গহী‌নে বিষাদ

কি যেন একটা (জানুয়ারী ২০১৭)

সারোয়ার কামাল
চার কি পাঁচ মাই‌লের সমান ঘন উঁচু শাল গা‌ছে ঘেরা দীর্ঘ শালবন । ব‌নের যত গভী‌রে যাওয়া যায় গাছপালাগু‌লোকে আরও নি‌বিড়ভা‌বে পরস্প‌রের সা‌থে জ‌ড়ি‌য়ে থাক‌তে দেখা যায় । ব‌নের মা‌ঝে অপ্রশস্ত সিঁ‌থির মত পা‌য়ে হাটা রাস্তা সা‌পের মত এঁকে‌বে‌কে দূ‌রে ব‌নের আরও গহী‌নে গি‌য়ে মি‌শে‌ছে ।হে‌টে চলা পথটা মা‌ঝে মা‌ঝে এত সংকীর্ণ হ‌য়ে গে‌ছে যে ঝোপঝা‌ড়ের কাঁটা শার্ট প্যা‌ন্টে আট‌কে যা‌চ্ছে । হাটার সময় খুব সন্তর্প‌ণে প‌থের মা‌ঝে ঝোপঝা‌ড়ের কাঁটা ভ‌র্তি লতা‌নো ডালপালা হাত দি‌য়ে সরা‌তে গি‌য়ে বিঁ‌ধে যা‌চ্ছে কাঁটা । ভা‌গ্যিস জু‌তো জোড়া পা‌য়ে দি‌য়ে এসে‌ছি । না হ‌লে এই বুনো কাঁটায় পা‌য়ের যে কি হাল হত !জামার হাতাটা টে‌নে হাতঘ‌ড়ি‌তে সময় দে‌খে নিলাম । চারটা বে‌জে পঁ‌চিশ মি‌নিট ।বি‌কে‌লের নরম সোনা রোদ শালগা‌ছের ডালপাতার ফাঁক গ‌লে বনভূ‌মির শীতল মা‌টি‌তে কাটাকু‌টি খেল‌ছে ।শন্ শন্ শ‌ব্দে গ‌া‌ছের ডালপালায় মৃদু বাতা‌সের ‌গোপন কানাকা‌নি । কেন জা‌নি ম‌নে হল দীর্ঘকাল এই বনভূ‌মি ঘু‌মি‌য়ে ছিল নি‌শ্চি‌ন্তে,আজ‌কে হঠাৎ ক‌রে দুজন অযা‌চিত অভ্যাগত সেই ব‌নে প্র‌বেশ ক‌রে জা‌গি‌য়ে তু‌লে‌ছে বন‌কে ।অকস্মাৎ এভা‌বে দুজন অপ‌রি‌চি‌তের ব‌নের মা‌ঝে ঢু‌কে পড়ায় বনভূ‌মি অপ্রস্তুত এবং বিব্রত হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছে ।মা‌থার উপ‌রে টর্-র্-র্-র্ শ‌ব্দে কি একটা বি‌চিত্র পা‌খি এক‌ঘে‌য়ে ডে‌কে যা‌চ্ছে । ঠক্ ঠক্ ঠক্ ক‌রে নি‌বিষ্ট ম‌নে একটা কাঠ‌ ঠোকরা পা‌খি শাল গা‌ছে গর্ত কর‌তে ব্যস্ত । কোথায় থে‌কে যেন একদল চড়ুই জাতীয় পা‌খি মাথার কয়হাত উপর দি‌য়ে ফুড়্ ফুড়্ ফুড়ুৎ ক‌রে উড়ে পালা‌লো । বি‌কে‌লের ঘন ছায়া নে‌মে এসে‌ছে বনভূ‌মির বু‌কে । শত শত নাম না জানা পা‌খির কি‌চির মি‌চির শ‌ব্দে পু‌রো বন মুখ‌রিত । হাট‌তে গি‌য়ে একটু থম‌কে দাড়ালাম । এপা‌শের বনটা আরও গভীর । চাপা মা‌টির বনজ গ‌ন্ধে কেমন একটা নেশা নেশা ঘোর লাগ‌ছে । শরীরটা আল‌স্যে শি‌থিল হ‌য়ে আস‌ছে । ইচ্ছে কর‌ছে এই বন্য মা‌টির বু‌কে শু‌য়ে এখ‌নি ঘু‌মি‌য়ে প‌ড়ি ।আর কখ‌নো জাগব না । জীবনানন্দ দা‌শের ক‌বিতার সেই লাইন‌টির মত -"‌কোন‌দিন জা‌গিবে না আর
জা‌গিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম -অ‌বিরাম
ভার স‌হি‌বে না আর ।" ‌
শো শো শ‌ব্দে একটা দমকা বাতাস মাথার উপর ডালপালা ‌নে‌ড়ে ব‌য়ে গেল । আমি চোখ বু‌জে সমস্ত ইন্দ্রিয় দি‌য়ে অনুভব কর‌তে লাগলাম । ম‌নে হ‌তে লাগল আমার অতীত ব‌লে কখ‌নো কিছু ছিল না । এই ব‌নে আমি ঠিক এই মুহূ‌র্তে নয়‌তো অযুত লক্ষ বছর ধ‌রে এভা‌বে ঠায় দা‌ড়ি‌য়ে আছি । এই বন ,ব‌নের পাখপাখা‌লি, গুল্মলতা ,‌ঝোপঝাড় ,চাপা গন্ধে ভরা শীতল মা‌টির মত আমিও একজন । শান্ত সুগভীর অর‌ণ্যের বাই‌রে আমার কখ‌নো কোন আলাদা জগৎ ছিল না । এমন একটা অপা‌র্থিব মাদকতায় ঠিক কতক্ষণ বুঁদ হ‌য়ে ছিলাম জা‌নি না রাতুল আমায় ধাক্কা মে‌রে জা‌গি‌য়ে দিল- "তণয় স‌রে যা , সাপ্-প্-প্ " ।
চোখ মেল‌তেই দে‌খি পা‌য়ের ঠিক একহাত দূ‌রে কা‌লো কুচকু‌চে একটা দেড় দুই হাত লম্বা সাপ শুক‌নো পাত‌ার উপর দি‌য়ে সরসর ক‌রে চ‌লে যা‌চ্ছে । ঘটনার আক‌স্মিকতায় প্রথমটা হতভম্ব হ‌য়ে গেলাম । একটু অসাবধানতায় সা‌পের হা‌তে মারা পড়‌তে হত । আমার চে‌য়েও রাতুল ভয় পে‌য়ে‌ছে জোর । ওর পাংশু‌টে মু‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে অভয় দি‌য়ে বললাম-" ধূরর , এমন ভীতুর ডিম না তুই । এই সব সা‌পে বিষ থা‌কে না ।"
রাতুল বলল-"তুই কিভা‌বে জান‌লি বিষ থা‌কে না ? "
আমি আমতা আমতা ক‌রে বা‌নি‌য়ে বললাম-"নানু বা‌ড়ির এক ওঝার সা‌থে আমার খুব বন্ধুত্ব । তুই আমার সা‌থে গে‌লে প‌রিচয় ক‌রি‌য়ে দেব । ওর মত সর্প বিষয়ক জ্ঞান আমি আজ পর্যন্ত কা‌রো মা‌ঝে দে‌খি নি । ওর থে‌কেই শি‌খে‌ছি কোন সাপ বিষধারী আর কোনটা বিষহীন । আমার যতদূর ম‌নে হয় এই সা‌পে বিষ নেই ।"
-‌কি সাপ রে এটা ? শঙ্খচুড় বা চন্দ্রবড়া জাতীয় কিছু নয়‌তো ।
আমি রাতুল‌কে সাহস দি‌তে গি‌য়ে খুব জোর দি‌য়ে মি‌থ্যে বললাম-"আ‌রে না । অই সব সাপ এখা‌নে কোথায় পা‌বি ? ওরা থা‌কে আরও বড় বড় জঙ্গলগু‌লো‌তে । এ আর এমন কি বন , এর থে‌কে কত বড় বড় বন আছে । তাই বল‌ছি শুধু শুধু ভয় পাবার কোন প্র‌য়োজন নেই । "
এমন শান্ত নি‌বিড় প্রকৃ‌তির কো‌লে এভা‌বে নির্জলা মি‌থ্যে কথা বলাটা খুবই বেমানান ঠেক‌লো আমার কা‌ছে । কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কি ?রাতুলটা যা ভীতু । একবার ভয় পে‌য়ে গে‌লে য‌মেরও সাধ্য নেই ও‌কে এই জঙ্গ‌লে ধ‌রে রাখ‌তে । ও নি‌জে তো জঙ্গল ছে‌ড়ে বে‌রি‌য়ে যা‌বে সা‌থে আমা‌কেও টে‌নে হিচ‌ড়ে নি‌য়ে যা‌বে । আমি তা চাই না । এমন উদাস ক‌রা ব‌নের আরও গভী‌র থে‌কে গভী‌রে যে‌তে চাই ।বনদেবীর কো‌লে এসে অতৃ‌প্তি নি‌য়ে ফি‌রে যাবার প্রশ্নই আসে না । ব‌নের ছায়াটা আরও দীর্ঘতর হ‌য়ে‌ছে । শেষ বি‌কে‌লের কোমল রো‌দেলা আঙুল আল‌তো ক‌রে গা‌ছের ডালপালায় মা‌টি‌তে বু‌লি‌য়ে যা‌চ্ছে অস্তমান সূর্য । ঝো‌পঝা‌ড়ে ঝি ঝি পোকার চাপা এক‌ঘে‌য়ে সুর । উঁচু উঁচু শালগা‌ছের গোড়ায় কেমন একটা জমাট গুচ্ছ অন্ধকার । রাতুল আর আমি নীর‌বে শুক‌নো ঝড়া পাতার উপর খসখস শ‌ব্দে হে‌টে চ‌লে‌ছি লক্ষ্যহীন গন্ত‌ব্যে । হাত ঘ‌ড়ি দেখার কথা একবার ম‌নে হ‌তেই ভাবলাম কি দরকার ?ঘ‌ড়ি ধ‌রে ধ‌রে চলার জায়গা ঠিক এটা নয় ।দুই আড়াই ফুট লম্বা একটা উঁইয়ের ঢি‌বির নিক‌টে আস‌তেই আমা‌দের নীরবতায় ছেদ পড়ল রাতু‌লের কথায়-"আর কতদূর হাট‌বি ? "
আমি বললাম-"‌সে কি রে ,এতটুকু হাট‌তে গি‌য়েই হা‌পি‌য়ে পড়‌লি । "
- "হা‌পি‌য়ে প‌ড়ি নি । ত‌বে এরকম উদ্দেশ্যহীভা‌বে হে‌টে তো কোন লাভ নেই । সব জায়গাই তো একরকম । "
-লাভ লোকসান সব সময় খু‌জিস কেন বল তো ? বন জঙ্গল অরণ্য পাহাড় নদীনালা সমুদ্র এইসব হ‌চ্ছে সকলপ্রকার লাভ লোকসা‌নের উ‌র্ধ্বে । ত‌বে বল‌তে পা‌রিস আত্নিক লাভ আছে । ব‌নে জঙ্গ‌লে আস‌লে প্রকৃ‌তির শুদ্ধতায় নি‌জের অন্তরও শুদ্ধ হ‌য়ে যায় । কোন ভেজাল থা‌কে না । এর জন্য বন‌কে শুধু চোখ দি‌য়ে দেখলে চল‌বে না, হৃদয় দি‌য়ে গভীরভা‌বে অনুভব করতে হ‌বে । " আমি প্রায় দার্শ‌নিকসুলভ ভ‌ঙ্গি‌তে কথাগু‌লো ব‌লে গেলাম ।
রাতুল হঠাৎ দূ‌রে আঙুল দে‌খি‌য়ে বল‌লো -" ওটা কি রে ? ঝো‌পের আড়া‌লে নড়াচড়া কর‌ছে । ভাল করে দেখ ।
"আ‌মি বললাম -" মানুষজন হ‌বে হয়ত ।ব‌নে কাঠ কাট‌তে কিংবা পাতা কু‌ড়ো‌তে এসে‌ছে । "
রাতুল আমার কথা যে তিলমাত্র বিশ্বাস ক‌রে‌নি সেটা ওর ভাবভঙ্গি‌তে স্পষ্ট । সে মাথা নে‌ড়ে বলল-"উহু !মানুষ মো‌টেও ম‌নে হ‌চ্ছে না । "
আমি মহা বিরক্ত হ‌য়ে বললাম - " তাহ‌লে কি বল‌তে চাই‌ছিস জ্বীন ভূত । তোর সব বিষয় নি‌য়ে একটা কাল্প‌নিক ভয় না জন্মা‌লে চ‌লে না ,তাই না ।
" রাতুল আমার কথায় বিন্দুমাত্র বিচ‌লিত না হ‌য়ে শান্ত কিন্তু চাপা স্ব‌রে বলল-" একটা ব্যাপার খেয়াল ক‌রে‌ছিস তণয় ? আমরা এতক্ষণ ধ‌রে ব‌নের মা‌ঝে হাট‌ছি অথচ কোন মানুষজ‌নের সা‌থে দেখা হয়‌নি । ম‌নে হ‌চ্ছে আমরা জনমানব ব‌র্জিত বি‌চ্ছিন্ন একটা জায়গায় এসে প‌ড়ে‌ছি । "
রাতু‌লের ভাবনাটা যে আমার ম‌নে একবারও আসে‌নি এমনটা নয় । আমিও ম‌নে ম‌নে ব্যাপারটা খেয়াল ক‌রে‌ছি । ত‌বে আমল দিই নি । শু‌নে‌ছি জঙ্গ‌লের একপ্রা‌ন্তে ক‌য়েকঘর সাঁওতালের বাস । কোথায় সেই সাঁওতাল পল্লী ? কোথায় সেই সব সাঁওতাল ? না‌কি আরো গভী‌রে তা‌দের বস‌তি । না‌কি আমরা পথ ভু‌লে ঘু‌রে ফি‌রে একই জায়গায় এসে পড়‌ছি বারংবার। রাতু‌লের কথাই হয়ত ঠিক জঙ্গলটা সব জায়গায় একই রকম ।‌দেখ‌তে দেখ‌তে আমরা ঝোপটার ধা‌রে এসে পড়লাম । ঝো‌পের আড়া‌লে একটা সাদা ধবধ‌বে গরু বাধা । সেটা খচমচ শব্দ ক‌রে ঘাস চি‌বি‌য়ে খা‌চ্ছে । এতক্ষণ তাহ‌লে এই গরু‌কে অতিপ্রাকৃত কিছু একটা ভে‌বে নি‌য়ে ভয় পা‌চ্ছিল রাতুল । রাতু‌লের দি‌কে তাকা‌তে সে কিছুটা ল‌জ্জিত হ‌য়ে হে‌সে ফেলল।
আমি বললাম-"গরু যে‌হেতু আছে, আশেপা‌শে মানুষজনও থাক‌বে নিশ্চই । " রাতুল প্রস্তাব কর‌লো কিছুক্ষণ ব‌সে জিরা‌নোর । আমরা দুজ‌নে গা‌ছের গু‌ড়ির সা‌থে বাধা‌নো গরুটার অদূ‌রে নরম ঘা‌সের উপর ব‌সে পড়লাম । ব‌নের গাছগাছা‌লির মাথায় এখন ম্রীয়মাণ সূ‌র্যের আলো । আসন্ন সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়ায় ভারী হ‌য়ে উঠ‌ছে ব‌নের আকাশ বাতাস ।মাথা উচুঁ ক‌রে ডালপালার ফাঁক দি‌য়ে ক্রিস্টা‌লের মত স্বচ্ছ মেঘমুক্ত আকা‌শের দি‌কে তাকা‌লে বুকটা হু-হু ক‌রে ও‌ঠে । ম‌নে হয় আমাদের চারপা‌শে অসীম শূণ্যতা খাঁ-খাঁ কর‌ছে ।আমরা দুজ‌নে ধ্রুব‌কের মত সেই শূণ্যতায় ঝু‌লে আছি। আচমকা একটা রিন‌রি‌নে মে‌য়েলী গলার স্ব‌রে সচ‌কিত হ‌য়ে পিছন ফি‌রে দে‌খি সাত আট বছ‌রের একটা বাচ্চা মে‌য়ে দা‌ড়ি‌য়ে আছে । আবলু‌ষের মত কা‌লো শরীর , উস্কখুস্ক চুল, পর‌নে ময়লা ছেড়া ফ্রক, ধূলো ম‌লিন পা । ওর হা‌তে দেখলাম একটা বাঁশী । মে‌য়েটা এই ব‌নের মা‌ঝে শার্ট প্যা‌ন্টে ফিটফাট্ দুজন মানুষ‌কে হঠাৎ এভা‌বে দেখ‌তে পে‌য়ে ঘাব‌ড়ে গে‌ছে । আমা‌দের দুজ‌নের দি‌কে মে‌য়েটা এমন ভা‌বে দেখ‌ছে যেন আমরা ভীনগ্রহবাসী কেউ । আমি ওর অমূলক ভয় দূর করার জন্য হাত নে‌ড়ে ডাকলাম-"খুকী , এদি‌কে শোন । " সে মাথা নে‌ড়ে অস‌ম্ম‌তি জানা‌লো । আমি বললাম-"গরুটা বু‌ঝি তোমার ?" সে এবার হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাকা‌লো ।
-"ভারী সুন্দর গরু ‌তোমার।" মে‌য়েটার স‌ঙ্কো‌চিত মু‌খের ভাবটা এতক্ষ‌ণে স্বাভা‌বিক হল । রিনরি‌নে চিকন গলায় ব‌লে উঠল-"ইর নাম বিতলু" ।আ‌মি প্রসন্ন গলায় বললাম-"‌বেশ ভাল নাম তো তোমার গরুর । তোমা‌দের বা‌ড়ি কোথায় খুকী ? " মে‌য়েটা এবার ব‌নের উত্তর দি‌কে আঙুল ইশারা ক‌রে এমন দু‌র্বোধ্য ভাষায় কথা বলল যে রাতুল আর আমি দুজন দুজ‌নের মু‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইলাম । ভাষা না বুঝ‌লেও এটা নি‌শ্চিত বুঝলাম যে মে‌য়েটা সাঁওতাল পল্লীর আর ব‌নের উত্তর প্রা‌ন্তে সেই সাঁওতাল পল্লী । অল্পক্ষ‌ণের ম‌ধ্যেই খা‌তির হ‌য়ে গেল মে‌য়েটার সা‌থে । কথায় কথায় জানা গেল মে‌য়েটার নাম জি‌নিয়া । য‌দিও ওর সবকথা বোধ্যগম নয় আমা‌দের কা‌ছে ।জি‌নিয়া একপ্রকার জোড়াজু‌ড়ি ক‌রে সাঁওতাল পাড়ায় ও‌দের বা‌ড়ি‌তে নি‌য়ে গেল আমা‌দের দুজন‌কে ।আগ্রহ অব‌শ্যি আমা‌দেরও ছিল । এতদূ‌রে যখন চ‌লে এসে‌ছি ,তখন সাঁওতাল পল্লী না দে‌খে যাব তা কি হয় ।
সাঁওতাল পল্লী বল‌তে যেরকম ভে‌বে‌ছিলাম সেরকম মো‌টেও নয় ।চার পাঁচ ঘর সাঁওতাল প‌রিবা‌রের বাস । খ‌ড়ের তৈরী খুপ‌ড়ির মত ঘর । উঠোন কাঁদা দিয়ে লে‌পে মা‌ঝে একটা উনুন খু‌ড়ে‌ছে ।উনু‌নে মা‌টির হা‌ড়ি‌তে কি একটা চাপা‌নো হ‌য়ে‌ছে । উনু‌নের মু‌খে লক‌ড়ি ঠে‌লে জ্বাল দি‌চ্ছে বছর প‌চিঁ‌শের এক যুবতী । দোহারা কা‌লো গা‌য়ের রঙ । একটা ম‌লিন ছেড়া শাড়ী জ‌ড়ি‌য়েছে শরী‌রে । পা‌শে হাট্টাগাট্টা সুগ‌ঠিত দে‌হের এক যুবক খা‌লি গা‌য়ে ব‌সে চুরুট জাতীয় একটা কিছু টান‌ছে ।আন‌ন্দের আতিশ‌য্যে প্রায় লাফা‌তে লাফা‌তে জি‌নিয়া ওর বাবা মা‌য়ের সাম‌নে হা‌জির করল আমা‌দের । এমন অনাকা‌ঙ্খিত অতি‌থি দে‌খে উনু‌নের মু‌খে ব‌সে থাকা সাঁওতাল যুবতী পু‌রোপু‌রি অপ্রস্তুত হ‌য়ে গেল । পা‌শেই ব‌সে থাকা খা‌লি গা‌য়ের যুবকটা চুরুট ফে‌লে ঝট ক‌রে উঠে দাড়াল । তা‌কে খুব আড়ষ্ট দেখা‌চ্ছে । তার সাত আট বছ‌রের মে‌য়েটা যে এমন সব অতিথি নি‌য়ে হা‌জির হ‌বে এটা সে কল্পনাই ক‌রে নি । আমি আন্ত‌রিকভা‌বে হে‌সে জি‌নিয়ার বাবার দি‌কে তা‌কি‌য়ে জি‌জ্ঞেস করলাম-"কেমন আছ?" সে ইতস্তত কর‌তে কর‌তে বলল -"ভাল আছি বাবু" । আ‌মি বুঝ‌তে পারলাম এদের খুব বিপ‌দে ফে‌লে‌ছি আমরা । আমি জি‌নিয়ার বাবা‌কে আশ্বস্ত করলাম এই ব‌লে যে আমরা তোমা‌দের পাড়াটা একটু ঘু‌রে বে‌ড়ি‌য়েই চ‌লে যাব । আমার কথায় যেন যুবকটা আকাশ থে‌কে পড়‌লো -" সে কি বাবু ! তোমরা আমার বে‌টির অতি‌থি । খা‌লি মু‌খে চ‌লে যা‌বে তা হয় না । তা হয় না ।আজ‌কে তোমরা এই গ‌রিবখানায় থাক ।স‌াঁঝ হ‌য়ে গে‌ছে । এখন আর তোমরা পথ খুঁ‌জে যে‌তেও পার‌বে না । কাল সকা‌লে আমি তোমা‌দের দি‌য়ে আসব। " আমরা দুজ‌নে আপ‌ত্তি করলাম কিন্তু আমা‌দের কোন কথাই কা‌নে তুল‌তে সে রাজী নয় । জি‌নিয়াও আমা‌দের দুজ‌নের দু‌টো হাত ধ‌রে এমন জোড়াজু‌ড়ি করতে লাগল যে শেষ‌মেষ থে‌কে যেতে হল ।যা দেখলাম প্রচন্ড দা‌রি‌দ্রের মা‌ঝে আধু‌নিক সভ্যতার বাই‌রে পান্ডবব‌র্জিত এমন ব‌নে বসবাস করেও এদের আন্ত‌রিকতার কম‌তি নেই । অতি‌থি সেবার উপকরণ একেবা‌রে নগণ্য হ‌লেও যা আছে তাই দি‌য়ে হৃদয় নিঙড়ে এরা অতি‌থি সেবা ক‌রে ।রা‌তে খাবার পা‌তে দেখলাম সেদ্ধ মি‌ষ্টি আলু , ঘুঘু পা‌খির মাংস , পা‌তি লেবুর ফা‌লি , শুক‌নো ম‌রিচ পোড়া । আয়োজন খুব সাদা‌সি‌দে । ত‌বে তা‌দের নি‌র্ভেজাল আতি‌থিয়তায় এই সাধারণ খাবার পরম তৃ‌প্তি নি‌য়ে খেলাম দুজ‌নে । খে‌তে ব‌সে জি‌নিয়ার বাবা যথাযথ খা‌তির যত্ন কর‌তে না পারায় বার বার কাচুমাচু ক‌রে ক্ষমা চে‌য়ে নিল যেন সে মস্ত বড় অপরাধ ক‌রে ফে‌লে‌ছে । আমি তা‌কে এই ব‌লে আশ্বস্থ করলাম যে আমা‌দের কোন সমস্যাই হ‌চ্ছে না ,বরং সে যা করে‌ছে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ ।খাওয়া শে‌ষে উনু‌নের ধা‌রে পি‌ড়ি‌তে ব‌সে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম জি‌নিয়ার বাবার সা‌থে । কেন তারা এই নির্জন ব‌নে এভা‌বে বাস কর‌ছে ?‌কি ক‌রে তা‌দের চল‌ছে ? জায়গা জ‌মি কিছু আছে কি না ? এইসব প্রশ্ন শু‌নে জি‌নিয়ার বাবা বিষাদ কা‌লো মুখে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ।আধো বাংলায় তার নি‌জের মত ক‌রে যা বলল তার সারমর্ম এরূপ - বন পেড়ি‌য়ে নদীর ওপা‌রে তা‌দের নিজস্ব একটা পাড়া ছিল । একশ দেড়‌শো ঘর সাঁ‌ওতাল বাস করত সেখা‌নে । চা‌ষযোগ্য জ‌মি ছিল , ভি‌টেমাটিতে ঘরবা‌ড়ি ছিল , হা‌লের বলদ ছিল , সু‌খে শা‌ন্তি‌তে ঘর সংসার কর‌ছিল । এক‌দিন শহু‌রে এক বাবু এসে বলল তা‌দের সেখান থে‌কে বস‌তি উঠি‌য়ে অন্যত্র চ‌লে যে‌তে হ‌বে । সেখা‌নে না‌কি কলকারখানা হ‌বে মস্তবড় । সাঁওতালরা প্রথম‌দি‌কে ঘোর প্র‌তিবাদ জানা‌লো । তাদের বাবা দাদার ভিটা । আজন্ম তারা এখা‌নে আছে । ভি‌টেমা‌টি ছে‌ড়ে তার কোথাও যা‌বে না । দরকার হ‌লে তারা রক্ত দি‌বে ।রক্ত তা‌দের এক‌দিন স‌ত্যি দি‌তে হল কিন্তু তা‌দের বসত ভিটা রক্ষা কর‌তে পারল না । শহু‌রে বাবু গুন্ডাপান্ডা এনে মারধর ক‌রে ঘরবা‌ড়ি‌তে আগুন জ্বা‌লি‌য়ে দিল । অ‌নেকে পা‌লি‌য়ে গেল ,অ‌নে‌কে আগু‌নে পু‌ড়ে মারা গেল । পু‌লি‌শের কা‌ছেও তারা বিচার চাই‌তে গি‌য়ে‌ছিল । কিন্তু পু‌লিশ তা‌দের কথা শুন‌বে কেন ? প‌ু‌লিশ নি‌জেও সা‌হে‌বের দ‌লের লোক । সব‌কিছু হা‌রি‌য়ে সহায় সম্বলহীনভা‌বে আজ তারা এই অর‌ণ্য‌ঘেরা নির্জন প‌রি‌বে‌শে একাকী বাস কর‌ছে । " এই পর্যন্ত ব‌লে জি‌নিয়ার বাবা বিধ্বস্ত চো‌খে চুলায় নিভু নিভু আগু‌নের গাঢ় লালাভ কয়লার দি‌কে মাথা নিচু ক‌রে তা‌কি‌য়ে থাক‌লো দীর্ঘক্ষণ । আমি আর রাতুল দুজ‌নে এই বিপন্ন সাঁওতাল‌দের জন্য গভীর ম‌নোকষ্ট অনুভব করলাম ।এদের সা‌থে এত বড় অন্যায় হবার পরও প্রশাসন কি ক‌রে এতটা নি‌র্লিপ্ত থাক‌তে পা‌রে । এই লোকগু‌লো‌কে কেবলমাত্র সান্ত্বনা দেয়া মা‌নে এদের নি‌য়ে নিষ্ঠুর প‌রিহাস ,ঠাট্টা তামাশা করা । য‌দি এদের হৃত জায়গাজ‌মি ঘরবা‌ড়ি পুনরায় এদের ফি‌রি‌য়ে দেয়া যায় ত‌বে সেটাই হ‌বে এদের জন্য সার্থক উপকার । আমি জি‌নিয়ার বাবার কাঁ‌ধে হাত রে‌খে বললাম -"‌চিন্তা ক‌রো না । তোমা‌দের সা‌থে যে অন্যায় হ‌য়ে‌ছে আমরা তা প্রশাস‌নের সাম‌নে তু‌লে ধরব । তোমা‌দের প্রাপ্য বিচা‌রের জন্য আমরা সরকার‌কে চি‌ঠি লি‌খে জানাব । " আমার কথায় মাথা তু‌লে তাকাল জি‌নিয়ার বাবা ।‌যেন এই কথাটুকু শোনার জন্যই সে নির্জন এই জঙ্গ‌লে উন্মুখ হ‌য়ে অপেক্ষা কর‌ছিল ।শুধু চাই‌ছিল চার পাঁচ মাই‌লের এই বন ডি‌ঙে কেউ এসে তার অসহায় কাঁ‌ধে হাত রাখুক,একটু ভরসার কথা শু‌নি‌য়ে যাক । আমার হাত চে‌পে ধ‌রে আপ্লুত ক‌ন্ঠে সে বলল-"বাবু তোমা‌দের দয়া , বাবু তোমা‌দের দয়া " । বল‌তে গি‌য়ে হুহু ক‌রে শিশুর মত কে‌দে ফেলল । আমি কাঁদ‌তে দিলাম তা‌কে । কাঁদুক সে । জগদ্দল পাথ‌রের মত দীর্ঘ‌দি‌ন বু‌কের মা‌ঝে চেপে থাকা ক্ষোভ দুঃখ য‌দি কিছুটা লাঘব হয় ,কাঁদ‌তে দোষ কোথায় । রাত বাড়‌তে লাগল । ব‌নের মাথায় ডালপালার ফাঁ‌কে ঘোলা‌টে মে‌ঘের আড়াল থে‌কে উঁকি মারল চাঁদ । দূ‌রে একটা নি:সাড় শালগা‌ছের পাতায় ঝটপট আলোড়ন তু‌লে উড়ে গেল রাত জাগা পা‌খি । শনশন শ‌ব্দে হাওয়া বই‌তে লাগল ।স্ফ‌টি‌কের মত স্বচ্ছ জ্বলজ্ব‌লে তারা ভরা আকা‌শের দি‌কে অপলক তা‌কি‌য়ে ভাব‌তে লাগলাম ,আজ য‌দি উদ্দেশ্যহীনভা‌বে এই ব‌নের প‌থে হাটতে না আসতাম তাহ‌লে হয়ত এই নিপী‌ড়িত অসহায় সাঁওতাল‌দের অন্তর্দহন জ্বালা , নির্বা‌সিতের মত এই দীর্ঘ ব‌নের মা‌ঝে বেঁচে থাকার ম‌নো‌বেদনা কখ‌নো জান‌তে পারতাম না । কি বা হত না জান‌লে ! দি‌ব্যি আধু‌নিক প্রযু‌ক্তির সু‌যোগ সু‌বিধা সম্ব‌লিত ঝকঝ‌কে তকত‌কে ঘ‌রে নরম বিছানায় নিদ্রা যাপন করতাম । সারা‌দিন কর্মব্যস্ত অফি‌সের পর সন্ধ্যা‌বেলা বন্ধু‌দের সা‌থে আড্ডা দিতাম ,তাস পেটাতাম ,‌বি‌দেশী মদ গিলতাম ,দল বে‌ধে নাইট শো‌তে সি‌নেমা দেখ‌তে যেতাম । বেশ তো থাকতাম । স‌ত্যি কি বেশ থাকতাম ?সত্যি কি এভা‌বে বেশ থাকা যায় ?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহা রুবন আমিও যেন বনে আপনাদের সঙ্গি হয়ে গিয়েছিলাম। ভাল লাগল। আগ্রহ ভরে পড়েছি। শুভেচ্ছা।
নাঈম লেখাটা খুব ভালো লাগলো, বাতিঘর পড়ে মতামত দেয়ার আমন্ত্রণ রইল

১৪ অক্টোবর - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪