অপেক্ষা

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

আহমেদ সাবের
  • ৩৩
  • 0
- ১-

কলেজ থেকে ফিরছে বেণু। মনটা ভীষণ খারাপ। উচ্চ মাধ্যমিক টেষ্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। বেণুর আশা ছিল, প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকবে, কিন্তু ওর স্থান হয়েছে পনেরো জনের মধ্যে সপ্তম। যে বাংলা নিয়ে ওর এত আশা ছিল এবং ভেবেছিল প্রথম হবে, তাতে হয়েছে তৃতীয়। বাংলার স্যারের সাথে তর্ক করে শেষে কেঁদে টেদে অস্থির। থানা শহরের কলেজ, কোনমতে খুঁড়িয়ে চলছে। শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন পান না। তাই কেউই বেশী দিনের জন্য টিকে থাকেন না। কয়েক মাস পরেই উধাও হয়ে যান। ক্লাস হয়না নিয়মিত। তবুও তো কলেজ টা আছে বলে বেণুদের মত মেয়েদের কলেজে পড়া হচ্ছে।

আষাঢ় মাসের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, তবু তেজ কমেনি। বাতাসে আগুনের হল্কা। বৃষ্টি কি আসবে? আকাশের দিকে তাকায় বেণু মেঘের খোঁজে। কত দিন বৃষ্টিতে ভিজেনি, আজ খুব ইচ্ছা করছে। মন খারাপ বলেই কি? সীমা আছে ওর সাথে প্রতিদিনের মতো। ওরা দুজন একই পাড়া থেকে আসে, পড়েও একই ক্লাসে। তাই কলেজে আসা যাওয়া হয় প্রায় এক সাথেই।

পালোয়ান তোকে পছন্দ করেনা বলেই নাম্বার কম দিয়েছে। আগের স্যার থাকলে বাংলায় ঠিকই ফাষ্ট হতি। বলে সীমা। গাট্টা গোট্টা চেহারা বলে বাংলার শিক্ষক রাশেদ সাহেবকে সবাই পেছনে পালোয়ান বলে ডাকে।

পালোয়ান বলে কি জানিস, বেণু যোগ দেয় কথায়। বলে, আমি খাতার পাতা গুনে নাম্বার দেই না।

তুই বলতে পারলি না, খাতার পাতা গুনে নাম্বার দিতে কে বলেছে? ওতে কি আছে, তা পড়ে নাম্বার দিন। বেশী লিখলেই কি লেখার গুন কমে যায়? ভদ্রলোক অলস বলে পড়তে কষ্ট হয়, তাই লেখা না পড়েই আন্দাজে নাম্বার দেন। সীমা রেগে যায়।

বাদ দে ও কথা। তোর ব্যাপার কি? পাশ করলি মাত্র তিনটাতে, বাকী গুলোতে ফেল।

চেষ্টা তো কম করি না রে; কিন্তু মাথায় যে কিছুই ঢুকে না। ঠিক করেছি, ফাইন্যাল পরীক্ষা দেব না। পড়াশুনা করে কি হবে বল? পড়লেও হাঁড়ি ঠেলা, না পড়লেও হাঁড়ি ঠেলা। তা হলে শুধু শুধু কষ্ট করে লাভ কি? আর কদিন পরে তো পড়া শুনা এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে। সীমার কণ্ঠে মন খারাপের হাওয়া। সীমার বিয়ের কথা বার্তা চলছে। ছেলের শহরে দোকান আছে। মোটামুটি সচ্ছল।

তোর তো পড়া শুনা না করলেও চলবে। আমাদের না করে তো উপায় নেই। তোর মতো তো ডানা কাটা পরী হলে তো কথা ছিল না।

তুই ডানা কাটা পরী না হয়েও যা দেখাচ্ছিস । নে, তোর বডি গার্ড এসে গেছে, আমি পালাই। হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করে সীমা।

কথাটা প্রথম বুঝতে পারেনি বেণু। আড়চোখে পেছন তাকিয়ে দেখে, অন্যদিনের মতো বাশার আজও পেছন পেছন আসছে। সীমাদের বাড়ী এসে গেছে বলে সে বাড়ীর পথে পা বাড়ায়। আরো দশ বারোটা বাড়ীর পরে বেণুদের বাড়ী। বাশার বেণুদের কলেজেই পড়ে। নানা ফন্দি ফিকির করে অন্য ক্লাস পেরিয়ে এলেও বি, এ তে এসে আটকে গেছে। কলেজের ছাত্র পরিষদের সহ সভাপতি। জেলা সদর থেকে নেতারা এলে তাদের পেছন পেছন ঘুরে। কলেজের শিক্ষকরা বেশ সমীহ করে ওকে।

বাশারকে বেণু অনেক দিন থেকেই চেনে ছাত্র নেতা হিসেবে। কি কারণে একবার ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। বেণু তখন দশম শ্রেণীতে পড়ে। ক্লাস চলছিল রোজকার মতো। হঠাৎ একটা মিছিল এসে থামলো ওদের স্কুল গেটে। হেড মিষ্ট্রেস আপা স্কুলের গেটে তালা দিতে বললেন দারোয়ানকে। দারোয়ান তালা লাগাচ্ছিল ভয়ে ভয়ে। এমন সময় মিছিল থেকে একটা ছেলে এসে দারোয়ানের চুল ধরে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। ছেলেটাকে তখন চিনতোনা বেণু; এখন চেনে। শহরের সবাই চিনে টেরা বাশারকে।

রাস্তার মোড়ে হারিসের পান-বিড়ির দোকানে আজও আড্ডা জমেছে রোজকার মত। ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান চলছে। বেণুকে দেখতেই এক ছোকরা হাম তোমছে প্যায়ার হো গিয়া ... বলে হেঁড়ে গলায় টান দিয়ে উঠলো। বাকীরা হো হো করে হেসে উঠলো সাথে সাথে। বেণুর গা সওয়া হয়ে গেছে এসব নিত্য শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে। পেছনের পদ শব্দটা এগিয়ে আসছে দ্রুত, এবং ধরে ফেললো ওকে।

কিরে, পালোয়ান নাকি তোকে বকাবকি করছে? ব্যাটা হারামজাদার এত বড় সাহস ! বেশ উত্তেজিত মনে হলো বাশারকে।

না বাশার ভাই, তেমন কিছু না। ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলো বেণু।

তুই কিছু না বললেই, কিছু না হইয়া গেল? বেণুর কথায় পাত্তা দেয় না বাশার। বেশী দিন হয়নাই তো। তাই ব্যাটা এখনো মানুষ চিনে নাই।

বেণুদের বাসা এসে গেছে। আপনি স্যাররে কিছু বইলেন না বাশার ভাই, বলে ঘরের দিকে আগায় সে।

তুই কইলেই ছাইড়া দিমু? টাইট না দিলে হারামজাদা মানুষ হইবো না, চিৎকার করে বলে বাশার।

ঘরে ঢুকেই মায়ের অগ্নিমূর্তির সামনে পড়ে যায় বেণু।

তুই আইজও শয়তান পোলাডার লগে আইছস ! তোরে কইছি ওর লগে মিশবি না। গেরামে থাকি, একটা বদনাম হইলে ..., ক্ষোভে কথা শেষ করতে পারেন না জামিলা বেগম।

মা, বাবারে কইয়ো আমার একার লাইগা একটা আলাদা রাস্তা বানাইয়া দিতে, রেগে চিৎকার করে বলে বেণু।

- ২ -

বেণুর বাবা রমিজ উদ্দিন থানা বাজারের লাকী ফার্মেসিতে কাজ করেন। দোকানের মালিক ইমদাদ সাহেব বহু দিন থেকে ঢাকাবাসী। ইমদাদ সাহেবের বাবা রমিজ উদ্দিনকে ছোটকাল থেকে পালন করেছিলেন এতিম হিসেবে। রমিজ উদ্দিন আর ইমদাদ সাহেব মানুষ হয়েছেন এক সাথে। ইমদাদ সাহেব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। জীবনে অনেক উন্নতি করেছেন। ঢাকায় বড় চাকুরী করেন। ওনার বাবা মারা যাবার পর লাকী ফার্মেসির দেখাশোনার ভার পড়ে রমিজ উদ্দিন এর উপর। এবং সে দায়িত্ব আজ পর্যন্ত তিনি বিশ্বস্ততার সাথে পালন করে যাচ্ছেন।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফার্মেসিতে থাকতে হয় রমিজ উদ্দিনকে। তাই সংসারের দেখাশুনার পুরো দায়িত্ব জামিলা বেগমের উপর। রমিজ উদ্দিন যে বেতন পান, তাতে সংসারে প্রাচুর্য না থাকুক, টানাটানিও ছিল না। স্বামী স্ত্রী দু জনেই অল্পতে তৃপ্ত বলে সংসারে তেমন অশান্তিও ছিলনা। মাস দুয়েক আগে, দুপুরে ভাত খেতে আসলে স্বামীর চেহারা দেখেই জামিলা বেগম ধরে ফেললেন, কোন সমস্যা হয়েছে।

তোমার চেহারাডা খারাপ লাগতাছে, কিছু হইছে? স্বামীকে ভাত দিয়ে কথা পাড়েন জামিলা বেগম।

তেমন কিছু না। দোকান থেইকা কিছু অষুধ চুরি হইছে। আমি ইমদাদ ভাইরে কি জবাব দিমু?

চোরে চুরি করছে, তুমি কি করবা? থানায় জানাইছ?

জানাইছি, কিন্তু কিছু করবো বলে মনে লয়না। আর করবেই বা কি। শুনছি, টেরা বাশারের দলের পোলারা চুরি করছে অষুধ। পুলিশরাও অগরে ডরায়।

আজ রাতে খেতে বসে কথাটা আবার পাড়েন রমিজ উদ্দিন। জামিলা, দোকানটা বোধহয় আর রাখতে পারুম না। বাশারের দলের পোলারা প্রায়ই চাঁদা নিত। এখন কইতাছে, মাসে এক হাজার টাকা কইরা না দিলে দোকানে আগুন ধরাইয়া দিব। মাসে এক হাজার টাকা... এত টাকা আমি দিমু কি কইরা আর দোকানডা গেলে সংসারডা চালামুই বা কি কইরা? ক্ষোভে ভেঙ্গে পড়েন রমিজ উদ্দিন।

বেণু পড়ার টেবিল থেকে নীরবে শুনে যায় কথাগুলো। জামিলা বেগম গলা নামিয়ে স্বামীকে কিছু বলেন। সেটা শুনতে পায়না সে। পড়াতে মন বসে না আর ওর।

কথাটা শুনেছে বেণুর ভাই রজবও। নাইনে পড়ে সে। ভাই বোন একই টেবিলে পড়ে। না পড়েই বা উপায় কি। বাবার সামর্থ্যের সীমা ওরা জানে।

আপা, হারামজাদা বাশারের পেডে যদি ছুরি না ঢুকাইছি, আমার নাম রজব না। ফিস ফিস করে বলে রজব।

চুপ, বলে ভাইয়ের মুখ চেপে ধরে বেণু।

- ৩ -

টেষ্টের পরেও যে সব বিষয়ের সিলেবাস শেষ হয়নি, সে গুলোর ক্লাস চলছে। সীমার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে। সে আর কলেজে আসছে না, তাই বেণুকে একাই কলেজে আসা যাওয়া করতে হয়। সীমার জন্য বেণুর মনটা খারাপ হয়। দু জনে আসা যাওয়ার পথে কত গল্প হতো। আর ভয়টাও কম লাগতো। বাড়ী ফিরছে বেণু ক্লাসের পর - একা। কলেজে বন্ধুরা গল্প করছিল, ঢাকাতে নাকি র‍্যাব বলে কি একটা পুলিশ নেমেছে। মাস্তানদের ধরে সোজাসুজি গুলি করে মেরে ফেলছে। ওদের ভয়ে ঢাকা নাকি এখন মাস্তান শূন্য। মানুষ জন শান্তিতে আছে। র‍্যাবরা এখানে আসেনা কেন? বেণু হাটে আর ভাবতে থাকে। আকাশ মেঘ করে আসছে। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। একবার শুরু হলে আর থামবে না। ওর ভাঙ্গা ছাতাতে মাথা বাঁচলেও গা বাঁচবে না। নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না বলে বাশার টের পাচ্ছে না কোন দিন ও কলেজে আসছে। তাই নিয়মিত পিছুও ধরতে পারছে না। থপ থপ থপ। পায়ের আওয়াজ টা শুনে না দেখেও বেণু বুঝে ফেললো, কে আসছে। নে, তোর বডি গার্ড এসে গেছে, সীমার কথাটা মনে পড়ে গেলো। আক্রোশে জ্বলছে বেণু। শয়তানটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। পাশে এসে গেছে আওয়াজটা।

আমারে পাহারা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা দিতে পারুম না কিন্তু। বাশারের দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলে বেণু।

কথাটা শুনে থমকে দাড়ায় বাশার। তার পর ছুটে বেণুর সামনে এসে দাড়ায় - পথ আগলে। বাশার প্রথম ভেবেছিল, বেণু রসিকতা করছে। কিন্তু বেণুর মুখ দেখে ধারনাটা ভেঙ্গে যায় ওর। বেণুর চোখে মুখে রাজ্যের আগুন।

এইটা কি কইলা বেণু?

অন্যায় কিছু কইলাম? মানুষ, দোকানপাট পাহারা দিয়া টাকা কামান। মানুষ কি আর তা জানে না?

বেণু ...., ক্ষোভে, দুঃখে কথা হারিয়ে ফেলে বাশার। বেণু, তুমি আমারে এই কথাডা কইতে পারলা?

পথ ছাড়েন বলে বাশারকে এড়িয়ে এগিয়ে যায় বেণু। বাশার পেছন পেছন হাটে, দূরত্ব রেখে।

রাস্তার মোড় এসে গেছে। আজও আড্ডা জমেছে রোজকার মত হারিসের পান-বিড়ির দোকানে। ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান চলছে। বেণুকে দেখতেই অন্য দিনের মতো সেই ছোকরা হেঁড়ে গলায় টান দিয়ে উঠে, হাম তোমছে প্যায়ার হো গিয়া ...। হাসির হল্লা উঠে রোজকার মত। পেছনের পদ শব্দটা তীরের মতো ছুটে গেল সামনে এসে ছুটে গেল দোকানের দিকে। বাশারের একটা হাত সাড়াশি হয়ে দ্রুত বেগে ধরে ফেললো ছেলেটার চুলের গোছা। টেনে আনলো সামনের দিকে। সমস্ত হই চই থেমে যায় মুহুর্ত্তের মধ্যে।

হারামজাদা, রোমিও হইছ ! কাম নাই, কাজ নাই, সারাদিন আড্ডা ....। আর কোন দিন যদি এহানে আড্ডা দিতে দেহি, ঘাড়ের উপর কল্লা লইয়া বাড়ীত যাইতে দিমু না। আর একখান কথা, লাকী ফার্মেসির ধারে পাশে যেন কোন হালারে না দেহি।

বেণু থামে না। চলতেই থাকে সামনে। বাশারের চিৎকারের প্রতিটা শব্দ কানে আসে ওর। বৃষ্টি এসে গেছে ঝম ঝম করে। ভাঙ্গা ছাতাটা আর খোলে না সে। কিই বা হবে খুলে?

- ৪ -

জামিলা বেগমের সামনে চাটাইতে বসে আছে বাশার। বাইরে শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরছে অবিরল ধারায়। ঢাকায় চাকরী হয়েছে তার। বিদায় নিতে এসেছে সে। ঘরের এক কোনে বসে, কুলায় চাল বাছছে বেণু। বাশারকে দেখে দরজা খুলতে চাননি জামিলা বেগম। ভেতর থেকেই ভয়ে ভয়ে বললেন, কি চাও?

খালাম্মা, ঢাকা চইলা যাইতাছি আইজ। বিদায় লইতে আইলাম । ছাতার নীচ থেকে বলে বাশার।

মনটা একটু নরম হয় জামিলা বেগমের। ঘরে আহ, বৃষ্টিতে ত একবারে ভিজা গেলা। দরজা খুলে ধরেন তিনি।

চাকরিডা ভালা। বসতে বসতে বলে বাশার। ঢাকার গুলশানে বিরাট অফিস। ভাবলাম, কি হইবো পড়া শুনা কইরা। দেশের যা অবস্থা, চাকরীডাও ভালা .....।

তোমাগো এত জাগা জমি, ঠিকমত চাষ করলে খোরাগি অইয়া বাঁচার কথা।

বাপে অসুখে পড়লো। ঠিকমত দেখাশুনা করতে পারে না।

তাতে কি, তুমি জোয়ান ছেলে। তুমি ত দেখতে পার।

খালাম্মা, জীবনে কোন দিন হাল ধরি নাই। চাষ বাস আমারে দিয়া অইবো না। চাকরীই ভালা। অফিসের কাম। দশটা পাঁচটা অফিস, কোন ঝামেলা নাই।

বস, আমি তোমার লাইগা এক কাপ চা লইয়া আসি। বলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ান জামিলা বেগম।

না, না, চা লাগবোনা খালাম্মা। বলে উঠে বাশার।

বাশারের কথাকে পাত্তা না দিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যান জামিলা বেগম।

সেদিনের ঘটনার পর তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। তার পর আজই প্রথম বাশারকে এত কাছ থেকে দেখল বেণু। এ তিন সপ্তাহ কাছাকাছি না এলেও বাশারের উপস্থিতি পলে পলে অনুভব করেছে সে। সে জানে, বাশার দুর থেকে সারাক্ষণ নজর রাখছে ওর উপর। বাশারের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে বেণু বসেই থাকে। বাশার উসখুস করে, তারপর উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে প্যান্টের ডান পকেটে হাত রাখে।

কেমন আছ বেণু? বেণুর কানে অন্য রকম শোনায় বাশারের গলা।

বেণুর প্রাণটা ধ্বক করে উঠে। এই বুঝি বাশারের পকেট থেকে একটা পিস্তল বের হয়ে এলো। বাইরে বৃষ্টির ঘনঘটা। রজবও বাড়ীতে নাই। বাশার কি জেনে শুনে কোন বদ মতলব নিয়ে বাড়ীতে ঢুকেছে। মা কেন যে ওকে ঘরে ঢুকতে দিল?

বেণু উত্তর দেয়না। কুলার উপর স্থির করে রাখে দৃষ্টি।

বাশারের ডান হাতটা বার কয়েক প্যান্টের ডান পকেটে ঢুকে আর বের হয়। আড়চোখে তাই দেখে বেণু।

নাও, চা খাও, বলে বাশারের দিকে চা এর কাপ এগিয়ে ধরেন জামিলা বেগম।

বাশার বসে আবার। চায়ে চুমুক দেয়।

খালাম্মা, বহুত অন্যায় করছি, মাপ কইরা দিয়েন। কাজের চাপে কবে যে ফেরৎ আইতে পারুম, ঠিক নাই। খালুরেও বইলেন, আমারে যেন মাফ করে। দোকানে কেউ ঝামেলা করলে আমার ভাই মফিজরে খবর দিয়েন। ওরে কইয়া রাখছি।

ঘরে বিস্কুট টিস্কুট কিছুই নাই। তোমারে খালি চা ই দিলাম বাবা।

না না খালাম্মা, বিস্কুট লাগবো না। বাশার ধীরে ধীরে চা শেষ করে।

খালাম্মা, যাই। খেয়া নৌকা ধইরা ইষ্টিশানে যাইতে অইবো। দেরী করলে নৌকা পামু না; নৌকা না পাইলে আইজকা আর যাওয়াও অইবো না।

দাঁড়ায় বাশার। বেণু ওর যায়গায় অচল হয়ে বসে থাকে পাথরের মত। বাশার ডান হাত প্যান্টের পকেটে দিয়ে কি ভাবে নিমগ্ন হয়ে।

যাও বাবা, দোয়া করি যেন উন্নতি হয়। জামিলা বেগমের কথায় চমকে উঠে সে।

জামিলা বেগমকে পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে বাশার।

যাই বেণু। বাশারের গলাটা কান্নার মত শোনায়।

বেণু উত্তর দেয়না। অনড় হয়ে বসে থাকে নিজের যায়গায়।

ঘরের বাইরে পা রাখে বাশার। একটু দুরে এসে পেছনে তাকায় সে। দমকা বাতাসে ছাতা সরে যায় মাথার উপর থেকে। বৃষ্টির ছাটে ওর সারা মুখ ভিজে যায়। বন্ধ দরজা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

- ৫ -

শওকতের সাথে হেটে যাচ্ছে বাশার খেয়া ঘাটের পথে। পাকা রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় কাদা ময়। দু জনের জুতো আর কাপড়ের অবস্থা শোচনীয়। ছাতা থাকলেও শরীর ভিজে একশা।

দোস্ত, মনে হইতাছে তোরে ফাঁসিতে ঝুলাইতে লইয়া যাইতাছি। নীরবতা ভাঙ্গে শওকত। বুঝছি, কোনদিন বাপ মারে ছাইড়া যাস নাই ত। একটু খারাপ লাগবোই। আমারও লাগতো। মাস খানেক পার হইয়া গেলে বাড়ীর কথা মনেই পড়বো না।

বাশার নিঃশ্চুপ হাটতে থাকে।

বি-এ, এম-এ পাশ কইরা কি অইবো? ক কি অইবো? কে তোরে চাকরী দিব? সিকিরুটির চাকরী, যত খারাপ ভাবছস, তত খারাপ না। দিনে ঘুম, রাত্তিরে পাহারা দিবি। মাঝে মাঝে ফাই ফরমাশ খাটবি। সাহেবগোরে খুশী রাখবি। মাস কাবারে পাঁচ হাজার টাকা। এই বাজারে পাঁচ হাজার টাকা ফেলনা না। কোন খরচ নাই । টাকা জমাইয়া এক দিন সৌদি না হয় জাপান চইলা যাবি। ফেরত আসলে তোর দাম তোলা তোলা।

বক বক করতে থাকে শওকত। কোন উত্তর দেয়না বাশার। নীরবে হাটতে থাকে।

ঝড়ো বাতাসে সিগারেট ধরাতে কষ্ট হয়। অনেক কসরত করে সিগারেট ধরায় শওকত। কয়েকটা টান দিয়ে এগিয়ে দেয় বাশারের দিকে। নে, খা।

না রে শওকত, সিগারেট আর কোনদিন খামু না। উদাস গলায় বলে বাশার।

খেয়া ঘাটে চলে এসেছে ওরা দু জন। দেখে, আরও দু জন লোক অপেক্ষা করছে সেখানে নৌকার জন্য। তারা চিনে বাশার কে। সালাম দেয় সমীহ করে।

ভাই, কই যাইবেন? জিজ্ঞেস করে ওদের এক জন।

কোন উত্তর দেয়না বাশার । ঘড়ি দেখে, বিকাল প্রায় সাড়ে তিন টা। চারটার মধ্যে নৌকা না আসলে ট্রেন ধরতে পারবেনা আজ।

নদীতে বড় বেশী স্রোত। আইজ বোধ হয় নৌকা আইবো না। বলে অন্য জন।

আকাশের দিকে তাকায় বাশার । বৃষ্টি ধরে আসছে একটু একটু করে। আকাশটা একটু পরিষ্কার হয়ে আসছে। নৌকা কি আসবে? মনে মনে ভাবে সে । কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ ঝোপের দিকে এগিয়ে যায় বাশার।

কই যাইতাছস? সপ্রশ্ন দৃষ্টি শওকতের।

আইতাছি বলে ঝোপের আড়ালে চলে যায় বাশার।

ছোডডা পাইছে বোধ হয়। মনে মনে ভাবে শওকত।

একটা গাছের নীচে দাড়ায় বাশার ছাতাটা গাছের গায়ে ঠেকিয়ে। পকেটে হাত দিয়ে বের করে জলে ভেজা চিঠি টা। অনেক বার পড়া চিঠিটা পড়ে আবার।

বেণু,

সবার কাছে মিথ্যা বললেও তোমার কাছে তো আর মিথ্যা বলতে পারি না। সবাই জানে, আমি ঢাকায় ভাল চাকরী নিয়ে যাচ্ছি। আসলে, শওকত আমার জন্য একটা দারোয়ানের চাকরী ঠিক করেছে ঢাকায়। জীবনে অনেক বড় হবার আশা ছিল। মানুষের সব আশা কি পূরণ হয়?

আমার সামনে দুটো পথ - একটা, অন্ধকারে ডুবে যাওয়া । অন্যটা, খড় কুটো যা পাই, তা ধরে যুদ্ধ করে বাঁচা। আমি অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই না, বেণু। আমার একা যুদ্ধ করার শক্তি নাই। তুমি কি আমার পাশে এসে দাঁড়াবে?

যদি রাজী থাক, আমি প্রাণপণে তোমার যোগ্য হবার চেষ্টা করবো। যেটুকু অবসর পাই, তা কাজে লাগিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো। তুমি যদি পাশে থাকো, সফল আমি হবোই। তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?

ইতি
বাশার

বৃষ্টি ধারা পড়ছে চিঠিটার উপর টপ টপ করে। কালি লেপটে যাচ্ছে একটু একটু করে, এক একটি শব্দের। ধীরে ধীরে সব অক্ষর গুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়।


- ৬ -

বাশার চলে যাবার সাথে সাথে মনটা উদাস হয়ে যায় বেণুর। এতটা নিষ্ঠুর সে হতে পারলো কি করে? ভাল মন্দ নিয়েই তো মানুষ। কালকের খারাপ মানুষটা কি আজ ভাল হয়ে যেতে পারে না? কি ক্ষতি হতো একটু কথা বললে? সেদিনের ঘটনার পর প্রায় তিন সপ্তাহ হলো, বেণুকে আর জ্বালাতে আসেনি বাশার। তবে, বেণু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তার উপস্থিতি টের পেয়েছে সারাক্ষণ; ও আছে, কাছেই আছে কোথাও। বেণু বাবার মুখে শুনেছে, গত তিন সপ্তাহ বাবার দোকানে কেউ আর চাঁদা চাইতে আসেনি। বাবাকে হয়রানি করেনি কেউ।

সন্ধ্যা বোধহয় হয়ে এলো বলে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। উঠানে নেমে আসে সে। কালো মেঘের গণ্ডী ভেঙ্গে উঁকি দিচ্ছে এক টুকরা নীল আকাশ। তার গণ্ডীতে কেউ যেন বুলিয়ে দিয়েছে একটু রূপালী রং এর প্রলেপ। রূপালী রং পরিবর্তিত হয়ে যায় কমলাতে, ধীরে ধীরে। তার পর ছাই রং এ। শ্রাবণের আঁধার নামে একটু একটু করে।

সন্ধ্যা হইয়া গেছে, ঘরে আয় মা। বেণুকে ঘরে ডাকেন জামিলা বেগম পরম আদরে।

বেণুর প্রাণের গভীরে একটা ঐকান্তিক ইচ্ছার চারা জন্ম নেয়। ধীরে ধীরে সেটা মহীরুহ হয়ে যায়। প্রচন্ড বান নামুক নদীতে; ফিরে যাক সব খেয়া নৌকা। বাশার ফিরে আসুক, বাশার ফিরে আসুক।
দুরে, অনেক দুরে চোখ পড়ে যায় ওর। একটা বিন্দু বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। কেউ যেন আসছে। বাশার, না অন্য কেউ?

বেণু কি অপেক্ষা করবে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১২ দিন হাসপাতালে কাটাবার পর গত কাল ঘরে ফিরলাম। শরীর এখনো বেশ দুর্বল। কিন্তু গল্প-কবিতার প্রতি ভালবাসার টানে কম্পিউটারে না বসে পারলাম না। আগস্ট মাসে রোজা এবং এবং লেখার সংখ্যাধিক্যের কারণে ধরেই নিয়েছিলাম, সব লেখা পড়া হবে না। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আরও পিছিয়ে গেলাম। আমার প্রিয় অনেক লেখকের লেখা পড়া হলো না। এ মাসে সময় পেলে গত মাসের সেরা ২৫’এর গল্প আর কবিতাগুলো পড়ে নেব ( যে গুলো পড়া হয় নি) । আমার অনুপস্থিতিতে অনেকেই আমার লেখায় এসেছেন; অনেকে মন্তব্য করেছেন। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং ঈদ মোবারক।
এফ, আই , জুয়েল # বড় গল্প / ভীষন ভালো ।
মিজানুর রহমান রানা প্রাণের গভীরে একটা ঐকান্তিক ইচ্ছার চারা জন্ম নেয়। ধীরে ধীরে সেটা মহীরুহ হয়ে যায়। ----এতো সুন্দর গল্প আমার পক্ষে লিখা সম্ভব হবে কি-না তাই ভাবছি। ধন্যবাদ অগ্রজ সাবের ভাইকে। শুভ কামনা রইলো।
মাহমুদা rahman খুব ঝরঝরে লেখা...পড়তে বেগ পেতে হয়নি.....অনেক ধন্যবাদ
শাহ্‌নাজ আক্তার বেনু কে আর অপেক্ষা করতে হবেনা ,, বাশার যে আসতেছে , খুব ভালো লাগলো |
কৃষ্ণ কুমার গুপ্ত বাশার ফিরে আসুক......খুব ভালো লাগলো গল্প ....ভোট দিতে না পেরে খারাপ লাগছে ...সে যাই হোক, ভালো থাকবেন, শুভ কামনা রইলো...
হোসেন মোশাররফ `রেনু কি অপেক্ষা করবে?' এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই , লেখকই তা ভাল জানেন / তবে আমরা কিন্তু আপনার পরবর্তী লেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম ........
সূর্য আপনার "চক্র" কবিতায় লিখেছিলাম বোধহয় "সুন্দর একটা গল্পের শুরু মনে হলো"| গল্পে আপনি সাবলীল এবং সফল................
নাজমুল হাসান নিরো ঢংটা দেখে কেন জানি মনে হল লেখাটা অনেক আগে লেখা হয়েছে। যাই হোক একটি সাহিত্যকর্ম যে সব সময়ই অনেক উন্নত প্লটের হতে হবে এমন নয়। মুন্সিয়ানার জোরে অনেক হালকা প্লটও সুপাঠ্য হয়ে ওঠে তার প্রমান এই গল্প। সাহিত্যে জীবন প্রকাশ ছাড়াও বিনোদন বলতেও একটা কথা থাকে। অবধারিতভাবে সেটা পেলাম। কয়েকটা জায়গায় প্রমিত বানান রীতির একটু অনুসরন দরকার। যেমন: কমেনি, হয়না, ভিজেনি, করেনা; সবগুলোতে না এবং নি এর মাঝে একটা স্পেস হবে, লাগতো = লাগত, সে গুলো = সেগুলো, দু জন = দু' জন হবে। শুধরে নিলে কৃতার্থ হব।
Azaha Sultan সাবের ভাই, গল্প তো অসাধারণ--কিন্তু বাশারকে তো ফিরিয়ে আনতে পারতেন বোধহয়? হা-হা......যাই হোক, চাঁদা চাওয়া যে বন্ধ হয়েছে এটাই স্বস্তির কথা....ধন্যবাদ...

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪