় ছেলের নাম পলাশ।


আমি খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। এই প্রথম বারের মত তিথির চোখে চোখ রাখলাম। তিথি আমার চোখে চোখ রাখল। ওর চাহনি আমার হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গেল। আমি বললাম, ভয়ের কিছু নেই। কাল সকালে আবার আসবো। তিথির মুখের ব্যথার নীল পদ্মের মাঝে এক টুকরো হাসির গোলাপ ফুটে উঠলো মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুরের মত।


না আমি কথা রাখতে পারিনি। তিথিকে বলেছিলাম, কাল সকালে আবার আসবো। কিন্তু সে কালের পর কত কাল গত হয়ে গেল। আমার আর আসা হল না। সেদিন রাতেই ঢাকা থেকে ফোন আসলো, বাবার হার্ট এটাক হয়েছে। রাত থাকতেই নৌকা করে তারাগঞ্জ; ভোরের বাসে ঢাকা। তারপর বাবাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতাল, তারপর ব্যাংকক। ফিরে আসার পর আমার ইন্টার্নশিপ শুরু হয়ে গেল মিটফোর্ডে। সেই মিরপুর থেকে মিটফোর্ড, দিনের পর। ইন্টার্নশিপ শেষ হবার পর পটুয়াখালীতে পোস্টিং। হারিয়ে গেল তিথি।


এবার রাজুর ফোন পেয়ে সুখ নগরে আসার কথা হতেই, মনে পড়ে গেল আবার তিথির কথা। জীবন তো এমনই। কত স্মৃতি মনের মধ্যে চাপা পড়ে থাকে। ঘটনাচক্রে আবার হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়। আবার মনে পড়ে গেল তিথির মুখের ব্যথার নীল পদ্মের মাঝে এক টুকরো হাসির ছবিটা। মা জোর করে ধরেছেন, এবার ছুটি থেকে ফেরার আগে যেন বিয়ে করে যাই। মাকে বলে এসেছি, দেখো, রাজুর বিয়ের দিন হয়তো আমিও বিয়ে করে ফেলতে পারি। মা হেসে উঠে বলেছেন, তা হলে তো আমি মেয়ে দেখার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাই। তারাগঞ্জ নেমেই ইচ্ছে হয়েছিল, রাজুকে জিজ্ঞেস করি তিথির কথা। কোথায় আছে, কেমন আছে তিথি? পড়াশুনা কি শেষ হয়েছে? সে কি এখনো অবিবাহিতা? কিন্তু সঙ্কোচের ব্যূহ ভেঙ্গে কথাটা মুখে আনতে পারিনি। মনের কথা মনেই রয়ে গেছে।


রাজু, এই বাড়ীটায় তুই আমাকে একবার নিয়ে গিয়েছিলি না? তিথিদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যেতেই প্রশ্নটা করলাম আমি।


কবে? মনে নাই তো। বলল রাজু।


মনে নাই? বলে উঠলো মজিদ। ইমন ভাইজান গতবার যখন আইছিল, তিথির মা মচকাইছিল বইলা আপনে তাইনরে অগো বাড়ীত নিয়া গেছিলেন।


বাদ দেন ত ওই সব অকৃতজ্ঞ মাইয়া মানুষের কথা ইমন ভাই। তিথির কথা এড়াতে চাইল রাজু।


কেন, তিথি অকৃতজ্ঞ হল কি করে?


অকৃতজ্ঞ না ত কি? আপনে চইলা গেলেন ঢাকা ভোরের ট্রেনে। আপনেরে ট্রেনে তুইলা দিয়া আইসা দেখি তিথি এক্কেবারে ঠিক হইয়া গেছে। ব্যথার নাম গন্ধ নাই। আমারে কইল আপনেরে খবর দিতে, ‘আমি ভাল আছি। ভাল হইয়া গেছি’। কদিন পরে কলেজ থেইকা ফিরার পথে ডাকলাম। আমারে পাত্তাও দিল না; যেন আমারে চিনে না। আমি সেই দিন না থাকলে হারামজাদী নুলা হইয়া থাকতো। অকৃতজ্ঞ না হইলে এমুন ব্যাবহার করে।


বলিস কি রে? আমি অবাক হই।


শুধু এই নাকি? আমার নামে আজে বাজে কথা রটানো শুরু করল, আমি না কি ছেলে ভাল না। মেয়েদের পিছনে লাগি। মেয়েরা আমার সাথে ভাব করে, তাতে ওর কি?


রাজু, খুব খারাপ লাগছে তোর কথা শুনে। রাজুকে সান্ত্বনা দেই আমি। যাক, এখন সে কোথায়?


হেইডা আমি কি কইরা জানি। গেরাম ছাইড়া নাকি কই চইলা গেছে। বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় রাজু। যেমন কর্ম, তেমন ফল। আমি ত ওরে বন্ধু বানাইতে চাইছি; খারাপ কিছু চাই নাই। আমার লগে তারাগঞ্জে সিনামা দেখতে লইয়া যাইতে চাইছি। আমার কথা শুনলোনা। চিনেনা আমি কেডা। দিছি সব গোমর ভাইঙ্গা। আপন মনে বকতে থাকে রাজু।


কি করে গোমর ভাঙ্গলি?


কি কইরা আর? দিলাম একদিন মুখে এসিড মাইরা আন্ধা কইরা।


কি বললি? থানা পুলিশ হয় নি? আমি চিৎকার করে উঠি।


গেছিল বাপেরে লইয়া থানায়। অবজ্ঞাভরে বলল রাজু। দারোগা সাবে কইল, সাক্ষী কই? সাক্ষী লইয়া আহেন। বলে হো হো করে হেসে উঠলো সে। সাথে যোগ দিল মজিদ ওর প্রেতের হাসি নিয়ে।


রাজুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। রাস্তার মাটির সাথে পা আটকে গেল আমার। তিথির মুখে ছুড়ে মারা এসিডটা যেন আমার চোখে মুখে এসে পড়লো। আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। অন্ধকার, অন্ধকার। একরাশ অন্ধকারের মাঝে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সঞ্চিতা সাবের চাচা, অনেক দিন পর গল্পকবিতায় ঢুকে আপনারটি ই প্রথমে পরলাম --অসাধারণ, 'রাজুর যে চরিত্র -- ( মফস্সলের বিত্তবানদের ছেলেরা দাপুটে -বদ- খেয়ালি হয় ) তারই দারুন চিত্র অঙ্কন করেছেন নিটোল হাতে . তিথির ১ টুকরো হাসি -জীবনের প্রথম প্রেম ই বলা যেতে পারে ....না কি বলেন চাচা? '
ধন্যবাদ সঞ্চিতা। তোমাকে অনেকদিন পরে পেয়ে ভাল লাগল। বাবা সংখ্যায় তোমার লেখা থাকছে তো?
মোঃ শামছুল আরেফিন গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে আমি তো চাচা ভাষা হারিয়ে ফেললাম মনে হচ্ছে। গল্পের শেষটা যে এত করুন হতে পারে প্রথমে তা বুঝে উঠিনি। যতই গল্প পড়ছিলাম ততই গল্পে মজে যাচ্ছিলাম। একদম শেষে এসে তিথীর এমন পরিনতি দেখে খুব কষ্ট লাগছে। ইমনের মত বলতে ইচ্ছে করছে, "তিথির মুখে ছুড়ে মারা এসিডটা যেন আমার চোখে মুখে এসে পড়লো। আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। অন্ধকার, অন্ধকার।" খুব কষ্ট লাগলো। অসাধারণ লিখেছেন চাচা। তবে আপনি ভোটিং বন্ধ করে রেখেছেন বিধায় খারাপ লাগছে। এমন গল্প সেরা লেখাগুলোর তালিকায় উঠে আসাটা খুব জরুরী ছিল।
গত দু মাসই তোমার লেখা মিস করলাম আরেফিন। আগামী সংখ্যায় ফাঁকি দিচ্ছনা তো ? পরীক্ষার ঝামেলা মিটেছে কি? তাড়াহুড়ো করে লেখা গল্পটা নিয়ে এমনিতেই বিব্রত আছি। তারপর তোমার মাপের লেখকের কাছ থেকে "অসাধারণ" মন্তব্য সেই জ্বালা আরও বাড়াবে বই কমাবে না।
বাবা সংখ্যার জন্য লেখা দিয়েছি চাচা। পরীক্ষার ঝামেলাটা আগামী মাসে নেই। বাবা সংখ্যার পরের সংখ্যাও আশা করি গল্প দিতে পারব। তাড়াহুড়ো করে লিখলে গল্প কখনই খারাপ হয়না চাচা। আপনার গল্পটিই তার প্রমাণ। শেক্সপিয়ারের অধিকাংশ নাটক এক বসায় লিখা বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। গল্প চাচা আসলেই অসাধারণ ছিল। এবার বিব্রত হবেন না আশা করি।
বিন আরফান. পরিপক্ক লেখকের পরিপক্ক ও অসাধারণ গল্প. আমি মুগ্ধ . সালাম নিবেন.
ধন্যবাদ বিন আরফান। আপনাকেও সালাম। ভাল থাকবেন।
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম আহারে--- এসিড মেরে প্রিয়ার চোখের অব্যক্ত কাহিনীর এমন অবসান ....? কি আর বলব, অসাধারণ ।
ধন্যবাদ এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম
তানি হক একদম গভীর ভাবে ডুবে গেলাম গল্পে ..অসাধারণ গতি ছিল গল্পে ..খুব ভালো লাগলো ..তিথির জন্য মন খারাপ লাগছে ..অবস্যই ইমন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে তিথির জন্য কিছু করবে এই কামনায় রইলাম ...ধন্যবাদ স্রদ্ধ্য় সবের কাকাকে ..
খোরশেদুল আলম চরিত্র গুলো সুন্দর ভাবে ফুটেছে। নতুন ডাঃএর অনুভুতি এবং রাজুর চরিত্র যেন হুবুহু একেছেন। গল্পের শেষের মেসেস আমাদের সবার জন্যই শিক্ষণীয়। শুভ কামনা রইল।
ধন্যবাদ খোরশেদুল আলম ভাই।
মোঃ আক্তারুজ্জামান আপনার গল্প পড়ার মাঝে শান্ত বিলের মাঝখান দিয়ে নৌকার তর তর করে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দটুকু পাওয়া যায়| কোথাও থামতে হয় না, হোচট খেতে হয় না| তিথিদের জন্য সত্যি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল| ভালো থাকুন সবসময় এই কামনা করি|
ধন্যবাদ মোঃ আক্তারুজ্জামান ভাই। আপনারও কল্যান কামনা করি।
Arup Kumar Barua অসাধারণ লাগলো | শুভকামনা |
সূর্য এই যে রাজুর চরিত্রটা আঁকলেন এটা যে কতটা বাস্তব, এদের সবাই আমরা চিনি তাদের আচার আচরণ সবই আমরা জানি তবুও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ঐশি শক্তিতে এরা সব সময়ই ধরাছোয়ার বাইরে থাকে। গল্পের শেষ পর্যন্ত পড়ে ফ্লাশব্যাকটা ধরতে হয়েছে। কিছুটা তাড়াহুড়ো হয়েছে সাবের ভাই। অনেক অনেক শুভকামনা। (এছাড়াতো দেবার কিছুই নেই কারণ আমাদের ভোট তো আপনি নিবেন না হা হা হা)
ধন্যবাদ সূর্য। জানি না অক্ষমতাটা কার। রাষ্ট্র আর জনগণ, দায়ভারটা কি সমান সমান নয়? আমাদের দেশ নানা দিক দিয়ে এত উন্নত হবার পরেও প্রতিবাদের ভাষায় কেন এখনো এত আদিম রয়ে গেল?
ম্যারিনা নাসরিন সীমা দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়লাম । আপনার লেখার ধরন আমার বরাবরই ভাল লাগে ।সত্যি তিথির জন্য খারাপ লাগছে । এই যে পাঠকের মনের একটা প্রতিক্রিয়া এটাই লেখকের গুনের কথা বলে দেয় । ধন্যবাদ সুন্দর একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ।
ধন্যবাদ ম্যারিনা নাসরিন সীমা , সময় করে গল্পটা পড়বার জন্যে।

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪