পদ্মা পাড়ের যাত্রী

কি যেন একটা (জানুয়ারী ২০১৭)

Sheikh Samim
  • 0
  • 0
সকাল সাড়ে ১০টা বাঁজে।চারিদিকে চমৎকার মিষ্টি রোদ উঠেছে।অগ্রায়ণ মাসের এই সময়টাতে নদী তীরে হালকা মৃদুমন্দ বাতাস থাকে।শীতের অাগমনি বার্তা এই বাতাসেই দূরদূরান্তে বয়ে চলে।কদমতলীর ঘাট এখন যাত্রীদের দারুন ব্যস্ততা অার কোলাহলে পরিপূর্ণ।যে যার মত সবাই হন্যে হয়ে ঘাটের দিকে ছুটছে।মাঝে মধ্যে দু-একটা লন্স এবং ট্রলার ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে।জেলে নৌকা গুলো একটি একটি করে ঘাটে ফিরছিলো তখনও।রুবায়েত অারও একটু জোরে হাঁটছিলো।দেখে মনে হচ্ছে তার ভীষণ তারা অাছে।রুবায়েত দেখতে মোটামুটি সুদর্শন একজন যুবক,বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ এর মত হবে।পেশায় একজন হাতুড়ী ডাক্তার।নদীর এপাড়ে কালুখালী জংশনের পাশেই একটি কলনীতে থাকতো সে।বাপ দাদার ভিটা নাজিরগন্জের অাশে পাশে কোথাও হবে।পেশার কারনেই অল্প বয়সে নদীর এ পাড়ে এসেছিলো। লেখা পড়া খুব বেশি করতে পারেনি রুবায়েত।বলা চলে, নিজের চেষ্টা অার অধ্যাবসায়ের এর মাধ্যমেই সে যা কিছু শিখেছে।রুবায়েত লন্সঘাটের কাছাকাছি অাসতেই,কুলিদের একটি বছর সাত অাটের বাঁচ্চা ছেলে বলে উঠলো,"স্যার,দেন না! ব্যাগটা অামার মাথায়।দুই টেহা দিয়েন।রুবায়েতের হাতে দুটি ব্যাগ।বড় ব্যাগটিতে তার নিত্যদিনের ব্যবহৃত কাপড় চোপড়।অন্যটি কালো চামড়ার ছোট ব্যাগ তার ডাক্তারীর কলকব্জা রাখার জন্য।খুব যে বেশি ভারি তা কিন্তু নয়।কিন্তু ছেলেটির অসহায় অার ক্ষুদার্ত শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারলোনা সে।"নে ধর,বলে কালো ব্যাগটি ছেলেটির মাথায় তুলে দিলো।অার কাপড়ের ব্যাগটি নিজের সাথে নিয়ে ঘাটের দিকে এগুলো রুবায়েত।দু-মিনিটের মাথায় লন্সঘাটে পৌছে গেল সে।নদীর কোল ঘেঁষে রেলিংয়ের উপর দাড়িয়েই দেখলো,এম নাজির-৭ লন্সটি এখন ঘাটের একেবারে সম্মুখে।রেলিং অার লন্সের দূরত্বে লম্বালম্বি ভাবে মোটা কাঠের পাটাতন পাতা।দু-তিনটা সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামলো সে।কাঠের পাটাতনে সম্মুখগামী প্রথম পা-টি রাখতেই,কি যেন একটা তীব্র হাহাকার বুকের বামপাশে অনুভব করলো সে।পুরোনো কিছু স্মৃতি বেদনা হয়ে, মনের অন্তস্থলে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় দ্বিগবিদ্বীগ ছুটে চললো।বেদনাশিক্ত নির্লিপ্ত দুটি চোখ অপলক চেয়ে অাছে কয়েকটি পা ফেলে লন্সে ওঠার অপেক্ষায়।কেমন যেন অসাড় হয়ে উঠতে লাগলো সারা শরীর।সম্মহিত ভাবটা কাটলো বাচ্চা ছেলেটির ডাকে,"স্যার! ও স্যার,যাইবেন না?লন্সতো ছাইড়া দিবো।বাচ্চা ছেলেটি বারবার চেঁচিয়ে বলছিলো কথাগুলো।রুবায়েত ভারাক্লান্ত দুটি পা তুলে ধীরে ধীরে লন্সে উঠলো।ছেলেটি তখন রুবায়েতের ব্যাগটি তার বুকের সাথে চেপে ধরে অাছে।"অাপনার কি শরীর খারাপ লাগতেছে?বেশি খারাপ লাগলে এর পরের টিপ এ যান"।ছেলেটি একটু অাগ্রহের সাথে বললো।রুবায়েত কোন কথার উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ টা বের করলো।মানিব্যাগে দু টাকার কোন নোট ছিল না।তাই বাধ্য হয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট দিতে হলো।"ভাংতি তো নাই,ভাংতি কইরা অানি স্যার?কথাটি বলে রুবায়েতের সামনে বোকার মত দাড়িয়ে রইলো ছেলেটি।"লাগবেনা,তুই পুরোটাই রাখ।তোর নাম কিরে বেটা"?একটু কৌতুহলের সাথেই জিগ্যেস করলো রুবায়েত।একটু মৃদু হেসে ছেলেটি জানালো,তার নাম মফিজ,ঘাটের অাশে পাশের সকলে এবং তার বন্ধুরা তাকে মফজা বলে ডাকে।কথাটি শেষ করে মফিজ চকচকে পাঁচ টাকার নোটটি ট্যাক এ গুজে লন্সের ওপাশে কেবিনের দিকে হেটে গেলো।বেলা বেড়েছে এখন,অাকাশে একফোঁটা মেঘের ছিটেও নেই কোথাও।একেবারে পরিষ্কার নির্মল অাকাশ।রোদের তাপে শরীর রীতিমত চিটবিট করছে, পায়ের কাছে ব্যাগটি গুছিয়ে পাশ ফিরে রেলিং ঘেঁষে দাড়ালো রুবায়েত।পকেট থেকে সিগারেট অার দেয়াশলাই বেড় করে, একটা সিগারেট ধরালো।সাঁইরেন বাঁজিয়ে লন্সটি তখন ঘাট ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে।ঘাট অার লন্সের দূরত্ব যতটা না বাড়ছে,তার চেয়ে বেশি দূরত্ব তৈরি হচ্ছে রুবায়েতের শৈশব অার কৈশরের স্বপ্নে লালিত অাবেগের কুঁড়ে থেকে।এ ব্যবধান কি দূর নীল অাকাশ,অার নিচে বিস্তীর্ণ জলরাশির চেয়ে দূর?হয়তো তাই।অানমনে ভাবতে শুরু করেছে রুবায়েত,সেই দিনগুলোর কথা।হৃদয় পটে সেগুলো শুধু দুঃখ অার অানন্দের স্মৃতি নয়।সেগুলো যেন অায়নার অপর প্রান্তের নির্জলা চিত্রপট।সে গল্প পুরোনো নয়।
২য় পর্ব
বছর পাঁচেক অাগে এমনি এক সকালে সে ওপাড় থেকে এপাড়ে এসেছিলো।তখন মাত্র অাইয়ে পরিক্ষা শেষ হয়েছিলো তার,কিন্তু বাবা মা অার ছোট ভাইটির মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার তাগিদেই তাকে অাসতে হয়েছিলো।তাই লেখাপড়া বেশি করেনি সে।এই সর্বনাশা নদীর পেটেই রুবায়েতের বাবার সকল চাষের জমি।এই রাক্ষুসে নদী,গিলে নিয়ছে সব,শুধু বসত বাড়ীটি ছাড়া।এপাড়ে কালুখালী জংশনের পাশেই ছিলো মামার বাড়ী।রুবায়েতের মামা ছিলেন জংশনের পাশের গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক।মামার ব্যাগ টানতে টানতে এখন সে নিজেই ডাক্তার।রুবায়েতের মামা বেশিদিন বাঁচেনি,কি একটা জটিল রোগে অাক্রান্ত হলো অাশ্বিনের মাঝামাঝি, হঠাৎ করেই মারা গেলো লোকটি।মামা বিয়ে শাদী করেননি,তাই মামার ওষুধের দোকান,ব্যবসা,তাকেই দেখাশোনা করতে হলো।কলোনির পাশেই অাব্দুল লতিফের বাড়ীতে দুটি রুম নিয়ে থাকতো রুবায়েত অার তার মামা।যেদিন প্রথম এ বাড়ীতে এসেছিলো সেদিনের কথা মনে পড়ছে রুবায়েতের।সেদিনষ্টেশনের পাশে ৪নম্বর গলিতে ঢুকেই হাতের ডান পাশে, মরিচা ধরা গেটে শব্দ করতেই,একটি মেয়ে গেট খুলে দিলো।মেয়েটি অসম্ভব সুুন্দরী,পরিপাটি করে চুল অাচড়ানো কাঁধের দুপাশে বেণী করা,মুখে কৈশরের লাবন্য তখনও স্পষ্ট।বয়স ষোল কি একটু বেশি হবে।মেয়েটি জিগ্যেস করলো" অাপনি কি রুবায়েত? "জীঁ হ্যা,ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো রুবায়েত।"অাসুন,অাপনার মামা বলে গিয়েছিলো অাপনার অাসার কথা।বাড়ীতে কেউ না থাকায় বাড়ীর গেটটি অামাকেই খুলতে হলো।একনাগাড়ে বলে চললো মেয়েটি।অবশেষে একটু দম নিয়ে বললো,তার নাম কলি এবং এটা তাদেরই বাড়ী।রুবায়েত কে তার ঘরটি দেখিয়ে কলি চলে গেলো।হাত মুখ ধুয়ে সারাটা বিকেল রুমেই শুয়ে থাকলো রুবায়েত। মামা যখন সন্ধাবেলায় ফিরলেন,তখন কলির বাবা মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।কলির বাবা অাবদুল লতিফ মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক,তিনি স্থানীয় একটি কলেজে দর্শন পড়ান।অার কলির মা একজন অাদর্শ গৃহিনী বললেই ভালো হয়।তাদের সাথে কথা বলে রুবায়েত এটুকু বুঝেছিলো,তারা অাসলেই অত্যন্ত সাধাসিধে মানুষ।
বেলা বেড়েছে,রোদের তাপ ও অাচমকাই বেড়ে যাচ্ছে।রুবায়েত ঘড়ির দিকে তাকালো,নাজির গন্জ যেতে বিকেল হয়ে যাবে।এতো দেরি লাগবে না, যদি না লন্সটি অারও দু-ঘাটে যাত্রী নামাতে দেরি না করে।রোদের তাপ বেড়েছে তাই কেবিনে যাওয়াটাই উত্তম।রুবায়েত ব্যাগ দুটি হাতে নিয়ে লন্সের কেবিনের একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।কেবিনের ভিতর নানা ধরনের লোক পায়চারি করছিলো।হকার রা বিভিন্ন ভাবে যাত্রীদের দৃষ্টি অাকর্ষনের চেষ্টা করছে।কেউ তাদের কাছ থেকে কিছু কিনছে বলে মনে হচ্ছেনা।রুবায়েত চেয়ারে হেলান দিয়ে এই কোলাহল পূর্ণ পরিবেশে একটু চোখ বোজার চেষ্টা করলো।পুরোনো কথা মনে করতে রুবায়েতের একটু ইচ্ছে করছেনা।কিন্তু কেন যেন ভুলতেও পারছেনা,কি যেন একটা কিছু ফেলে গেলো সে,নদীর এ পাশে।সেটাই কি তার অস্তিত্ব্য ছিলো?কিংবা বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।মনে পড়ছে রুবায়েতের সেই দিনের কথাটি,একদিন কলি বায়না ধরলো তাকে মদনমোহনের অাঙিনাতে দূর্গা প্রতিমা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে।সেদিন বিকেলে মামার ওষুধের দোকান থেকে ফিরে,রুবায়েত সবে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দার গেটের সামনে এসে দাড়ালো।দরজার সামনে,কলি হলুধ রংয়ের একটি শাড়ী পড়ে এসে দাড়ালো।কপালে লাল টকটকে একটি টিপ,ঠিক যেন দেবী প্রতিমার টিপের মত উজ্জল লাল রং।মুখের দু পাশে গোলাপি অাভা, অার হাতে বিভিন্ন রংয়ের রেশমি চুড়ি।দরজা জুড়ে দাড়িয়ে অাছে অনন্ত যৌবনা অারেক দেবি মূর্তি।তাকে অবহেলা করে দু হাতে ঠেলে সম্মুখে এগোয় এমন সাধ্য জগতে কার অাছে।তাই সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইলো রুবায়েত।"এই যে মি: শুনছেন,অাজকে অামাকে মেলায় নিয়ে যেতে হবে।অনেক কষ্টে মা কে রাজি করেছি।কোনপ্রকার ইতস্ততা ছাড়াই বললো কলি।যদিও, এ কদিনে কলির সাথে রুবায়েতের যথেষ্ট সখ্যতা গড়ে উঠেছে।কখনও পড়াশোনার জন্য, কখনওবা বিনা অযুহাতে রুবায়েতের কাছে চলে অাসত কলি।কলির মা বাবাও রুবায়েতকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন।তাই তারাও কলিকে বাধা দিত না।বলা চলে তারা একে অপরের অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছিলো।একটু পড়ে কলির মা বারান্দায় এসে দাড়ালো।কলি পথ ছেড়ে দাড়িয়েছে তখন।রুবায়েত একপাশ দিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো।পেছন থেকে কলির মা ডাকলো,"বাবা রুবায়েত,তুমি কি একটু কলিকে নিয়ে অাঙিনা থেকে ঘুরে অাসবে।সকাল থেকে মেয়েটা মেলায় যাবে বলে বাড়িটা মাথায় তুলেছে।ওর বাবা তো সন্ধায় ফিরবে, তুমি যাবে একটু ওর সাথে।"ঠিক অাছে খালাম্মা,যাবো।বলেই,রুবায়েত নিজের রুমের দিকে হেঁটে গেলো।একটু পড়েই রুবায়েত তৈরি হয়ে গেটের সামনে এসে দড়ালো।দু-তিন মিনিট পর কলিও গেটের সামনে এসে দাড়ালো।
৩য়পর্ব
গলি পেরিয়ে জংশনের ওপাশে গিয়ে একটা রিক্সা নিলো ওরা।মিনিট বিঁশেক লাগবে মোদনমোহনের অাঙিনায় পৌছুতে।অাশ্বিনের শুরুতেই এবার পূজা শুরু হয়ে গেছে।অাকাশে হালকা মেঘ,বৃষ্টি হতেও পারে।কিছুদূর যাওয়ার পর,কলি কোন সংকোচ ছাড়াই,রুবায়েতের গা ঘেঁষে বসলো।কেমন যেন একটু শিহরন জাগছে কলির,তার কারণ কখনও রুবায়েতের এতো কাছে বসেনি সে।কেমন যেন একটা ভালো লাগায় মনটা উতলা হয়ে উঠছে। সেই একই সমস্যা রুবায়েতেরও,সে কেমন যেন একটু সংকোচ বোধ করছিলো।কুমোড় পাড়া চলে এসেছে তারা,রাস্তার দুপাশে অসংখ্য মাটির হাঁড়ি পাতিল,অার মাটির কোলার ভাঙ্গা অংশের স্তুপ জড়ো করা।এ পাশে ছোট একটি নদী অাছি,পদ্মার উপশাখা,এ নদীর নাম চন্দনা।নদী না বলে একটা খাল বললেই ভালো হয়।চন্দনার ছোট্ট সেতুটা পার হলেই নদীর কোলেই মদনমোহনের মন্দিরটা।দূর্গা পূজার সময় মন্দিরের ভোলই পাল্টে যায়,কত দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত এবং দর্শনার্থীরা যে অাসে প্রতিমা দর্শনে,তার কোন ইয়ত্তানেই।রিক্সা থেকে নামলো তারা,চারিদিকে দারুন ভিড়,অার ঢাকের অাওয়াজে একবারে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ।বাতাসে ধুপ অার ধুনোর গন্ধে চারপাশ টা মোঁ মোঁ করছে। ভীড়ের মধ্যে ঢুকেই কলি রুবায়েতের হাতটি শক্ত করে ধরলো।প্রথম গেট দিয় ঢুকে প্রতিমা দেখে অপর গেট দিয়ে বেরুলো।মন্দিরের সামনে বেশিক্ষণ দাড়ানো যায় না।এপাশে মেলা বসেছে,মন্দিরের পেছনে বিশাল বড় মাঠ,মাঝখানে একটি পুরোনো বটগাছ।হাজার টা শেকড় দেখলেই বোঝা যায়, এর বয়স নেহায়েত কম নয়।চারপাশে হড়েক রকমের দোকান বসেছে,গ্রামের মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসই বেশি।নানারকম মিষ্টীর দোকানও রয়েছে।এছাড়া মেয়েদের চুড়ি কসমেটিকস্ ইত্যাদির দোকান বসেছে এখানে।কলি সেই যে ভীড়ের মধ্যে হাতটি ধরেছে,এখন পর্যন্তও সেই একই ভাবে রুবায়েতের হাতটি ধরে অাছে।কলির হাতের উষ্ঞতা অনুভব করতে পারছে রুবায়েত।নিরাপদ অাশ্রয় পেয়েছে যেন কলির চিকন কোমল হাতটি।ইচ্ছা করলেও ছেড়ে দিতে পারা যায় না।সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখলো দুজন।অনেক কিছুই কিনলো কলি।অবশেষে জানালো ফুচকা খাবে সে।রুবায়েত মাঠের শেষ প্রান্তে একটি ফুচকার দোকানের সামনে এসে দাড়ালো।দোকানদার একজন ষাট উর্ধ মুরুব্বি লোক।সাদরে বসতে বললেন টুলের উপর।টুলের উপর বসে অারাম করে খাচ্ছিলো কলি এবং রুবায়েত।মাঝে মধ্যে ঝালের জন্য হা হুতাশ করছিলো কলি।"সন্ধা হয়ে এলো,এখন ফিরে যাওয়া যাক,বেশি দেরি করা ঠিক হবেনা"।নিরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা বলল রুবায়েত।"কেন অাপনার কি অামার সাথে ঘুরতে খারাপ লাগছে।খারাপ লাগলে চলুন ফিরে যাওয়া যাক"।খেতে খেতে উত্তর দিলো কলি।"না না তা না,বেশি দেরি করলে খালাম্মা যদি কিছু বলেন?একটু ইতস্ত হয়ে বলল রুবায়েত।মনে মনে অন্য কিছু বলল হয়তো,বোঝা গেলো না।রুবায়েত কলিকে এতোদিনে মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছে।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি কখনও।কলির হাবভাবে মনে হয় সেও রুবায়েত কে ভালোবাসে।হয়তো রুবায়েতের বলার অপেক্ষায়, সেও অধির হয়ে অাছে।যাই হোক,খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে উঠলো দুজন।ইতি মধ্যে প্রায় সন্ধা হয়ে এসেছে,মন্দির অার মেলা মাঠের অাশপাশের লাইটগুলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে।দুজনে সেতুর এপাশে এসে দাড়ালো।রিক্সা খুঁজতে লাগলো রুবায়েত।কলির অাচরণ দেখে বোঝা গেলো তার বাড়ী যেতে ইচ্ছা করছে না।অার ও কিছুক্ষন ঘুরে দেখতে পারলে হয়ত তার ভালো লাগতো।অবশেষে একটি রিক্সা পেলো, হুট তুলে উঠে বসলো দুজনে।অাকাশে অষ্টমীর চাঁদ, হালকা জোস্নায় সন্ধার এই প্রকৃতি অসম্ভব সুন্দর লাগছে এখন।ইচছা করেই কলি, রুবায়তের হাতে নিজের হাতটি রাখলো।রীতিমত পরম যত্নে ওর হাতে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিলো।রুবায়েতের ক্ষমতা নেই এই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে।সে ও তো কলিকে মনে প্রানে ভালোবাসে।তাই বাঁধা না দিয়ে বরং কলির ভালোবাসায় ইন্ধন যোগালো।কলিও অপর পক্ষ থেকে সাড়া পেয়ে রুবয়েতের বুকে অালতো করে মাথা রাখলো। দুটি মনে পরিপূর্ণতা এলো।সকল বাধা অতিক্রম করে দুটি মন বাঁধা পড়লো।অবশেষে বাসার সামনের গলিতে এসে রিক্সা থেমে গেলো।
৪র্থ পর্ব
ঘুমঘুম চোখে এসবই ভাবছিলো রুবায়েত।লোকজনের শোরগোলে তার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটলো।কেবিনের দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল সে।বেলা পড়ে গেছে,সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে এখন।গৌড়ীপুর ঘাটে এসে থেমেছে লন্স।যাত্রীরা কেউ কেউ নেমে যাচ্ছে এখানে,কেউবা উঠছে নাজির গন্জ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য।নাজিরগন্জ থেকে এই লন্সটি অাবার সন্ধায় কদমতলী ফিরে যাবে। এখানে ত্রিশ মিনিটের বিরতি।একেবারে বালুর চরে ঘাট টি,পাশেই গৌড়ীপুরের ছোট্ট বাজার।তেলে ভাজা মশলাদার মাছের গন্ধে,রুবায়েতের ক্ষিদেটা চাড়া দিয়ে উঠলো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে তিনটার মত বাঁজে।এতক্ষণে মনে হলো সকাল থেকে তার কিছু খাওয়া হয়নি।তাই ভাবলো নিচে নেমে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।যেহেতু নাজিরগন্জ যেতে অারও ঘন্টা দুয়েক লাগবে।তাই ব্যাগপত্র নিয়েই নিচে নামলো রুবায়েত।লন্সেও হোটেল অাছে,কিন্তু সে শুনেছে এখানকার সব কিছুই নদীর পানি দিয়ে রান্না হয়,তাই এখানে খেতে ইচ্ছা করলোনা।ওর চেয়ে নদীর তীরের বাজার থেকে টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলেই ভালো লাগবে।লন্স থেকে নামতে যাচ্ছে,কোত্থেকে মফিজ এসে হাজির।মফিজ বলছে"স্যার স্যার ব্যাগটা অামার মাথায় দেন,অামি নিয়া দেই,এক পঁয়শাও লাগবো না"।"দরকার নেই,তুই বরং চল অামার সাথে,এবং বল এখানে সবচেয়ে ভালো খাবার পাবো কোন দোকানে।লন্স থেকে নামতে নামতে বলল রুবায়েত।মফিজ বলল, "ঐ যে টিনের চালের ছাপড়া করা ঘর,ঔখানে।অনেক নাম ডাক অাছে ঐ দোহানের।অাপনে অামার লগে অাহেন"বলেই অাগে অাগে দৌড়াতে লাগলো মফিজ।পিছনে পিছনে ব্যাগ নিয়ে হাটতে লাগল রুবায়েত।দোকানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে দুজনের খাবার অর্ডার করলো রুবায়েত।মফিজ প্রথমে খেতে রাজি হয়নি,সে জানালো সকাল থেকে এ পর্যন্ত সে বেশ কিছু টাকা কামিয়েছে।শ খানেক টাকা তো হবেই।সে টাকা থেকে প্রথম যেখানে লন্স থেমেছিল,সেখানেই করলা ভাজা অার অালুর তরকারি দিয়ে পুরো এক প্লেট ভাত খেয়েছে সে।তাই এখন তার একদম খাওয়ার ইচ্ছা নেই,অাবার এই লন্সে রাতে ফিরে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সাথে খাবে সে।লন্স দেড়ি করে ছাড়লে অনেক রাত হয়ে যাবে।যদিও সে প্রতিদিন গৌড়ীপুট ঘাটে নেমে অন্য লন্সে সন্ধা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায়।কিন্তু অাজ একটু বাড়তি রোজগারের অাশায় নাজিরগন্জ পর্যন্ত যাচ্ছে সে।যাই হোক অনুরোধ করায় রাজি হয়েছে সে।দূজনে মিলে নদীর বেলে মাছের চচ্চড়ি অার বড় অাড়শঁলা মাছ ভাজি খেল।মফিজ অনেক তৃপ্তি করে খেলো,কে জানে এমন খাবার হয়তো অনেক দিন খাওয়া হয়নি ওর।অল্প কয়েকটি দোকানপাট এ বাজারে,এই রকম হোটেলে রুবায়েতেরও এমন স্বাদের খাবার খাওয়া হয়নি অনেক দিন।অবশেষে,খাওয়া শেষ করে লন্সের অভিমুখে হাটছে তারা।এখন রুবায়েতের ডাক্তারী ব্যাগটা মফিজের মাথায়।চরান্চলের মানুষ গুলো কেমন যেন অসহায়,দুপাশের ঘরবাড়ি অার দোকান পাট দেখলেই তাদের দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়।এই নদীই তাদের বেঁচে থাকার মূল অাশ্রয়,অাবার এই নদীই তাদের অস্তিত্ব্য বিলীন করতে একটুও দ্বিধা করেনা।চাষের জমি গুলোতে পলি পড়াতে এখানে সবচেয়ে সেরা ফসল জন্মে।তবু এদের অভাব কখনও যায় না।লন্সে এসে জানা গেল,লন্স ছাড়তে একটু সময় লাগবে,লন্সের পাখাটায় কি যেন একটা গন্ডগোল হয়েছে।এজন্য ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।রুবায়েত কেবিন ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ালো,রেলিং ধরে দাড়িয়ে কোলাহলে মুখর জমজমাট বাজারটির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।মনটা অাবার খারাপ হয়ে গেছে রুবায়েতের।কলির কথা খুব মনে পরছে তার।বেশ কাটছিলো ওদের দিনগুলো।এভাবেই কেটে যেতো হয়তো অারও বেশ কিছুদিন।কদিন অাগে,ওদের সম্পর্ক টা জানাজানি হলে কলির মা মেনে নিয়েছিলেন,কিন্তু কলির বাবা রাজি হননি।তিনি মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চান।একজন হাতুড়ী ডাক্তারের সাথে তো অবশ্যই নয়।বাধ্য হয়েই রুবায়েত কে বাসাটি ছাড়তে হয়েছে।দোকানের জন্য যদিও অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা যেত,কিন্তু অন্য কোথাও কলির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।তাই রুবায়েত চায় না কলির সাথে ওর দেখা হক।এজন্য নিজের বাড়ি নাজিরগন্জ ফিরে যাচ্ছে ও।
৫ম পর্ব
রোদ পড়ে গেছে,বিকেল হয়ে গেছে এখন।বিকট অাওয়াজে সাঁইরেন বাঁজিয়ে এম নাজির-৭ লন্সটি ছেড়ে দিয়েছে।ঘন্টা খানেক লেগেছিল লন্সের পাখাটি ঠিক করতে।অাস্তে অাস্তে ঘাট ছেড়ে কিছুদূর চলে অাসলো লন্সটি।রুবায়েত তখনও রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে। নদীর দু -পাশের সাদা বালুচরের দিকে তাকিয়ে,রুবায়েত একটি কথাই শুধু বারবার ভাবছিলো,কেন এসেছিলো সে এপারে।নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া শেকড়-বাকর হীন জীবনেই বেশ ছিলো।দাম দিয়ে দুঃখ কেনার কোন মানে হয়না।বাবা মা অার ছোট্ট ভাইয়ের সাথে সুখে দুখে একবেলা না খেয়েও কাটানো যেত।কিন্তু এখন কি করে কাটবে ওর জীবন।ভালোবাসা দুঃখ অার বেদনার সমন্বয়,কিন্তু এর দুঃখ সইবার ক্ষমতা, পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই রয়েছে।নিজেকে নিঃশেষ করার ক্ষমতাও ওর নেই,কি করে করবে,বাবা মায়ের স্নেহ ভরা মুখটি প্রতিনিয়ত দু-চোখে ভেসে ওঠে।ও ছাড়া তাদেরই বা কে অাছে?তাই বাবা মা অার ভাইটির মুখের দিকে তাকিয়েই বাকি জীবন টা কাটাবে ও।এমনটাই ভেবেছে রুবায়েত,নিজেকে অারেকটু শক্ত করার চেষ্টা করছে সে।ভালোবাসা সে তো তুচ্ছ!বাবার ঘামে ভেজা করুন হাসিটির কাছে।সে হাসি যেন করুন না হয়ে অারও প্রাণবন্ত অার সজীব হয়,সেটাই দেখার ইচ্ছা প্রতিটা সন্তানের থাকা উচিৎ।তাই রুবায়েত সব ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে।কিন্তু কি যেন একটা বেদনা তার মনকে বিষাদে পরিপূর্ণ করে ফেলছে।কলিদের বাসা থেকে যখন সে অাসছিল,কলির সাথে না দেখা না কোন কথা! কোনটাই হয়নি তার।শেষবারের মত একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করেছিল রুবায়েতের।অাপাতত সে ইচ্ছেটা বাদ দিতে হচ্ছে।নদীর একপাশ দিয়ে যাচ্ছে লন্সটি,এপারের তীরের ঘরবাড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।পদ্মার সংলঘ্ন বাড়ি গুলো ছোট ছোট টিনের ঘর।নদীর এপাশে চর পরেনি,মাঝে মাঝে নদীর কোল ঘেঁষে দু একটি ছোট্ট বাড়ি।নিতান্তই সহায় সম্বলহীন মানুষ গুলোই এতো ঝুঁকি নিয়ে এখানে এখনও বাস করছে।এ বছরের বর্ষায়, ভাঙনের অাগেই বাড়ি না সরালেই নয়।দূরে একটি নাড়িকেল গাছ নদীতে পড়তে পড়তে এখনও দাড়িয়ে অাছে।শেকড়গুলো অর্ধেক নদীর কিনারে বেড়িয়ে অাছে।পরবর্তি ভাঙনে নদীতে বিলীন হওয়ার অাশাতে।বিকেল হয়ে গেছে এখন,গোধূলির মিষ্টি অালোতে দু একটি সাদা বক্ নদীর ওপারে যাচ্ছে।নদীর সৌন্দর্য ভয়ানক,এর প্রকৃতিতে শুভ অশুভ দুটি জিনিষই মিশে থাকে।রুবায়েত রেলিং ছেড়ে ওপাশে গিয়ে দাড়ালো,ছোট একটা জটলা বেঁধেছে সেখানে।লন্সের পাখাটি অাবার অাটকে গেছে,পাশেই কোথাও থামতে হবে।এদিকে সন্ধা প্রায় হয়ে গেছে।এজন্য যাত্রীরা অস্থির হয়ে গেছে।রাত বিরাতে এ পথে ডাকাতির ভয়ও অাছে।অবশেষে,কসবার চরের এক মৌলানা সাহেব সবাই কে একটু সান্তনা দিয়ে বললেন,"ভাই সব অান্নেরা কেউ গোলমাল কইরেন ন,অাল্লায় বাঁচাইলে,কারো কোন ক্ষতি অইতো ন।সবাই এট্টু ধৈর্য্য ধরেন,দোয়া দরুদ পড়েন"।তাই শুনে সবাই একটু শান্ত হলো।এখানে অাশে পাশে কোন ঘাট ও নেই।বড় বড় কাশের বনে ছেয়ে অাছে চরান্চল,মাঝে মাঝে দু একটি পুরোনো খঢ় গাছ।একটু সামনে এগিয়েই,নদী সংলঘ্ন পায়ে হাঁটা একটি পথের পাশেই ছোট্ট ঘাট।এখানেই লন্সটি দাড় করানো হলো।এঘাটে সচরাচর কেউ অাসে না,শুধু গরুর রাখাল রা ছাড়া।না হলে অন্তত,একটি খেয়া নৌকা দেখা যেত। কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ।একটু দূরে কিচ্ছু দেখা যায় না।শুধু পূবের অাকাশে একটিমাত্র নক্ষত্র ছাড়া, উজ্জল অালো চারপাশে অার কোথাও নেই।রুবায়েত লন্সের উপর তলার কেবিনে গিয়ে বসলো।উপরতলার কেবিনে ত্রিশ জন মতো লোক।এর মধ্যে দশ বারো জন মহিলাও অাছে।দু একজনের কোলে বাঁচ্চাও অাছে।সবার মধ্যেই একটা চরম ভিতি কাজ করছে।লন্সের একজন কর্মচারি এসে জানালেন,অার অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই লন্স ছাড়বে।দয়া করে কেউ যেন,বাইরে না যায় অথবা কোন প্রয়োজনে নিচে না নামে।নদী পথে রাতের বেলা চলাচল করা অত্যন্ত কষ্টকর একটা ব্যাপার।কেবিনের উপরের সিলিং এর মিটমিটে হালকা অালোতে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে সবাই।নির্জন,সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় লন্সটি দাড়িয়ে অাছে।রুবায়েত অাবারও উঠে রেলিংয়ের দিকে যাচ্ছিলো,কেবিনের শেষ মাথায় একটা লোককে খুব চেনা চেনা লাগল।পাশেই একটা মেয়ে অল্প বয়সী।সম্ভবত ওনার মেয়ে,বোরকা পরে অাছে।কোথায় যেন দেখেছে লোকটাকে,মনে করতে পারছিল না রুবায়েত।লোকটাও বারদুই ইচ্ছাকৃত চাহনীতে তাকালো রুবায়েতের দিকে।ওর ইচ্ছে করলো একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে,কি ভেবে ইচ্ছেটা দমন করলো।অার এই মিটমিটে অালোতে ভাল করে দেখাও যাচ্ছে না।কে না কে! সম্পূর্ণ অচেনাও তো হতে পারে।যাই হোক রুবায়েত লন্সের রেলিংয়ের ধারে গিয়ে দাড়ালো।বাইরের অাবহওয়াটা এখন দারুন,মৃদুমন্দ হালকা বাতাসে মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে।যত ক্লান্তি অার বিষাদ কে এই বাতাসে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে রুবায়েতের।লন্স ছেড়ে দিয়েছে,ভটভট শব্দে রাত্রির নিরবতাকে খানখান করে এগিয়ে চলছে লন্সটি।চারিদিকে জলের শব্দ,অার কালো অন্ধকার অাকাশে দু একটি পরিষ্কার নক্ষত্র,সব মিলিয়ে ভয়ংকর সুন্দর প্রকৃতি।
৬ষ্ট পর্ব
নিগূঢ় অন্ধকারে ছেয়ে অাছে চারপাশ,মাঝে মাঝে দু একটি ডিঙি নৌকা সাঁ করে লন্সের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।নৌকা গুলোতে একজন বা দুজন করে জেলে, জাল পানিতে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।এতো ছোট নৌকায় মাঝ নদীতে মাছ ধরা নিতান্তই সহজ ব্যাপার না।বুঝাই যায় এরা অত্যন্ত সাহসি প্রাণী।সচরাচর যারা নদীতে চলাফেরা করেননা,তারা দেখলে একটু অাশ্চার্য্যই হবেন।লন্স প্রায় নাজিরগন্জের কাছাকাছি চলে এসেছে।দূর থেকেই নাজিরগন্জ ঘাটের অালো দেখা যায়।রুবায়েত হঠাৎ খেয়াল করলো,মাঝ নদী থেকে গোটা দুই টর্চ, লন্সের ডেকে এসে পরছে।অালোটা এমন ভাবে ফেলা হচ্ছে যেন,নির্দেশ করা হচ্ছে লন্সটা থামানোর জন্য।কিন্তু লন্সের গতি না কমে বরং মনে হচ্ছে বেড়ে যাচ্ছে।রুবায়েত ব্যাপারটা সহজে অান্দাজ করতে পারেনি,যতক্ষন না লন্সের একজন কর্মচারী এসে জানালেন,"অাপনারা কেউ বাইরে থাকবেন না,দয়া কেবিনে এসে বসুন,সম্ভবত জলদস্যুরা অামাদের লন্সের পিছু নিয়েছে"।কথা গুলো বলতে যতটুকু দেরি,কেউ অার এক সেকেন্ডও উপরে থাকলো না।যে যার মত দৌড়ে কেবিনে গিয়ে ঢুকলো।রুবায়েতও ধীরে ধীরে কেবিনের পেছনের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো।দূরের অালোটা ধীরে ধীরে অারো কাছে চলে এসেছে।নাজির গন্জে যেতে অারও অাধাঘন্টা মত লাগবে।কেবিনের লোকজন ইতিমধ্যে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলেছে।ডাকাতদের ব্যাপারটা সবাই কানাকানি করছে।রুবায়েত সবাই কে একটু শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করলো।বলল"অাপনারা একটু শান্ত হয়ে বসুন,অাগে দেখাই যাক না ব্যাপার টা কি।ডাকাত তো নাও হতে পারে।খামোখা উতলা হবার কোন মানে হয় না"।রুবায়েতের কথায় একটু কাজ হলো মনে হয়, সবাই একটু শান্ত হলো।সাত কিংবা অাট মিনিটের মাথায়,সাঁ করে একটা ডবল ইন্জিনের ট্রলার লন্সের পাশ কেটে চলে গেল।অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না ট্রলারে কি অাছে।হঠাৎ লন্সের গতি একেবারে কমে অাসলো,মনে হচ্ছে থেমে যাচ্ছে।কেবিনের মহিলারা সবাই এক সঙ্গে কেঁদে উঠলো।রুবায়েত সবাইকে শান্তনা দিয়ে অারেকবার চুপ থাকার জন্য অনুরোধ করল।কেবিনের লাইটটা ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।শুধু চালকের রুমের লাইটটা তখনও মিটমিট করে চলছে।রুবায়েত কেবিনের সামনের দিকের কাঁচের জানালা দিয়ে চালকের রুমটা দেখার চেষ্টা করল।কাউকেই দেখা যায় না।কেবিনের দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে, কাউকে বললো দরজাটা লাগিয়ে দিতে।অাস্তে অাস্তে রেলিং এর উপর পা দিয়ে ছাদে উঠলো সে।শরীর টা ছাদের সাথে মিলিয়ে সামনে চলে অাসলো।দেখলো,লন্সের ঠিক সামনে অাড়াঅাড়ি ভাবে একটা ডবল ইন্জিনের বিশাল অাকারের ট্রলার দাড়িয়ে।দুজন সেপাই ধাঁচের ডাকাত ট্রলার থেকে লাফ দিয়ে লন্সের ডেকে নামল।দুজনের হাতেই চকচকে বড় রামদা।দুজনেই লুন্গি পরা ফুল হাতা মোটা জামা শার্ট পড়া। লন্সের চালকের রুমের দরজা খোলা,কিন্তু অালোটা জালানো।সেই অালোতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনের দিকটা।ট্রলারের ওপাশ থেকে দীর্ঘদেহী একজন লোক এগিয়ে অাসলো সেও লুন্গি পরা কিনতু গোলগলা গেন্জি গায়ে।লোকটার ভুঁড়িটা অসম্ভব রকম বড়।কাধে একখানা দেশি রাইফেল,হাতে তৈরি করা।ট্রলার বরাবার অাসলেই ওপরের দুজন হাত বাড়িয়ে লন্সে টেনে তুললেন।লোকটা সম্ভবত ডাকাতদলের সরদার।পরপর অারও দুজন রামদা হাতে নামলেন।বাকি দুজন ট্রলারে বসে থাকল।একজন হাল ধরে বসে অাছে।নদীতে এখন একদম স্রোত নেই।তাই সহজেই ট্রলারটি লন্সের সামনে ভেসে থাকল দূরে না গিয়ে।অার ওপর জন নোঙরটি লন্সের রেলিং এ অাটকিয়ে দড়ি ধরে বসে থাকলেন।সরদার লোকটা চালকের রুমের সামনে গিয় দাড়ালেন।দুজন গিয়ে চালক কে সিটের নিচ থেকে টেনে তুললো।সরদার একগাল পানের পিক ফেলে রেগে বললেন,"কি রে মাইয়ানদারের পো! তরে কয়বার সিগনাল দিলাম এ্যাঁরে?দাড়ালি না ক্যানে?নায়ক সাজত চাস বাইনচ.."। বলেই পেটের উপর কয়েকটা লাথি দিল।বেচারা গোবেচারা টাইপ মানুষ।লাথি খেয়েই মেঝেতে শুয়ে কাতরাতে লাগল।মুখ দিয়ে বারকয়েক বমি করে নেতিয়ে পরলো।পেছন থেকে দুজন লন্সের টিকেট চেকারকে বাইরে বসার বেন্চের তলা থেকে ধরে অানল।সরদারের সামনে অানলে সরদার বললেন,"তরে কিছু কইয়াম না,লাইট জালায় দে কেবিনের দেহি কি অাছে।জলদি কর যা"।চেকার সাহেব নিচতলার কেবিনে গেলেন ডাকতদের সাথে।উপরে দুজন ডাকাত দাড়িয়ে থাকলো।রুবায়েত সবকিছু দেখছিল।হঠাৎ খেয়াল করলো, দুজন লোক তার পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে অাসছে।কাছে অাসতেই রুবায়েত বুঝলো,এরা লন্সের যাত্রী।লোক দুজনের বয়স তার থেকে একটু বেশি।কাছাকাছি অাসলে তারা একসাথে নিচুস্বরে কিছুক্ষন কথা বলল।একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হলো তিনজন।বোঝা গেল তাদের মনোভাব,কিছু একটা করতে চায় তারা।ডাকাতদের সরদার সহ সবাই নিচতলার কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো।সাথে দুজন অল্প বয়সি মেয়েকে ধরে নিয়ে অাসলো তারা।সরদারের হকুমে নিচতলার দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হল।লন্সের উপরের কেবিনেই বেশি যাত্রী ছিল।সেপাই গোছের দুজন ডাকাত উপরের কেবিনের দরজাটি ভান্গতে শুরু করলো।দুচারটি লাথি দেওয়ার সাথেই দরজা ভেঙ্গে গেল।চেকার ভেতরে ঢুকে লাইট জালালো।রুবায়েতরা এখন পেছনের দরজার ঠিক উপরে শরীরটা ছাদের সাথে লাগিয়ে শুয়ে অাছে।দুজন ডাকাত রাম দা হাতে পায়চারি করছিল দরজার সামনে, বাদবাকি কেবিনের মধ্যে।সুযোগের অপেক্ষায় অাছে তারা।দুজনের মধ্যে একজন ট্রলারে কি যেন অানতে গেল।সম্ভবত সিগারেটের প্যাকেট অানার জন্য গেল।রুবায়েত রা অপেক্ষা না করে একসঙ্গে তিনজনই দরাজার সামনে দাড়িয়ে থাকা ডাকাতের উপর ঝাপিয়ে পড়লো।রুবায়েত মুখটা চেপে ধরে মেঝেতে ঠেসে ধরলো।বাকি দুজন যাত্রী হাত থেকে রাম দাটি কেড়ে শব্দ না করার জন্য বলল।গায়ের শার্ট খুলে মুখ বাঁধলো।অার রাম দা দিয়ে দড়ি কেটে অন্য পাশে রেলিংয়ের সাথে হাত পা বেঁধে রাখল।।শব্দ একটু হয়েছে,কিন্তু যাত্রীদের মালামাল লুট করায় এত ব্যাস্ত যে,ভেতরের ডাকাতরা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি।অন্য ডাকাতটি অাবার সস্থানে এসে তার সাথিকে না পেয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিল,কিন্তু রুবায়েত রা সে সুযোগই দিল না।সেটাকেও একই কায়দায় বেঁধে রাখল।কেবিনের ভেতরে মিটমিটে অালোয় সবকিছু দেখা যাচ্ছিলোনা।ডাকাতরা টর্চ ও জ্বেলেছে,কিন্ত দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।রুবায়েতরা বামপাশের জানালার কাছাকাছি গেল,এখন সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সব মালামাল প্রায় লুট করে ফেলেছে তারা।সরদার সেই মাঝবয়সি ভদ্রলোকের সামনে এখন,রুবায়েতের দিকে বারবার যে ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকিয়েছিলেন।পাশে বসা অল্পয়সী মেয়েটিকে বললেন"এই মাইয়া মুখটা খোল দেহি"।জানোয়ারের মত মেয়েটির মুখের সামনে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল।কোন কিছুর গন্ধ যেভাবে নেয় ঠিক সেভাবেই।মেয়েটি মুখটা ঘুরিয়ে নিল।ভদ্রলোক বললেন,"অাপনার দোহায় লাগে,অামাগ কাছে যা অাছে সব দিয়া দিলাম।দয়া করে ওরে ছাইড়া দেন"।সরদার বলল,"ওই মিয়া অামি কি ওরে ধইরা রাখছি,যে ছাইড়া দিমু।অামি ত,একটু গন্ধ নিলাম।এহন দেহি ছাইড়া দিমু না সঙ্গে নিমু"।বলেই সরদার টান দিয়ে মেয়েটার মুখের নেকাবটা তুলে ফেললো।অাশ্চার্য্য! একি দেখছে রুবায়েত! এতো কলি।হ্যা কলিই তো।একটু মুখ এগিয়ে ভাল করে দেখল রুবায়েত।অার পাশে বসা ভদ্রলোক কলির ছোট মামা।দু একদিন দেখেছে রুবায়েত ওনাকে কলিদের বাড়ি।কিন্তু মনে করতে পারছিল না।তাহলে কি কলি তার সাথে একই লন্সে এসেছে।কলি কেন অাসলো বুঝতে অার বাকি নেই রুবায়েতের।সরদার দুজন ডাকাত কে বললো মেয়েটিকে সাথে নিয়ে যেতে।সব যাত্রীকে মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে বসতে নির্দেশ করল ডাকাত সরদার।মালামাল লুটপাট হয়ে গেছে,শুধু নগদ টাকা পয়্সা অার গয়না গাটি নিয়েছে তারা।এর পর কলিসহ অারও দুটি মেয়েকে নিয়ে ডাকাতরা কেবিন থেকে বেড়ুচ্ছিল।হটাৎ সামনে থাকা ডাকাতটি বাইরেে এসে দেখল দরজায় যারা পহারায় ছিল তারা সেখানে নেই।সরদার রাইফেল তাক করে বাই রে বেড়িয়ে এলো।বাইরে ভিষন অন্ধকার।এরকমই প্লান ছিল রুবায়েতদের।উপরে তাদের তিনজনের একজন,এক গাছি মোটা কাছি ধপাস করে ফেলে দিলো রেলিং অার কেবিনের মাঝামাঝি পথে।অন্ধকারে মানুষ ভেবে ওইদিক লক্ষ করে দুটি গুলি করল।রুবায়েত অার অন্য যাত্রী কেবিনের বামপাশে অন্ধকারে দড়িয়ে ছিল।সরদারের মনোযোগ অন্য দিকে গেলেই,দুজন মিলে দৌড়ে গিয়ে সরদার কে রেলিং এ চেপে ধরলো।এমন অবস্থায় সরদার কোন মতে বন্দুকের নল এদিকে ঘোরাতে পারছিল না।ভেতরের ডাকাত দুজন সরদারকে সাহায্য করতে এলে বাকি যাত্রীরা সুযোগ বুঝে তাদের ধরে ফেললো।চিৎকার চেঁচামেচিতে রাতের নিস্তবতা খান খান হয়ে গেল।অবস্থা অান্দাজ করে ট্রলারে পাহাড়া দেওয়া দুজন ডাকাত ট্রলার স্টার্ট দিল,কিন্তুু লন্সের রেলিংয়ে বাঁধানো নোঙরের দড়ি কাটতে কাটতে যাত্রীরা এসে ওদের অাটক করলো।লন্সের কোন একজন কর্মচারী জরুরী অবস্থার এ্যালার্ম বাজিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে ডাকাতদের একসঙ্গে বেঁধে ইন্জিন রুমে তালা দিয়ে রাখল।সকলের মালামাল সবাই বুঝে নিল।অাবার লন্স ছেড়ে দিয়েছে,সকল যাত্রীই এতবড় একটা বিপদ থেকে রেহাই পেয়ে, নিশ্চিন্ত মনে খোশগল্পে মেতে উঠেছে।শুধু রুবায়েত এখনও রেলিংয়ের একপাশে হালকা অালোতে দাড়িয়ে অাছে।একটু পরে কলি অার ওর মামা অাসলো।কলির মামা জানাল,মেয়ের জিদটাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হল।কোন উপায় না দেখে তিনিই কলিকে রুবায়েতের কাছে পৌছে দিতে সম্মত হয়েছেন।কলির ভয় যদি রুবায়েত অভিমান করে অার সেখানে কখনও ফিরে না যায়।লন্স নাজিরগন্জ ঘাটের কাছাকাছি অাসতেই, দেখা গেল ঘাটে অনেক লোক তাদের লন্সের অপেক্ষায় দাড়িয়ে।ইতিমধ্যে পুলিশের একটি ট্রলার রেডি হচ্ছিল তাদের কে উদ্ধারের জন্য।তার অার দরকার হল না।লন্সের অাগে যে ট্রলার গুলো এসেছে,তারাই খবরটি ঘাটে দিয়েছে।লন্স থেমে গেল,সকল যাত্রী তারাহুড়ো করে নিচে নামছিল।কলি অাগে, তারপর রুবায়েত লন্স থেকে নামল। কি যেন একটা বোঝা মন থেকে নেমে গেল তার।কি যেন একটা খুশিতে ভরে উঠলো মন।হঠাৎ মফিজ কোথা থেকে রুবায়েতের ব্যাগ দুইটা নিয়ে হাজির।ব্যাগ নিয়ে রুবায়েত নেমে অাসল।কলির মামা তার এক অাত্মিয়ের বাসায় থেকে কাল ফিরে যাবেন। অনেক রাত হয়ে গেছে এখন।এখান থেকে রুবায়েতের বাসা বেশি দূরে নয়।তাই রুবায়েত কলির হাত ধরে দ্রুত হাটতে লাগল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

০৩ ডিসেম্বর - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী