কান্নাভেজা চোখ

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২০)

মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
  • ৪৩১
এক.
আজো কান্নাভেজা চোখে দূর থেকে চিৎকারের শব্দ এসে কানে ভাসে, বাবা মানুষ হতে চেয়েছিলাম; এমন তো চাইনি! জন্ম হয়ে এ আজন্মের কষ্টগুলো আর কতো আঁচলে বেঁধে রাখবো? মা কেন-ই বা জন্ম দিয়েছিলে!?

রেণুর চিৎকারের শব্দ প্রতিনিয়ত বাতাসে উড়ে বেড়াই। মা রেহানা কথা বলতে পারছেন না। বৃদ্ধ বয়স। বাবা হাটতে পারছেন। চলে ফিরে সংসারের জন্য কিছু করতে পারছেন না। প্রতিটা বাবা-ই সংসারের জন্য রণক্ষেত্র। যদি সে রণ ভেঙে যায় তাহলে সংসারে আসে বিদীর্ণ বেদনা।
যখন রেণু এভাবে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, মা কিছুই বলতে পারছেন না। তবুও ঠোঁট নেড়ে জায়নামাজে আল্লাহর কাছে কি যেন সংগোপন করে যাচ্ছেন। সেটা সেই মহান সৃষ্টিকর্তায় ভালো জানেন।

রেণুর আধো আধো স্বপ্নগুলো এখনো উড়ে বেড়াই পশ্চিমা দিগন্তে। স্যাতে স্যাতে অন্ধকার একটা রাত। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু কথা সংগোপনে উলোটপালোট করে, কিছু কথা বুকের ভিতরে এসে দামামা বাজিয়ে তুলে; কিছু চেয়েও যেন সে পারে না। না পারার ভীষণ অভিমানে নিজেই পোড়ে একা অমাবস্যায়!
এভাবে চলতে থাকে কতদিন, কতরাত! কেউ দেখেও না দেখার খুব ভাঁন করে থাকে।

-) আজ থেকে দশ বছর আগে৷ রাজু একমাত্র বোন রেণুর ভাই ছিল। কলেজের গন্ডি পেরিয়ে সে ভার্সিটির পথে পা বাড়িয়ে ছিল। চান্স পেয়েছিল ভর্তি হওয়ার। বাবার স্বপ্ন ছিল একদিন আমার ছেলে অনেক বড় হবে। এই যে আমার দিন মজুরের কঠিন পরিশ্রমের মুখে একটু হাসি ফোটাবে। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীরে একটা চুমো দিয়ে বাবার সমস্ত অভিমান কেটে দিবে। মা স্বপ্ন দেখতেন, আমার ছেলে একদিন মানুষ হবে। অনেক সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠিত করবে। সমাজে গরীব দুঃখীদের বিপদের সহায় হবে। শুধু টাকা পয়সা দিয়ে-ই যে মানুষের মন কেড়ে নিতে পারে তাই নয়; সুন্দর ব্যবহার, অন্যের বিপদের বন্ধু, হাসি মুখে কথা বলেও মন কেড়ে নেওয়া যায়৷ ঠিক সেভাবেই সে সবার বন্ধু হবে।

-) রাজু খুব লেখালেখি করতো৷ বেশ আবেগ নিয়ে লেখার প্রতি চমৎকার মনোনিবেশ ছিল। সে লেখার জন্য স্কুল কলেজে সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক পুরস্কার পেয়েছিল৷ একদিন তার এলাকায় রোডের কাজের জন্য সরকার নির্দিষ্ট একটা বাজেট পেশ করেন। বাজেট পেশ করার কয়েকদিন পর কাজ শুরু হয়ে গেলে সে এলাকার চেয়ারম্যান একটু দূর্নীতি করেন। যেমন তেমন কাজ করে বাকী টাকা লুটে নেন পকেটে৷ যথাসময়ে এমন ব্যাপার নিয়ে লেখার করুণ দশায় তার প্রতি আক্রমণ করা শুরু করে দেয় চেয়ারম্যানের পক্ষপাতিত্ব লোকজন। এমন আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে তার বাবা তাকে নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু কোন কাজ হল না৷ চেয়ারম্যান ও তার পক্ষপাতিত্ব লোকজনের উপর এমন অভিযোগ রাজু ও তাঁর বাবার উপরে ভয়ে আনে আরো করুণ দশা। এর উপরেই নির্ভর করেই একদিন রাজুকে গুম করে এবং তার বাবাকে পিটিয়ে দুই পা ভেংগে দেয়। তাঁর মা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে এসেছিলেন এর বিচার জন্য। কিন্তু দশ বছর পেরিয়ে গেলেও আইনপক্ষের লোকজন আজো তার বিচার করলো না।

দুই.
বিনোদনের শহর। জানেন তো, কাল্পনিক। কাল্পনিক শহরে হেটে হেটে বহুদূর পাড়ি দেওয়া যায়। যেমন কবি ভেবে ভেবে আকাশে পাড়ি জমান, দশ হাজার নয়শত তেইশ মিটার মহাসাগরের গভীরে ডুব দিয়ে মুক্তো খোঁজে আনেন। এটা কবির অধিকার। তবে নায়েক যখন অভিনয় করেন, তখন আর তিনি সে গভীরে ডুব দিয়ে দর্শকের জন্য নতুনত্ব আনতে পারেন না। যেটা পারেন সেটা কাল্পনিক স্পর্শতা।

ঠিক তেমন করে করে কল্পনার শহরে ভেসে ভেসে রেণুর মা স্বপ্ন দেখতেন, একদিন এর বিচার হবে। একদিন এই সবকিছুর প্রমাণ আসবে। অথচ এই স্বপ্নের ভিতরে ঘটে গেল আরেকটি বাস্তবিক ঘটনা। আরেকটা নির্মম বেদনা।
রেণু তখন অস্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেধাবী একজন ছাত্রী। বাবা খুব আদর করে রেণু বলে ডাকতো। ফুটফুটে সুন্দর চেহারা। বাবার পা ভাংগা, ভাই নেই। কর্ম করার মতো মা ছাড়া আর কে বা আছে। পাড়াপড়শি তো দুই একদিনের জন্য মাত্র। এরপর আর খবরও থাকে না। রেণুর মা খুব কষ্ট করে সময়ের সাথে যুদ্ধ করে সেলাই কাজ করতেন। এ কঠিন পরিশ্রম করে যে কয় টাকা ইনকাম হত, তা দিয়ে সংসার মোটামুটি কাটতে থাকে।

-) একদিন চতুর্দিক থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে। সহজ সরল মেয়েটা কোচিং থেকে বাসা ফিরছিল। ঠিক তখনি চেয়ারম্যান পক্ষের একদল লোক এসে সেই যের ধরে মেয়েটিকে অপহরণ করে এবং কি যেন একটা বিষ ইনজেকশনের সাথে ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর রাস্তার কিণারায় তাকে ফেলে যায়।
লোকজন দেখলে তাকে বাড়িতে ফিরে নিয়ে আসে। রেণুর মায়ের বেড়ে যায় আরো বেশি আহাজারি। মেয়েটি স্বপ্ন দেখতো যত কষ্টই হোক না কেন, সে একজন আইনজীবী হবে। একদিন দেশের মানুষের উপকারে আসবে। সঠিক বিচার করে মানুষের মন কেড়ে নিবে। সেদিন না হয় বিচারের জন্য আইন খুঁজবে ভাইকে গুম করে হত্যার। কই আর সেই স্বপ্ন! কিছু কিছু স্বপ্ন যে সত্যি হয় না, এটাই তার চমৎকার উদাহরণ। আবার অনেকে বলে চার দেওয়ালের ভিতরে থেকে স্বপ্ন দেখলে সে স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। আ রে রেণু তো চার দেয়ালের মাঝে থেকে স্বপ্ন দেখেনি, তাহলে সে কেন বাস্তব রূপ দিতে পারলো? সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র নায়েকদের মানবিক বিবেক, অবশেষে আইন যদি ঠিক হয় কারো স্বপ্ন পূরণ করতে কারো যুদ্ধ করতে হয় না। স্বপ্ন নিজেই সত্যিকারে বাস্তব রূপ দেয়।

-) রেণুর বিষক্রিয়া এতোটাই আক্রমণ করেছিল যে, আজো রেণু পেটের ব্যথায় আল্লাহ বলে, মা বলে চিৎকার করে। তার চিৎকারের শব্দ আজো দশ ঘরে গিয়ে পৌছে। ছুটে আসে রাস্তার অচেনা পথিক। অচেনা মানুষজন। তবুও চোখ ফিরে দেখে না এ রাষ্ট্র, এ সমাজ, এলাকার বিবেকবান মানুষ। কতোটি বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ মেয়েটির আজো বিয়ে হয়নি। টাকার জন্য করতে পারেনি কোন চিকিৎসা৷ মাঝেমাঝে না খেয়ে পাড়ি দিতে হয় এক একটি দিন, একটি রাত। বারবার প্রশ্ন ভেসে আসে, গরীবের জন্য এতো কোটি কোটি টাকার সম্পদ আসে____ সেখান থেকে কি রেণুদের মতো সংসারের কোন জিনিস আসে না? তারা এ দেশের নাগরিক নয় কী? তাদের জন্য কি কারো ভালোবাসার জন্ম হয় না___??

তিন.
বাবা আজো জায়নামাজের উপরে কান্নাভেজা চোখ নিয়ে আকুতি মিনতি করেন। মা আঁতুড় ঘরে পড়ে থাকেন। সন্তানের গুম, মেয়েকে অপহরণ করে বিষ প্রয়োগ এবং স্বামীকে মেরে পা ভেংগে দেওয়ায় কোন বিচার না পাওয়ায় বেদনার শহরে কঠিন পরিশ্রমের সাথে লড়াই করতে করতে আরো তাড়াতাড়ি বৃদ্ধা হয়ে যান। আঁতুড় ঘরেই একমাত্র উনার আজকের বাসস্থান।

এমন কষ্ট দেখলে জলে ভেজা চোখ ছাড়া কে না থাকতে পারবে? তবুও আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নায়েকেরা থাকতে পারেন। থাকতে পারেন কিছুকিছু কঠিন হৃদয়ের মানুষ।
আ রে এরই নাম কি স্বাধীনতা? রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হওয়া দেশে আমরা কি এটাই চেয়েছি? প্রতিদিন এক একটা প্রশ্ন উড়ে বেড়াই, শুধু উত্তরগুলো অজানা___!

রেণুদের বিচার পৃথিবীর কেউ করতে পারবে না। কেউ তাঁদের খোঁজ নিবে না। করবে না তাঁদের এমন বিচার। তাই তো তারা প্রতিনিয়ত কান্নাভেজা চোখ নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছেই হাত তুলেন, বিচার চেয়ে থাকেন। তাঁদের বিচার হবে শেষ বিচারের দিন। যেদিন আর কোন ঘুষ হবে না৷ যেদিন থাকবে না আইনের ভিতরে বেআইনি। সেদিন সুষ্ঠু বিচার হবে। ন্যায় বিচার পাবো। হে মহান রব, ক্ষমা করিও না তুমি সেদিন কাউকে। রেণুর মা বাবা প্রতিদিন দু'হাত তুলে এভাবেই সৃষ্টিকর্তার কাছে বলে যাচ্ছেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত বরাবরের মত ভাল লাগা , ভালবাসা , শুভকামনা ।
ফয়জুল মহী অনিন্দ্য সুন্দর ,লেখা। খুবই ভালো লাগলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

"স্বাধীনতা" শব্দটি যদিও বুকের ভিতরে মুক্তির সুর তুলে, যদিও ঢেউ আঁকে প্রশান্তির; আসলেই কি আমরা মুক্তি পেয়েছি? প্রশান্তির আঁকা সুরে সুর মিলাতে পারছি? আধো নয়! এই সুর যেন ঘুমিয়ে পড়ে আছে কোন সমুদ্রতটে কিংবা অজানা কোন এক শহরে। দোলায়িত উষ্ণ বাতাস যেন চুপসে রেখেছে তাকে। কোনভাবেই সে জেগে উঠতে পারছে না। ঠিক তেমনি রাজু, রেণু মা রেহানা ও বাবাকে নিয়ে জেগে উঠা এই স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে গেল। যেখানে মুখ খুলে প্রতিবাদ করা যায় না, সেখানে মুক্তির দাবী করাটা বোকামী ছাড়া কিছু নয়। যেখানে অপহরণকারীর বিচার হয় না, যেখানে ধর্ষণের বিচার হয় না___ বিচার হয় না কোন নির্যাতনের সেখানে স্বাধীনতা শব্দটি যেন খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়। এ গল্পে রাজুর গুম, রেণুকে অপহরণ ও তার বাবাকে পিটিয়ে পা ভেংগে দেওয়ার দশটি বছর পেরিয়ে এলেও কোন বিচার মিলল না। শান্তি দিতে পারলো না আইন, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন নায়েক। দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের রয়েছে অনেক বড় অধিকার৷ গরীব-দুঃখী হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে রয়েছে কিছু পাওয়ার অধিকার। অথচ কেউ তাঁদের খোঁজও নেয়নি। এটাই কি স্বাধীনতা? এটাই কি একাত্তরের সংরক্ষণ করা স্বরলিপি? মোটেও নয়।। সুতরাং গল্পটির মূলভাবকে ব্যাখ্যা করলে স্বাধীনতা বিষয়ের সাথে শতভাগ সামঞ্জস্যতা পাবে বলে মনে করি।

২২ ডিসেম্বর - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৬৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী